সোনারগাঁও উপজেলার এলহিনগর গ্রামে ১৯৫৫ সালে হাসান হাফিজে জন্ম। বেড়ে উঠেছেন বাংলাদেশ আন্দোলনের সঙ্গে। দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধ, দেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে আমাদের এগিয়ে চলা, পিছিয়ে পড়া, হোঁচট খাওয়া আর নানা ঘাত-প্রতিঘাত সবই তার জানা। প্রায় চার দশক পেরিয়ে আসার পথে ইতোমধ্যে তার দেড় শতাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে।
হাসান হাফিজ কবিতার উপাদান সংগ্রহ করেছেন মানুষের ভেতর থেকে। তার কবিতার বিষয় মানুষ। সেই মানুষকে প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি মানুষের চারপাশে বিশেষত ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতিকে অবলম্বন করেছেন। মানুষের মন, মনের নানা পর্যায় তিনি নিজস্ব চেতনা-দর্শনে মুড়িয়ে প্রকাশ করেছেন। যাকে আশ্রয় করেছে প্রকৃতি। আর এই দুইয়ের সাজুয্য খুঁজতে তিনি সময় এবং সমাজ বিকাশের ধারাকেও আমলে রেখেছেন। ফলে তার কবিতা হয়ে উঠেছে মানুষের কথা। তিনি নিজের চিন্তা-চেতনার ধারাকে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার যে মন্ত্র ধারণ করেছেন, তা তার কবিতার পাঠককেও আলোড়িত করে। ফলে তার কবিতা হয়ে ওঠে ভালোবাসার আশ্রয়, হয়ে ওঠে প্রকৃতির আশ্রয়, হয়ে ওঠে চেতনার মানবিক সৌন্দর্যের প্রকাশ। জীবনের চিরায়ত সত্যকে ধারণ করেই তিনি ঠিক নিয়তিবাদীর মতোই কবিতার ধমনীতে জিইয়ে রাখেন চিরকালীন দেশ ও মানুষ।
গোলাপ ফুল পাখি নয়,
তারপরও উড়তে চায় অনন্ত আকাশে।
মেঘলোকে উড়তে পারে না বলে
তার মনে বিষাদ পাথর হয়ে জমে
তার প্রিয় ঠাঁই হচ্ছে তরুণীর খোঁপা
চুলের চুম্বনে হবে সম্পন্ন সার্থক।
তরুণীর মনে ঢেউ অশান্তির, মুখ ভার—
গোলাপের বিকশিত সৌন্দর্য সে
এক পলক চেয়েও দেখে না,
প্রেমিকের সঙ্গে তার হঠাৎ-বিচ্ছেদে
দুই চোখ হয়ে উঠছে নোনাজলে সমুদ্র সমান
ব্যথিত তরঙ্গরাশি স্বপ্নচূড়া ভেদ করে
নিজের দেশের সীমা পার হয়ে ঊর্ধ্বাকাশে
আশেপাশে তাকানোর সময় কোথায়?
