প্রিয় হেলেন,
আসন্ন হেমন্তের আগাম সৌরভে আমোদিত এই শারদ-রাতে বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে কেমন আছেন? কোথায় আছেন? এই মহাশূন্যের যেখানে থাকুন না কেন, জানি না—আমার প্রশ্নে আর কারও কথা মনে পড়ছে কি না? আপনার প্রেমে পাগল এক যুবক একদিন আপনাকে লিখেছিলেন, ‘এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো।’ মনেপড়ে? বলেছিলেন,
কতদিন তোমাকে দেখি না
তুমি ভালো আছো? সুখে আছো? বোন নেত্রকোনা?আমাকে কি চিনতে পেরেছো? আমি
ছিলাম তোমার এক আদরের নাগরিক, নিকট-আত্মীয়
আমাদের বড় বেশি মাখামাখি ছিলো,
তারপর কী থেকে কী হলো
আভাইগ্যা কপাল শুধু বিচ্ছেদের বিষে নীল হলো।’
মনে পড়ে? মনে পড়ে সেই যুবকের কথা? হেলাল হাফিজের কথা? যিনি আপনার সঙ্গে নেত্রকোনায় বেড়ে উঠেছেন। ছিলেন আপনার খেলার সঙ্গী। আপনাকে ঘিরে যিনি গড়েছিলেন স্বপ্নের সামাজ্য। যার সুখের নাম ভূমিকায় ছিলেন আপনি। অথচ একদিন আপনি চলে গেলেন তার জীবন থেকে অনেক দূরে। হয়তো নিয়তিই নির্ধারণ করে দিয়েছিল দূরত্বের সীমানা; হয়তো হেলাল হাফিজের ‘দুঃখের আরেক নাম’ হবেন বলেই আপনি একদিন তাকে জানালেন, আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা। শুনে তার বুক শূন্যতায় ভরে গেলো। মুহূর্তেই ভেঙে গেলো তার সুখ-সাম্রাজ্যের স্বপ্ন। কিন্তু একজন কবি আর কতটুকু পারে? না, তিনি আপনাকে আটকাতে পারেননি। হয়তো তিনিও চাননি। কবি তো কাউকে শেকলে বাঁধে না। মায়ায় ভোলায়। কেউ যদি চলে যায়, তাকে যেতে দেয়। বুকে হারানোর ক্ষত নিয়ে নীরবে, নিভৃতে চোখের জল ফেলে। আর আর?
আর কবিতার পঙ্ক্তিতে-পঙ্ক্তিতে গুঁজে দেয় সমুদ্রের ঢেউ আর আকাশের শূন্যতাকে। পৃথিবীর বুকে প্রতিনিয়ত বিলীন হওয়া লাখ, কোটি মুহূর্তের একটিকে দান করে অনন্তের মর্যাদা। আপনাকে নিয়েই হয়তো কবি লিখছেন,
ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।
কিন্তু আপনি চলে যাওয়ায় কতবার সমাপ্তিতে লিখতে হলো,
ইচ্ছে ছিলো রাজা হবো
তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
. রাজা আছে
. ইচ্ছে আছে,
শুধু তুমি অন্য ঘরে।
জানি না—কবিতাটি আপনার চলে যাওয়ার হাহাকারটুকুই উঠে এসেছে কি না? নাইবা হলো আপনাকে নিয়ে লেখা এই কবিতা। এছাড়া কবিকে তার জীবনচরিতে পাওয়া যাক বা না যাক, কবি যখন লেখেন,
হিরণবালা তোমার কাছে দারুণ ঋণী সারা জীবন
যেমন ঋণী আব্বা এবং মায়ের কাছে।ফুলের কাছে মৌমাছিরা
বায়ুর কাছে নদীর বুকে জলের খেলা যেমন ঋণী
খোদার কসম হিরণবালা
তোমার কাছে আমিও ঠিক তেমনি ঋণী।তোমার বুকে বুক রেখেছি বলেই আমি পবিত্র আজ
তোমার জলে স্নান করেছি বলেই আমি বিশুদ্ধ আজ
যৌবনে এই তৃষ্ণা কাতর লকলকে জিভ
এক নিশীতে কুসুম গরম তোমার মুখে
কিছু সময় ছিলো বলেই সভ্য হলো
মোহান্ধ মন এবং জীবন মুক্তি পেলো।আঙুল দিয়ে তোমার আঙুল ছুঁয়েছিলাম বলেই আমার
আঙুলে আজ সুর এসেছে,
নারী—খেলার অভিজ্ঞতার প্রথম এবং পবিত্র ঋণ
তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে সত্যি কি আর শোধ হয়েছে?
