খুব অল্প কয়েকজন অভিনেতার অভিনয় দেখে দর্শক হিসেবে অভিনয় কী জিনিস বুঝতে শিখেছিলাম। তাই লিখলাম তাকে নিয়ে। কোনো জ্বরে পড়ে নয়, তাকে নিয়ে যে আজ হোক কাল হোক, দুনিয়াজুড়ে ঝড় ও জ্বর হবে দর্শকদের মধ্যে, সেটা অবধারিত ছিল।
বিদেশি ছবি, বিশেষত হলিউডের ছবি দেখা শুরু করার কয়েক বছর পর পর্যন্ত আমি নায়ক-নায়িকা-পরিচালক কারও নাম জানার প্রয়োজন বোধ করতাম না, মনেও রাখতে পারতাম না। আমার ধারণা, আমার মতো প্রচুর দর্শক আছে এই উপমহাদেশে।
ফিল্মের জগতে টাইটানিক একটি মাইলস্টোন এই উপমহাদেশে। টাইটানিক আমাদের মতো লাখো দর্শকের অভ্যাস বেশ খানিকটা বদলে দিয়েছিল বোধ করি। শুধু নায়ক-নায়িকা নয়, পরিচালক, স্ক্রিপ্ট রাইটার, গানের শিল্পীর নাম আর চেহারা পর্যন্ত চিনতে শুরু করেছিলাম এই ছবি দেখার পর থেকে। এরপরও কয়েক বছর পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল, জেমস ক্যামেরুনই সবচেয়ে ভালো পরিচালক, লিওনার্দোই সবচেয়ে সুদর্শন ও ভালো অভিনেতা, কেট ছাড়া আর সব অভিনেত্রী ম্যাড়মেড়ে।
এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে প্রচুর সিনেমা দেখতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ওই তিন জনের অবসেশন কাটানো মুশকিল। কারণ, একে তো তারা আসলেও নিজ নিজ জায়গায় সেরা, তার ওপর ছিল কৈশোরের অবসেশন। অন্য অভিনেতা চেনা শুরু করি ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ সিনেমা দেখার পর থেকে। এরপর জানলাম রাসেল ক্রোর মতো সুদর্শন নায়ক আর হোয়াকিন ফিনিক্সের মতো মেধাবী অভিনেতাও আছে দুনিয়ায়। ২০০০ সালের এই ছবিটা দেখেছিলাম ২০০৬ বা ৭ সালের দিকে। দেখতে দেখতে ভিলেনের ওপর খুবই ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হয়েছিলাম (তখনো কৈশোর পুরোপুরি কাটেনি। তাই অভিনয় কী জিনিস বুঝতে শুরু করিনি)। কিন্তু একসময় মনে হলো, আচ্ছা এই লোক তো অভিনয় করেছে, এত ভালো অভিনয়, এই লোক কে?
রিভার ফিনিক্স অসাধারণ অভিনয় করতেন। সিনেমায় কাজ শুরু করেছিলেন। অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড নমিনেশনও পেয়েছিলেন লিড অ্যাক্টর হিসেবে।
খুঁজতে খুঁজতে হাজারও তথ্য পেয়ে গেলাম। এরপর আমি তার সিনেমা দেখা শুরু করলাম। একটার পর একটা। আই অ্যাম স্টিল হিয়ার, টু লাভারস, রিজার্ভেশন রোড, ডোন্ট টেল কিডস, সিক্রেট উইটিনেস, হোটেল রুয়ান্ডা, সাইনস, বাফেলো সোউলজারস, ৮-এমএম, প্রতিটি চরিত্র আলাদা। প্রতিটি গল্প ভিন্ন।তবু একটা যোগসূত্র আছে। প্রায় সব চরিত্রই ক্রাফটেড, গল্পের মোড় ঘোরাতে ভূমিকা রাখে। কিছুটা ডিস্টার্ভডও। তারপর দেখলাম হার, দ্য মাস্টার, ওয়াক ইন দ্য লাইন, দ্য ইরেশনাল ম্যান, উই ওয়্যার রিয়েলি নেভার হিয়ার। সবশেষে দেখলাম জোকার। এই অভিনেতা যে অবধারিতভাবে জোকার চরিত্রের জন্য যথোপযুক্ত, তা তার আগের সব নিউরোটিক ক্যারেক্টার এমনকি সাধারণ চরিত্রগুলোর অভিনয় দেখলেও বোঝা যায়। রোমান্টিক ড্রামা ঘরানার ‘টু লাভারস’ ছবিতেও জোকারের মতো একটি দৃশ্য পেয়ে যাবেন। দৃশ্যটি ছিল খাবার টেবিলে ৭-৮ বছরের এক শিশুর সঙ্গে মজা করার। একই রকম একটি দৃশ্য জোকার ছবির বাসের মধ্যে থাকা একটি শিশুর সঙ্গেও রয়েছে। অথচ টু লাভারস ২০০৪ সালের ছবি।