(গোলাপ যখন উপেক্ষিত)
হাসান হাফিজ—বিশ শতকের সত্তরের দশকের কবি। বাংলা কবিতার ইতিহাসেই শুধু নয়, আমাদের জাতীয় জীবনের জন্যও সত্তর দশক খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই দশকে বাঙালির মহৎ অর্জন লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে তার স্বাধীনতা। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সময়ের ছাপ রয়েছে এ সময়ের শিল্প-সাহিত্যেও। সত্তর দশকের কবিতার পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে জীবন এবং রাজনীতি। প্রায় চার দশক সময় পেরিয়ে সত্তর দশকের কবিতা তার নিজস্ব উজ্জ্বলতায় স্পষ্ট। এ দশকের কবিতায় রাজনীতি এসেছে, তবে তা জীবনকে অস্বীকার করে নয়। কবিতায় উুঁচ স্বর শোনা গেছে, কিন্তু তা শিল্পকে অস্বীকার করে নয়। বরং জীবনের প্রয়োজনেই, শিল্পকে বেছে নেয়ার তাগিদ থেকেই তৈরি হয়েছিল শিল্পকর্ম। আর তাই এ দশকের কবিতায় ব্যক্তির অনুভূতিমালার সঙ্গে সামগ্রিক অনুভূতি একাকার হয়েছে। হাসান হাফিজ এ সময়ের কবি। দশকের লক্ষণগুলো তিনি যেমন নিজের ভেতরে ধারণ করেছেন তেমনি কবিতা থেকে নিজের অনুভূতিকেও সরিয়ে রাখেননি। নিজের অনুভূতিমালাকে প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনিও রাজনীতি, জীবনকে সামনে রেখেই বর্ণনায় সিদ্ধ হয়েছেন।
তৃণলতা তৃণলতা বোঝো না তুমি মনোব্যথা
সে কারণে চোখ ভেজে শিশিরে ফোঁটায়
তৃণলতা ক্ষুদ্র তুমি কিন্তু মনে বড়ো
আবেগের উষ্ণ ঢেউ দীপ্র থরোথরো
সর্বাঙ্গে বিষের তাপ ছিন্ন জরোজরো
তৃণলতা আমি তার অভাবে অচলা হয়ে
আছি পড়ে চলচ্ছক্তিহীন জরোজরো
তৃণলতা তৃণলতা উহাকে ফিরিয়ে আনো
সে এসে তাচ্ছিল্য দিক, তারপরও ফিরে সে আসুক
ও বন্ধু দোহাই তোমার তুমি কিছু একটা করো
(কিছু করো তৃণলতা)
হাসান হাফিজ—একদিকে যেমন বাংলাদেশের ভেতর থেকে দেখেছেন দেশের জন্ম। শৈশবে দেখেছেন মুক্তিপাগল মানুষের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গের মহাকাব্য। তার রয়েছে ভ্রমণ পিপাসু মন। পেশায় সাংবাদিকতার কারণে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তার অনুসন্ধানী চোখ। অভিজ্ঞতা, মন আর চোখ এই তিনের সম্মিলনে তিনি কবিতায় তুলে এনেছেন নানা রঙের বিষয়-আশয়। তার আত্মোপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতায় একে একে শব্দের মালায় উঠে এসেছে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষ।
সত্তরের দশকের কবিতায় জীবন ও রাজনীতির যে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে থাকা, তার স্পষ্ট উদাহরণ হাসান হাফিজের কবিতা। তিনি কবিতাকে মানুষের খুব কাছের করে তুলেতে চেয়েছে। ফলে জীবনের যন্ত্রণাকে যেমন প্রকাশ করেছেন, তেমনিভাবে তার আত্মোপলব্ধিকেও স্পষ্ট করেছেন। এতে করে তার দেখা এবং তার উপলব্ধি—এ দুইয়ের সম্মিলনে পাঠক নিজেকে আবিস্কার করতে সক্ষম হয়। সমাজের নানা স্তরের ভেতের ভেতরে যে সংকট, আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে যা দাঁড়িয়ে রয়েছে, যে দ্বন্দ্ব আমাদেরকে ক্রমাগত পেছনের দিকে ঠেলে দিতে থাকে, সেইসব অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বহীনতার কথামালাই তিনি কবিতায় সাজিয়ে তুলতে চেয়েছেন।
