বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘সংকল্প’ কবিতায় বলেছেন, ‘বিশ্বজগৎ দেখব আমি/ আপন হাতের মুঠোয় পুরে।’ তার ওই কবিতা রচনার এতকাল পরে এসে মনে হচ্ছে—সত্যিই তো! বিশ্ব তো এখন হাতের মুঠোয়। প্রযুক্তির উৎকর্ষে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। এখন আর সংবাদবাহক পাঠাতে হয় না, কাউকে চিঠি লিখতে হয় না, পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। এই যে এত কিছু করতে হয় না; এরপরও কিছু একটা তো করতে হয়। হ্যাঁ, করতে হয় বটে। কারণ এখন মেইল, ফোন, অনলাইনের যুগ। যা কিছু করতে হয়, সবই হাতের মুঠোয়।
পরিবর্তন যখন আসে; সবকিছুতেই আসে। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা হচ্ছে দূরদর্শিতা, খাপ খাওয়াতে না পারা হচ্ছে পশ্চাৎপদতা। তেমনিভাবে সাহিত্যচর্চায় পরিবর্তন এসেছে। ১৮০১ সালে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছে। এরপরও সংস্কার হয়েছে নানাভাবে। বই, কাগজ, ছোটকাগজ পেরিয়ে সাহিত্যচর্চা এখন অন্তর্জালমুখী হয়ে উঠছে। এখন অনলাইন পোর্টাল, ওয়েবম্যাগ, ওয়েবজিন, ফেসবুক নির্ভর হয়ে উঠছে সাহিত্য। তবে পুরনো স্মৃতি তো আর সহজেই ভোলা যায় না। হৃদয়ের কোণে চিহ্নটা তো থেকেই যায়। সেই স্মৃতিচিহ্ন নিয়েই আজ লিখতে হয় ওয়েবম্যাগে।
সত্যি বলতে কি, আমাদের অনেকেরই হয়তো লিটলম্যাগে তেমন আগ্রহ ছিল না। আর তখনো অনলাইন মিডিয়া বাংলাদেশে আসেনি, তাই দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতাকেই লেখা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম মনে হতো। বই প্রকাশের চিন্তাও তখন অনেকের মাথায় আসতো না। গ্রাম বা মফস্বল শহরে যারা বসবাস করতেন, তারা মফস্বলে থেকেই জাতীয় দৈনিকগুলোতে লেখা পাঠাতেন। কেনোটা প্রকাশ হতো, কোনোটা হতো না। তাতে কোনো দুঃখ ছিল না। যে লেখাটি প্রকাশিত হতো না, সেটিকে উৎকৃষ্ট বলে মনে করতেন না। সে সময়ে কোনো কোনো লিটলম্যাগের সম্পাদকের সঙ্গে দৈবক্রমে সম্পর্ক গড়ে উঠতো। লিটলম্যাগ প্রচারের স্বার্থে মফস্বলের দুই/একজনকে সম্পাদনা বিভাগেও রাখা হতো। আর মফস্বল থেকে যারা করতেন, তারা রাজধানীর দু’একজনকেও রাখতেন শ্রীবৃদ্ধি ঘটানোর জন্য। কিন্তু তাতেও কি লেখা সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি আমরা? কারণ লিটলম্যাগ তো সবাই পড়ছে না, বা কিনছেও না। আমরা যারা সাহিত্যচর্চা করি, তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এমনকি প্রায় লিটলম্যাগই অনিয়মিত। আবার খুব সামান্য কপি ছাপা হচ্ছে। কখনো কখনো লেখক সংখ্যাটাও পাওয়া যায় না। ফলে লিটলম্যাগের প্রতি আগ্রহে ভাটাই থেকে যায়। এরপর দেশে অনলাইন পোর্টালের সংখ্যা বাড়তে থাকলে সাহিত্যচর্চার আঙিনা প্রসারিত হয়। পাশাপাশি অনেক লিটলম্যাগই মুদ্রণ ছেড়ে ওয়েবম্যাগের দিকে রূপান্তরিত হয়ে যায়। লিটলম্যাগের চেয়ে ওয়েবম্যাগে একটি সুবিধা হচ্ছে—লেখাটি বর্তমান প্রযুক্তির কল্যাণে অসংখ্য মানুষের কাছেও পৌঁছানো সম্ভব। লিটলম্যাগে যেটা কখনোই সম্ভব নয়। তবুও লিটলম্যাগ প্রকাশিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি লিটলম্যাগের জায়গা ওয়েবম্যাগ দখল করে নিচ্ছে? সেটা না-ও হতে পারে। জায়গা দখলের বদলে বলা যায়, নতুন অনেক ওয়েবম্যাগের আগমন ঘটেছে ঠিকই। তবে লিটলম্যাগের জায়গায় লিটলম্যাগ থাকবে। ওয়েবম্যাগ নিজস্ব জগত তৈরি করে নিয়েছে। কারণ মুদ্রণের চেয়ে এখন অন্তর্জালে লেখা প্রকাশের সংখ্যা বাড়ছে।
