‘লেখক’ কথাটি উচ্চারণমাত্র চোখে ভেসে ওঠে সৃষ্টিশীল কল্যাণকামী মানুষের অবয়ব। যিনি যুগপৎ সুন্দর ও শান্তির স্বপ্নে তৎপর। অবশ্যই লেখক কতটুকু কল্যাণকামী হবেন, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। তবু, সমাজের নানা পদপদবি ও পরিচয়ের ভিড়ে লেখকের রয়েছে স্বতন্ত্র সম্মানের আসন। মহৎ লেখক নবসৃষ্টির উন্মাদনায় ক্রমশ অগ্রসর থাকেন। কেবল গতানুগতিক তাল-লয়-ছন্দে-আনন্দে তিনি পরিতৃপ্ত হতে পারেন না। জীবন ও জগতের বহুবর্ণিল রূপ-রস-গন্ধের অনুসন্ধানে মৌলিক লেখক নিজেকে নিযুক্ত রাখেন। অরূপরতনের খোঁজে উদয়াস্ত খুন করেন।
একজন লেখক কেন লেখেন? কখন, কোন পরিস্থিতিতে লিখতে শুরু করেন? লেখা কোনো দৈব ইশারা? না কি একান্তই ব্যক্তিমনের প্রেরণা ও প্রেষণার প্রকাশ। যুগযুগ ধরে এই জিজ্ঞাসা অব্যাহত থাকলেও সর্বসম্মত উত্তর পাওয়া যায়নি। কারণ লেখার সৃজনপ্রক্রিয়া মোটেও সহজ কোনো ব্যাপার নয়। কারও কাছে লেখা দৈবপ্রকাশ। অর্থাৎ অদৃশ্য কেউ লেখকের মনে লেখার অধরা আনন্দের ভার বইয়ে দেন। সেটাই তিনি প্রকাশ করেন। কেউ আবার এই অনুপ্রেরণায় বিশ্বাসী নন। ফলে ব্যক্তিভেদে লেখা সৃষ্টির প্রক্রিয়াও আলাদা। লেখার সৃজনবেদন আলাদা হলেও প্রকাশের স্বাধীনতা ও চ্যালেঞ্জ প্রায় এক।
মুহূর্তের ভাবালুতায় সৃষ্ট লেখা বুদ্বুদের মতোই সাময়িক, ক্ষণস্থায়ী। ফলে লেখা শেষ হওয়ামাত্র প্রকাশে উদগ্রীব হয়ে ওঠা মোটেও সমীচীন নয়।
লেখক স্বাধীনভাবে যেকোনো প্রসঙ্গ নিয়ে লিখতে পারেন। জাগতিক কিংবা পারলৌকিক, বিজ্ঞান কিংবা কল্পনা, ধর্ম কিংবা দর্শন ইত্যাদি অনায়াসে তার লেখার বিষয় হতে পারে। এই নিরিখে বলা যায় লেখক স্বাধীন। কিন্তু তার লেখাটি শিল্পমণ্ডিত হয়েছে কি না, এমন বিবেচনায় অবতীর্ণ হলে লেখক নিজেই অদৃশ্য এক শেকলে জড়িয়ে পড়েন। পরাধীনতা মেনে নিয়ে নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। মোটাদাগে লেখক গুরুত্বপূর্ণ দুটি দায়বদ্ধতা অনুভব করেন।
প্রকরণ পরিচর্যা
প্রকরণ পরিচর্যার ক্ষেত্রে একজন মহৎ লেখক সদা সচেষ্ট থাকেন। তিনি জানেন, লেখায় নিজস্ব স্বর আবিষ্কারে ব্যর্থ হলে লেখক হিসেবে তার ব্যর্থতাও অনিবার্য হয়ে ওঠে। একজন মহৎ লেখক যখন যা মনে আসে, তা হুবহু লিখে ফেলার পক্ষপাতী নন। উদ্দিষ্ট বক্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি উপযুক্ত আঙ্গিকের আরাধনা করেন। শিল্পের অঙ্গীকার মেনে নিয়ে তবেই লেখায় অবতীর্ণ হন। মুহূর্তের ভাবালুতায় সৃষ্ট লেখা বুদ্বুদের মতোই সাময়িক, ক্ষণস্থায়ী। ফলে লেখা শেষ হওয়ামাত্র প্রকাশে উদগ্রীব হয়ে ওঠা মোটেও সমীচীন নয়।
সময় ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা
একজন লেখক যে কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে পারেন। এই ক্ষেত্রে তিনি স্বাধীন বটে। তবে তার লেখা মানুষ ও মানবতার জন্যে কতটা হিতকর। এরকম দায়বদ্ধতার প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ বৈকি। লেখায় যদি মানবজীবন সম্পর্কিত বিচিত্র বিষয়ের শিল্পিত উৎসার না থাকে। তবে সে লেখা অন্তঃসারশূন্যতার অভিযোগে গন্তব্যহীনতায় পর্যবসিত হয়। ফলে মহৎ লেখকের জন্যে এটাও একধরনের চ্যালেঞ্জ। সময় ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে লিখতে গেলে লেখক নিজেই কিছু প্রত্যক্ষ বাধার সম্মুখীন হন। ফলে সমাজ-রাষ্ট্র, ধর্ম-বিজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে সঠিক প্রতিবাদ করাও লেখকের জন্যে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনীতি নিয়ে কথা বললেও বিপদ। ধর্ম নিয়ে কথা বললেও সন্দেহজনক।
অন্তর্গত বোধের বহিঃপ্রকাশ নানা আঙ্গিকে হতে পারে। ব্যক্তিমনের ভাব-সরোবরে যখন প্রকাশের তাড়না তৈরি হয়। তখনই মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কবি লেখেন কবিতা, চিত্রশিল্পী আঁকেন ছবি। সুরকার মেতে ওঠেন সুরসাধনায়। গল্পকার ও ঔপন্যাসিক কাহিনীর বৃত্তে বন্দি করেন জীবনের নানা রঙবাহার। এভাবে অভিনয়, নৃত্য-গীত কিংবা প্রবন্ধে দেখা দেয় শিল্পিত প্রকাশ। মাধ্যম আলাদা হলেও শিল্পীর মানসলোকের গঠন প্রায় নিকটবর্তী। সবাই অনুভূতি ও উপলব্ধির প্রকাশ করেন।
যখন যে কথা যেভাবে মনে আসে, সে কথা অনুরূপ লিখে পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে উদগ্রীব হয়ে ওঠা মোটেও সমীচীন নয়। লেখার স্বাধীনতা থাকলেও এই ক্ষেত্রে লেখককে নির্মোহ সংযম পালন করতে হয়।
লেখা প্রকাশে সংযমী হওয়া লেখকের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। লেখা শেষ হওয়ামাত্র আত্মপ্রকাশের মোহ সব লেখকের মধ্যেই থাকে। অন্যের মনে নতুন সৃষ্টির অনুভব ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষে লেখক যেন অস্থির হয়ে ওঠেন। প্রকাশের আনন্দ পেতে তড়পাতে থাকেন ভেতরে ভেতরে। সবাইকে জানাতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। তর সইতে না পেরে একপর্যায়ে লেখা প্রকাশও হয়। কিন্তু লেখা প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই চোখে পড়ে ভাব ও ভাষাগত অসঙ্গতি। পাঠকের চোখে তো বটে, স্বয়ং লেখক সেসব অসঙ্গতি দেখে বিব্রত বোধ করেন। ফলে দেখা যায়, অনেক নামি-দামি লেখকও নিজের প্রকাশিত লেখা সংশোধন করেন। কখনওবা পূর্বে প্রকাশিত লেখা দুর্বল বিবেচনায় খারিজ করে দিতে দ্বিধা করেন না।
