জীবনানন্দ-উত্তর আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মেধা-মনন, স্বীয় প্রতিভা ও স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যে কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক স্বর্ণযুগের সূচনা করেছিলেন, সৈয়দ শামসুল হক (২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫-২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬) তাদের অন্যতম। সুদীর্ঘ এক সাহিত্যিক জীবন পার করেছেন তিনি। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদসহ শিল্প-সাহিত্যের যে শাখায় তিনি বিচরণ করেছেন, সে শাখায়ই তুলে এনেছেন অসামান্য সাফল্য। সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে শব্দের ব্যবহার ও রূপকল্প সৃষ্টির পাশপাশি কাহিনিতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে নৈপুণ্য তিনি দেখিয়েছেন, তার জুড়ি মেলা ভার। ১৯৫৩ সালে ‘একদা এক রাজ্যে’ কবিতাগ্রন্থ দিয়ে তার যাত্রা শুরু হলেও ‘তাস’ গ্রন্থটি আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর অবিরাম লিখেছেন সৈয়দ হক। তবে সব ছাপিয়ে তিনি কবি হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত।
তার ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’, ‘পরাণের গহীন ভিতর’, ‘নাভিমূলে ভস্মাধার’, ‘আমার শহর ঢাকা’, ‘বেজান শহরের জন্য কেরাম’, ‘বৃষ্টি ও জলের কবিতা’ এসব কাব্যগ্রন্থের অজস্র কবিতায় তার নানা নিরীক্ষার ছাপও স্পষ্ট। কাব্যনাট্য রচনায় ঈর্ষণীয় সফলতা পাওয়া সৈয়দ হক ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’ নাটকে রেখেছেন মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর। তিনি যেমন মহাকাব্যিক পটভূমে ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ নামের দীর্ঘ উপন্যাস লিখেছেন, তেমনি স্বল্প পরিসরের উপন্যাসের সংখ্যাও কম নয়। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকে তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে তার ‘নিষিদ্ধ লোবান’সহ অন্যান্য উপন্যাসে। এছাড়া ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘নীল দংশন’, ‘মৃগয়া’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘এক মহিলার ছবি’, ‘দেয়ালের দেশ’, ‘স্তব্দতার অনুবাদ’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’, ‘মহাশূন্যে পরানমাস্টার’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’, ‘অন্তর্গত’, ‘এক মুঠো জন্মভূমি’, ‘শঙ্খলাগা যুবতী ও চাঁদ’, ‘আয়না বিবির পালা’সহ ৫০টির বেশি উপন্যাসের রচয়িতা তিনি। এছাড়া ষাট, সত্তর ও আশির দশকে চিত্রনাট্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রের জন্য গানও লিখেছেন। তার ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’র মতো বহু গান এমনই জনপ্রিয় যে, এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