এখানে অর্থ অবশ্যই বিশাল ফ্যাক্ট। অর্থাভাবে অনেক লিটলম্যাগ অঙ্কুরেই বিনাশ হয়েছে। টাকার কারণে মাসের পর মাস ঝুলে আছে লিটলম্যাগ। প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে না। অথচ ওয়েবম্যাগে তেমন অর্থের কচকচানি নেই। ডোমেইন, হোস্টিং, ডিজাইন, গ্রাফিক্স ও আপলোডার মিলিয়ে একবারই ইনভেস্ট করলে হয়। এই প্রক্রিয়াটা সম্পাদকের। তবে লেখকরাও ঝুঁকছেন ওয়েবম্যাগের দিকে, তার কারণ হচ্ছে—দ্রুত লেখা প্রকাশ, প্রচারের সহজলভ্যতা, সংযোজন-বিয়োজন বা মুছে ফেলার সুবিধা। এছাড়া ওয়েবে লিখতে গেলে শব্দের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। ফলে স্বাধীনভাবে যত খুশি লেখা যায়।
কখনো কখনো ওয়েবম্যাগে বানান ভুলের আধিক্য লক্ষ করা যায়। তবে এটা কি শুধু ওয়েবম্যাগের ক্ষেত্রেই? না। বেশিরভাগ অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাহিত্য বিভাগ দেখলে, সেখানেও ভুল বানান পাওয়া যাবে। মূল কথা হচ্ছে—ওয়েবম্যাগ করা সহজ; সম্পাদনা করা কিন্তু সহজ বিষয় নয়। শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, বানান সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকলে নির্ভুল লেখা প্রকাশিত হবে কিভাবে? এ দেশের বেশিরভাগ লেখক বানান সম্পর্কে সচেতন নন। ফলে বানান শুদ্ধ করার দায়িত্বটা তো সম্পাদককেই নিতে হবে। এখন সম্পাদক নিজেও যদি এসব বিষয়ে সচেতন না হন, তাহলে এমন অভিযোগ তো অমূলক নয়।
বড়কাগজ-ছোটকাগজ-ওয়েবম্যাগ, যাই বলি না কেন, এসবের পেছনে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকেই। তবে ওয়েবম্যাগ কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে করছে, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ওয়েবজিন বা ব্লগজিন সাহিত্যকর্মীকে উপকৃত করতে পারে। যদি লেখকের সদিচ্ছা থাকে। মূল কথা হচ্ছে—ইচ্ছা অনুযায়ীই তো কর্ম হবে। এরচেয়ে বেশি কিছু তো সম্ভব নয়। কেউ সম্পাদনা করেন কর্তৃত্ব জাহির করতে, কেউ করেন ভালোবাসার জায়গা থেকে, কেউ করেন তেলবাজি করার জন্য। যে যেভাবেই করুক, কর্ম মন্দ হলে তার ফলও মন্দ হয়।
একটি কথা মনে রাখতে হবে—বই পাঠ জরুরি নয়। আসলে পাঠ জরুরি। এখন এই পাঠ আমি ওয়েবম্যাগ, ওয়েবজিন, অনলাইন পোর্টাল, ফেসবুক, ইউটিউব, পিডিএফ, ই-বুক থেকেও নিতে পারি। তবে হ্যাঁ, বইপাঠ কমছে। আর বইপাঠ কমলে প্রকাশনী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রকাশনা শিল্প হুমকির মুখে পড়বে। এটা পরিবর্তনের ফল। যা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। ডাউস ডাউস বই যদি আমি হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরতে পারি, তাহলে ঘরটাকে আস্ত লাইব্রেরি বানিয়ে কী লাভ? মানুষ বইপাঠ বিমুখ হলেও আপত্তি নেই। শুধু পাঠবিমুখ না হোক—এটাই কামনা।
