আগে সাংবাদিকদের প্রায় একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো; ‘সব খবর কিভাবে সবার আগে পান?’ প্রশ্নটি কিছুটা জটিল হলেও এরমধ্যে ছিল এক প্রকার আত্মতৃপ্তি। গর্বের সঙ্গেই প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি মিশ্রিত উত্তরটা দিতেন। মুখে উত্তর যা-ই দিতেন; মনে মনে বলতেন, ‘এখানেই তো সাংবাদিকদের ক্যারিশমা। সবার আগে খবর পাই বলেই তো আমরা সাংবাদিক।’ তখন ভুলে যেতেন রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে সংবাদ সংগ্রহের কষ্টের কথা। অগ্রজদের মুখে এখনো সেই গল্প শোনা যায়। তবে শোনা যায় না আর এসব প্রশ্ন। কারণ, উত্তর অনেকেরই জানা। এক কথায় উত্তর একটাই, ‘ঘরে ঘরে আছে ডটকম’।
একটা-দুটি কম্পিউটার নিয়ে যে কেউ খুলে বসছে একটা অনলাইন পাত্রিকা। তাদের খবর সংগ্রহের মাধ্যমও অন্যান্য অনলাইন নিউজপোর্টাল। কপি-পেস্ট প্রক্রিয়ায় চালাতে প্রয়োজন হচ্ছে না প্রতিবেদকের। প্রয়োজন হচ্ছে না কোনো সোর্সের। একটি বা দুটি কম্পিউটার আর নেট লাইন থাকলেই হলো। মুহূর্তের খবর পৌঁছে দেয় মুহূর্তে। বর্তমানে বাংলাদেশে অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচ হাজার। এর মধ্যে পেশাদারিত্ব ও মোটামুটি পেশাদারিত্ব আছে এমন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা পাঁচ বা ছয়ের বেশি হবে না (টিভি ও দৈনিক পত্রিকার ওয়েবসাইট বাদে)। অর্থাৎ পাঁচ হাজারে পাঁচটা। শতাংশের হিসাবে তা ০.১ ভাগ। তার মানে হলো ৯৯.৯ ভাগ পোর্টালের পেশাদারিত্ব নেই। এই পোর্টালগুলো অন্য পোর্টালের সংবাদ নির্লজ্জভাবে চুরি করে কিছুটা পরিবর্তন করে বা হুবহু প্রকাশ করে থাকে। এগুলোতে কোনো বিনিয়োগ নেই। প্রয়োজনীয় নিজস্ব সংবাদকর্মী নেই।
বিষয়টি মাশরাফির দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘What a headline, journalism at his best…যারা বছরের পর বছর এ পেশাটাকে শুধু পেশা হিসেবেই নয়, সর্বোচ্চ সম্মানের সঙ্গে করে এসেছেন তারাও এসব দেখে লজ্জা পান, মনে হয়….’
এসব পোর্টালের একমাত্র মূলধন ওই চৌর্যবৃত্তি। মানে কপি ও পেস্ট। কপি ঠেকানোর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা থাকলে এ পোর্টালগুলোর জন্মের পরই মৃত্যু হতো। হয়তো জন্মই হতো না। গণমাধ্যমের মূল দয়িত্ব সংবাদ সরবরাহের চেয়ে তারা ব্যক্তিস্বার্থ উসুলের উদ্দেশ্যেই অনলাইনগুলো চালু করেন। এতে পাঠক উপকৃত হোক চাই না হোক, কিছু মানুষ কোনো প্রকারের দক্ষতা-অভিজ্ঞতা ছাড়াই সাংবাদিক বনে যেতে পারেন বটে। চায়ের দোকানি, পাড়ার বেকার ছেলেটা, রাতারাতি ধনী বনে যাওয়া প্রতিবেশী থেকে শুরু করে স্কুলের গণ্ডিতে আটকে যাওয়া বন্ধুটিও সাংবাদিক বনে যান। তারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেন সাংবাদিকতাকে। এসব নিয়েও অনেক লেখা ইতোপূর্বে হয়েছে। তাতে থেমে নেই। আজকের আলোচনা ভিন্ন। এত সব ভুঁইফোড় গণমাধ্যমের ভেতর কিছু মানসম্পন্ন অনলাইনও আছে। এতে অনেক অভিজ্ঞ সাংবাদিক কাজ করেন। অর্থাৎ বোদ্ধা পাঠক তাদের গ্রহণও করে। কিন্তু মাঝে-মধ্যে তারাও হতাশ করতে ছাড়ে না। তাদের পর্যাপ্ত সোর্স আছে, প্রতিবেদক, সম্পাদনা পরিষদ; সবই আছে। তাহলে হতাশ করছে কেন? কারণ সব থাকার পরও আছে বেশি হিটের প্রতিযোগিতা। মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান সংসদ সদস্য মাশরাফির একটি স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে থেকেই নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে একটি খবর। শিরোনাম দেখে বোঝার উপায় নেই প্রকৃত ঘটনা কী। বরং নোংরা হেডলাইনে ভুল বার্তা পেয়েছে পাঠক।
বিষয়টি মাশরাফির দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘What a headline, journalism at his best…যারা বছরের পর বছর এ পেশাটাকে শুধু পেশা হিসেবেই নয়, সর্বোচ্চ সম্মানের সঙ্গে করে এসেছেন তারাও এসব দেখে লজ্জা পান, মনে হয়….’
