সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ১৯৮৮ সালের ০১ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার উত্তর উড়ার চর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় সালাহ উদ্দিন মাহমুদ বাংলায় সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি কবিতা, গল্প, ফিচার, কলাম লিখে থাকেন। এযাবৎ নয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে সালাহ উদ্দিন মাহমুদের। কথাশিল্পী হিসেবে বেশ আলোচিত তিনি। ‘সার্কাসসুন্দরী’ (২০১৭), ‘নিশিসুন্দরী’ (২০১৮) ও ‘সুন্দরী সমগ্র’ (২০১৯) তার গল্পগ্রন্থ। কবিতায়ও ভালো হাত রয়েছে তার। কবি হিসেবেও তিনি যশ লাভ করেছেন।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি আবৃত্তি ও অভিনয়ে সফল তিনি। এ-পর্যন্ত তার দুটি কবিতার বই ‘মিথিলার জন্য কাব্য’ (২০১৭) ও ‘তুমি চাইলে’(২০২০)বের হয়েছে। প্রেম, হতাশা, না-পাওয়ার যন্ত্রণা ইত্যাদি সালাহ উদ্দিনের মাহমুদের কবিতার মূলসুর। আত্মহত্যা ও প্রবঞ্চনার অবতারণাও দেখা যায় অনেক কবিতায়। কবিতায় তিনি কিছু নতুন নতুন শব্দ ব্যবহার করেছেন। সময়কে এড়িয়ে না-গিয়ে ধরে রাখতে চেয়েছেন কবিতায়। এসব দিক নিয়েই আজকের আলোচনাটি এগিয়ে নেবো।
২.
শহরের হাহাকার, জ্যাম আর ঘাম ছাড়িয়ে শুধু ভালোবাসা পাওয়ার আকুলতা রয়েছে: ‘মুহূর্তেই ভুলে যায় প্রগাঢ় প্রেম/ স্মৃতির উঠোনজুড়ে কেবল বিষাদের ছায়া’ (মুখোমুখি বসে আছি)। প্রেমের কবিতার ঐতিহ্যের সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলমান চিন্তার একটি শৈলী যা যুক্তি দেয় যে আবেগের পরিবর্তে আনুগত্য মানবজাতির প্রধান গুণ। প্রেমে কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। ‘মিথিলা’ হচ্ছে কবির মানসী। মিথিলা নিয়ে বেশ কিছু কবিতা রয়েছে। প্রেমের কিছু কবিতাও রয়েছে। এগুলোতে প্রেমের কর্তৃত্ব নিয়ে কথা বলা হয়েছে। প্রেম ও প্রেমিকাকে সামনে রেখে প্রেমের বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন কবি। আবেগের সাথে নিরুৎসাহ, প্রেমের পাশাপাশি বিরহ, না-পাওয়া তালিকা, বঞ্চিত করা বা হওয়ার গল্প ইত্যাদি কবিতার পরতে পরতে উঠে এসেছে। ‘মিথিলার জন্য কাব্য’ কবিতার সিরিজ। ছয়টি একই শিরোনামে কবিতা। প্রেমের কথা, প্রেমিকার প্রতি আবেগের কথা, কাছে না-পাওয়ার কথা, অজানা কারণে বা আবহে চিলের পিছে ছোটা ইত্যাদি কবিতার বিষয়। ‘তোমার জন্য কারফিউ’ কবিতায় প্রায় নতুন এক ধারণা। উল্লিখিত বিষয় নিয়ে কিছু কবিতা তুলে ধরছি :
১.
যেদিন তুমি-আমি হুডখোলা রিকশায় ঘুরবো সারা শহর;
সেদিন অঘোষিত কারফিউ থাকবে শহরজুড়ে।
রিকশাঅলার বাবড়ি চুলের মতো উড়বে আমাদের মন;
সেখানে জ্যাম নেই- ঘাম নেই, শুধু ঠোঁটে ঠোঁট।
(তোমার জন্য কারফিউ)২.
বই আর তোমার মধ্যে তেমন পার্থক্য দেখি না
যতই পড়ি গভীরে তলিয়ে যাই।
মদ আর তোমার মধ্যে তেমন পার্থক্য দেখি না
যতই পান করি মাতাল হয়ে যাই।
ফুল আর তোমার মধ্যে তেমন পার্থক্য দেখি না
যতই কাছে যাই সুবাসিত হই।
(তুমি এবং যাবতীয় পার্থক্য)৩.
