বাংলাদেশের যে ক’জন তরুণ কথাশিল্পীর গল্প আমাকে টানে, তার মধ্যে সালাহ উদ্দিন মাহমুদ একজন। আমার মনে হয়, বাংলা সাহিত্যের নবীনতম শাখা হিসেবে ছোটগল্প অনেক পিছিয়ে, বিশেষ করে তরুণ লেখকদের। বাংলাদেশের এ শাখায় খুব বেশি তরুণ কথাশিল্পী এগিয়ে যেতে পারছেন না। লিটারেচার জাস্টিস; ভালোকে ভালো বলা, খারাপকে খারাপ বলা; হিসেবে সালাহ উদ্দিন মাহমুদ বেশ ভালো গল্প লেখেন। কবিতার সমালোচনা আর কথাসাহিত্যের সমালোচনার মানদণ্ড এক হয় না।
বাংলা কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে বাঙালির জীবনের পরিপ্রেক্ষিত আলোচনা করতে হবে। এর মধ্যে ভৌগলিক একটা ব্যাপার থাকে। ইতিহাস, সামাজিক প্রেক্ষাপট থাকতে হবে। চরিত্রগুলোর বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে গল্পের সার্থকতা। এসব বিবেচনা করে; বড় আলোচনায় আরও বেশি ইন্ডিকেটর চলে আসবে; ছোটগল্পের মান বিবেচনা করা যাবে। এসব গুণ ভালোভাবে গল্পে থাকলে তা মানোত্তীর্ণ হয় এবং পাঠক-হৃদয়ে গভীর ও স্থায়ী ছাপ ফেলে। এসব নির্মোহ আলোচনায় সালাহ উদ্দিন মাহমুদের গল্পের মান অনেক উঁচুতে না থাকলেও খারাপ অবস্থানে থাকবে বলে আমার মনে হয় না।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ১৯৮৮ সালের ০১ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার উত্তর উড়ারচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় সালাহ উদ্দিন মাহমুদ বাংলায় সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি কবিতা, গল্প, ফিচার, কলাম লিখে থাকেন। আবৃত্তিকার হিসেবেও ভালো। কবিতায়ও ভালো হাত রয়েছে। তবে আজ তার গল্পগুলো নিয়েই আলোচনা করব। এ যাবৎ নয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে সালাহ উদ্দিন মাহমুদের। কথাশিল্পী হিসেবে বেশ আলোচিত তিনি। একটি উপন্যাস, চারটি গল্পের বই পড়লে তার প্রতি সমীহ জাগবে। কবি হিসেবেও তিনি যশ লাভ করেছেন। এ পর্যন্ত তার দুটি কবিতার বই বের হয়েছে। এ ছাড়া দুটি সম্পাদনাধর্মী বই প্রকাশ করেছেন তিনি।
এখনো আমি আমার হৃদয় ভাঙার শব্দ শুনতে পাই। মজনুর সঙ্গে সঙ্গে নিজের করুণ পরিণতির কথা ভেবে নিজে নিজেই সান্ত¡না খুঁজে নেই’ (নাকফুল) অথবা ‘ডানপাশে শোয়া মজিতনের সীমাহীন আনন্দ দেখে মকবুলের চোখ দু’টা অন্ধকারেও চিকচিক করে ওঠে’ (শাড়ি) গল্পের শেষের এ অংশ। বক্তব্যে নান্দনিকতা রয়েছে। অথচ পাঠকের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করাতে সক্ষম।
সাহিত্যের ওপর প্রভাব ফেলাসহ সমাজের ওপর প্রভাব ফেলতে পেরেছে তার গল্প। পাঠক মনে একটি ইমেজ তৈরি করতে পেরেছেন। একটু তার প্রকাশিত গল্পের আলোচনায় আসা যাক। সালাহ উদ্দিন মাহমুদ লিখলেন কখনো আঞ্চলিক সংকটের কথা, কখনো জাতীয় সংকট; জাতীয় সংকট পেরিয়ে বিশ্বজাতির বিভিন্ন সংকট, হতাশা প্রভৃতি। পাশাপাশি সমাধানের বার্তা বা ইঙ্গিত দিয়েছেন। গল্পকার হিসেবে এখানে তার সার্থকতা। সালাহ উদ্দিন মাহমুদের লেখায় প্রাণসঞ্চারী গল্প যেমন পাই, তেমন পাই সাহিত্যরসও।