তখন আপনাকেই এই কবিতার কেন্দ্রবিন্দু ভাববো, তাতে আর দোষের কী?
প্রিয় হেলেন, আপনার কাছে বড্ড জানতে ইচ্ছে করে কখনো কোনো উদাস করা দুপুরে কিংবা মন অবশ করা সন্ধ্যায় অথবা ঘোর লাগা বৃষ্টিতে, যখন সব কিছু থাকার পরও নিজেকে একা, একলা মনে হয়, তখন কি আপনার মনে একবারের জন্যে জাগেনি কবির কথা? আপনার হেলালের কথা? কেমন লাগতো তখন? কোন কথাটা জাগতো মনে? কোন স্মৃতিটা উসকানি দিতো? বড্ড জানতে ইচ্ছে করে। আপনাকে নিয়ে কবিতা লেখার কথা আপনি কি জানতেন? পড়েছেন কি সে কবিতা? কেমন লেগেছিল তখন?
পৃথিবী এক আজব জায়গা। এখানে ‘কার সাথে কে থাকে সে এক রহস্য।’ আপনি বিয়ে করে, ঘর-সংসার করে সুখী হয়েছেন কিংবা হননি। কবিকে হয়তো আর দেখেনইনি। তবু আপনার নামের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে কবির নাম। যতদিন বাংলা কবিতার পাঠক হেলাল হাফিজের নাম উচ্চারণ করবে, তার সঙ্গে উচ্চারণ করবে আপনার নামও। কী অদ্ভুত তাই না হেলেন? হিরণবালা?
কবিদের এই এক অসীম ক্ষমতা। না-পাওয়ার মাঝেও পাওয়া হয়ে যায়। অপ্রাপ্তিটুকুই তার প্রাপ্তি। আপনার একদা খেলার সঙ্গে তাইতো লিখেছেন, ‘তুমি জানো, পাড়া-প্রতিবেশী জানে পাইনি তোমাকে/ অথচ রয়েছো তুমি এই কবি সন্ন্যাসীর ভোগে আর ত্যাগে।’
একেই বোধহয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন—‘আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয় মাঝে আর কিছু নাহি চাই গো।’
সবাই যাকে কালের সীমায় বাঁধতে চায়, কবি তাকে পেতে চান কালোত্তরে। হেলাল হাফিজও তাই চেয়েছিলেন। ‘প্রতিমা’ কবিতার মাঝখানের কিছু পঙ্ক্তিতে উদ্ধৃত করছি:
শুনেছি সুখেই বেশ আছো। কিছু ভাঙচুর আর
তোলপাড় নিয়ে আজ আমিও সচ্ছল, টলমল
অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে
মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল।
এই যে কষ্টের বিনিময়ে আত্মোপলব্ধি ও ভালোবাসা বিরহে উজ্জ্বল হয়। সেই কষ্টটা কিন্তু কম নয়। নিঃশেষ করে দেয়। পুড়িয়ে খাক করে দেয়। আরেকটি কবিতা শোনাই আপনাকে:
আগুন আর কতোটুকু পোড়ে?
