এক.
কুয়াশার মসলিনে জড়ানো রাত। পথের দুই ধারে ঘনায়িত রহস্যের বন। কখনো রাতের ট্রেন আমাদের স্থির রেখে পেরিয়ে গেছে। কখনো বাস এত জোরে ছুটেছে, মনে হয়েছে এই বুঝি চাকায় আগুন ধরে গেল। পাঁচশ মাইল পেরিয়ে ভোরের টেকনাফ, ঊর্ধ্ব-অধঃ অভিন্ন। আকাশ-নদী-মাটি মিশে এক হয়ে গেছে সাগরিক কুয়াশায়। কুয়াশা কি সাম্যবাদী? নাস্তার টেবিলের চারদিকে হতদরিদ্র শিশু, বৃদ্ধ। একদিকে ক্ষুধায় আর্ত ওদের মুখ, অন্যদিকে সমুদ্রবিলাসী পর্যটকের ফূর্তি ঝিকোনো চোখ। মধ্যখানে ঠোঁটের ওপর কেলিয়ে দাঁত আঁকা বেনিয়া।
জাহাজে উঠে এলাম। শান্ত নাফ। প্রচ্ছন্ন পাহাড়।
দ্বীপ অপরূপা। দিনের আলো জ্বলল কী নিভল, আমাদের পা চালানোর বিরাম নেই। সাগরে মাথা ভেজালাম। কী স্বচ্ছ, শীতল সেই জল। ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ছিল, ওইখানে নীড় পেতেছে আমার ছোট্ট ক’টি ভাই। আমি ভুলতে পারি না, একদিন ওরা এখানে জলডুবি হয়ে মরেছে। ওদের আমি ফেরত চাই। ভাবনা করি না। জানি ওরা ফের জন্মাবে। সেই খামখেয়ালি আধপাগল লেখকের বাড়ি-সমুদ্রবিলাসের নীল ফটকে এসে দাঁড়িয়ে চুপ হলাম। ভারাক্রান্ত মন ভর নামাতে চায়। স্মৃতিকাতরতায় উপশম নেই। সরে এলাম। দুটিতে মিলে ভাটার সাগর যাপন করলাম। জল সরে বহুদূর পর্যন্ত প্রবালকাঁটা নগ্ন করে দিয়ে গেছে। সূর্য ডুবে গিয়েছিল। কালচে জমাট রক্তের মতো আলোয় একটা প্রাচীন পৃথিবী আমার মনে পুলক জাগাল। প্রাচীন পৃথিবী! আমার রক্তে তার ডাক।
আলো নিভল। তখন দ্বীপের পশ্চিম সৈকতে দাঁড়িয়ে। ‘অপার্থিব’ উচ্চারণ করতে গিয়ে থেমে গেলাম। মূর্খতা। এ তো পৃথিবীরই দৃশ্য। সৈকতে জোছনা দেখেছি। এমন আর দেখিনি। কেয়া দেখেছি। এমন রহস্যময়ী কেয়া? নারকেলপাতার দোল দেখেছি। জোছনাঝালর-আঁকিয়ে এমন শিল্পী দেখিনি আগে। দূরে কালো কোরাল শুয়ে আছে দিগ্বিদিক। তারও দূরে শান্ত সাগর চুপ শুয়ে আছে। জলের আয়নায় চাঁদফেরানা রূপালি আলো ছাড়া তার উপস্থিতির আর কোনো প্রমাণ নেই। বালুর ওপর হাঁটু ভেঙে পড়লাম। এত সুন্দর সইতে পারিনি। শরীর ভীষণ ক্লান্ত। তবু আমার ঘুমোনোর ইচ্ছে সাগরে আহুতি নিয়েছে। তাঁবুর নিচে একা বসে আমি তার জলদাপ শুনতে পাই।
দুই.
