একদিন আমাদের কুমিল্লার ‘যন্ত্রণা’ বাসায় গিয়ে হাজির হন হুমায়ূন আহমেদ। সঙ্গে বোন, বোনের মেয়ে, তাঁর দুই মেয়ে—নোভা আর বিপাশা। দুই জন প্রকাশক বন্ধু। ঘণ্টা দুয়েক ছিলেন। তারপর আবার ঢাকায়। সেই প্রথম তাঁর সঙ্গে সরাসরি দেখা। সেটা মনে হয় বিরানব্বই সালের কথা। এরপর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে কয়েকবার। ধীরে ধীরে মানুষটাকে ভালো লাগতে থাকে। তিনি সবসময় নিজেই আসরের মধ্যমণি। যেকোনো বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ কথা চালিয়ে যেতে পারতেন। তাঁর ‘সেন্স অব হিউমার’ এত চমৎকার ছিল যে, কাউকে কখনো বিব্রত হতে হয়নি এ কারণে। রসিকতা কাকে বলে, কত প্রকার, যারা তাঁর সঙ্গে মেশেননি, তাদের বোঝানো যাবে না।
চুরানব্বই সালের ১৩ নভেম্বর তাঁর বাসায় নেমতন্ন করলেন। সন্ধ্যার পর পরই যেতে বললেন। সারাদিন দারুণ এক উত্তেজনায় কাটে আমার। কত জ্ঞানী মানুষজনের সঙ্গে দেখা হবে! এক তোড়া ফুল কিনে তাঁর বাসার নিচে গিয়ে দাঁড়াই। দারোয়ান খুব বেশি পাত্তা দিতে চায় না। হুমায়ূন আহমদের সঙ্গে কথা বলে বলে দারোয়ান নিশ্চিত হয় যে, আমি নিমন্ত্রিত অতিথি। এরপর ভেতরে যাওয়ার অনুমতি মেলে। এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যাল থেকে হাতিরপুল যেতে হাতের বামে কমপ্যাথ ডায়াগনস্টিকের পাশের গলিতে ছিল সে বাসা। তখনো ঢাকায় অ্যাপার্টমেন্ট এত জনপ্রিয় ছিল না। লিফটে উঠতে যাব, হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। কী করব, ভাবছি। দারোয়ান বললো, সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে। তাঁর ফ্ল্যাট আট তলায়। হেঁটেই আট তলায় উঠি। দরজা খুলে স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, আট তলায় উঠতে খুব কষ্ট হয়েছে? আসো, বসো।
তাঁর রুমে তেমন কোনো আসবাব নেই। একটা বুক সেলফ, একটা ক্যাসেট প্লেয়ার, অসংখ্য ক্যাসেট আর বেশ কিছু ফুলের তোড়া। সবাই নিচে বসে আছে, কার্পেটে। আমিও বসলাম। সেখানে পরিচয় হলো— বর্তমান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, অন্যপ্রকাশের মাজহার ভাই, সময়ের ফরিদ ভাই, সূবর্ণ’র জাহাঙ্গীর ভাই, মাওলার মাহমুদ ভাই, প্রতীক প্রকাশনীর আলমগীর ভাই, অভিনেতা সালেহ আহমদ, তুহিন, মোজাম্মেল স্যারসহ অনেকের সঙ্গে। সবাই বিখ্যাত মানুষ। কেবল আমিই ছিলাম অখ্যাতষ। আড্ডা চলছে। সে আড্ডায় শিল্প, সংস্কৃতি, গান, সিনেমা, হিমু, মিসির আলী, শুভ্র, বই মেলা—কোনোটাই বাদ যায় না। আমার মতো আরও কয়েকজন সিঁড়ি দিয়ে বেয়ে উঠেছেন। কে যেন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, এত ওপরে ফ্ল্যাট নিলেন কেন ? তিনি ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, মশারা পাখায় ভর করে আট তলা পর্যন্ত উঠতে পারে না। দেখেন, আমার বাসায় কোনও মশা নেই।
এটা আমার কাছে মিসির আলীর যুক্তি মনে হয়েছে। আড্ডা চলছে। এটা-সেটা খাবার আসছে। এর মধ্যে বিশাল বিশাল দু-তিনটে গোটা মাছ ভেজে নিয়ে আসা হলো। তিনি সবার উদ্দেশে বললেন, সবাই মিলে এই মাছগুলো খেতে হবে কিন্তু।
পুরো আড্ডায় আমি দু-তিনটি প্রয়োজনীয় কথা বলেছি শুধু। আসলে বলব কী! চোখের সামনে এত এত গুণী মানুষজন। বিস্ময় নিয়ে তাঁদের দেখছি। কথা শুনছি। একটা ঘোর লাগা অনুভূতি নিয়ে রাত দশটা নাগাদ বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসলাম সে ফ্ল্যাট থেকে।
তারপর আবার দেখা তাঁর বাসায়। সেটা ৯৫ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি। তখনো তিনি এলিফ্যান্ট রোডে থাকেন। তাঁকে বললাম, এবারের একুশের বই মেলায় আমরা একটা দোকান দেব। সে দোকানে আমরা শুধু আপনার বই রাখব। অন্য সব কটি প্রকাশনীর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আপনি রাজি হলে তাদের কোনও আপত্তি নেই। বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে বের হওয়া আপনার সব ক’টি বই তারা আমাদের দেবেন। এটি হবে আপনার সব বই একসঙ্গে পাওয়ার একমাত্র দোকান। দোকানের নামও ঠিক করে ফেলেছি। আরেকটা কথা স্যার, আপনি যখনই মেলায় যাবেন—’কোথাও কেউ নেই’ স্টলে বসবেন।
কিছু না বলে তিনি শুনলেন। আমি থামার পর বলা শুরু করলেন, প্রথমে বলো, ‘কোথাও কেউ নেই’ স্টলটা কার?