তেরোটি গল্প নিয়ে প্রথম গল্পের বই ‘সার্কাসসুন্দরী’। বইটি পাঠ করেই মুগ্ধ হয়ে যাই গল্প বুননের কারিশমা দেখে। এ গ্রন্থের প্রতিটি গল্পেই একজন সুদক্ষ কথাশিল্পীর ছাপ সুস্পষ্ট। গল্পকার তার গল্পগুলোয় সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা, প্রেম, বিরহ, বেকারত্ব, প্রতারণা, নতুন প্রজন্মের অবক্ষয়সহ নানা অনুষঙ্গ সুনিপুণভাবে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। ‘মাঝ রাতে কবির সঙ্গে’ শীর্ষক গল্পটিতে সালাহ উদ্দিন মাহমুদ আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থা, সাহিত্যচর্চার দুর্দশার কথা বলেছেন। তার ‘ক্ষত’ গল্পটি সমসাময়িক যৌনমনস্তাত্ত্বিক জটিল বিষয়ে আবর্তিত। গল্পের শুরুটা অসাধারণ। শুরুতেই, ‘তোমার মন চাইলে যে কারো সঙ্গে সেক্স করতে পার। আমি তাতে রাগ করবো না।’ বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামীর এমন কথা শুনে ভড়কে যায় নববধূ সোহানা। চমৎকার শুরু। এমন শুরু তার অনেক গল্পে। গল্পের চরিত্রে কণ্ঠস্বর যত শক্তিশালী হবে গল্পের শৈলী তত বলিষ্ট হবে। এছাড়া তার আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত ‘হাক্কা’ গল্পটি চমৎকার।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদের দ্বিতীয় গল্পের বই ‘নিশিসুন্দরী’। বইয়ের প্রতিটি গল্পই পাঠকহৃদয় ছুঁয়ে যাবে। গল্পগ্রন্থের নামগল্প ‘নিশিসুন্দরী’ পড়লে মনে হবে, আজ যেটা ঘটলো; পরদিন তার ঠিক উল্টো ঘটতে পারে। এর গল্পগুলো সোজাকথা বলে, জীবনের বিভিন্ন কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। চরিত্র নির্মাণ গল্পের মান উন্নীত করার অন্যতম অনুষঙ্গ। গল্পের সার্থকতার মান নির্ভর করে চরিত্র-নির্মাণের ওপর। উল্লিখিত গ্রন্থের চরিত্র নির্মাণে পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে বলিষ্টতা, ইচ্ছাশক্তি, নতুনত্ব ইত্যাদি বিষয়েও চমৎকারিত্ব রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে গল্পগুলো সার্থক। ‘নুরু দাদার অন্তিম প্রস্থান’, ‘হাতঘড়ি’, ‘নিশিসুন্দরী’, ‘চাদর’ প্রভৃতি গল্পে জীবনের অলিগলি, ভালোবাসার রকমফের, হতাশা, দ্বৈততা প্রভৃতি বিষয় উঠে এসেছে। পাঠক লেখকের কাছে সমস্যার পাশাপাশি সমাধানও চায়। ‘হাতঘড়ি’ গল্পে দাম্পত্য জীবনের সমস্যাদির পাশাপাশি সমাধানের মন্ত্রও দিয়েছেন, আকার-ইঙ্গিতে। সালাহ উদ্দিন মাহমুদের গল্পগুলোয় সমস্যা ও সমাধেনের পথ প্রতিফলিত হয়েছে। ‘চৈতির রোমজনামচা’ ভালোবাসার রকমফের, জটিলতা, সূক্ষ্ম-বিষয়গুলো