তিনি যেন জীবনকেও নিরীক্ষণ করেছেন। আর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে তার সৃষ্টিকর্মে। বলার অপেক্ষা রাখে না, কবি-শিল্পীরা তাদের সাহিত্যকর্মে ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতা প্রকাশে নানামুখি তত্ত্বের অবতারণা ঘটিয়েছেন। শিল্পকর্ম বিনির্মাণে গড়ে তুলেছেন নানা ফর্ম। এ তত্ত্বের আধুনিক ধারাটি হচ্ছে ‘চিত্রকল্প’। সাহিত্যকে বলা হচ্ছে, ‘সামগ্রিক জ্ঞান, অনুভূতি ও চৈতন্য যা হয়ে ওঠে পঞ্চেন্দ্রিয়ের কাছে অর্থময়, আবেগবাহী ও ব্যঞ্জনাধর্মী’—এ অর্থে, পাঠকের ইন্দ্রিয়কে নাড়া দিতে গিয়ে শিল্পস্রষ্টাকে তার কল্পনাশক্তির ওপর জোর দিতে হয়। কবির মৌলিক শক্তিও ‘কল্পনাশক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত। যে কবির কল্পনাশক্তি যত প্রখর, সে কবির কবিতাও তত বেশি শক্তিশালী। কবি জীবনানন্দ দাশও ‘কল্পনাশক্তি’র ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন, ‘মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা বুদ্ধি নয়, হৃদয় নয়-কল্পনা। কবিতা এত শক্তিশালী হয়ে ওঠে এ জন্যেই যে কল্পনা তার পেছনে সবচেয়ে প্রধানভাবে সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে কাজ করে যায়।’ কবিতায় কল্পনাশক্তির প্রয়োগের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ‘চিত্রকল্প’ অভিধাটি। কবিতার চিত্রকল্প দৃশ্যগত ও ইন্দ্রিয়গম্য হিসেবে পাঠকের উপলব্ধিতে আসে। সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় এ দুই ধরনের চিত্রকল্পেরই সন্ধান মেলে।
চিত্রকল্পের ধারণাটি প্রাচীন হলেও বাংলা সাহিত্যে ত্রিশ কালপর্বে খ্যাত পঞ্চকবির হাতে চিত্রকল্পের সার্থক উপস্থিতি লক্ষণীয়। এরই ধারাবাহিকতায় পঞ্চাশের শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ কবিদের অন্তর্মূল ধরে নাড়া দিয়েছিল কবিতার শরীরে সংহতি-ভাবনা। ফলে এই সময়পর্বের কবিরা কবিতা শরীরে প্রতিমা স্থাপনের কৌশল গ্রহণ করেন। চিত্রকল্প নির্মাণের জন্য ব্যক্তিগত উপলব্ধির প্রয়োগ ঘটান কবিতার শরীরে। যে কারণে এই সময়পর্বের কবিতায় চিত্রকল্পের নকশায় একটি সুচিন্তিত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। শব্দের প্রতীকী তাৎপর্য ও নাটকীয়তায় কবিতায় চিত্রকল্পগুলো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এ ধারায় সৈয়দ শামসুল হককে অগ্রবর্তী হিসেবে শনাক্ত করা যায়। তার কবিতার বিষয়-প্রকরণ যেমন বহুমাত্রিক অনুভাবনা জারিত, তেমনি আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যঋদ্ধ। কবিতায় প্রেম, স্মৃতিকাতরতা, অবচেতন মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশে তিনি সমসাময়িক কবিদের চেয়ে ব্যতিক্রম মনোভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। কবিতায় সমকালীন মৌল প্রবণতাগুলো তুলে ধরতে কবিতাকে চিত্রকল্পের অবয়বে বিনির্মাণ করেছেন।
এখনও পরায় মনে পরাগের মতো রাত নেমে এলে বাংলার প্রান্তরে
সেই দূর কবেকার মেয়েদের দীর্ঘ কালো চুল
পাখির চিৎকার শুনে এখনও তো করে উঠি ভুল-
বুঝি সেই! সেই তারা! এখনও মেলার দিনে ডাকে যেন কেউ
আমারই এ ভুলে যাওয়া ডাকনাম ধরে।
‘তবু বেঁচে থাকা অপরূপ’ কবিতায় কবিকে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত মনে হলেও ভাবনাটি একটি সুস্পষ্ট গ্রাম্য দৃশ্যের ভেতর পাঠককে টেনে নিতে সক্ষম। তিনি ঘন ও জটিল জীবনের রূপায়ন তুলে ধরেছেন এ কবিতায়।
‘আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় কেন,
ক্যান এত তপ্ত কথা, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছন নিয়া ক্যান অন্য ধান খ্যাত রোয়?
অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিরাম ধ্যান।
…. মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?
পুন্নিমার চান হয় অমাবশ্যা কিভাবে আবার?
সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?
সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?
মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর
নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।’
গল্পের পটভূমে রচিত ‘পরানের গহীন ভিতর’ কবিতাটি আবেগনির্ভর হলেও সুসংহত। এ কবিতায় জীবনের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা ও বাসনার তীব্রতা লক্ষণীয়, যা পোড় খাওয়া সম্পর্কের ইতিবৃত্তকে ইন্দ্রিয়গম্য করে তোলে। সহজ ও সুনির্মিত দৃশ্যকল্পের কারণে কবিতাটি পাঠ মাত্রই পাঠকের হৃদয়ে সঞ্চারিত হয় এবং চৈতন্যলোকে ঠাঁই করে নেয়। কিংবা—‘আমার কি আছে? গ্যাছে সুক/ য্যান- কেউ নিয়া গ্যাছে গাভীনের বাঁটে যতটুক দুধ আছে নিষ্ঠুর দোহন দিয়া।’ সৈয়দ শামসুল হক প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠে কবিতায় চিত্রকল্প এঁকেছেন। এ কবিতার মধ্য দিয়ে গোটা বাংলাদেশই চিত্রিত হয়ে ওঠে পাঠক হৃদয়ে। যেখানে নকল আভিজাত্যের কোনো প্রলেপ নেই।
এ কথা অত্যন্ত জোরে দিয়েই বলা যায়, ‘বাংলাদেশের কবিতায় সৈয়দ শামসুল হক একটা বলয়ের অধিকারী, নিজস্ব সে বলয়ে অনুগামী করেছেন প্রজন্মান্তরের কবিদের। উদাহরণে ‘পরানের গহীন ভিতর’-এর সনেটগুচ্ছ কিংবা একবারে দিব্য-উন্মীলন কাব্যনাট্যের ভাষ্যসমূহ। এসবে বিশ্লেষণমাত্রা হয়ে উঠতে পারে বহুমাত্রিক। কথাটি এজন্য যে, তাঁর কবিতায় সে ভঙ্গিমাটিই প্রধান। যেন ভরা নদীর মতো উপরিপৃষ্ঠে সৌম্য-শান্ত কিন্তু ভেতরে স্রোতস্বিনীর গতিময়তা। তবে উত্থান-পতন আছে, স্থির বা অস্থিরতা আছে কিন্তু শৈলীটি পেয়েছে দুর্বার দুরন্ত রূপ’- কথাটি উল্লেখ করেছেন গবেষক শহীদ ইকবাল। যেখানে তার কবিতায় চিত্রকল্পের বিষয়টিই উঠে এসেছে গভীর পর্যবেক্ষণে। বলেছেন:
বাংলার নদীতে সেই বিদ্যাপতি মহাজন বিখ্যাত ভাদরে
জলের তুমুল চুমো একদিন মনে মনে
কামরাঙা সে কার অধরে!
আমিই সে আমি বুঝি ভাদর বাদলে ভেজা মেয়েটির মুখ
করতলে তুলে নিই, রাখি ঠোঁট-ওতেই যা হয়েছিলো সুখ—
এখনো ভুলিনি সেই দস্যিপনা প্লাবিত সবুজে!
‘বাংলার নদীতে সেই’ কবিতাটিতে ‘জলের তুমুল চুমো’ কিংবা ‘ভাদর বাদলে ভেজা মেয়েটির মুখ’ চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবি চিরচেনা আবহমান বাংলার প্রতিকৃতি অঙ্কন করেছেন। সৈয়দ হক প্রকৃতি সত্তার অংশ হিসেবে প্রকৃতির অন্তর্গত ছল, রস ও জরার কাব্যিক রূপান্তর করেছেন যা চিত্ররূপের সঘন অবয়বে পাঠক হৃদয়ে ভেসে ওঠে। ব্যক্তিগত আবেগ ও চিন্তার সুষম বিন্যাস তার কবিতায় বহুমাত্রিক বোধ উৎপন্ন করে।
আমাদের এক নয়, অনেক জীবন।
মাঝে মাঝে মনে হয় সংখ্যা নয়, সংখ্যার বিভ্রম—
তবে একটিই জীবন! বিপরীত বিরূদ্ধ কি নয় তারা?
‘হে অমর আগুনপাখি’ শিরোনামের দীর্ঘ কবিতায় তিনি জীবনকে সংখ্যাতত্ত্বে ফেলে নানাভাবে বিশ্লেষণ করে জীবনের মানে খুঁজেছেন। কখনো প্রকৃতির দ্বারস্থ হয়েছেন। লন্ডনের পাতাল ট্রেনের হইসেলের মধ্যে ঘোরলাগা দৃশ্যপটে কবি প্রিয় মাতৃভাষার অপেক্ষা করেছেন। আবার, এ কবিতায়:
কত কাল কাটিয়েছি কত স্বৈরশাসকের বুটের তলায়,
চাবুকের প্রহারে প্রহারে আমি কুঁকড়ে গেছি, পউষের শীতেও কি আমি
রৌদ্রের প্রার্থনা নিয়ে দাঁড়াইনি জানাজার মতো মাঠ ব্যাপ্ত হাহাকারে?