যিনি লিখতে পছন্দ করেন। লেখা শেষ হলে প্রকাশের জন্য যে মাধ্যমটি সুযোগ দেয়, তাতেই প্রকাশ করেন। কেউ লেখা চাইলে বলেন না, কোথায় প্রকাশ হবে? তবে সম্পাদক যদি বিজ্ঞ হন—অনেকেই লেখা দেন। কারণ একজন বিজ্ঞ সম্পাদকই একজন লেখকের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেন। ফলে লেখার মাধ্যমের চেয়ে অনেকেই বেশি চিন্তা করেন—সম্পাদক কে? সেটাই তার কাছে মুখ্য। যেহেতু তিনি লেখক; তাই তিনি চাইবেন—তার লেখা প্রকাশিত হোক। চাই তা সংবাদপত্র, নিউজ পোর্টাল, ওয়েবম্যাগ, ওয়েবজিন বা ব্লগ যা-ই হোক না কেন।
সবসময়ই প্রিন্টেড সংখ্যা সীমিত হয়। তবে সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে সুবিধাটা দ্বিগুণ। যেমন কাগজেও ছাপা হয়, আবার ই-পেপার বা অনলাইন সংস্করণের মাধ্যমেও পাঠকের কাছে পৌঁছায়। তবে সাহিত্যপত্রিকার চেয়ে নিউজ পোর্টাল বা সংবাদপত্রের অনলাইন ভার্সনের ভিউয়ার বা রিডার বেশি। সাহিত্যপত্রিকাগুলো এখনো অধিক রিডারের কাছে পৌঁছতে পারেনি। আমরা সব মাধ্যমের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে পারি—সাহিত্যচর্চা, প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে কোনো মাধ্যমই অবাঞ্ছিত নয়।
যদিও দৈনিকের সাহিত্যপাতা বরাবরই অবহেলিত। অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বহীনও বটে। যেমন এখন কারো লেখা প্রকাশ হলে পাঁচ-দশ টাকায় পত্রিকাটি না কিনে অনলাইন সংস্করণের লেখাটা ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে দিচ্ছেন। সাহিত্যপাতার জন্য অনেকেই পত্রিকা কেনেন না, বরং পত্রিকার সঙ্গেই সাহিত্যপাতাটি চলে আসে। এছাড়া দেখবেন, অনেক পত্রিকার প্রিন্টেড সংখ্যায় সাহিত্য বিভাগ না থাকলেও তার অনলাইন সংস্করণে সাহিত্য বিভাগ রয়েছে। ওয়েবম্যাগ বাড়লেও দৈনিকের সাহিত্যপাতা কর্তৃপক্ষের মর্জি মতোই চলবে। হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি নেই। ওটা সৌন্দর্য হিসেবে রাখতে হয়, তাই রাখা।
সুতরাং সব হিসেব-নিকেশ মিলিয়ে প্রথমত মানসম্পন্ন লেখা, দ্বিতীয়ত সুসম্পাদিত লেখা প্রয়োজন। একটি দুর্বল লেখাও সুসম্পাদনার ফলে মানসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া হিট বাড়ানোর জন্য কুরুচিপূর্ণ বিষয় থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। ফেসবুক সেলিব্রেটি হলেই তাকে লেখক হিসেবে মহান করে তোলার প্রয়োজন নেই। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো তিনি শেয়ার দিলে লেখাটি বেশি হিট হবে—এই লোভে নিজেদের আদর্শ জলাঞ্জলি দেওয়া ঠিক নয়। ফেসবুকে এখন সেলিব্রেটি অনেকেই। সেলিব্রেটি হলেই ভালো লেখক হওয়া যায় না। বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের ফ্যান-ফলোয়ার বাড়তে পারে; লেখার মান না-ও বাড়তে পারে।