মধ্যবিত্ত স্বপ্ন এক খাঁচাবন্দী অসহায় পাখি। ডানা
তার ভুলে গেছে স্বচ্ছন্দ উড়াল। পরান্ন বা দানাপানি
নিত্যদিন যতোটুকু জোটে, তাকে মন্দ বলি না মোটেও।
তারপরও মুক্তির তাড়নাঢেউ, অতৃপ্তির গোঙানি অস্থির
গুমরে গুমরে কাঁদতে থাকে লোলচর্ম বুকের ভিতর।
অস্বস্তি ও অন্ধকার থাবা মেরে মুহূর্তে গুঁড়িয়ে দেয়
তিল তিল বুননের অস্তিত্ব-কাঠামো। তার কোনো পর নেই
আদি অন্ত বিরতির লেশমাত্র দিকদিশা নাই।
(অন্বেষার বিঘ্ন ভাঙচুর)
যন্ত্রণাকাতর অতৃপ্ত মধ্যবিত্ত জীবনের ছবির সঙ্গে সঙ্গে তার কবিতায় বারে বারে উঠে এসেছে সময় এবং বাংলাদেশ। তিনি সবসময়ই চেয়েছেন কবিতার মধ্য দিয়ে একটি সময়কে ফুটিয়ে তুলতে। এক্ষেত্রে শব্দ ব্যবহার এবং বর্ণনার নৈপুণ্যে তা শুধু একা হাসান হাফিজের বর্ণনা হয়েই থাকেনি, হয়ে উঠেছে পাঠকের নিজেরও অনুভূতি। হাসান হাফিজের কবিতা মানবিক বোধে উজ্জীবিত। একইসঙ্গে তার কবিতা স্বকাল এবং স্বদেশের চেতনাকেও লালন করে। দীর্ঘ সময় ধরে কবিতার ভুবনে রয়েছেন হাসান হাফিজ। স্বাভাবিকভাবেই যে দীর্ঘ সময়ের ভেতর দিয়ে তিনি যাত্রা করেছেন, যে সময় এবং পরিবেশের মধ্যে তিনি বাস করেন, তার ছায়া খুঁজে পাওয়া যায় তার কবিতায়। তবে সেই খুঁজে পাওয়া দৃশ্যাবলী প্রায়ই রূপকাশ্রয়ী। তিনি কবিতাকে সরাসরি কথা বলার মাধ্যম করে তোলেননি প্রায়। বরং কবিতা যে আড়াল দাবি করে, সেই অবগুণ্ঠনে মুড়িয়েই তিনি উপস্থাপন করেন অনুভূতি। যাতে তার কবিত্বশক্তি এবং চিন্তার অভিনবত্বকেও পাঠক টের পান। আর এতে করে তার কবিতা অর্থহীন না হয়ে একটি সামগ্রিক অনুভূতির প্রকাশ হয়েই ধরা দেয়।
আধফোটা কলি আধখানা চাঁদ
ভ্রমে ও কুহকে পাতা ছিল ফাঁদ।
তুমিই গোপনে পিছলিয়ে পা
পড়েছিলে ভুলে? জানাই হলো না!
আধফোটা ভ্রণ এক ফালি শ্বাস
গুমরিয়ে কাঁদে একা বারো মাস
তুমি সেই চোখে দেখেছিলে জল
দেখে ভুলে গেলে বেশ জানো ছল।
(বেশ জানো বেশ)
হাসান হাফিজ কোনো গণ্ডীর ভেতরে নিজেকে আটকে রাখেননি। তিনি প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতা, চেষ্টা, আবেগ, স্মৃতি এবং পরিবর্তনশীলতাকে নিজের ভেতরে ধারণ করে আমাদের চিরায়ত অনুষঙ্গগুলোকে লালন করে সৃষ্টিশীল রেখেছেন নিজেকে। যেখানে তার আন্তরিকতা, তার সৃষ্টিশীলতা আচ্ছন্ন করে রাখে পাঠককে। হাসান হাফিক নিজের অভিজ্ঞতার জগৎকে অনায়াসে পাঠকের চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। আর এই মিলিয়ে দেওয়া এবং ভাবনার জগতের সঙ্গে পাঠকের যে সেতুবন্ধন গড়ে তুলেছেন লেখার মধ্য দিয়ে তার অনুভূতিই বারে বারে হাসান হাফিজকে প্রকাশিত হতে সহায়তা করে। যা তাকে এবং তার বিকাশকালের সীমানা ছাড়িয়ে এনেছে। আজ (১৫ অক্টোবর) কবি হাসান হাফিজের জন্মদিন। নিরন্তর শুভকামনা।