হোই-আন (Hoi An)-এর প্রতি আমি বরাবরই মোহবিষ্ট। এখনো রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার উপমা দিতে গেলে হোই-আনের রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়াটা চোখে ভেসে ওঠে। এত রোমান্টিক এত প্রাণের জায়গা আর দেখিনি।
এখানটায় আমরা সবসময় বুটিক হোটেলে উঠি। অনেকটা পুরনো ধাঁচে বেশ বড় জায়গা নিয়ে তৈরি হোই-আন বুটিক হোটেল। ভ্রমণপিপাসু মানুষ এর মোহে আবিষ্ট হয়ে যায়; বারবার এখানেই আসে। অনেকটা পারিবারিক আবহে চলছে হোটেলটি। আমাদের রুমের বারান্দা থেকে নিচের সুইমিং পুলটা দেখা যায়। রুমটিতে ট্রাইবাল কাপড় দিয়ে এমব্রোডায়েরি করা কারুকার্য। এদেশের মানুষের দেখে এটা বুঝেছি, তারা একটাকা নিলে সেটার সার্ভিসটাও যেন সুন্দর করে দিতে পারে, সে চেষ্টাটাই করে। সবকিছু ছিমছাম, গোছানো, সহজ-সরল। তাছাড়া, দাইফের (আমার বর) কয়েকজন খুব ভালো বন্ধু আছে। সে সুবাদে আমরা ভ্রমণের জন্য অনেক তথ্য ও সুবিধা পাই। তাদের সঙ্গেও আমার পাড়া প্রতিবেশীর মতো সম্পর্ক। তাদের পরিবারের খোঁজ নেই। তারাও আমার খোঁজ নেন। ভিয়েতনামিজদের বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক আগ্রহ। সে কথা বলবো আরেকদিন।
বুটিক হোটেলের ব্রেকফাস্টটা আমরা বেশ সময় নিয়েই করি। বুড়োবুড়িরা বেশিরভাগ সময় দলবেঁধে আসেন বা ছাড়া ছাড়া আসলেও এখানে এসে এক হয়ে যান। আমরা দু’জন বাইরের দিকে সুইমিং পুলের কাছটায় টেবিলে বসি। বুড়োবুড়িদের দলগুলোও বেশিরভাগ এদিকটায় বসে, আড্ডা দেয়। বাচ্চাকাচ্চারা ঘুরে ঘুরে খেলতে থাকে। এখানে যারা বুড়োবুড়িরা আসেন, তারা আমাদের মতো বয়স থেকেই আসছেন।
একদিন ব্রেকফাস্টের ঘটনা। পাশের টেবিলে চারজনের পরিবার। তাদের ছোট্ট ছেলেটার নতুন হাঁটা শেখা দেখছিলাম। হাঁটতে গিয়ে ঠুসঠাস পড়ে যাচ্ছে, আবার উঠছে। বাবাটা ছেলেকে একবার দেখে খাবারে মনোনিবেশ করলেন। মা খেয়ে নিচ্ছেন। পিচ্চিটার কর্মকাণ্ড দেখে সবাই খুব মজা পাচ্ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ তাদের পরিবারের ঠাণ্ডা সদস্য ছোট্ট পরীটাকে দেখতে পেলাম, চুপচাপ সব দেখছে। আমি ফল আনতে চলে গেলে ব্রেকফাস্ট নিয়ে বাবা-ছোট্ট পরী মেয়েটা ঝগড়া শুরু করলো। এসে দেখি দাইফ হো হো করে হাসছে। পরী মেয়েটা বাবার সঙ্গে ঝগড়ায় না পেরে কান্না শুরু করলো, চোখে একফোঁটা পানি নেই। বাবাটা মেয়েকে কোলে নিতে গেলে সে চেয়ারের হ্যান্ডল ধরে ঝুলতে থাকে আর অশ্রুবিহীন কান্নাটার শব্দ আরও বাড়লো। একপর্যায়ে বাবাটা পরী মেয়েটাকে পাঁজাকোলা করে রুমে চলে গেলেন। মা এবার শান্তিপূর্ণভাবে নিজের আর ছোট্ট ছেলেটার ব্রেকফাস্ট শেষ করে উঠে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ঝগড়াটে পরীটা বাবার হাত ধরে এসে ব্রেকফাস্ট করছে। বাবাটা তাকে সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দিচ্ছেন। পরী মেয়েটা পকপক করেই যাচ্ছে, বাবাটা কফি খেতে খেতে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। বাবার কাছে মেয়েরা যখন খুব দামি হয়, সে দৃশ্যটা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যের একটা!