অনেক কথাই বলা যেত
একটু যদি সময় হতো,
নোঙর ফেলে আমার ঘাটে’
(অনেক কথা)৪.
নিজের সাথে বোঝাপড়া করে নিজেই হেরে যায়,
কোন সাহসে সারাজীবন তোমার কাছে চাই?’
(বোঝাপড়া)৫.
ভেবেছিলাম তোকেই ভালোবাসবো
সুযোগ পেলে ঠোঁটে এঁকে দেবো প্রেমচিহ্ন।
(ভাবনাগুলো)৬.
মিথিলার প্রজাপতি আজো ঘাসফুল ছুঁতে পারেনি
শুধু আকাশেই উড়ে উড়ে বেড়ায়
(মিথিলার জন্য কাব্য-দুই)
‘মিথিলা’ নিয়ে লেখা বেশ কিছু কবিতা রয়েছে। প্রেমের কবিতা। আছে বিরহের ভাষা, না-পাওয়া কিছু দাবি তুলে ধরা হয়েছে কিছু পঙ্ক্তিতে। ‘মিথিলা বড্ড ঘুম পাচ্ছে’, হাত বাড়ালেই, প্রেমিকার প্রতি, ভাবনাগুলো এমন ধরনের কবিতা। ‘তুমি এবং যাবতীয় পার্থক্য’ কবিতায় প্রেয়সীর প্রতি দায়বদ্ধতা, আবেশ বা আগ্রহের স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে। আবার প্রেমিকা যে রহস্যময়, জটিল তা আমরা জানি। আর এ রহস্যের জন্য অনেক রাজা হেরে গেছেন, রাজত্ব হারিয়েছেন; ট্রয়নগরী ধ্বংস হয়েছে। ‘তোমাকে পড়া সহজ’ কবিতা এমন। ‘তুমি চাইলে’ কবিতায় কবি বলেছেন,
তুমি চাইলে মন্দ আমি ভালো হতে পারি,
তুমি চাইলে ভালো আমি মন্দ হতে পারি।
(তুমি চাইলে)
৩.
নাগরিক জীবন বড়ই হতাশাময়। কৃত্রিমতা বড় জিনিস এখানে। কেউ কারও চেনে না, কাউকে নিয়ে কেউ ভাবে না। সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। ‘বস্তি পোড়াই’, ‘ধ্বংশ করি’, ‘আগুন-খেলা করি’ ইত্যাদি শব্দ/শব্দগুচ্ছ ব্যবহারে সালাহ উদ্দিন এসব কথার বহিঃপ্রকাশ করেছেন। তার ‘মৃত্যুর ফাঁদ’ কবিতায় নাগরিক-জীবনের অন্ধকার দিকগুলো ফুটে উঠেছে। ‘আগুন আগুন খেলা’ কবিতা বস্তি বা কারখানা পুড়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
পাঠক চিন্তাভাবনা না-করেই বক্তব্য বুঝে নিতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অতি সহজ এবং রহস্যমুক্ত শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। তার কবিতা পড়ে মনে হয়েছে, বিদ্রোহ করেই ভাষা বা কবিতায় ভিন্নতা আনতে হয়।
কবিতায় নাগরিক জীবনের যোগ-বিয়োগের কথা রয়েছে কিছু কবিতায়। নিজস্বার্থের জন্য অনায়াসে হচ্ছে এসব। নাগরিক-জীবন বড়ই কুটিল। নানান হিসাব নিকাশ চলে। ‘লাভ ছাড়া’ কিছুই হতে চায় না এখন। এ-কথার সপক্ষে কিছু কিছু কবিতাংশ তুলেই ধরি:
১
বস্তুত আমরা প্রত্যেকেই একা
জন্ম এবং মৃত্যুর মতো,
বেদনা কিংবা বিষাদের মতো চুপচাপ;
প্রার্থনা বা আকাঙ্ক্ষার মতো উদগ্রীব।
(একা)২
নিমতলী আর চুড়িহাট্টায়
বুকজুড়ে হাহাকার,
রাজধানীতে অগ্নিকাণ্ডে
স্বপ্ন পুড়ে ছাড়খাড়।
(আগুন আগুন খেলা)৩
কবি হতে চেয়েছিলাম—পারিনি
শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম—পারিনি
অভিনেতা হতে চেয়েছিলাম—পারিনি
সাংবাদিক হতে চাইনি—হয়েছি
সংসারি হতে চাইনি—হয়েছি
হিসেবি হতে চাইনি—হয়েছি
মানুষ হতে চেয়েছিলাম—চেষ্টা করছি’
(মানুষ হতে চেয়েছিলাম)৪.