কবিতায় ‘স্বৈশাসকের বুটের তলায়’ উল্লেখ করে তিনি স্বাধীন ভূ-খণ্ডে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের চিত্রকল্প এঁকেছেন। একাধিক স্বৈরশাসকের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া কবি জীবনের ব্যক্তিক জীবনের ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধির কথা ব্যক্ত করেছেন। সময়ের বৈচিত্র্য ও কালের ব্যাপ্তিতে যাপিত জীবনে তিনি জেনেছেন অনেক কিছু। বাঙালি জাতির মঙ্গলভাষ্য রচনা করতে চেয়েছেন ‘কারবালা’ ও ‘কুরুক্ষেত্র’ ইত্যাদি মিথিক শব্দসমবায়ে। কবিতাটির শেষে ‘আগুনপাখি’ নিজেই পুরাণে পরিণত হয়। মানবজাতির অগ্রযাত্রায় ভস্ম থেকে জন্ম নেওয়া এই আগুনপাখিকে তিনি জাতির মুক্তি-দূত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। যা কবির দেশপ্রেমের এক অমল দৃষ্টান্ত। দীর্ঘ এ কবিতা পাঠে পাঠক তার নিজের জীবনের বর্তমান, ভবিষ্যৎ, রাষ্ট্র-সমাজ, প্রকৃতি-পরিবেশ সম্পর্কিত চিন্তার আবর্তে ক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে। এ কবিতাটিতে কখনো দৃশ্যকল্প আবার কখনো ইন্দ্রিয়জ চিত্রকল্পে সঘন বলা যায়।
স্বীকার করতে হবে, পরিবর্তনই জীবনের অন্য নাম। অনবরত এই পরিবর্তন চেতনালোকে স্পষ্ট অভিঘাত সৃষ্টি করে। মানুষ এক সময় হয়ে পড়ে জরাজীর্ণ। তবে একথাও ঠিক যে, ‘ধর্ম-পুরাণ, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য প্রাত্যহিক শর্তে কবির আয়ুকে বাড়িয়ে দেয়।’ আর পরিবর্তনজনিত কবির সে চেতনার অভিজ্ঞতা বিচিত্ররূপময়। লক্ষণীয় যে, সৈয়দ শামসুল হক জীবনের এই পরিবর্তনকে কবিতায় তুলে ধরেছেন এক অপরূপ মুগ্ধতায়। তার ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’র যে ধারাবিবরণী তা ‘পরানের গহীন ভিতর’ এসে আরও পুরাণময় হয়ে উঠেছে। তার সৃষ্টি কিংবদন্তির আবহেও উচ্চকিত।
খেলা যে দেখায়, তার দ্যাখানোর ইচ্ছায় দেখায়
ডাহুক উড়ায়া দিয়া তারপর আবার ধরে না
সোনার মোহর তার পড়ে থাকে পথের ধুলায়
এ বড় দারুন বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।
সাহিত্যের ‘অনন্য বাজিকর’ সৈয়দ হকের ‘পরাণের গহীন ভিতর’-এ লোকসংস্কৃতির বিন্যাস থাকলেও এর অনুভূতি যেমন চিরায়ত, তেমনি সব মানুষের। বস্তুত প্রান্তিক মানুষের আবেগ-উচ্ছ্বাস, হতাশা-আনন্দ-বেদনা এর বিষয়-আশয়কে করেছে সমৃদ্ধ। এ কাব্যে যে ‘জিজ্ঞাসা, প্রশ্নবিদ্ধ প্রবণতা, প্রাত্যহিক আচার-আনুষ্ঠানিকতা—তার সবটুকু স্বপ্ন-জাগানিয়া উচ্ছ্বাস—জন্ম-মৃত্যু রহস্য, প্রেম-বৈরাগ্যের প্রতিনিধিত্বকারী।’ আবার তার ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’য় তিনি যখন বলেন, ‘আমারও সংসার হবে- শিল্পের সংসার, তখন কবিতাটি অনন্যমাত্রা অর্জন করে। কবির শিল্পপ্রাণতার গভীরতম অনুধ্যানময় নান্দনিকতার বিস্তারই স্পষ্টায়িত হয়।
হাজার বছরের বাংলা কবিতার ভিত্তিভূমে দাঁড়িয়ে কাহ্নুপা, বিদ্যাপতি, বড়ুচণ্ডীদাস হয়ে মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ দাশের সহযাত্রী হয়ে বাংলা কবিতাকে মাধুর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন সৈয়দ শামসুল হক। নিপুণ চিত্রকর্মে বাংলার মুখ এঁকেছেন আর নিবিড় মমতায় লালন করেছেন হাজার বছরের বাংলার ঐতিহ্য। সৈয়দ শামসুল হক চিত্রকল্পের উৎস হিসেবে নানামাত্রিক জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা, উপমা, অলংকার, উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি শিল্পভাবনার দারস্থ হয়েছেন। ভাষা প্রয়োগ দক্ষতায় এসব শিল্পশ্লিষ্ট উপকরণ দিয়ে ইন্দ্রিয়গম্য চিত্রকল্প বিনির্মাণ করেছেন।
