একটি দেশ। সেই দেশের প্রগতিশীল রুচি ও জ্ঞানচেতনা যদি দ্বিধা, শঙ্কা ও জড়ময় বৈপরিত্যের মাঝেই হয়, তাহলে নতুন কোনো ধীশক্তিসম্পন্ন ও দূরদর্শী মানুষের আবির্ভাব ঘটবে না। সম্প্রতি ফেসবুকে সলিমুল্লাহ খানকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় ও কটূক্তি দেখে সেটাই মনে হচ্ছে।
সলিমুল্লাহ খান। বাংলাদেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব, প্রাবন্ধিক ও চিন্তক। সম্প্রতি একটি লাইভ অনুষ্ঠানসহ তার কিছু বক্তব্যের আলোচনা সমালোচনা ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি একজন জ্ঞানী; বাগ্মী। তার প্রখর স্মরণশক্তি ও মুখস্থশক্তি তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কেউ মুহূর্তের বক্তব্য বা ভাষণ শুনে তাকে মূল্যায়ন করেন। কেউ তার বক্তব্য শোনা ও তাকে পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝার চেষ্টা করেন। কথা হচ্ছে, যারা শুধু ইউটিউব-ভিডিও, সভা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম বা টক শো’র ট্রাডিশনাল আয়োজনের ভেতর দিয়ে তাকে মূল্যায়ন করেন; তাদের জ্ঞান, চিন্তা ও উপলব্ধি কতটা প্রখর ও মানসম্পন্ন; এ-ও একটা বড় প্রশ্ন। তাকে না বুঝে, না-পাঠ করে, না-উপলব্ধি করেই একটি গোষ্ঠী অন্ধভাবে খারিজ করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে অনেক বোধসম্পন্ন মানুষও বিভ্রান্ত হচ্ছেন। আরেকটি গোষ্ঠী আছে—সম্পূর্ণ ঈর্ষাপরায়ণ ও অহংবোধের জায়গা থেকে, বেপরোয়া সমালোচনা করছেন।
একটি দেশের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ভিত্তি যদি দুর্বল হয়; তাহলে যতই জ্ঞান-প্রজ্ঞার সর্বোচ্চ মানদণ্ডে আপনি থাকুন, শেষ অব্দি সেই ভিত্তির দুর্বল কাতারেই, নানা ফাঁদে আপনাকে জড়িয়ে যেতে হবে অথবা মিশে যেতে হবে।
দেশ ভ্রমণ করে আমরা শিক্ষিত ও উদার হতে পারি। মানুষ হিসেবে নিজের অক্ষমতাকে বুঝতে পারি। আবার সমাজের মানুষ স্টাডি করেও শিক্ষিত ও উদার হতে পারি। নিজের অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা ধরতে পারি। একজন মানুষ মুহূর্তের মধ্যেই (লব্ধজ্ঞানকে) পুরো বিশ্বভ্রমণ শেষ করে, তলানীর শেষ-হাড়িটুকুর রহস্য উন্মোচন করছেন। খবরদিচ্ছেন—শত রেফারেন্স দিয়ে, জানা বিষয়কে তার যুক্তি ও জ্ঞানকাণ্ডে অনবদ্য করে উপস্থাপন করছেন। সমাজকে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তার দোষ হলো—তিনি তথা-আধুনিক, দুর্নীতিপরায়ণ, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাপনার (এই দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ দাঁড়িয়ে গেছে) বিপরীত অবস্থানে আছেন। তিনি শাস্ত্র-জ্ঞানতত্ত্বের আলোকে বাস্তবমুখী বক্তব্য দিয়ে শিক্ষামূলক একটি ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছেন। দেশের তথা-শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার প্রমাদগুলোও ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