নিজের সাথে বোঝাপড়া করে নিজেই হেরে যায়,
কোন সাহসে সারাজীবন তোমার কাছে চাই?’
(বোঝাপড়া)
ইতিহাস বিকৃতি বাঙালির অন্যতম নেশা বলে জানি। নিজেদের স্বার্থের জন্য যেকোনো বিষয় বিকৃতি করে উপস্থাপন করতে ভালোবাসি। ‘ইতিহাসের রাজনীতি’ এমন এক কবিতা যেখানে এসব কথা বলে।
আমি রাজনীতি বুঝি না—
আমি ইতিহাস বুঝি না,
আমি আমার স্বদেশকে চিনি।
আমি বিকৃতি বুঝি না—
আমি জয় বাংলাকে বুঝি,
আমি ইতিহাসকে হেঁটে যেতে দেখি।
(ইতিহাসের রাজনীতি)
বর্তমান সময়ে হত্যা, ধর্ষণ ও আত্মহত্যার পরিমাণ বেড়ে গেছে। এটা কিন্তু সমাধান নয়। আধুনিক জীবনে হতাশা অন্যতম বিষয় বা অনুষঙ্গ। মানুষের হতাশা, ক্ষোভ বা দুঃখের চিত্র ফুটে ওঠে কবিতায়। যা আধুনিক কবিতার অন্যতম প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য। ভালো-কবিরা সময়কে এড়িয়ে যেতে পারেন না। সালাহ উদ্দিন কবিতায় সময় ধরে রেখেছেন। হত্যা, নির্যাতন ধর্ষণ বা আত্মহত্যার বিষয়গুলোকে তার সময়ের নিপীড়িতদের নাম কবিতায় উল্লেখ করেছেন। আমরা জানি, ‘সাহিত্য হচ্ছে সমাজের দর্পণ’। সালাহ উদ্দিন কবিতায় বর্তমান সময়ের অনেক ঘটনার মূলচরিত্র ধরে রেখেছেন। ‘ভালোবাসা-বিশ্বাসে তোমার হাতে দেব নির্ভরতার চাবিকাঠি’(এবার বসন্তে), ‘যন্ত্রণাবিদ্ধ টিনের চালে বিরহী কবুতর বসে না আর’ (বাজেয়াপ্ত), ‘অহংকারী আমি ওদের প্রতিনিয়ত পিষে মারি’ (তুমিহীন বিছানায়), ‘এখনো তোমার বুঝতে বাকি—তোমার স্বপ্ন ঘুমিয়ে আছে তোমার মনের গহীনে।’ (তোমার স্বপ্ন ঘুমিয়ে আছে), ‘সুখের তো শেষ নেই তবুও অ-সুখের ছড়াছড়ি’ (অ-জাতীয় আলাপ) ইত্যাদি পঙ্ত্তি সে কথাই বলে। ‘তুমি চাইলে’ কাব্যে কিছু ইঙ্গিতবহ কবিতা হচ্ছে :‘বেদনা ভুলতে কবিতা’, ‘মুখোশ’, ‘গভীর রাতে কতগুলো কুকুর’, ‘জিরাফের গলা’, ‘পা’, ‘একা’, ‘স্লোগান’, ‘এক টুকরো বিস্কুট’ প্রভৃতি। কবিতাগুলোকে আমরা ‘প্রতীকী’ কবিতা হিসাবে দেখতে পারি। ‘প্রতীকী’ এসব কবিতায় মানবতা, ঘুণেধরা সমাজ, অবিচার, অনাচার প্রভৃতি বিষয় তুলে এনেছেন। হত্যা, শিশুর প্রতি লালসা ও ধর্ষণের কথা উঠে এসেছে ‘সায়মা’ ‘আরবারের জন্য শোকগাথা’, ‘আত্মহনন’ কবিতায়। ‘শহরের কবিতা’ সিরিজ (চারটি) রয়েছে। শহরের জ্যাম, গরিবের ঘাম, দুঃখ, সুখ, পাওয়া-চাওয়া, কৃত্রিমতা নিয়ে এসব কবিতাগুলো। ‘আমি ফুটপাতের ক্রেতা’ শহরকেন্দ্রিক কবিতা; তবে প্রতীকী।
১.
