একজন কবি সার্বক্ষণিক কবি। তিনি যখন কবিতা লেখেন না, তখনো কবিতাকে ধারণ করেন নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে। কবিতা একটা ঘোর। এই ঘোরে অহর্নিশি আবর্তিত হয়ে কবিকে নিরবচ্ছিন্ন কবিতাযাপন করতে হয়, না হলে কবিতা তাকে ছেড়ে চলে যায়। কবিতার ঘোরে নিমজ্জমান তেমনি একজন কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল।
এই কবি প্রতিদিনই কবিতা লেখেন। তোরোটি বর্ণে তার নাম। আনলাকি থার্টিন নিয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন। কিন্তু আনলাকি তিনি নন। তিনি লাকি পোয়েট। গদ্যচর্চা, গবেষণা, সম্পাদনা তার প্রিয় বিষয় হলেও কবি হিসেবে পাঠকের কাছে তিনি সমূহ সমাদৃত। ভাগ্যবান কবি বলেই তো পাঠকের মনের মণিকোঠায় তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। আর ক্রমাগত লিখতে পারার এই যে ক্ষমতা, তা তার প্রতিভার দুর্দমনীয় শক্তির ফলেই সম্ভব; সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যা পরিবর্তন হয় না, তা ক্ষয় হয়। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেননি। তার কবিতার আঙ্গিক, ভাষাভঙ্গি বিচিত্র। দীর্ঘদিন তিনি এক ফর্মে লেখেন না। নিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পরিবর্তন করেন কবিতা বলার স্টাইল, নির্মাণ কাঠামো। উত্তরাধুনিক উন্মাদনার সময়ে লেখেন দক্ষিণাধুনিক কবিতা, অনুবাদ অসম্ভবের ক্লিব কবিতা।
অনেকেই বলেন, প্রতিটি লেখকের নিজস্ব একটি স্টাইল থাকা উচিত; নাম মুছে দিলেও পাঠক যেন বুঝে নিতে পারেন, এটা কার কবিতা। আমি এই ধারণায় বিশ্বাসী নই। আমি মনে করি, একজন কবি এভাবে টাইপট হলে তিনি আর এগোতে পারেন না। এই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা মানেই কবির মৃত্যু। হ্যাঁ, স্বাতন্ত্র্য তো থাকবেই, সে স্বাতন্ত্র্য চিত্রকল্প নির্মাণ, শব্দ তৈরি, শব্দের ব্যবহার, ভাষাবোধ, মনন, দেখার চোখের স্বাতন্ত্র্য। এই স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেই সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ একটির থেকে আরেকটি আলাদা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তৃষ্ণার্ত জলপরী’ থেকে ‘সঙ্গমের ভঙ্গিগুলো’ ও ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘তিন মিনিটের কবিতা’ পর্যন্ত অনেক কাব্যগ্রন্থে তার প্রমাণ মিলবে। একজন শক্তিমান কবির জন্য প্রতিনিয়ত নিজেকে অতিক্রম করার এই প্রবণতা, এটা অপরিহার্য বলে আমি মনে করি।
কোন কোন বিষয়ে সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল কবিতা লেখেন, সেটা জানার আগে জানতে হবে তিনি কী কী বিষয়ে তিনি লেখেননি! তার লেখার বিষয় দেশ, ভাষা, মা, মাটি, মানুষ, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধশিশু, আত্মস্বীকৃতখুনি, দেশভাগ, সংস্কৃতি, সমাজ, প্রেম, প্রবাস জীবন, বহির্বিশ্ব সবই তার লেখার বিষয়। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ তার কবিতায় এক অনিবার্য অনুষঙ্গ। আমাদের জীবন, পরিবেশ, পরিপার্শ্ব-প্রতিবেশের এমন কোনো জায়গা নেই; যা তাকে স্পর্শ করেনি। এই কারণে তার কবিতায় বৃষ্টি, বজ্রপাত, ভূমিকম্প, ইবলিশ, ফেরেশতা, যিশু, নবী, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, ভিক্ষাবৃত্তি, ভাত, ঘুম, ফুল, পাখি, কৈশোর, যৌবন, নদী, ডাক্তার, হাসপাতাল, কোমা, আইসিইউ, মাছ, কুমির, মদ, নারীমাংস, কবর, নেতা, মন্ত্রী, ভূত, বৃক্ষ, কচ্ছপ, হাদিয়া, মাদুলি, স্বপ্ন, খোয়াবনামা, বিবাহ, সেক্স, মাস্টারবেশন, তুলসী, আপেল, চকোলেট, আইসক্রিম, কাগজ, কলম, বই; এমন অসংখ্য প্রকৃতি-জীবন সংশ্লিষ্ট নিত্যশব্দ, শব্দসম্ভার তার কবিতায় ব্যবহার হতে দেখি। শব্দ ব্যবহারে তিনি এতখানি কুশলী, যেকোনো বিদেশি শব্দ, বিশেষত যেকোনো ইংরেজি শব্দ অনায়াসে তার কবিতায় একীভূত হয়ে যায়।
একজন কবিকে পাঠকের কাছাকাছি পৌঁছাতে এখন আর পত্রিকার দ্বারস্থ না হলেও চলে। প্রতিদিনই তার নতুন কবিতা, নতুন নিরীক্ষায় আমরা চমৎকৃত হই।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল দীর্ঘদিন কানাডা প্রবাসী। দেশের বাইরে অবস্থান করলেও দেশের প্রতিটি সংকট, বিপর্যয়, অমানবিকতায় তিনি সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তার কবিতায় রয়েছে তীব্র প্রতিবাদ, শ্লেষ, ব্যাঙ্গোক্তি। অনবদ্য চিত্রকল্পে, রূপকের মধ্য দিয়ে কবিতায় প্রকটিত হয় তার বক্তব্য। তিনি দেশপ্রেমিক, রাজনীতি সচেতন কবি।
পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি ফেসবুকে নিয়মিত লিখছেন। ফেসবুক এখন একটি শক্তিশালী সামাজিক গণমাধ্যম। একজন কবিকে পাঠকের কাছাকাছি পৌঁছাতে এখন আর পত্রিকার দ্বারস্থ না হলেও চলে। প্রতিদিনই তার নতুন কবিতা, নতুন নিরীক্ষায় আমরা চমৎকৃত হই।
ফেসবুকে সম্প্রতি লেখা সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের একটি কবিতা ‘মালতি-রিপোর্ট’ উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে আমি আমার আলোচনায় বলা কথাগুলোর স্বপক্ষে দৃষ্টান্ত হিসাবে তুলে ধরতে চাই। আসুন এটি পাঠ করি:
গ্রামে আমরা অনেক গরিব ছিলাম;
আমাদের রেডিও ছিল না; সেন্ডেল ছিল না।
খালি পায়েই সাপ্তাহিক নাটক শুনতে যেতাম-
মালতি দি’র বাড়িতে
সন্ধ্যা মালতির গন্ধে পুরো পাড়া মউ মউ করতো।আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে
বজ্রপাত হতো রেডিও’র ভেতর, নাটকের মধ্যেও
আবদুল্লাহ আল মামুন আর ফেরদৌসী মজুমদার
বৃষ্টিতে ভিজতে থাকতো সন্ধ্যামালতির গন্ধে।মালতি-দি মাঝে-মধ্যে আপ্যায়ন করতো
টুল দিতো, চা দিতো।
পানি পান করতে চাইলে এনে দিতো জল।
তার আগে একটা রহস্য ছড়িয়ে বলেছিল-
মালতির মায়ের নাম:
মোছাম্মৎ মালিহা খাতুন!ব্যাটারি ফুরিয়ে গেলে মালতি নিজেই গল্প করলো:
‘রাজকুমারী কবুতরের পায়ে বেঁধে সওদারকে চিঠি লিখলো
কবুতরটা আর ফিরে আসেনি!
লোভী সওদাগর কবুতরটা জবাই করে
মাংস ভক্ষণ করেছিল!’আরেক দিন মালতি তুলসি-চায়ের সাথে
একটি চিঠি দিলো।
চিঠিটা ছিলো হিন্দিতে কিন্তু আমি হিন্দি জানিনা,
জানিনা কি ছিলো সেই হিন্দিতে লেখা পত্রে?