বিশেষ করে তরুণ লেখকদের ক্ষেত্রে দ্রুত লেখা প্রকাশের প্রবণতা বেশি ক্ষতিকর। দীর্ঘদিন লেখালেখিতে আছেন এমন অভিজ্ঞ প্রবীণ লেখক স্বতন্ত্র প্রকরণ ও ভাষাভঙ্গি রপ্ত করা সাপেক্ষে এই অসঙ্গতি থেকে কিছুটা রেহাই পেতে পারেন। তবে তরুণ লেখকের বেলায় এটা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। লেখা প্রকাশের আগে পাণ্ডুলিপি অবশ্যই কয়েকবার সম্পাদনা করা জরুরি। এই সম্পাদনা লেখক নিজেও করতে পারেন। অথবা অভিজ্ঞ কোনো সম্পাদকের মাধ্যমে করা যেতে পারে। লেখা যেহেতু ভাষা-নির্ভর শিল্প। সেহেতু ভাষা সম্পর্কে দক্ষ না হলে বানান-বিভ্রাট, বাক্যের গঠন, শব্দের যথার্থ প্রয়োগ, আলঙ্কারিক অসঙ্গতি লেখকের জন্যে লজ্জার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
একটি লেখা শৈল্পিক হয়ে ওঠার নেপথ্যে শিল্পের সুনির্দিষ্ট কাঠামো বিবেচনায় নেওয়া হয়। নবীন লেখক শুরুর দিকে শিল্পসচেতন না হয়েই লেখার জগতে প্রবেশ করেন। এটা মোটেও দোষের নয়। তবে ক্রমশ তাকে শিল্পসচেতন হয়ে ওঠা জরুরি। শিল্পের নানামাধ্যমে আঙ্গিকগত স্বাতন্ত্র্য ও শিল্পসৌন্দর্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থেকে অগ্রসর হওয়া সচেতন লেখলের দায়বদ্ধতার অংশ। সমকালীন দেশি-বিদেশি শিল্পপ্রবণতা ও সাহিত্য-আন্দোলন সম্পর্কেও ধারণা রাখতে হবে। তবেই সাহিত্য আধুনিক ও আন্তর্জাতিক স্রোতে প্রবাহিত হবে।
সদ্য লিখিত হয়েছে এমন লেখা পত্রিকায় প্রকাশের আগে বারবার সংশোধন ও সম্পাদনা করে নেওয়া উচিত। গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রেও এরকম বেশকিছু ধাপ অতিক্রম করতে হয়। ভুল বানানে কিংবা ভুল বাক্যে লেখা বই পাঠকের হাতে তুলে দিয়ে আদতে লেখক নিজেই লজ্জিত হওয়ার পথ তৈরি করে দেন। লেখা কম্পোজ, পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা, বানান সম্পাদনা, প্রয়োজন বোধে প্রাসঙ্গিক ভূমিকা, বইয়ের সার-সংক্ষেপ, লেখকপরিচিত, বইয়ের মেক-আপ, প্রাসঙ্গিক ও দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ, ছাপাখানা ও বই-বাইন্ডিংসহ নানামাত্রিক কাজ বই প্রকাশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এসব বিষয়ে প্রকাশকের পাশাপাশি লেখক নিজেও সচেতন হবেন বৈকি।
মহৎ লেখক বিষয় ও প্রাকরণিক পরিচর্যা না করে লেখা প্রকাশে উৎসাহ বোধ করেন না। লেখা যখন শিল্প, তখন অসম্পাদিত লেখা প্রকাশে শিল্পমান ক্ষুণ্ন হয়। একজন প্রুফ রিডারের সহযোগিতায় বানানগত সমস্যা থাকলে সমাধান করা সম্ভব। ভাষা ও শিল্পের কলাকৌশল সম্পর্কে অভিজ্ঞ লেখক-সম্পাদকের মাধ্যমে পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করা যেতে পারে। সর্বোপরি, যখন যে কথা যেভাবে মনে আসে, সে কথা অনুরূপ লিখে পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে উদগ্রীব হয়ে ওঠা মোটেও সমীচীন নয়। লেখার স্বাধীনতা থাকলেও এই ক্ষেত্রে লেখককে নির্মোহ সংযম পালন করতে হয়।