এখানের মেন্যুটা বেশ সাধারণ। আমরা বিভিন্ন ফলের দিকে মনোযোগ দেই। ড্রাগন, লংগান, রামবুটান, লিচু, আম, পেয়ারা, আনারস আরও অন্যান্য রকম ফল আর ওদের বিভিন্ন রকম দই। আর ভিয়েতনামিজ এরাবিকা কফি তো অবশ্যই। কোয়াং, আমাদের এক ভিয়েতনামিজ বন্ধু, যে সারা দেশটি ঘুরে ফটোগ্রাফি করে, বহুদূরের গ্রামে চলে গিয়ে নতুন নতুন লোকালয় আবিষ্কার করে, সে আমায় কফির ঘ্রাণ ধরে ধরে শিখিয়েছে—এরাবিকা, রোবস্টা। সবচেয়ে ভালো হয় এরাবিকা আর রোবস্টা কফি বিন মিক্স করে নিলে। এর ঘ্রাণ অসাধারণ! হোই-আন হলো কফির স্বর্গ্যরাজ্য।
হোই-আনে (Hoi An) গেলে আমি রাস্তাঘাট নিজে নিজেই বের করে নিতে পারি। কখনো দোকানে গিয়ে গল্প করি। আমার বর মহাশয় তখন হয়তো লন্ড্রিতে কাপড় দিতে গিয়েছেন আবার কখনো বাইক ভাড়া করতে গিয়েছেন। হোটেলগুলোর পাশে লন্ড্রির দোকান দেখা যায়। কেজি হিসেবে তারা কাপড় নেয়। এক কেজি কাপড় পঁচিশ হাজার দং মানে আমাদের টাকায় পঁচাশি টাকা।
এরপর দাইফ বাইক ভাড়া করে আমায় থু বান নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। আমি প্রথমেই ওল্ড টাউনের জাপানি ব্রিজের দিকটায় যাই। পনেরশো নব্বই শতকের দিকে জাপানিজ কমিউনিটি এটি তৈরি করে। বলা হয়ে থাকে ওই সময়ে নদীর অন্য পাড়ের চাইনিজ কোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এই ব্রিজের একদিকে একজোড়া বানর, অন্যদিকে একজোড়া কুকুরের মূর্তি। কেউ কেউ বলেন, এই ব্রিজ তৈরির সময় বানর বর্ষ ছিল এবং ব্রিজ তৈরি শেষ হলে কুকুর বর্ষ ছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, জাপানের বেশির ভাগ সম্রাট বানর বর্ষ ও কুকুর বর্ষে জন্মেছিলেন বলে ব্রিজের দু’দুদিকে এই মূর্তিগুলো তৈরি করা হয়েছিল।
ব্রিজটা পার হলেই সুন্দর সুন্দর সিল্ক আর এমব্রোডায়েরির দোকান। তবে দামটা খুব চড়া বলে এখান থেকে কিছু কেনা হয় না। এছাড়া ওদের সিল্কটা বেশ ভারী হয়। আমাদের দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে তেমন স্বাচ্ছন্দ্যের হয় না। হ্যান্ড এমব্রয়ডারিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি, কিছু ফটো তুলে নেই। আমি গতবার সাপার বাক হা বাজার থেকে বেশ কম দামে এক লাখ বিশ হাজার দং মানে প্রায় পাঁচশ বিশ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। এখান থেকে কিনতে গেলে প্রায় দশগুণ চড়া মূল্যে কিনতে হবে।