উডি অ্যালেনের ফিলোসফিক্যাল ড্রামা-ক্রাইম মিস্ট্রি ঘরানার ‘ইরেশনাল ম্যান’-এর প্রফেসর চরিত্র আর গল্পটা আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছে। সেই বিষণ্ন সেলফ ডেস্ট্রাকটিভ দর্শন প্রফেসর, যে তার ছাত্রীকে বলে যে ফিলসফি পড়ে কী করবা? শুধু হতাশা ইনভেনশনের জন্যই ফিলসফি পড়া, সে Existentialism crises নিয়ে কাজ করতে বাংলাদেশে এসেছিল, ক্ষুধার্তদের সঙ্গে দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছিল, বিভিন্ন রাজনৈতিক মিছিলে জনতার সঙ্গে অংশ নিয়ে দেখেছে আসল ক্রাইসিসে কোনো ফিলসফিই তেমন কাজে লাগে না, কাজে লাগে শুধু ‘অ্যাকশন’। শেষে দেখা যায় সে প্রেমের কারণে উজ্জীবিত না হয়ে একজনকে খুন করার জন্য উজ্জীবিত হয় এবং খুন করেও ফেলে।
যে অভিনেতার নাম জানার আগেই যাকে জাত অভিনেতা বলে চিনতে শুরু করা হয়, তাকে নিয়ে লেখা যায় যেকোনো সময়। এখন মনে হয়, আসলে অভিনেতাদের অশিক্ষিত ও কিচ্ছু না জানা-বোঝা দর্শককে ভালো দর্শকে পরিণত করতে অনেক অবদান। তাই যে ক্যামেরার সামনে যায় একটা গল্পের অংশ হয়ে, তার প্যাশনের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ববোধ থাকাটাও জরুরি।
হোয়াকিন ফিনিক্সের ব্যক্তি জীবন ও ব্যাকগ্রাউন্ড খুবই আকর্ষণীয়। আমার মনে হয়, তা সবার জানা উচিত। এই উপমহাদেশের মানুষজনের অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে একটি হল তারা রোল মডেল, নেতা ইত্যাদি বাছাই করতে পারে না। দুনিয়ার সব কাজের ক্ষেত্রেই রোল মডেল থাকে। হোয়াকিন ফিনিক্স হলেন অভিনয়ের রোল মডেল। সর্বকালের সেরা অভিনেতাদের মধ্যে তিনি একজন, এটি নিশ্চিত, অন্তত হলিউডে।
তার বাবা-মা ‘ফিনিক্স’ পদবিটা গ্রহণ করেছেন ‘ফিনিক্স’ শব্দ থেকে যার অর্থ নিজ ধ্বংসাবশেষ থেকে উত্থিত পাখি, যাকে নতুন জীবনের উত্থান হিসেবে দেখা হয় বাইবেলে। তারা পুরো পরিবার প্রকৃতিপ্রেমীই শুধু নয়, প্রকৃতিই তাদের কাছে ঈশ্বর। যদিও পারিবারিকভাবে তার বাবার বংশ ইহুদি, মায়ের দিক থেকে খ্রিষ্টান। ৫ ভাইবোনের নাম রিভার, রেইন, লিবার্টি, সামার ও হোয়াকিন। নিজের নাম অন্যান্য ভাইবোনের সঙ্গে মিলিয়ে নিজে রেখেছিলেন লিফ মানে পাতা। পরে অবশ্য ছবিতে অভিনয় শুরু করার পর হোয়াকিন নামেই ফিরে আসেন।
৫ সন্তান নিয়ে ফিনিক্স পরিবার আর্থিক অনটনে দিন কাটতো। অনটন কাটাতে ৫ সন্তানের প্রত্যেককেই ছোট বয়স থেকেই কাজ করতে হতো। তবে তাঁদের উপার্জনের একমাত্র উপায় ছিল পথ নাটকে অভিনয়, বিভিন্ন মেধা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া, গান গাওয়া ইত্যাদি। এসব করতে করতে তারা হলিউডের বিখ্যাত এজেন্ট আইরিশ বার্টনের নজরে পরে যান। এরপর রিভার ও হোয়াকিনসহ তাদের ৫ সন্তানই বিভিন্ন টিভি বিজ্ঞাপন, ছোট ছোট সিরিজে অভিনয় করতে শুরু করেন। রিভার ফিনিক্স অসাধারণ অভিনয় করতেন। সিনেমায় কাজ শুরু করেছিলেন। অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড নমিনেশনও পেয়েছিলেন লিড অ্যাক্টর হিসেবে।
একজন একুশ শতকের প্রযুক্তি আর খ্যাতির জ্বরে আক্রান্ত দুনিয়ার শিল্পীর কাছ থেকে আর কত বিনয় ও পারফেকশন আশা করা যায়?