বর্তমান পৃথিবী একটি বিশ্বগ্রাম। আমরা সেই বিশ্বগ্রামের বাসিন্দা। মানুষ শেষ পর্যন্ত পরিবার, রাষ্ট্র ছাপিয়ে একটি সমাজেই মূলত বসবাস করে। অন্তত আমাদের বাংলা মুলুকে সেটাই বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম—বহুল চর্চিত একটি বায়বীয় ও ছায়া মাধ্যম। রুচি-মেজাজ ও পাত্রভেদে এখানেও তৈরি হয়েছে একটি ছায়া-সমাজ। দেশ ছাড়িয়ে দেশের বাইরে, পরিচিত অপরিচিত অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গেই তৈরি হয়েছে মানসিক নব ঐক্য। হয়েছে হৃদ্য-যোগাযোগ, আত্মিয়তা ও বন্ধুত্বের সুষম বন্ধন। এই মাধ্যমে শত, হাজার, লক্ষ-লক্ষ-কোটি-কোটি ইউজার আছেন। বিভিন্ন মতবাদ, মতান্তর, মতাদর্শ-চিন্তার বায়বীয় পীঠস্থানও এই জনপ্রিয় মাধ্যম। নিত্য বহুলচর্চার মধ্য দিয়ে এরকম একটি ভার্চুয়াল মাধ্যমে, কমবেশি সবাই তার সমমনা, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ঠিকই তৈরি করে নিয়েছেন। আবার এই গোষ্ঠীর মধ্যেও থাকতে পারে, শত মতবাদ ও মতাদর্শের মানুষ।
এই মাধ্যমের সুস্থ চর্চাকারী যারা, তারা ঠিকই তাদের অন্বেষণের পথটি বেছে নেন। আবার এই চর্চাকারীর ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা অনেকের বাজে মুখোশও উন্মোচিত হতে দেখা যায়—একেক জনের, একেক প্রচার ও উসকানিতে অনেকেই হয়ে পড়েন দ্বিধাগ্রস্ত, শঙ্কিত ও বিব্রত। কেননা অনেকেই আগাপাছতলা না ভেবে, ভেড়ার পালের মতো খানাখন্দক না-চিনেই দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন—তারা খুবই বিপজ্জনক; বর্ণচোরা ও অন্ধ।
বাঙালি জাতির স্বভাবে কিছু দোষ বা গুণ দ্বান্দ্বিক। যা তার রক্তের সাথে মজ্জাগত হয়ে আছে। তবে সঠিক শিক্ষা ও বোধের সুষম সমন্বয় থাকলে অবশ্যই আমরা তা ওভারকাম করতে পারি; দোষগুলো এড়াতে পারি।
এমনিতেই আমাদের ক্রান্তিকাল চলছে। ভরসা করার মতো আলোকিত ক্ষণজন্মা অনেকেই গত হয়েছেন। মুষ্টিমেয় যারা আছেন, তাদের সম্পর্কেও আমাদের ধারণা ভাসা ভাসা; অথবা ওয়াকিবহাল নই। এছাড়া এই মুলুকে চিত্ত বা মেধার চেয়ে বিত্তশালীরাই দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ হয়ে উঠছেন। এখানে ক্ষণজন্মা বীরদের মৃত্যু পরবর্তী মূল্যায়নটাই কপালে বেশি জোটে। কেউ আবার বার্ধক্যজনিত স্বাভাবিক মৃত্যু দিয়েই তার প্রমাণ দেন, এমন একজন মনীষা এই দেশে বা সমাজে ছিলেন। কাউকে নিজের জীবনের বিনিময়েই বুঝিয়ে দিতে হয়; একটি দেশের জন্য হিমালয় সমান অনেক বড় মাপের একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন—বঙ্গবন্ধু যার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
সলিমুল্লাহ খানের বক্তব্যে যে অতিকথন নেই, তা বলা যাবে না। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সুস্থ ও যৌক্তিক আলোচনা সমালোচনা করা উচিত। মূল প্রসঙ্গ এড়িয়ে, টু দ্য পয়েন্ট কথা না বলে, কারও জ্ঞানকাণ্ডকেই সরাসরি খারিজ করার একটি অসুস্থ সংস্কৃতি আমাদের দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। জাতির জন্য এটি সত্যি লজ্জার; অশনি-সংকেতও।
অনেকেই বলছেন, আলোচনায় তিনি সমাপ্তি টানেন না। একটি সীমাবদ্ধ আয়োজনে শত রেফারেন্স টানতে পারাও একটি যোগ্যতা। সেই রেফারেন্সের সূচিসূত্র ধরে যৌক্তিক মতো দিতে পারাও প্রাজ্ঞের যোগ্যত। তিনি রেফারেন্স টেনে সমাপ্তি টানেন না এটা আরোপিত—কথা হচ্ছে সমালোচনার সুস্থ উঠোন যদি আমরা না বানাতে পারি, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা অন্ধকানাইয়ের ভূমিকাই পালন করছি। আমরা না বুঝে একচক্ষু হরিণের মতো সমালোচনা করছি। কেউ বা বুঝে, অস্থির হয়ে অনেকটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছেন। মুহূর্তেই মন্তব্য করছেন, বক্তব্য দিচ্ছেন, বাহবা কুড়াচ্ছেন। মাত্রাজ্ঞান রোহিত হয়ে প্রলাপ বকছেন। যে কথাটি অনিবার্য সত্য, তা হলো যিনি সমালোচনা করছেন, তার নিজযোগ্যতা, জ্ঞানের পরিধি ও চর্চা কেমন?