শুধু কবিতা নয়, গল্প রচনায়ও তিনি বৌদ্ধিক প্রকাশে স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন, অনেক সাক্ষাৎকারেই বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সমাজ-সত্যের অন্বেষণ করেছেন। জীবনের উপরিতলবিহারী দৃষ্টিকোণে নয়, মধ্যবিত্তের অন্তর্লীন যন্ত্রণাকে মুহুর্মুহু আবিষ্কার করেছেন গল্পের কাঠামোতে। শব্দের সচেতন ব্যবহারে, গল্পের কাঠামোগত বৈচিত্র্যে, বিষয়ভাবনার দুঃসাহসিকতা ও উপস্থাপনার সাবলীলতার মাধ্যমে সৈয়দ হক একনিষ্ঠ জীবন পাঠ করেছেন। তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন নাগরিক জীবনে পুঁজিবাদ ও বুর্জোয়াতন্ত্রের আগ্রাসন এবং পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার আন্তঃসারশূন্যতা। কীভাবে নাগরিক চেতনা অবসন্ন হয়ে ওঠে, সাধারণ মানুষের স্বপ্ন সাধনা কীভাবে ধূলিস্যাৎ হয়ে পড়ে। শেকড়-উন্মূল মানুষের অস্তিত্বহীনতার আশঙ্কা; শিক্ষা, সংস্কৃৃতি, নীতি-নৈতিকতার চরম অবনতি মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের আত্মসংকটসহ বিবিধ প্রপঞ্চের প্রামাণ্য দলিল হয়ে রয়েছে সৈয়দ হকের গল্প এবং উপন্যাস সমগ্র।
সৈয়দ শামসুল হকের নাটক সম্পর্কে নাট্য ব্যক্তিত্ব আতাউর রহমানের বক্তব্যই প্রণিধানযোগ্য। তিনি এক প্রবন্ধে সৈয়দ হক সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন—‘রবীন্দ্রউত্তর বাংলা সাহিত্য নির্মাণের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধদেব বসু এবং আমাদের দেশের সৈয়দ শামসুল হক বিচিত্র বর্ণে পল্লবিত করেছেন আমাদের সাহিত্যভাণ্ডারকে। সৈয়দ শামসুল হক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যথার্থই উত্তর সাধক।’ এ মন্তব্যের সার্থকতা সর্বাংশে প্রতিফলিত হয়, যখন পাঠক সৈয়দ হকের সাহিত্য বিশেষ করে নাটকের গভীরে প্রবেশ করেন। দেখা যায়, সৈয়দ হক আদি ও অকৃত্রিম কাব্যভাষাকে নাট্যভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কাব্যে যেমন রূপালঙ্কার, সংকেত, প্রতীক ও বিমূর্ততা ব্যবহার করার সুযোগ আছে, তেমন নাটকেও তিনি ওই আঙ্গিকের নিরীক্ষা করে সফল হয়েছেন। তিনি নাটক রচনায় গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস, এস্কিলাস, সংস্কৃত ভাষার মহাকবি ও নাট্যকার কালিদাস এবং আধুনিক নাটকের পথপ্রদর্শক উইলিয়াম শেকসপিয়র প্রমুখের অনুগামী হয়েছেন। সৈয়দ শামসুল হক কবি বলেই যথার্থভাবে তিনি কাব্যভাষাকে তার নাট্যভাষায় রূপান্তর করতে পেরেছেন। এর সফলতা হিসেবে বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে রয়েছে তার ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ এবং ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ নাটকটি। ‘সৈয়দ হকের বিশেষ কৃতিত্ব হলো, পাশ্চাত্যের ইংরেজি ভাষা ও বাক্যলগ্ন এবং শব্দের দ্যোতনাকে প্রাচ্যের ভাষাতে অনন্য কুশলতায় রূপান্তরিত করেছেন।’ বিষয়বস্তুর গভীরতা ও বিস্তারের পাশাপাশি নাট্যভাষা নির্মাণে তিনি যে স্বীকায়তার স্বাক্ষর রেখেন, তাতে একথা বলা বোধ করি অসঙ্গত হয় না যে, তার নাট্যসাহিত্য সমগ্র সাহিত্যকর্মের অতি-উজ্জ্বল একটি অংশ। বাংলা ভাষার একজন অনন্য ও অগ্রগণ্য নাট্যকার হিসেবে তিনি অনাগত কাল ধরে বিবেচিত হবেন। শুধু নাট্যসাহিত্যই নয়, তার সমগ্র সৃষ্টিকর্ম বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারে অমূল্য সম্পদ হিসেবেই সংযোজিত। লেখক হিসেবে তিনি বাঙালি পাঠকের ‘পরাণের গহীন ভিতরে’ চিরদিন জাগরুক থাকবেন।