মূল ঘটনা ছিল, মাশরাফির নির্বাচনি এলাকা লোহগড়ায় ১ জুন ইতি খানম নামের এক অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নির্যাতন করে রাস্তায় ফেলে যান তার স্বামী। নির্যাতন সইতে না পেরে অচেতন হয়ে রাস্তায় পড়েছিলেন ওই নারী। পরে জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানান স্থানীয়রা। খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে পুলিশ। এরপর থেকে স্বামী, শ্বশুরবাড়ি কিংবা বাবার বাড়ির কেউ খোঁজখবর নেয়নি তার।
হিটের পেছনে অনলাইনগুলোর যে অদ্ভুত ভুতুড়ে দৌড় চলছে, তা থামাতে না পারলে পাঠকের আস্থার জায়গায় পৌঁছানো অসম্ভব। কর্তৃপক্ষ ও কর্তৃপক্ষের কাছাকাছি পদ দখলকারী সাংবাদিক অভিভাবকরা এই কথা কখনো বুঝবেন?
খবর পেয়ে মাশরাফি সেই নির্যাতিতাকে তার শ্বশুর বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ওই নারীকে আশ্বস্ত করেন, তাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবেন। তার পাশে থাকবেন। এ ঘটনাকে নিয়ে খবর প্রকাশ করতে গিয়ে নোংরা শিরোনাম ব্যবহার করা হয়। এমন শিরোনাম এই প্রথম নয়, এই ধরনের গণমাধ্যমের অনেক শিরোনাম বহুবার সমালোচিত হয়েছে। শুধু এটি কেন? মূল ধারার গণমাধ্যম দাবি করা অনেক অনলাইন পত্রিকাও এ ধরনের শিরোনামের পেছনে ছোটে প্রতিনিয়ত। চটকদার শিরোনাম চাই, যেন পাঠক আকৃষ্ট হন। নতুবা প্রতিবেদক বা সাব-এডিটর অযোগ্য বলে বিবেচিত হন; এমন অভিজ্ঞতাও রয়েছে। কর্তৃপক্ষের চাই হিট। আর এই হিটের পেছনে ছুটেই এভাবে পাঠককে বিভ্রান্ত করা হয়। আমি একটা অনলাইনে মফস্বল ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত তখন। গুরুত্বপূর্ণ নিউজের চেয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি হিটের দিকে। সঙ্গত কারণে আজকে ভুয়া শিরোনাম দিয়ে সমালোনার মুখোমুখি দাঁড়ানো অনলাইনটিকে অনুসরণ করতো ওই অনলাইনটি। মফস্বলের সব নিউজ অন্তত ওই অনলাইনটির আগে প্রকাশ করতে হবে। এবং চমকপ্রদ শিরোনাম দিয়ে।
ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলছে তখন। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের বিদায় নিশ্চিত হলো যেদিন, সেদিন রাতের ঘটনা। আমাকে স্যোসাল মিডিয়া টিম থেকে চাঁদপুরের একটি নিউজের লিংক দেওয়া হলো। ‘বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশ ছিটকে পড়ায় সাবিকের আত্মহত্যা’ শিরোনামে খবরটি প্রকাশ করেছে আজকের আলোচিত গণমাধ্যমটি। খবরের ভেতর দেখলাম যে ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে তার নাম সাকিব। আমরা সংবাদটি প্রকাশ করেছিলাম, ‘বড় ভাইয়ের সঙ্গে অভিমান করে স্কুলছাত্রের আত্মহত্যা’ শিরোনামে। লিংকদাতাকে আমাদের অনলাইনে প্রকাশিত খবরটি দেখালাম। তিনি বললেন, ‘ছেলেটির নাম সাকিব এবং আত্মহত্যার কারণ বিশ্বকাপ। তাহলে এভাবে দিতে সমস্যা কী? আমি আমার চাঁদপুর প্রতিনিধিকে ফোন করে আত্মহত্যার কারণ নিশ্চিত হলাম- বিশ্বকাপের কারণে ছেলেটি আত্মহত্যা করেনি। যেহেতু একটি গণমাধ্যম ওই তথ্যে খবর প্রকাশ করেছে এবং বেশ হিটও পেয়েছে তাই আমার প্রতিষ্ঠান আমাকে ছাড়েনি। আমার প্রতিনিধির তথ্য ভুল বলে বেশ চড়া কথা শোনালো। আমি ওই গণমাধ্যমটির চাঁদপুর প্রতিনিধির ফোন নম্বর সংগ্রহ করে কথা বললাম। তিনি জানালেন, ‘সাকিব নামে ওই ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে বড় ভাইয়ের সঙ্গে অভিমান করে। তিনি ওই তথ্যই পাঠিয়েছেন। ছেলেটির নাম একজন ক্রিকেটারের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় ডেস্ক থেকে নিউজটি ওভাবে তৈরি করা হয়েছে।’ ওই প্রমাণ দেওয়ার পরও আমার কর্মস্থলের কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। কারণ অনেক হিট মিস হয়ে গেছে তাদের; এটাই বড় ব্যাপার।
প্রায়ই একটা কথা আলোচনায় আসে, আগামীর দুনিয়া অনলাইন গণমাধ্যমের। প্রিন্ট মিডিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এসব কারণে হয়তো দুনিয়ার সব জায়গায় অনলাইন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা পেলেও বাংলাদেশে সম্ভব নয়। হিটের পেছনে অনলাইনগুলোর যে অদ্ভুত ভুতুড়ে দৌড় চলছে, তা থামাতে না পারলে পাঠকের আস্থার জায়গায় পৌঁছানো অসম্ভব। কর্তৃপক্ষ ও কর্তৃপক্ষের কাছাকাছি পদ দখলকারী সাংবাদিক অভিভাবকরা এই কথা কখনো বুঝবেন?