আমি কিছু মানুষ চিনি—
অন্ধকারে ভেসে ওঠে
জানোয়ারের মুখ।
আমি কিছু মুখোশ চিনি—
আড়ালে তার হেসে ওঠে
রক্তখেকো সুখ।
(মুখোশ)২.
দুঃখরা যখন লালবাতি জ্বালায়
সাদারা তখন নীরবে গোরস্থানে যায়।
(ফানুস)৩.
আজকাল তোমার অনুভূতি আমি টের পাই—
আজকাল বিবর্তিত তোমার সান্নিধ্য পাই।
(তরজমা ও বিবর্তন)৪.
তোমাদের স্বপ্ন ভঙ্গের জন্যই রোজ জেগে উঠি
তোমাদের পাঁজরের হাড়ে গড়ে তুলি বিশাল শিল্প
তবুও সেলাই দিদিমণিরা স্বপ্ন বুনে যাও
(সেলাই দিদিমণিরা স্বপ্ন বুনে যাও)
মানুষের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব বড়। চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে মিল কমই। মানুষ যা চায় তা পায় না, যা পায় তা হয়তো চায় না। দ্বন্দ্বমুখর ও জটিল জীবন। এমন হিসাব নিকাশের কথা তুলে ধরেছেন ‘মানুষ হতে চেয়েছিলাম কবিতায়’। মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে কবিতা ‘মানুষ জানে না’। হতাশা, আমরা সবাই অন্ধ, আমাদের যা যা নেই প্রভৃতি কবিতায় অস্ফুট কথা, হতাশার কথা, বেদনার কথা, কৃত্রিমরূপ ইত্যাদি তুলে ধরেছেন।
এই শহরের হৃদয়জুড়ে মৃত্যুর ফাঁদ পাতা,
এই শহরের আকাশজুড়ে অবিশ্বাসের ছাতা।
জমে থাকা জলের কোণায় আজরাইলের হাসি,
ঘুমে থাকা শিশুর কানেও অগ্নিকাণ্ডের বাঁশি।
এই শহরে কেন আছি—এটাই বড় পাপ,
অভিভাবকহীন এই শহর শুধুই অভিশাপ।
(মৃত্যুর ফাঁদ)
নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো বদলায়নি। ক্ষমতায়ন বা অন্যান্য মূলস্রোতে তাদেরকে টেনে আনতে পারেনি; প্রবল অনীহা রয়েছে। কিন্তু সমাজ বিনির্মাণে, দেশ উন্নয়নে নারীর ভূমিকাকে মূল্যায়ন ও অন্তর্ভুক্তি করা প্রয়োজন। এসব তাগিদ কবি বুঝতে চেয়েছেন। লিখেছেন এ নিয়ে। এমন কিছু কবিতা উল্লেখ করাই উত্তম।
১.
নারী, তোমার সামনে দেয়াল—
পেছনে ভয়াবহ ঝড়ের পূর্বাভাস,
তুমি কোন দিকে যাবে হে অনাগ্রহী রমণী?
(পূর্বাভাস)২.
নারীকে কেবল নারীই ভেবেছি—
কখনো মানুষের মতো ভাবিনি।
(মানুষ নয় নারী)
মানুষ পরিবর্তনশীল। প্রেমিকাও। সময়ে সময়ে বা অসময়ে মানুষ বা নিকটজনের বদলে-যাওয়া সাধারণ দৃশ্য। প্রকারন্তরে মানুষজাতির অবমূল্যায়ন হচ্ছে। ধীরে ধীরে বিবেক ও বোধ কমে যাচ্ছে। ফলিশ্রুতিতে মানুষে মানুষে দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, অবিশ্বাস চলে আসছে। আবার ঠুনকো বিষয়ে বড় অঘটনও ঘটিয়ে ফেলছি। এমন ধারণা সালাহ উদ্দিন মাহমুদ কিছু কবিতায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। মাঝেমধ্যে কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চান তিনি।
আমি আজ আর প্রেমের কবিতা লিখি না।
বিদ্রোহ গর্জে উঠেছে মনে,
অন্তরে অতৃপ্তি নিয়ে ভালোবাসা যায় কি কিছু?