পাঠকের মনে চিত্র এঁকে দেয়। এগুলো আসলে আমাদের সমাজে বিরাজমান। গল্পকার তার চোখে উপস্থাপন করেছেন, ভিন্ন-আলোকে। ‘ভালোবাসার মধ্যে পাপ ঢুকে যাচ্ছে’ গল্পের অন্যতম বিষয় হয়েছে। আত্মহত্যা কাঙ্ক্ষিত নয়, আবার সহজও নয়। তবুও মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অবহেলার শিকার হতে হতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় অনেকে। এরকম ঘটনার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে ‘হাতঘড়ি’ গল্পে। ‘বালিকা থেকে যুবতী’ গল্পে শিরোনামের মতোই ভালোবাসার ভিন্নরূপ দেখা যায়। মেয়েদের বিভিন্ন-পর্যায়ে চড়াই-উৎরাই, সমস্যাদির চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে এ গল্পে। সালাহ উদ্দিন মাহমুদের অনেক গল্পে আমরা এ চিত্র দেখতে পাই। গল্পগুলোর সিগমেন্ট পড়তে পড়তে মনে হবে আমাদের আশপাশও তো এমন! এমনকি আমরাও অনেকেই তো এমন। আমাদের অনেকের মনেই তো পাপ বিরাজ করছে! এসব চিত্র তুলে ধরার মধ্য দিয়েই কথাশিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদের ‘কলমের জোর’ পাওয়া যাচ্ছে।
মানুষ মুখোশেই ঢেকে থাকে। সত্যিকার মানুষ হওয়া বা পাওয়া কঠিন একটি ব্যাপারই। মুখোশ একটি ভয়াবহ বিষয়। সমাজে লাভ-ক্ষতির বিষয়টাই মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। পতিতাদের আমরা নিকৃষ্টতর ভাবি। কিন্তু মানুষ নামের মুখোশধারীরা ‘নিকৃষ্টতম’ তা ভাবি না। পতিতা এখানে প্রতিনিধি। সমাজে এমন অনেক পেশা, শ্রেণি রয়েছে; যাদের আমরা খারাপ ভাবি। এসব থেকেও মুখোশধারীরা, ভণ্ডরা সমাজের জন্য কীট, তার সংকেত পাই ‘নিশিসুন্দরী’ গল্পে। ‘মানুষ চেনা বড় দায়’ প্রতিপাদ্য নিয়েই এ গল্প বিকশিত হয়েছে। দেশ স্বাধীন করে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের ধন্য করেছেন। কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত, নিষ্পেষিত। মুক্তিযোদ্ধার আর্তি নিয়ে বেড়ে উঠেছে এ গল্পগ্রন্থের ‘চাদর’ গল্পটি। এ গ্রন্থের আলোচনা থেকে বলা যায়, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তর্নিহিত গল্পগুলো, অস্ফুট কথাগুলো তুলে এনেছেন কথাশিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।
লেখকের তৃতীয় গল্পের বই ‘বেদেসুন্দরী’। বইটিতেও তিনি গল্প বয়ানের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন শতভাগ। এ গল্পের বইয়ের গল্প সিংহভাগই ৯০ দশকের প্রেক্ষাপটে লেখা। গল্পের পরতে পরতে উঠে এসেছে সেই সময়ের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং মানুষের জীবনযাপনের চিত্র। বইয়ের ‘বয়জা’ গল্পটি আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। গল্পটিতে মাদারীপুর জেলার একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েন