হোই-আন খুব রোমান্টিক একটি শহর। সেবার সারাদিন ঝুম বৃষ্টি থাকায় ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে বের হইনি। দু’চোখে জড়িয়ে নিয়েছি সব সৌন্দর্য! মাঝে মাঝে মোবাইলটা বের করে ক্লিক ক্লিক। দাইফ (আমার বর) লম্বা পা ফেলে হাঁটা শুরু করলে দৌড়ে গিয়ে তার হাত ধরি। রাতের আলোতে হোই-আনের আলোকজ্জ্বল পথ দিয়ে হেঁটে যায় নানা দেশের নানা রঙের ইতিহাস প্রিয় মানুষ।
শহরটির মাঝখানে ছিমছাম একটি নদী থু বান। এ নদীর তীর ঘিরেই গড়ে উঠেছে হোই-আন ওল্ড টাউন। ১৬ শতক থেকে থু বান নদীর তীর ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। চীন, জাপান, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, পুর্তগাল আর ভারত বর্ষ হতে নৌযান আসতো! তখন থেকেই হই-আন ওল্ড টাউনের শুরু। থু বান নদী তীরের ওল্ড টাউনের সেই পুরোনো ঘর দোকান-পাটগুলোকেই তারা হলুদ রঙ করে রেখেছে। আমরা দু’জন সে ইতিহাস ধরে হেঁটে যাই।
গতবার প্রচুর বৃষ্টি আর ক্লান্তির জন্য অনেক কিছু দেখিনি। এবার হোই-আন আমার কাছে পুরো যুবতী কন্যা, উচ্ছ্বল ভালোবাসার নগরী। সকালে দা নাং থেকে হোই-আন এসে পৌঁছেই ওল্ড টাউনের দিকে রওনা দিলাম। দা নাং থেকে প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ।
একপাশে দু’শ তিনশ বছরের পুরাতন স্থাপত্যে স্থান করে নিয়েছে বিভিন্ন করমের দোকান-পাট। প্রতিটি দোকানের সামনে বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন ডিজাইনের কাপড়ের লণ্ঠন। ভিয়েতনামিজ প্রাচীন লণ্ঠনগুলো সবুজ, লাল, সোনালি, গোলাপি, সাদা, নীল সার্টিনের কাপড়ের। দিনের বেলা হোই-আন এক রকম সুন্দর! রাতে আলোকজ্জ্বল ও গানে মুখরিত থাকে। প্রতিটা লণ্ঠন ঝলমল করতে থাকে। থু বান নদীর তীর ঘিরে পুরনো দালান কোঠাগুলো এখন বাণিজ্যের বিভিন্ন পসরা নিয়ে বসেছে। নদীতে নৌকায় চড়ে ট্যুরিস্টরা উইশ করে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ডিজাইন করা কাগজে মোম বাতির প্রদীপ করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেয়। একেকটা ইচ্ছে পূরণের জন্য একটা প্রদীপ। কখনো নৌকার ছাউনিটা হয় রঙিন কাগজের বিশাল শাপলার কখনো বিশাল ড্রাগন আকৃতির।
সবচেয়ে ভালো লাগে যখন ওল্ড টাউন বা ওল্ড কোয়ার্টার দিয়ে নানা দেশের প্রচুর মানুষ হাঁটতে থাকে। কেউ কেউ কাপল, কেউ পুরো পরিবার সঙ্গে, কখনো বাবা মা দু’তিনটা পিচ্চি নিয়ে আসেন, কখনো দেখেছি কোরিয়ান বাবা মেয়ে, মেয়ে বাবাকে শাসন করছে কোনো কারণে। বাবা চোরা চোরা মুখে কন্যার বকা শুনে যাচ্ছেন। কখনো দেখেছি ইউরোপিয়ান মা ছেলের মুখে চুমো একে দিয়ে যাচ্ছেন, ছেলে হুতুম পেঁচার মতো কালো করে রেখেছে মুখটা। কখনো দেখেছি জাপানি মেয়ে পরম মমতায় মায়ের হাতটা ধরে হেঁটে চলছে।