সাগর আনন্দের আশ্বাস দিয়ে ডাকে। সরল বিশ্বাসে কাছে যাই। টের পাই, হাহাকারে মন ভরে উঠেছে। কেন? খুব সকালে বিছানা ছাড়তে পেরে নিজেকে ধন্যবাদ দিয়ে তাঁবুর বাইরে এলাম। বেলাভূমি রাতভর তাপ ছেড়ে তখনও বরফ শীতলা। মধ্যরাতের চাঁদটানা জোয়ারে রাতক্লান্ত সাগর ঘুমোতে যেতে চায়। আমরা তিন অভিযাত্রী কপালে সূর্য নিয়ে পথে বেরোলাম। দ্বীপের মাঠ, মঠ, আর পৌরাণিক প্রবালশীলা নেচে, হেঁটে পেরিয়ে, ভাটায় জেগে ওঠা পথ ধরে আমরা যখন দ্বীপের দক্ষিণ সৈকতে, সূর্য তখন মাথার ওপর। মাইলের পর মাইল বালুর ওপর প্রবালে কাটা পা টেনে টেনে এগোলাম। শরীরে শক্তির খুব কমই অবশিষ্ট। শেষের নেই শেষ। তাই শেষ কয়েক পা আর না এগিয়ে তাই ফেরার পথ ধরেছি। সুন্দরে বিকল মন বহুক্ষণ হলো বিশ্রাম চায়।
সাগরের ওপর আজ মাথা খোয়ানো চাঁদ। সৈকতের বৈঠকী বিছানায় আধশোয়া দেখছি। কালো অশান্ত জলের ওপর রুপালি স্মৃতিসৌধ প্রতিফলিত। যতই পিছিয়ে দেখি, বিস্তারে বাড়ে। সেইন্ট মার্টিন দ্বীপের সৈকতকে আমার অপয়া মনে হয়। এখানে আমার মৃত ভাইগুলোর আত্মা চোখে বিষাদ নিয়ে হেঁটে বেড়ায়, নির্ঘুম; আমি ভুলতে পারি না। জলের প্রতি টান আমার আজন্ম। জলের প্রতি ভীতি আমার আশৈশব। সেই টানকে ছাপিয়ে ভীতি সবসময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। অবিশ্রাম জলসাঁতারেও আমি তার উত্থান কখনো ঠেকাতে পারিনি। মনের এই দুটো কাঁটা আজ তুলতে চেয়েছিলাম। পারলাম কোথায়। মনে হচ্ছিল, সাগরের যে যক্ষ ওদের টেনে নিয়ে গেছে, আমাকেও সে ছাড় দেবে না। তবু এগোতে আমাকে হবেই। কাচস্বচ্ছ সবুজাভ জলে বালুর অবাক সাঁতার দেখে মনে হলো, আকাশের অগণিত নক্ষত্রকলি ওখানে চাপা পড়েছে। আর, তাতে পা রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আমি দৈত্যাকৃতি-ঈশ্বর। খেয়ালি, প্রেমময়, বিকট।
তিন.
দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার আর বেশিক্ষণ নেই। রাতের হাহাকার খানিকটা ফিকে হয়ে এসেছে। সকাল থেকে অলস সময় কাটল। বেড়াতে আসা কত রঙরঙিন সৈকতবিলাসী মানুষ। ওরা কি দ্বীপেল-গাঁয়ের ভেতরের খবর রাখে? তাকিয়ে দেখি প্রশ্নে সমুদ্র সরব, সহমত কেয়ার সারি। সায়বান নারকেল-ঝাউবন, পাটো গাছের লাল হলুদাভ ফুল।
পাখিরা মানুষকে বিশ্বাস করে না, তবে ভালোবাসে। অসংখ্য গাঙচিল যে জাহাজের পেছন পেছন সারাপথ উড়ে এলো, তা কেবল খাবারের সাধে নয়। কাউকে ভালো না বেসেও তার দান গ্রহণ করার মতো মানুষও দেখেছি।