আমাদের স্টলের নাম ওটা
এবার গম্ভীর থেকে একটু হাসি মুখে জানতে চাইলেন, তার মানে তোমরা আমার বইয়ের একক স্টল দিচ্ছ? এটা ভালো যে, পাঠক এক দোকানে আমার লেখা সব বই পাবে। কিন্তু এতে কিছু সমস্যাও আছে।
কী সমস্যা স্যার, জানতে চাইলাম।
তিনি আমার কথা শুনলেন বলে মনে হলো না। আবার বলা শুরু করলেন, শুধু আমার বই রাখার কারণে এবং আমি যদি তোমাদের স্টলে বসি, তাহলে পাঠক আর অটোগ্রাফ শিকারীদের সামলানো মুশকিল হবে তোমাদের জন্য। তারচেয়ে এক কাজ করো, তোমরা শুধু আমার বই রাখো। আমি অন্য কোনও স্টলে বসব। তাতে তোমাদের ওপর চাপ কম পড়বে।
মেলা শুরু হলো। সব প্রকাশনী থেকে তাঁর প্রতিটি বইয়ের দশ কপি নিয়ে জমাতে শুরু করলাম আমাদের স্টলে। মেলার প্রথম সপ্তাহে তেমন ভিড় শুরু হয়নি। পাঠকরা এসে টুকটাক বই কিনে নিয়ে যায়। এর মধ্যে মেলায় আগত সব পাঠক জেনে গেছে, আমাদের স্টলে গেলে সব বই পাওয়া যাবে। লেখক যেদিন মেলায় আসবেন, সেদিনই আমাদের স্টলে বসবেন। ফলে দিন দিন আমাদের দোকানে ভিড় বাড়তেই লাগল। মেলার শেষের দিকে দোকানের সামনে পাঁচ ফুট দূরত্বে বাঁশ পুঁতে তার মধ্যে মোটা দড়ি পেঁচিয়ে পাঠকদের সামলেছিলাম। এরমধ্যে দুদিন পুলিশ দিয়ে লোকজন ঠেকাতে হয়েছে।
এই মানুষটার কারণেই সেন্টমার্টিন চিনলাম। তিনি সেখানে এক টুকরো জায়গা কিনলেন। ছোট করে একটা টিনের বাড়ি বানালেন। নাম দিলেন—সমুদ্র বিলাস। ২০০০ সালের একদিন তাঁকে বললাম, স্যার, সেন্টমার্টিন যাব। সমুদ্র বিলাসে থাকব।
তিনি রাজি হলেন। তবে কঠিন শর্ত দিয়ে দিলেন। বললেন, পূর্ণিমা দেখে যেও। আর শোনো, রাতে কোনোভাবেই সমুদ্র বিলাসে ঘুমানো যাবে না। সারারাত সমুদ্রের সামনে বসে পূর্ণিমা দেখতে হবে। এই শর্তে রাজি হলে যাওয়ার সময় একটা চিঠি নিয়ে যেও।
সমুদ্র বিলাসের কেয়ার টেকারকে লেখা তাঁর সে চিঠি নিয়ে আমরা তিন জন সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওয়ানা হই। সে সময় এখনকার মতো এত ‘শিপ’ ছিল না। দিনে দু-তিনটা ট্রলার যেত টেকনাফ থেকে। সে ট্রলারে বসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দুপাশ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। ভাড়া ছিল জন প্রতি ৫০ টাকা। তো, সে ট্রলারে চড়ে আমাদের যাত্রা শুরু। নাফ নদী পার হয়ে বঙ্গোপসাগরে ট্রলার পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে আর আতঙ্কে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। একেকটি ঢেউয়ে ট্রলার লাফ দিয়ে উঠে যায় শূন্যে। আমরা মাঝির হাতে-পায়ে ধরে মিনতি করি, আমাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। মাঝির দয়া হয়। ট্রলার ঘুরিয়ে আবার নাফ নদীতে আসে। সেখানে ছোট ছোট অসংখ্য মাছ ধরার নৌকা। তার একটাতে আমাদের নামিয়ে চোখের সামনে দিয়ে দুলতে দুলতে ট্রলার চলে যায় দ্বীপের দিকে। আমরা ফিরে আসি টেকনাফ।
জীবনে তাঁর সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে। আড্ডা হয়েছে। একসঙ্গে বসে গান শুনেছি। তাঁর বাসায় বছরে একবার যাওয়া হতো। তাঁর জন্মদিনে।