নিয়ে লেখা। আড়িয়াল খাঁ নদের তীরবর্তী গ্রাম শশীর চরে ইলিশের ডিমকে ‘বয়জা’ বলে। চরের বশিরদ্দিনদের অভাব, হতাশা, স্বপ্ন নিয়ে গল্প এগিয়ে নিয়েছেন। নিম্নমধ্যবিত্তদের কথা। শীতের পিঠা ও শীতের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে ‘পায়েস’ গল্প এগিয়ে নিয়েছেন। কৃষক, জমি, মজুরদের চিত্র চিত্রায়িত হয়েছে। বেড়ে-ওঠা মেয়ের প্রতি সমাজের খারাপ মানুষের লোলুপদৃষ্টি, অবহেলা, বাধা ইত্যাদি গল্পের ভাবনা। প্রায় শুরুতেই চমক রয়েছে তার বেশিরভাগ গল্পে। আর এ কারণেই পাঠককে গল্পের ভেতর টেনে নিতে সক্ষম। ‘বেদেসুন্দরী’ গল্পগ্রন্থে ৬টি গল্প: বয়জা, পায়েস, বেদেসুন্দরী, সমিরদ্দি পাগলা, বৈচাপাগল ও নিরানন্দ। নাম দেখেই গল্পের ভাবনা বুঝে নেওয়া যায়। গভীরে ঢুকতে গল্পগুলো পড়া দরকার। তার গল্প পড়ে মনে পড়ে মহাশ্বেতা দেবীর কথা; যিনি কথাসাহিত্যে নতুন মাত্রা দিয়েছেন, পাহাড়ি ও আদিবাসীদের জীবনযাত্রা অনায়াসেই প্রয়োগ করেছেন গল্প ও উপন্যাসে। সালাহ উদ্দিন মাহমুদের এ গল্পগুলোয় নিম্নশ্রেণী মানুষের কথাই বলা হয়েছে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদের চতুর্থ গল্পের বই; জীবনের কথা-বলা এগারোটি গল্পের; ‘এখানে কয়েকটি জীবন’। জীবন, সোনাবউ, শাড়ি, বিবস্ত্র, দায়ী, জয়শ্রী, কুমারী, নাকফুল, কুকুর, গোলেয়া এবং মিঠু শিরোনামের গল্প রয়েছে এতে। ‘এখানে কয়েকটি জীবন’ গল্পগ্রন্থ নিয়ে আলাদা করে কথা বলব। এখানেও যে তিনি গল্পকার হিসেবে শতভাগ সফল তা বলব না। তবে এ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি যে ভবিষ্যতের ভালো কথাশিল্পী হয়ে উঠছেন, তার গন্ধ পাওয়া যায়। তিনি সাবালকত্ব পেরিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখা যায়। সংলাপে শব্দ ও বাক্য প্রয়োগে আরও একটু সতর্ক হবেন। বিষয় নির্বাচনে আরও গভীরে (যা ব্যতিক্রমও) যাবেন আশা করি। ‘স্ত্রীর নাকফুলের দিকে তাকিয়ে থাকি। তখন হৃদয়ের সেই ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হয়। এখনো তার নাকফুলটি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এখনো আমি আমার হৃদয় ভাঙার শব্দ শুনতে পাই। মজনুর সঙ্গে সঙ্গে নিজের করুণ পরিণতির কথা ভেবে নিজে নিজেই সান্ত¡না খুঁজে নেই’ (নাকফুল) অথবা ‘ডানপাশে শোয়া মজিতনের সীমাহীন আনন্দ দেখে মকবুলের চোখ দু’টা অন্ধকারেও চিকচিক করে ওঠে’ (শাড়ি) গল্পের শেষের এ অংশ। বক্তব্যে নান্দনিকতা রয়েছে। অথচ পাঠকের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করাতে সক্ষম। জীবন-সংগ্রামের ছোট ছোট গল্পের এমন সব অংশগুলোই সালাহ উদ্দিন মাহমুদকে পরিণত করার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কবিতায় অন্তর্মুখী চরিত্র থাকে কিন্তু কথাসাহিত্যে বহির্মুখী চিন্তার একটা ব্যাপার থাকে। সালাহ উদ্দিন মাহমুদকে অনেক দূর যেতে হবে। তাই তিনি গল্পের ভুবনে ‘ধীরে ধীরে হাঁটবেন’;