(আমি আর প্রেমের কবিতা লিখি না)
‘ইতিহাস থেকে শিক্ষা না-নেওয়া’ ইতিহাসের বড় শিক্ষা। বাঙালিরা আবার এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। কবি ইতিহাস টেনে আর লজ্জিত হতে চান না। এমন সব দুঃখ ও বোধের কথা লিখেছেন বেশ কিছু কবিতায় :
আসুন হত্যাযজ্ঞের আনন্দে কবিতা লিখি—
ইতিহাস টেনে লজ্জা দেবেন না।
আমরা ইতিহাস পড়ি না,
কেমন যেন অদ্ভুত লাগে।
(বেদনা ভুলতে কবিতা)
আত্মহত্যার পরিমাণ দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে। প্রেম, বেদনা, কষ্ট বা হতাশা বা অতৃপ্তি থেকে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেন। কিন্তু এটা আসলে কোনও সমাধান নয়। এতে কারও সমস্যার সমাধান হয়নি; বরং অন্যদের জন্য আরও সমস্যা তৈরি হয়। কবির উপলব্ধিও তেমন :
আত্মহত্যার পর ভুলে গেছি পূর্ব পরিচয়
পৃথিবী নামক কোনো ভূ-খণ্ডের নাম
…আত্মহত্যার পর বুঝেছি—
এ কোনো সমাধানের পূর্বাভাস নয়
অনন্ত হতাশার সাময়িক সনদমাত্র
আত্মহত্যার পর মনে হলো
আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার বড্ড প্রয়োজন ছিল।
(আত্মহত্যার পর)
৪.
সালাহ উদ্দিন মাহমুদের বেশ কিছু লিরিকধর্মী ও অন্ত্যমিলের কবিতা রয়েছে। এসব কবিতায় অন্ত্যমিল লক্ষ করা যায়। একই শব্দের বারবার ব্যবহার তার কবিতায় দেখা যায়। এমন ব্যবহার পাঠকের কানে ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে।
কার এমন দায় পড়েছে ভালোবাসবে,
মিছেমিছি ভালো থাকার ভান করবে।
(কার এমন দায় পড়েছে)
তোমার মুখের আড়ালে ভয়ঙ্কর ফাঁদ, বহুজাতিক প্রেম, করপোরেট সম্পর্ক, উগ্র চুম্বন দাগের মতো শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন।
কয়েকটি কবিতায় আঞ্চলিক সংলাপ রয়েছে। এ আঞ্চলিক সংলাপ কবিতাকে মধুর করেছে। ‘দিনের বেলা সাদাসিধা বড় বড় বুলি আওড়াস/ আন্ধার রাইতে চুপি চুপি খানকি মাগির শরীর তোগাছ’। ‘বেশ্যার প্রলাপ’ কবিতায় আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ আছে। সমাজের অন্ধকারের কথা আছে। ‘আড়ালে আবডালে কত যে নোংরামী আছে’ তেমন মানুষের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবতার কথা বলা হয়েছে এভাবে :
খানকি মাগির পোলা অ্যাতো চটাং চটাং কথা কস ক্যান?
প্রেম করার পরও তুই নিত্য নতুন মাগি খোঁজস ক্যান?
প্রেম কি তুই একাই করোস, সব মেয়েই বেশ্যা ভাবোস-
যারে তুই নষ্ট করলি, তারে ফালায়া আমার কাছে ক্যান?
চুতমারানির পো বাপ-ব্যাটা এক মাগির বিছানায় ঘুমাস,
কাম ফুরালেই খিস্তি-খেউর থুতু ছিটাস বেশ্যার গায়।
(বেশ্যার প্রলাপ)
৫.
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ কবিতায় ‘তোমার মুখের আড়ালে ভয়ঙ্কর ফাঁদ’, ‘বহুজাতিক প্রেম’, ‘কর্পোরেট সম্পর্ক’, ‘উগ্র চুম্বন দাগ’ প্রভৃতি শব্দ, উপমা, ভাষা ব্যবহার করেছেন। ‘প্রতীকী’ ভাষাও চমৎকার। কিছু উদাহরণ দেই—
১.