১৩ নভেম্বর। এলিফেন্ট রোড ছেড়ে তিনি তখন ধানমন্ডির ‘দখিন হাওয়া’য়। ইতোমধ্যে তাঁর পরিবারের অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। গুলতেকিন ভাবি, বড় মেয়ে নোভা, মেজো মেয়ে শিলা আর ছোট মেয়ে বিপাশা। ছেলে নুহাশ। ছোট ভাই আহসান হাবীব (উন্মাদ সম্পাদক), জাফর ইকবাল স্যার, তাঁর বোন, তাঁর মা…
২০১০ সালে এসে তাঁর সঙ্গে কোনও এক কারণে আমার সম্পর্কের অবনতি হয়। সেজন্য আমি কোনোভাবেই দায়ী ছিলাম না। আমি তখন একটি হাসপাতালের পিআর বিভাগে কাজ করি। তাঁর মা ভর্তি হলেন সে হাসপাতালে। সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরও তাঁর মায়ের পরিচর্যায় কিছু ত্রুটি হয়। সেটাও তেমন গুরুতর কিছু না। খালাম্মার জন্য কাঁচা লবণ খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ভুলবশত তাঁর খাবারের সঙ্গে কাঁচা লবণ দেওয়া হয়। আর সেটাও কিনা পড়বিতো পড় মালির ঘাড়ে। তাঁর চোখেই ধরা পড়ল। এই নিয়ে ফোনে তিনি আমার সঙ্গে বকাবকি করলেন। ফোনে তিনি আমাকে চিনতে পারেননি। আমি যে পরিচয় দেব, সে সুযোগও পাচ্ছিলাম না। তিনি রেগে গেলে কাউকে কথা বলার সুযোগ দেন না। একাই বলে গেলেন অনেকক্ষণ। এক সময় থামলেন। আমি পরিচয় দেওয়ার পর কিছুটা ঠাণ্ডা হলেন। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে বললেন। আমি রাজি হলাম। লিখিতভাবে তাঁর কাছে ক্ষমাও চাইলাম। তিনি ক্ষমা করেও দিলেন। ব্যাপারটা এখানেই মিটে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাঁর চারপাশে ঘিরে থাকা তোষামোদকারীরা তাঁকে উস্কে দেয় আবার। তিনি পরের দিন একটি দৈনিকের প্রথম পাতায় এ নিয়ে বিশাল একটি লেখা লিখলেন। সে লেখা দেখার পর তাঁর প্রতি আমার প্রচণ্ড অভিমান হয়। আমি তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ বন্ধ করে দেই…।
সোনালী ইসলাম। সোনালী আপা। হুমায়ূন আহমেদের মায়ের সঙ্গেই মূলত যার সখ্য। সেই সোনালী আপা আমারও বন্ধু, বড় বোন। হাসপাতালের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এবং আমার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের ফোনালাপ সম্পর্কে আপা জানতেন। একদিন আপা আমাকে কল করে বললেন, মানুষটার প্রতি কোনও ক্ষোভ আর অভিমান রাখবেন না। তাঁর ক্যানসার ধরা পড়েছে। তাঁকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চিকিৎসার জন্য। তাঁর জন্য দোয়া করবেন।
শুনে আমি চুপ হয়ে যাই। কী বলব! এর কিছুদিন পর। ১৯ জুলাই, ২০১২ রাত এগারোটার দিকে সোনালী আপা আবার কল দিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, স্যার নেই।
এর বেশি বলতে পারেননি। তাড়াতাড়ি টিভি ছাড়লাম। টিভি স্ক্রলে দেখাচ্ছে—হুমায়ূন আহমেদের অবস্থা সংকটাপন্ন। তাঁর জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছে পরিবার। এভাবে পনর কুড়ি মিনিট গেল। এক সময় টিভি স্ক্রলের লেখাটা পাল্টে গেল হুমায়ূন আহমেদ আর নেই!