মালতিরা এখন হিন্দুস্থানে।
(মালতি-রিপোর্ট)
কবিতাটিতে একটা গল্প আছে। যে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মালতি দিদি। মালতিকে ঘিরে আমাদের অতীত, শৈশব, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, গ্রামীণ জীবন, দেশভাগ, ক্ষরণ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা আবর্তিত হয়েছে। নস্টালজিক হয়েছেন কবি। পাঠকও ভেসে যান নস্টালজিক স্রোতে। এই ছোট্ট একটি কবিতা পাঠককে টেনে নিয়ে যায় একটি দেশ, জাতির সংস্কৃতির বিভাজিত বেদনা বোধের কাছে। দেশভাগের আগে আমাদের গ্রামীণ জীবনের দারিদ্র্য, বিনোদনের একমাত্র আশ্রয় রেডিও, সাপ্তাহিক নাটক শোনার জন্য গ্রামের একটু সচ্ছল হিন্দু পরিবারে নিয়মিত যাওয়া, কবুতরের পায়ে বেঁধে প্রেমিকের কাছে চিঠি পাঠানো, পানি ও জলের বিভেদ এসবই আমাদের অতীত। যার ভেতরে লুকিয়ে থাকা গভীর বেদনাবোধ, আমাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি।
কী চমৎকারভাবে আমাদের বেদনা, সংস্কৃতি, ঐতিত্য, ইতিহাসকে একটি কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন! যা তার বিচিত্রবোধ ও বৈচিত্র্যময় কবিসত্তাকে চিহ্নিত করে বৈকি!
গ্রামের যে অসম বর্ণে প্রেম-বিবাহ; যার ফলে মালতির মায়ের নাম মোসাম্মাৎ মালিহা খাতুন আমরা জানতে পারি। তৎকালীন সমাজে এই অসম বিবাহের পিতা-মাতার সন্তান মালতি কেমন ছিলেন, তা হয়তো অনুমান করা যায়। কিন্তু মালতির বাড়িতে এলে সন্ধ্যামালতির ম-ম গন্ধে পুরো পাড়া যখন মাতোয়ারা হয়, তখন আমাদের মনে হয় এই যেন মালতির হৃদয়ে ফুটে থাকা মানবিক কুসুমের সুগন্ধ।
কবিতায় কী চমৎকার মেটাফর! যখন রাজকন্যারূপী মালতি কবুতরের পায়ে বেঁধে তার প্রেমিকের কাছে চিঠি পাঠায়, কবুতরটি তার কোনো প্রতি-উত্তর নিয়ে ফিরে আসে না; বরং সওদাগররূপী প্রেমিক কবুতরটি ধরে জবাই করে ভক্ষণ করে। এ রূপক আমাদের সমাজের লোভী সওদাগরের মতো প্রতারক ও পাপিষ্ঠ প্রেমিকের চেহারাই আমাদের সামনে উন্মোচন করে। আমার মনে হয়েছে কবিতাটির সবচেয়ে চুম্বক পর্ব এটি।
‘মালতি-রিপোর্ট’-এর শেষ পঙ্ক্তিতে দেখি, আরেকদিন কবির কাছে তুলসী চায়ের সঙ্গে মালতি একটি চিঠি দেয় হিন্দি ভাষায়। এ ভাষা জানা না থাকায় কবি সেই চিঠির মর্মোদ্ধার করতে পারেন না। মালতি তখন হিন্দুস্থানে। বাঙালি হয়েও, মুসলিম মায়ের সন্তান হিন্দু বাবার পরিচয়ে বেড়ে ওঠে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক রোষাঘাতে অনেকের মতো দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় সে। একই সংস্কৃতি, একই ভাষা থাকা সত্ত্বেও মালতি বাংলা ভুলে যায় বা ভুলতে চায়, সে কবিকে চিঠি লেখে হিন্দি ভাষায়। দেশ ভাগের পর হিন্দি ভাষার ক্রমাগত অগ্রাসনে পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত বাঙালিদের বাংলা ভাষা ভুলে যাওয়ার যে প্রবণতা; হয়তো সেটিকেই ইঙ্গিত করেছেন কবি।
কী চমৎকারভাবে আমাদের বেদনা, সংস্কৃতি, ঐতিত্য, ইতিহাসকে একটি কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন! যা তার বিচিত্রবোধ ও বৈচিত্র্যময় কবিসত্তাকে চিহ্নিত করে বৈকি!
টিএস এলিয়ট বলেছেন, ‘একটি ভালো কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গদ্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া।’ সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের কবিতার বিশেষ প্রবণতা অবাধ গদ্যধর্মিতা। তার মতো কবির কবিতা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘ পরিসর দাবি রাখে। এই আলোচনা আমার তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন মাত্র।
প্রিয় কবির জন্মদিনে শুভেচ্ছা। তিনি দীর্ঘজীবী হোন এবং বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিসম্ভারে ভরে দিন আমাদের বাংলা কবিতা ভাণ্ডারকে; আজকের দিনে এটুকুই প্রত্যাশা।