আমাদের সংস্কৃতি, অভিরুচি, মান বোধ, বিচার ইত্যাদির কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। এগুলো সবই সময়। একইসঙ্গে সময় প্রভাবিত মানব রুচির অধীনে বিক্রি হওয়ার জন্য প্রস্তুত পণ্য। আজকের জোয়ার যেদিকে প্রবহমান, সেদিকেই বেগবান আমাদের ঠিক-বেঠিক, ভুল সঠিক। আমরা মুখে এক, আর আচরণে আরেক, খুব ভালো করেই জানি, যে যা বলছি, তার প্রায়োগিক দিকটাতে আমাদের অবদান বা অংশগ্রহণ সবচেয়ে কম।
সংস্কৃতির নরম সূঁচে সুতো হয়ে জের টানতে অলক্ষেই ঢুকে অক্টোপাসের মতো পেঁচিয়ে আমাদের বোধটাকে আঁটকে ধরছে অর্থনীতি। তাই সংস্কৃতি আর অর্থনীতি আজকের দিনে স্বাতন্ত্র্য হারাচ্ছে ক্রমশ। কোনটা আমাদের নিজের, সেটা জানা তো দূরের কথা, যেটুকু জানি সেটুকও নির্দ্বিধায় ভুলতে বসে ঢোক গিলে বলি, আমরা বাঙালি। এর অশুভ সূচনা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে শুরু হয়েছে যদিও, তবু আজকের দিনের স্বশাসিত জীবনের উথাল-পাতাল ঢেউয়ের বিস্তার বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ঔপনিবেশবাদকে অযথা দোষ দিয়ে আমরা এক শ্রেণি কৌশলে নিজেদের চারিত্র্যিক দুর্বলতাকে ঢাকার চেষ্টা চালাই, কিন্তু বেলা শেষে ধরা পড়ে যাই নিজের কাছেই।
আমাদের যা কিছু আছে স্বাতন্ত্র্যের জায়গা তার সবটুকু জুড়েই রয়েছে বাজার আর চাহিদা। যেকোনো মূল্যেই মূল্যবোধকে আঁতুড় ঘরেই মেরে আমরা নিজেকে বিক্রি করি, যে কিনবে ঠিক তার চাহিদা মতো। এক্ষেত্রে যিনি ক্রেতা, তিনি আবার সময়শাসিত মানুষ, যেভাবে রুচি হবে সেভাবেই গিলবেন তিনি, তাতে যদি বদহজমও হয়, কোনো ক্ষতি নেই।
সরাসরি বলতে গেলে বলতে হয় আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রুচি-অভিরুচি, ন্যায়-অন্যায় কিংবা উচিত-অনুচিত কোনোটাই কিন্তু স্থায়ী কোনো আদর্শবাদী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। এগুলো সময়, প্রেক্ষাপট, গণচাহিদার রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে গায়ে রেশ নিয়ে আবর্তিত হতে থাকে। আর এরই ভিত্তিতে আমাদের সংস্কৃতির বাহনগুলোও (প্রচার মাধ্যম)গণচাহিদাকে মাথায় রেখে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করছে।
যদি নীতিবোধ, আদর্শ আর মূল্যবোধ সত্য হয়, সংস্কৃতির সত্যিকারের ধারক হয়, তবে স্রোতে গা ভাসিয়ে আর নয়। কারণ স্রোত কেবল ভাসাতেই জানে না, ডোবায়ও। তাও আবার বার দরিয়ায়।
আমাদের রুচি আর চাহিদার পরিবর্তনে প্রয়োজন হারাচ্ছে অনেক প্রয়োজনীয় বিষয়, গুরুত্ব কমছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুর। অদৃশ্য টান আমাদের বোধ নিয়ে টানাহেঁচড়া চালিয়ে মূল্যহীন করছে মূল্যবোধ। জাতি হিসেবে আমরা দেউলিয়া হচ্ছি আমাদেরই অনিয়ন্ত্রিত রুচি ও চাহিদার কারণেই।
সময়ের চোরাবালিতে আমাদের জাতিগত অভিরুচি অনেক ক্ষেত্রে এমন জায়গা পৌঁছে গেছে যে, আমরা নিজেরাই নিজেদের ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্যের ঘাতক হয়ে যাচ্ছি। কে খাবে না খাবে, কে গুরুত্ব দেবে না দেবে; এসব ভেবে প্রচার করছি না বা গুরুত্ব দিচ্ছি না অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে। আমাদের রুচির হাতে অর্থনীতির নাটাই ঘুরে ফিরে বলে প্রচার মাধ্যমগুলোও কতকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুরুত্বহীন জনপ্রিয় বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিতে বাধ্য হচ্ছে। বলা বাহুল্য, সব জনপ্রিয় জিনিসই জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। যেমন আমরা মাঝেই মাঝেই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির চেয়ে তাঁর ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছেন, তাকে চিনি এবং তাকেই জানতে চাই। আর আমাদের এই চাহিদা পূরণ প্রক্রিয়ায় কখনো কখনো আসল মানুষটা বা বিষয়টাই অলক্ষ্যে দৃষ্টিসীমার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
এ তো কেবল একটি উদাহরণ। এমন অসংখ্যক অপ্রিয় প্রসঙ্গ আমাদের প্রচার মাধ্যমের চাঞ্চল্যকর শিরোনামের নিচে ছোট অক্ষরে শোভা পাচ্ছে। যা কিছুর মূল্য প্রকৃত অর্থেই বেশি, তা গুণেমানে অসামান্যই থেকে যায়। কিন্তু আমাদের সর্বনাশা গতি-প্রকৃতি আমাদের কোনো বাস্তুহীন অতলে নিমজ্জিত করতে যাচ্ছে, তাও তো একবার ভেবে দেখা দরকার।
আমাদের রুচি বা মূল্যবোধের ওপর কারও দখল বা প্রভাব নেই, তাই আমরা কালো জলে গা ভাসাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু এই পরিবর্তনমুখী স্রোত আমাদের জাতিগত বোধ ও অভিরুচির জায়গাটিকে কোথায় নামিয়ে নিচ্ছে, তা ভাবার দায় কার? কে-ই বা রুচিহীনতার বিপরীতে গিয়ে সংস্কৃতির মূলধারাকে প্রবহমান রাখবে?
ভাবা প্রয়োজন, আমরা যা করছি, ভাবছি বা বহন করছি, তা কি আমাদের মানায়? শুনতে তো ভালো লাগে না প্রপিতামহের গেরস্থ বাড়ির শোরগোলের গল্পও। তাই বলে কি অস্তিত্ব ভোলা চলে! চলে না। যদি নীতিবোধ, আদর্শ আর মূল্যবোধ সত্য হয়, সংস্কৃতির সত্যিকারের ধারক হয়, তবে স্রোতে গা ভাসিয়ে আর নয়। কারণ স্রোত কেবল ভাসাতেই জানে না, ডোবায়ও। তাও আবার বার দরিয়ায়।
আরও পড়ুন : আমি তখন চোখ না ফোটা নিরীহ মানবশাবক ॥ শিমুল মাহমুদ