‘ভালো থাকতে ঘরে থাকুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন।’ বিশ্বকে থমকে দেওয়া করোনা রোধে এটাই উত্তম পন্থা। বিশ্বও অনেকটা মেনে নিয়েছে। একের পর এক লকডাউন ঘোষণা করছে দেশগুলো। গতিশীল বিশ্ব যেন থমকে গেছে। একলা চলো নীতি-ই এখন বাঁচার উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। আত্মকেন্দ্রিক এই যুগে মানুষকে ঐক্যে ফেরার আহ্বান জানানোর কথা ছিল। পৃথিবীতে নানা সময়ে সংকট তৈরি হয়। মহামারি, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নানা সংকট মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীর রয়েছে।
পাশের গ্রামের সঙ্গে যখন কাইজ্জা (সংঘর্ষ) লেগেছে তখন দেখেছি যে প্রতিবেশির সঙ্গে মুখ দেখা-দেখি বন্ধ চলছে সেও পাশে ঢাল ধরে বসে পড়েছেন।
ধরন আলাদা হলেও সব সংকটের একটি মিল রয়েছে। তা হলো-মোকাবিলা করতে হয় ঐক্যবদ্ধভাবে। যেকোনো সংকটই তো মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। বিশ্ব এর আগে দুই-দুইটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে। তখন একটি গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়েছে আরেকটি গোষ্ঠীকে দমাতে। পক্ষ দুটো হলেও ঐক্য ছিল। একাত্তরে আমরা যে যুদ্ধকালীন সংকটে পড়েছিলাম, তা রুখতে এক হয়েছিলাম বলেই জয় এসেছিল। দল, মত, ধর্ম, বর্ণ সব ভেদাভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে মুক্তিসেনারা ঝাপিয়ে পড়তে পেরেছিল বলেই আজ আমরা স্বাধীন।
বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের পরও দেখেছি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের পাশে দাঁড়ায় অন্য দেশ। ত্রাণ পাঠিয়ে, অর্থ দিয়ে সেই দুর্যোগ থেকে উত্তরণ ঘটাতে সাহায্য করে। ছোটবেলায় দেখেছি-ঝড়ের সময় যখন আমার দাদি-চাচা দোয়া দরুদ পড়ছেন তখন আশ্রয় নেওয়া হিন্দু পথিকও আল্লাকে ডাকতে শুরু করেছেন। অবাক হতাম। শিশু মনের তাড়নায় একদিন কারণটি জিজ্ঞেসও করেছিলাম। উত্তরে সমীর মিস্ত্রি বলেছিলেন, ‘বিপদ, দুর্যোগ সৃষ্টিকর্তা দেন। তোমাদের আল্লাহ, আমাদের ভগবান। যে নামেই ডাকি, তিনি শোনেন। একসঙ্গে যখন ডাকছি তিনি রক্ষা করবেনই।’ পাশের গ্রামের সঙ্গে যখন কাইজ্জা (সংঘর্ষ) লেগেছে তখন দেখেছি যে প্রতিবেশির সঙ্গে মুখ দেখা-দেখি বন্ধ চলছে সেও পাশে ঢাল ধরে বসে পড়েছেন। শত্রু ঠেকাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে যাওয়া মানিক আর রফিকের মধ্যে তো মামলা চলছে কয়েক বছর! দেখেছি বিষ্ণু আর আব্দুল্লাহর সমস্বরে চিৎকার দিয়ে শত্রুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। এ সবই বাংলাদেশের চিরায়ত দৃশ্য।
পাশে দাঁড়াতে হবে অসহায়দের। এই ভাইরাস রুখতে গড়তে হবে সামাজিক ঐক্য। একত্রিত হতে হবে পুরো বিশ্বকে।
যান্ত্রিকতার এ যুগে যখন যখন মানুষ কেবলই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে তখন তো জ্ঞানীরা দিচ্ছিলেন ঐক্যের পাঠ। এমন সময়ে করোনা নামক এক অচেনা শত্রু এসে শেখালো একা থাকতে হবে। ঘরে থাকতে হবে। প্রিয়জনকে আলিঙ্গনে জড়াতে পারবো না। চুমু খেতে পারবো না প্রিয় সন্তানকে। অফিস থেকে ফিরেই কোলে ঝাপিয়ে পড়া সন্তানের চোখ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে ঢুকছি ওয়াসরুমে। আবেগ মিশিয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরতে পারবো না। স্বাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দেয়া আগন্তুককে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে করমর্দন না করেই। প্রিয়জন মারা যাচ্ছে; লাশ বুকে জড়িয়ে আহাজারি করতে পারছে না স্বজনরা। জানাজা সৎকারেও নেই খুব উপস্থিতি। বাঙালি সত্তা কি এ অবস্থা মেনে নিতে পারে? মানতে হচ্ছে। মানতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছে। ঘরে বসে থাকতে থাকতে আবার বিষণ্নতা, উদ্বেগ, অস্থিরতা কাজ করছে মানুষের মাঝে। ছটফট করতে করতে আবার রাস্তায় বেরিয়ে আসছে মানুষ। কেউ বুকভরে দম নিতে। কেউ ক্ষুধার তাড়নায়।