এ কেমন আচানক বিষণ্ন দুপুর, পাখির ডানার ভাঁজে ভাঁজে উড়ন্ত মেঘ।
আলো-আঁধারির লুকোচুরি, ফিকে হয়ে আসে দিগন্তের হাসি।
কুয়াশার আড়ালে উঁকি মারে প্রিয়তমার ফ্যাকাশে মুখ।
এ কেমন কর্মহীন অলস দুপুর, রমনীর শরীরের ভাঁজে ভাঁজে সুখ।
শৃঙ্গারে শিৎকারে কাতরতা, ভাবি প্রজন্মের প্রত্যাশিত আলো।
সঙ্গমের আড়ালে উঁকি মারে আগামীর সুযোগ্য উত্তরাধিকার।
(উত্তরাধিকার)২.
শুধু কবিতা লিখবো বলে রক্ত ঝরিয়েছি একাত্তরে—
শব্দের পর শব্দ বুনে আবাদ করেছি স্বাধীনতা।
ভয়ংকর রাতে কম্পমান মায়ের করুণ মুখ,
ভয়ার্ত বোনের পাণ্ডুর হাসি দেখেছি কবিতার চরণে।
(কবিতা লিখবো বলে)৩.
প্রতিরাতেই ধর্ষণেচ্ছা নিয়ে ঘুমোতে যাই-
কেননা প্রতিদিন পত্রিকার পাতাজুড়ে ধর্ষণ উপভোগ করি,
লজ্জাহীন চোখের পাতায় তার দৃশ্যকল্প ভেসে ওঠে।
(মানুষ নয় নারী)
‘কবি আধুনিক কোন গুণে হন? ভাষাব্যবহারে কিছুটা, প্রতীক উপমা উৎপ্রেক্ষায় কিছুটা,কিছুটা—নিজের অজান্তে—কালধর্মিতাকে বরণ করে। কিন্তু এ-সবই বাহ্য। আধুনিকতার প্রাণ যে-মনোভঙ্গি, যার উদ্ভব বিশেষ করেই বর্তমানের উপলব্ধি ও চেতনা থেকে, তার যদি অভাব কারো কাব্যে ঘটে তাহলে তাঁকে পঙ্ক্তি থেকে বাদ দিতে হয় [কবিতা পত্রিকা, আশ্বিন ১৩৬৩/ রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ: দুজন অসবর্ণ কবি (নিরুপম চট্টোপাধ্যায়, পৃ-২২)]।’
সালাহ উদ্দিন মাহমুদের অনেক সহজ কবিতা ও প্রভাবিত থিম রয়েছে। তার ‘ভালোবাসা সংক্রান্ত কোনো সুড়সুড়ি নেই’, ‘হায় জীবনানন্দ’, ‘আমি কেমন আছি’, ‘কবিদের যেতে নেই’, ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’, ‘বাংলায় কথা বলতে চাই’, ‘কবিতা আমার সান্ত্বনা’, ‘কোথাও পাবি না খুঁজে প্রেম’ কবিতা সোজাপথে (একপথ) চলেছে। কবিতা সোজাপথ খুঁজতে পছন্দ করে না—রহস্যময় হতে চায়। কবিতায় ব্যবহৃত শাব্দাবলি যদি ব্যাখ্যায় ভিন্নরকম হয়, কবিতা সেখানেই সফল।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদের কবিতার ভাষা সরলপথের মতো। পাঠক চিন্তাভাবনা না-করেই বক্তব্য বুঝে নিতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অতি সহজ এবং রহস্যমুক্ত শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। তার কবিতা পড়ে মনে হয়েছে, বিদ্রোহ করেই ভাষা বা কবিতায় ভিন্নতা আনতে হয়। ভিন্নতা আনতে পারলে পাঠকের তুষ্টি হয়। এ-নতুনত্ব রুচি পরিবর্তন করে। আর সালাহ উদ্দিনের মাহমুদের বিদ্রোহের এই প্রবণতা তাকে প্রতিশ্রুতিশীল করে তুলেছে। ধীরে ধীরে তিনি নিজের একটি জগৎ তৈরি করতে পারবেন বলে মনে হয়েছে।