বাঙালি জাতির স্বভাবে কিছু দোষ বা গুণ দ্বান্দ্বিক। যা তার রক্তের সাথে মজ্জাগত হয়ে আছে। তবে সঠিক শিক্ষা ও বোধের সুষম সমন্বয় থাকলে অবশ্যই আমরা তা ওভারকাম করতে পারি; দোষগুলো এড়াতে পারি।
ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও শিল্পবিপ্লব পরবর্তী ঢেউ—আমাদের বস্তুচেতনা ও মানসচেতনায় পর-নির্ভর (ভাষা-কাঠামো, দর্শন ও আইডিওলজির) ভিত্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। সেই ভীতকে নাড়িয়ে দিয়ে অথবা তাকে গ্রহণের মধ্য দিয়ে কেউ কেউ স্বজাতি ও অনুভবের কথা, সম্পন্ন বাঙালিয়ানার ভেতর দিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। কেউবা নানা মতবাদের ভেতর দিয়ে, কেউবা নিজের দর্শনের ভেতর দিয়ে, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ে। সলিমুল্লাহ খানও (সেই কাঠামোয় থেকে) হাজার বছরের বাংলার বস্তু সংস্কৃতি; আমাদের উৎস নির্ধারণের ভেতর দিয়ে দেশ ও বৈশ্বিক নানা প্রপঞ্চকে সামনে আনার চেষ্টা করছেন—যেখানে তুলনামূলক বিশ্লেষণের প্রয়াস বা চেষ্টা লক্ষ্যযোগ্য। তার স্বজাত ভাবনা, দেশপ্রেম ও স্বদেশভাবনার সম্পূর্ণ পক্ষে; ইউরো কাঠামোর লব্ধ জ্ঞানের অন্ধধারক যারা; সেই দৃষ্টিভঙ্গি ও জ্ঞানের নির্মোহ সমর্থক যারা। দুটো প্রবল সমর্থক নজরুল থেকে শুরু করে মাটিলগ্ন, বাংলাবান্ধব অনেক মনীষীকুলের শিক্ষাগত যোগ্যতা; তাদের ধী-কর্মের অবমূল্যায়ন করেছেন। স্বয়ং সলিমুল্লাহ খান সেখানে জোর প্রতিবাদ করেছেন। তাদের পক্ষে কথা বলেছেন। তাহলে ডিগ্রিধারী বাংলাদেশের বড় পণ্ডিত, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, তাদের কেন তিনি অবমূল্যায়ন করবেন? এ-ও এক বড় ভাবনা বা চিন্তার বিষয়!
তার বক্তব্যের টিউন না বুঝেই অনেকে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। দেশের কোনো জনপ্রিয়, প্রথিতযশা ব্যক্তি নিয়ে তিনি সমালোচনা করেছেন মানে এই নয় যে, তার কর্ম নিয়েও তিনি ধী-মন্তব্য করেননি; অথবা তার ধ্যানে-জ্ঞানে ওই বক্তব্যই চূড়ান্ত। সবকিছুর সমাধান তিনিই দেবেন; তার বক্তব্যের সমাপ্তি তাকেই টানতেই হবে, এই প্রবণতাও আরোপিত ও চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতি।
আরও পড়ুন