আগের যেকোনো সংকটের চেয়ে এই করোনা সংকট বেশি নির্দয় বলা চলে। পৃথক করে ফেলছে আপনজন থেকে। কিন্তু এখানেও রয়েছে সূক্ষ্ম ঐক্যের শিক্ষা। সবার মতের জায়গায়, চিন্তার জায়গায় এক হতেই হবে। নিজে নিরাপদ থাকতে, আপনজনকে নিরাপদে রাখতে সচেতন থাকতে হবে। ঘন ঘন হাত ধোয়া, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকাসহ কিছু অভ্যাস আমাদের করতে হবে। পাশে দাঁড়াতে হবে অসহায়দের। এই ভাইরাস রুখতে গড়তে হবে সামাজিক ঐক্য। একত্রিত হতে হবে পুরো বিশ্বকে। ধর্ম-বর্ণ-জাতি ভেদ ভুলে এক হতে হবে এই করোনা রোধে। লকডাউনের এই সময়ে সবচে বিপদে নিম্নআয়ের মানুষেরা। যারা একদিন কাজ না করলে চুলোয় হাঁড়ি চড়ে না তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। এরইমধ্যে এমন খবর পাচ্ছি।
বন্ধুকে দেখামাত্র টেনে নেব বুকে। করমর্দনে অভিবাদন জানাবো আগন্তককে। আন্তরিকতায় মুগ্ধ করবো বিদেশি বন্ধুকে। এগুলোই তো আমাদের সম্পদ।
অনেক প্রতিষ্ঠান নিম্ন আয়ের মানুষের এক সপ্তাহ বা এক মাসের খাবারের দায়িত্ব নিচ্ছে। অনেকে নিচ্ছেন ব্যক্তি উদ্যোগে। সরকারি তহবিল থেকেও অনেক জেলা-উপজেলা প্রশাসন এই মহতী উদ্যোগ নিচ্ছে বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে। দরিদ্র থেকে মধ্যবিত্তের দিকে অগ্রসর হওয়া দেশটিতে নিম্ন আয়ের মানুষই যে বেশি! তাই তো হাতে গোনা উদ্যোগে এ সমস্যার সমাধান সহজ নয়। এগিয়ে আসতে হবে বড় বড় শিল্প-প্রতিষ্ঠানকে। এগিয়ে আসতে হবে শীর্ষ তালিকায় থাকা ধর্নাঢ্য ব্যক্তিদের। সচেতনতামূলক বাক্যে বলা সামাজিক দূরত্ব যেন হৃদ্যতা কমিয়ে না দেয়; সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। দৈহিক দূরত্ব বজায় রেখেই পাশে থাকতে হবে অসহায় মানুষগুলোর। পাশে থাকতে হবে আপনজনেরও। কয়েকদিন আগে কবি ও গবেষক রঞ্জনা বিশ্বাসের একটি পোস্ট চোখে পড়লো। তিনি লিখেছেন, ‘মরণে আমার ভয় নাই কিন্তু মরিবার আগে দু ফোঁটা অশ্রুবিন্দু দেখিয়া মরিতে চাই।’ সংকটকালে মানুষ সবচেয়ে বেশি থাকে ভালোবাসার কাঙাল হয়ে। কেউ একটু খোঁজ নিলে, সাবধানে থাকার পরামর্শ দিলেই যেন গলে যায় মন। ভরসা পায়। ভাইরাস এসেছে, চলেও যাবে। হয় তো কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু এই সংকটময় মুহূর্তের শিক্ষা আমাদের যেন সজীব করে, সতেজ করে।
এই একলা চলো নীতি যেন কোনো সম্পর্কে ফাটল না ধরাতে পারে। এই অচেনা ভাইরাসের ভয় যেন আপনজনের হৃদয় থেকে দূরে না সরিয়ে দেয়। নিরাপদে থাকতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে পাশে থাকতে হবে সাধ্যমতো। হতে হবে আরো ঐক্যবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী এই বিধ্বংসী ভাইরাসও আমাদের ইতিবাচক কিছু দিয়ে যাবে। সেগুলো আমাদের আগামী দিন আরো ভালো করবে। আলো ছড়াবে। আমরা জড় হবো শাহবাগের আড্ডায়। হেসে গড়াগড়ি খাব। বন্ধুকে দেখামাত্র টেনে নেব বুকে। করমর্দনে অভিবাদন জানাবো আগন্তককে। আন্তরিকতায় মুগ্ধ করবো বিদেশি বন্ধুকে। এগুলোই তো আমাদের সম্পদ। এগুলোই আমাদের অহঙ্কার। এগুলোই আমাদের পরিচয়। সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে গিয়ে যেন হৃদ্যতা কমে না যায় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।