রিভার ও হোয়াকিনই এখন পর্যন্ত হলিউডের একমাত্র ফিনিক্স ভাতৃদ্বয় যারা অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড নমিনেশন পেয়েছেন। কিন্তু রিভার অতিরিক্ত ড্রাগ নেওয়ার কারণে মারা যায় তার ক্যারিয়ারে সুবাতাস যখন কেবলই শুরু হয়। তার মৃত্যুর সময় হোয়াকিন উপস্থিত ছিলেন। ফোন করছিলেন জরুরি ৯১১ নাম্বারে। ওই ফোন রেকর্ড টিভি-রেডিওতে প্রচার করার প্রতিবাদে ওইসময় বছর খানেক অভিনয় থেকে বিরতি নিয়েছিলেন।
হোয়াকিন নিজেও ড্রাগের কবলে পড়েছিলেন। কিন্তু ভাইয়ের পরিণতি আর দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করতো। তিনি পুনর্বাসন কেন্দ্রে জয়েন করেছিলেন। মাদকমুক্ত হয়ে ফিরেই ক্যারিয়ারের সেরা কাজগুলো করতে পেরেছিলেন। ফিনিক্স মূলত সঙ্গীতশিল্পী হতে চেয়েছিলেন-হিপ হপ-এর প্রতি তার আকর্ষণ ছিল। সঙ্গীত পরিচালনাও করেছিলেন একটি অ্যালবামের। কিন্তু সেটাকে ক্যারিয়ার হিসেবে কখনো নেননি। তবে অভিনেতা হয়েও সঙ্গীতশিল্পী জনি ক্যাশের বায়োপিক ‘ওয়াক ইন দ্যা লাইন’ এ নিজেকে ঢেলে দিয়েছিলেন। বিখ্যাত সমালোচকরাও স্বীকার করেছিলেন, জনি ক্যাশের কণ্ঠ–গান আর তার কণ্ঠ-গান আলাদা করে বোঝা যায় না। নিজের গাওয়া জনির সব গানের জন্য তিনি গ্র্যামি পর্যন্ত জিতে নিয়েছিলেন। এরকম বিরল ঘটনা দুনিয়া কয়বার দেখেছে?
পারিবারিকভাবে প্রকৃতির প্রতি অনুরক্ত হওয়ায় পশু রক্ষা ও পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই। এ বিষয়ে তার দুটি তথ্যচিত্রও আছে। সেগুলোও খুব ভালো মানের ছিল। এসব কাজে সিরিয়াসলি দীর্ঘদিন যুক্ত থাকা ও অবদান রাখার জন্য পেয়েছেন হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড।
একজন অভিনেতার কাছে চেহারা একটা উপাদান, পুরোটা নয়। নিজের অবয়বের পুরোটা তারা চরিত্র রূপায়ণে ব্যবহার করেন, হোয়াকিন ফিনিক্সো এরকম একজন। চরিত্রের মধ্যে ঢুকে তিনি আর হোয়াকিন থাকেন না, হয়ে ওঠেন ওই চরিত্র। অভিনয়ে পারফেকশনের সংজ্ঞা তিনি। সেলেব্রিটিদের মিডিয়া ও সাধারণ মানুষের অতিমাত্রার কৌতূহল, প্রচার যুদ্ধ ইত্যাদি তার পছন্দ নয়। তিনি একটু নিভৃতে থাকতে চান সবসময়। তিনি মনে করেন, সিনেমার বাইরে বেশি বেশি ক্যামেরার সামনে এলে তার কাজ ও আদর্শ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রভাবিত হয়। তিনি তার কাজকে ও নিজেকে আরোপিত কিছুতে প্রভাবিত হতে দিতে চা্ন না।
সত্যিকারের শিল্পীরা কিন্তু এভাবেই ভাবেন। তাদের এত টাকা, খ্যাতি ও ক্রেজিনেসের ক্ষুধা নেই। তারা শুধু কাজটাই করে যেতে চান, কাজের মাধ্যমেই নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান। ফিনিক্সকে এরকম একজনই মনে হয়েছে। একজন একুশ শতকের প্রযুক্তি আর খ্যাতির জ্বরে আক্রান্ত দুনিয়ার শিল্পীর কাছ থেকে আর কত বিনয় ও পারফেকশন আশা করা যায়?