এসব দেখতে দেখতে আমরা দু’জন কোনো একটা স্থানীয় কফিসপে কফি পান করি। হটপট দিয়ে রাতের খাবার সেরে নেই। এরপর আবার নদী পাড়ে দু’টো মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাথে গল্প করি! ওয়াই গোত্রের মানুষ দেখলে আমার হা করা মুখ দেখে দাইফ হাসতে থাকে। মানুষ এত সুন্দর হতে পারে! আমার দেখা পৃথিবীর সুন্দরতম মানুষ ওয়াই গোত্রের! তাদের পোশাক দেখে তামাম ইস্ট এশিয়ার মেয়েরা তাদের মতো করে সাজে। এর মাঝে আমার চেয়েও পাগলি একটা কোরিয়ান মেয়েকে মাথায় লাইট বেঁধে হাঁটতে দেখি।
পরেরদিন আমি ব্যাকপ্যাক নিয়ে বের হই। দাইফ বাইক দিয়ে আমাকে ওল্ড টাউনে নামিয়ে দিয়ে যায়। সে আরও দূরে বাইক নিয়ে যাবে। ১৫ কি. মি. দূরে সাগর, ছোট ছোট গ্রামগুলো খুঁজে বার করে। আমি গেলাম না। কারণ এবার হোই আনে এসে একজোড়া সিরামিকের জুতো খুঁজেছি, যা গতবার নিতে পারিনি। সকাল থেকে বহু খুঁজেছি। পেয়েছি রঙ বেরঙের লাইট, পাথরের দামি জুয়েলারি, হাজার হাজার টাকার নন ব্র্যান্ডের চামড়া সামগ্রী, আর প্রচুর রোমান্টিক কাপল। আমি নিজ মনে ঘুরে ঘুরে প্রকৃতি দেখতে পছন্দ করি। এ ব্যাপারটায় দাইফ কখনো বাধা দেয় না। পুরো ওল্ড টাউনটা ঘুরে ঘুরে গ্রাউন্ড কফি কিনি, পাথরের জুয়েলারি নিয়ে দামাদামি করি, ভিয়েতনামিজ রূপকথার বই কিনি, দাইফের জন্য কফি মগের ছোট কোর্ট পিন কিনি, লংগান ফল কিনি। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর এলাম। একদম মূল বাজারে। এখানে দাইফের জন্য টিশার্ট কিনতে গিয়েও কিনলাম না, অনেক বেশি দাম। তবে কোয়ালিটি ভালো না। জায়গায় জায়গায় পদ্মফুল দেখি। কেনা হয় না। ফটো তুলে রাখি। কিছুক্ষণ পর পর দাইফ ভিডিও কল করে নতুন যা কিছু দেখছে, সব দেখায়। দুপুরে আমাকে বাজার থেকে বাইকে তুলে নিয়ে নতুন জায়গায় লাঞ্চ করালো। এরপর আমাকে দুর্গম সব পথ ধরে রাতের শহরটাকে দেখালো। মাঝে মাঝে এত স্পিড তুলেছে, আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে বকাবকি করছিলাম। সে হাসতে হাসতে বলে, সাহস না করলে এত সুন্দরগুলো অধরাই থেকে যাবে। পরদিন আমরা চলে যাচ্ছি। মনটায় একটা মায়ার পরশ রেখে যায় হোই-আন। অবশ্য তত খারাপ লাগে না। কারণ আমরা আরেকটা নতুন জায়গা দেখতে যাচ্ছি ফু-কোয়ক আইল্যান্ডে। আইল্যান্ডে দাইফ আমাকে নিয়ে একশ দশ কি. মি. বাইক চালিয়েছে। সে কথা লিখব আরেকদিন!