তার ‘বিবস্ত্র’ গল্পের প্লট আমাদের সমাজেরই। ‘…রুবি ছিন্নমূল শিশু। কিশোরী হয়তো বলা যায়। কিশোরী হওয়ার পর শান্তির ঘুমটাও ইদানিং ভেঙে যায়।’ কেন ভেঙে যায় পাঠককে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে না! চলমান সমাজের বিরাট প্রতিচ্ছবি! তবুও গল্পের পরের অংশ বলি, ‘কেননা মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে মাতাল কিংবা লম্পটের হাত পড়ে বুকে ও নিতম্বে।’ রুবিকে সমাজের আবহাওয়া সত্য বলতে না-দিয়ে তার মুখ দিয়ে বলায়: ‘…কুত্তার বাচ্চাডায় পায়ের ওপর পাড়া দিছে। মাতাল এট্টা। দেইখা হাঁটতে পারে না।’ পরে মনে ও দেহে পৈচাশিক অত্যাচার শেষে হত্যা। মেয়েদের এ অসহায়ত্ব সব শ্রেণির মধ্যে। রুবি তাদের প্রতিনিধি মাত্র।
‘জয়শ্রী’ গল্পের চম্বুক অংশ: ‘আমনে অগো বিচার করেন দাদা, আমনে অগো বিচার করেন… হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ইউপি চেয়ারম্যান মতি মিয়ার উদ্দেশে কথাগুলো বলে ইন্দ্রজিৎ। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় মতি মিয়া।’ চেয়ারম্যান ইন্দ্রজিৎকে ঘটনার বর্ণনা করতে বললে, ‘উপস্থিত নেতা-কর্মীদের মুখের দিকে তাকায়। সবার চোখে-মুখে বিস্ময়। তিনটি মুখের উপর চোখ পড়তেই ক্ষোভে তার চোখে রক্ত জমে যায়। মুখ তিনটি নিমিষেই শুকিয়ে আমসির মতো হয়ে যায়। তিনটি ঢোক গেলার শব্দ শোনা যায়।’ বিচারেরর নামে প্রহসন আর বিচারকদের এ চরিত্র বাঙালি সমাজে খুবই স্বাভাবিক। ‘কুমারী’ গল্প থেকে কিছু অংশ, ‘…বলতে দ্বিধা নেই যে, রহিতন মা হতে চলেছে। আগে হয়তো বুঝতে পারেনি কেউ। বমি বা পেট ব্যথাকে রোগ-বালাই ভেবেছে… চির চেনা সঙ্কেতে দরজা খুলে দেয় রহিতন… ভাঙাচোড়া একখান ছাতা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে পড়ে ফিরোজালী। এই গ্রামেরই ছেলে। সহজ করে বলতে গেলে প্রতিবেশী। সময়-সুযোগ বুঝে এসে হাজির হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।’ এ গল্পে সমাজের বাস্তব অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন লেখক।
‘জীবন’ গল্পে দম্পতির টানাপড়েনের গল্প; যা আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এ গল্পের একটি সংলাপ ‘আমারে ফোন দিছেন ক্যান?’ এ বাক্যকে আমরা অপরিণত বলতেও পারি, আবার সমাজে যা প্রচলিত আছে; সেটাই গল্পকার বলেছেন বলে ধরে নিতে পারি। কেননা গল্পে গল্পকারের নিজের কোনো ভাষ্য থাকে না। তবুও গল্পে এমন জায়গাগুলোয় ভাবার দরকার আছে বলে আমি মনে করি। কর্মসংস্থান যে কী! স্নায়ু ঠিক রাখতে কর্মসংস্থান দরকার। করোনায় বারেকদের মতো অনেকের অসহায়ত্ব রয়েছে। ‘সোনাবউ’ গল্পে উদ্ধৃতি হিসেবে বা সংলাপের অংশ হিসেবে ১৬ লাইনের গান তুলে দেওয়া বড় হয়ে গেল কি না? এ রকম বৈশিষ্ট্যগুলো এড়িয়ে চললেই ভালো। এক বা দু’লাইন ব্যবহার করলেই ভালো হতো বলে মনে করি। এতে অন্য বিষয় বা শব্দ অন্তর্ভুক্ত করে বৈচিত্র্য আনা সহজ হয়।