সীমাব্ধ তার ক্ষয় সীমিত বিনাশ,
মানুষের মতো আর অতো নয় আগুনের সোনালি সন্ত্রাস।আগুন পোড়ালে তবু কিছু রাখে
কিছু থাকে,
হোক না তা ধূসর শ্যামল রঙ ছাই,
মানুষে পোড়ালে আর কিছুই রাখে না
কিচ্ছু থাকে না,
খাঁ খাঁ বিরান, আমার কিছু নাই।’
প্রেমের আগুনে পুড়েছিল বলেই তার আর ঘরবাঁধা হলো না। ‘ছিমছাম সন্ন্যাসী’ হয়ে কাটিয়ে দিলেন সারা জীবন। কাটিয়ে দিলেন সারা জীবন তাসের খেলায় দুইটি জোকার নষ্ট হওয়ার কষ্ট নিয়ে। আপনি হয়তো বলতে পারেন, কবির জীবনে তো কত কত নারীই এলো। সবিতা সেনের কথা তো তার কবিতাতেই আছে।
হ্যাঁ, স্বীকার করছি কবির জীবনে এসেছিল অনেক নারী। অনেক নারীই তাকে দিয়ে গিয়েছিল মুহূর্তের সুখ। কবি অকপটেও স্বীকার করেছেন সে-কথা। কিন্তু বলুন তো, আপনার মতো আর কার অলঙ্কার হতে চেয়েছিল?
নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল তুমি নির্দ্বিধায়
অলঙ্কার করে নাও, এ আঙুল ছলনা জানে না।
একবার তোমার নোলক, দুল, হাতে চুড়ি
কটিদেশে বিছা করে অলঙ্কৃত হতে দিলে
বুঝবে হেলেন, এ আঙুল সহজে বাজে না।
হ্যাঁ, যে আঙুল সহজে বাজে না, সে আঙুলকেই আপনার নোলক, দুল হাতে চুড়ি, বিছা হতে দিতে চেয়েছিলেন। হতে পারেননি। এরপরও কবির এক জীবন আপনার নামে উৎসর্গ করেছিলেন। আপনাকে ভালোবেসেছিলেন বলেই কবি দেশ মাতৃকাকে ভালোবাসতে পেরেছিলেন। আপনার কাছে কবির আজন্ম ঋণ। যতই ব্রহ্মপুত্রের মেয়েকে ভালোবেসে অভিশাপ দিন না কেন। আপনার ডাকেই তিনি কাঙালের মতো উড়ে যেতে চেয়েছিলেন আপনার কাছে। পাবেন না জেনেও আপনাকেই চেয়েছেন হয়তো।
প্রিয় হেলেন, এখন গভীর রাত। কেমন নীরব হয়ে গেছে নগর। থেমে গেছে কোলাহল, কলবর। মাঝে মধ্যে দুয়েকটি গাড়ি চলে যাচ্ছে হুশ শব্দ করে। বিশাল আকাশ শুয়ে আছে আকাশে। চাঁদের ঢিমে জ্যোৎসায় ঝিমুচ্ছে নক্ষত্রেরা। অন্ধকারের চাঁদর গায়ে দিয়ে গৌতম বুদ্ধের মতো ঘুমোচ্ছে বৃক্ষরাজি। এই আকাশ, চাঁদ, তারা, বৃক্ষ যেমন চিরকালের, তেমনি বাংলাদেশের কবিতার পাঠকের কাছেও হেলেন—হেলাল হাফিজ চিরকালের। দূরে থেকেও যিনি আপনার এত কাছের, এত আপন, তাকে নিয়ে আপনার কথা শুনতে বড় সাধ জাগে। শুনতে ইচ্ছে করে আপনার কতটা দীর্ঘশ্বাসজুড়ে আছেন তিনি।
আজ আর নয়। কয়েক ঘণ্টা পরেই পৃথিবী জেগে উঠতে শুরু করবে পুরনো বিদায় দিয়ে নতুন করে। ভালো থাকুন।