আধুনিককালের সাহিত্য সর্বোতমুখী। ইউরোপে অনেক আগে শুরু হয়েছে। তবে বাংলা-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিষয় নির্বাচনে বৈচিত্র্য এসেছে। বলা যায়, সাবালকও হয়েছে; পরিপূর্ণতার দিকেই হাঁটছে। সালাহ উদ্দিন মাহমুদের গল্পগুলোর উপাদানে বৈচিত্র্য রয়েছে। তবে সিগমেন্টে আরও গভীরে যাওয়ার সুযোগ আছে। যদি তিনি পারেন বা এক্ষেত্রে সফল হন, ভবিষ্যতে ভালো এক গল্পকারকে মনে রাখবে বাঙালি। সমালোচনা সাহিত্যে আর একটি কথা গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হচ্ছে কলমের জোর, যা বলার দরকার তা বলার সাহস। কবিতায় কবি বলেন, আর কথাসাহিত্যে চরিত্রের মাধ্যমে বলা হয়। এ ক্ষেত্রে সালাহ উদ্দিন মাহমুদ মোটামুটি; ভালোর তো শেষ নেই; সফল। তার লেখার কণ্ঠস্বর স্মার্ট এবং মজাদার। তবে বেশকিছু স্থানের কণ্ঠস্বর খুব আবেগপ্রবণ এবং অতিরঞ্জিত ভাষার উদার ব্যবহার রয়েছে। শব্দ নির্বাচন, শব্দের ওজন ইত্যাদি সাহিত্যিক মূল্যায়নে দেখা হয়। প্রথম ক্ষেত্রে তিনি মোটামুটি সফল হলেও শব্দের ওজনে পিছিয়ে। এ কথা অবশ্য অনেক প্রতিষ্ঠিত কথাশিল্পীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে বলে মনে করি। এ মান উত্তীর্ণ হওয়া গল্পকারের সংখ্যা সাহিত্যের অন্যান্য শাখার বিবেচনায় বা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আমি মনে করি, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ পরবর্তী সময়ে অভিজ্ঞতার সমন্বয় ঘটিয়ে কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে পারবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ইচ্ছাশক্তি, কলমের জোর, অধিক সাধনা তাকে আমরা উত্তম গল্পকার হিসেবে পাবো। এ লক্ষণ তার গল্পে রয়েছে।
জনপ্রিয় গল্প মানেই যে মানোত্তীর্ণ তা কিন্তু নয়, এ কথা আমরা মানি। আবার সব জনপ্রিয় গল্প মানহীন তাও বলা যাবে না। সালাহ উদ্দিন মাহমুদ অন্তর্মুখী মানুষ। সাহিত্যচর্চা শুরুর অনেক পরে তার বই প্রকাশিত হয়েছে। কবিতায় অন্তর্মুখী চরিত্র থাকে কিন্তু কথাসাহিত্যে বহির্মুখী চিন্তার একটা ব্যাপার থাকে। সালাহ উদ্দিন মাহমুদকে অনেক দূর যেতে হবে। তাই তিনি গল্পের ভুবনে ‘ধীরে ধীরে হাঁটবেন’; এ আশা পাঠক হিসাবে আমি করি। তিনি গল্পে অতি-আবেগ বর্জন বা কমিয়ে দেবেন, চরিত্রের বক্তব্যকে আরও বলিষ্টতা দেওয়ার জন্য মাথা খাটাবেন। তাহলে পাঠকসমাজে অমরত্ব পাবেন বলে মনে করি।