সামাজিক প্রেক্ষাপট ও বিশ্বের ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনশীলতার মধ্যে দিয়ে কবিতার বিষয়, বক্তব্যধারা নিয়ত পাল্টে যাচ্ছে। আর এ পরিবর্তন-পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে বলা যেতে পারে, সময়-নিয়ন্ত্রিত কবিরা। ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’—সময়কে পেছনে ফেলে (বর্তমান যে চিন্তা-চেতনা-ধারণ লালন করছে) তাদেরই কেউ কেউ এগিয়ে যান আপন চিন্তা-চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে। হতে পারে বর্তমান যে চিন্তা চেতনা লালন করছে, ধারণ করছে, তা থেকে এই স্বতন্ত্র বোধ অগ্রসর অথবা অনগ্রসর বলে প্রতিয়মান হতে পারে সর্বসাধারণ্যে। তবু এই স্বাতন্ত্র্য সচেতনারই প্রয়াস।
ষাট, নিজস্ব বৈশিষ্ট্যেও কবিতার ঔজ্জ্বলতা দিয়ে ষাটের দশক বাংলা কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেকটা পথ। মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরে আধুনিকতার জগতে প্রবেশের পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বাংলা কবিতাকে। দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা-জীবন যাত্রার পরিবর্তন, সামাজিক প্রেক্ষাপট প্রভাব ফেলেছে ষাটের কবিদের ওপরে। নিয়ত এগিয়ে যাওয়ার পথে ষাটের তুমুল সংক্ষুব্ধ সময়ে স্বাতন্ত্র্য দিয়ে, কাব্য ভাষা দিয়ে, শিল্পীত আঙ্গিকে উপস্থাপন করে নিজেকে প্রতিষ্ঠার পথে, বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায় ইমারত গড়েছে অনেকে।
সমুদ্র গুপ্ত তাদেরই একজন। আপদমস্তক কবি। রাজনীতি সচেতন কবি সমুদ্র গুপ্ত— আপাতদৃশ্যমান বিষয়বস্তুর আবেগপ্রসূত নির্মাণই তার কাব্য। তার কবিতাগুলোয় এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে রয়েছে:
রাস্তার মধ্যিখানে শুয়ে আছে নির্বিকার একটি কুকুর
গাড়ী ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে এদিক ওদিক
পাশকেটে কুকুরের মাথার, ছায়ার
প্রাণহীন কুকুরের হৃদপিণ্ড কুঁকড়ে গেছে
খামছে ধরে রাজপথ কোঠাবাড়ী নাগরিক বিশাল বহর
বড়লোক গাড়ীর নীচে চাপা পড়ে মানুষ আর
মানুষের সরল জীবন-এটাই নিয়ম, অথচ
কি তাজ্জব! সমস্ত বিত্তশালী গাড়ী ঘোড়া
সতর্ক স্টিয়ারিংয়ে পাশ কাটছে
শুয়ে থাকা কুকুরের লাশ
যেন, এই লাশটাকে বাঁচাতেই হবে
পৃথিবীর রাজপথে চিৎপাত শুয়ে থাকা
এরকম কুকুরের লাশ যেন বাংলাদেশ
আসলে তো, বাংলাদেশ মানেই হলো
জীবনের মুখোমুখি বুলেটের অসভ্য চিৎকার
শোকচিহ্ন কালোব্যাজে পৃথিবীর শহীদ মিনার
(কুকুর: রোদ ঝলসানো মুখ)
তিনি যে চিন্তা চেতনা লালন-ধারণ করেন তাঁর সেই অন্তরভাবনার প্রকাশ ঘটেছে রোদ ঝলসানো মুখ কাব্যগ্রন্থে:
আমার স্বপ্নের সেই সোনালী বৃদ্ধকে আমি
অভিবাদন জানাবো
যিনি আমাকে তাঁর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে
দিন দিন শিক্ষিত করে তোলেন, যিনি
তাঁর কোঁচকানো চামড়ার ভাজ
একটি একটি করে খোলেন, আর
আমাকে দেখান মানুষের কব্জির যাবতীয় কাজ ও কারুকাজ
তিনি দেখান আর বলেন কোমল স্বরে
শ্রেণীযুদ্ধের ইতিহাসই মানুষের ইতিহাস।
(তোমার স্বপ্নের সেই সোনালী বৃদ্ধ: রোদ ঝলসানো মুখ)
শ্রেণীযুদ্ধের ইতিহাসে যারা এগিয়ে যায় বিজয়ের দীপ্ত পদভারে ক্রমাগত সামনে, তাদের বিজয় গাঁথার অনিবার্যতা ঘোষিত হয় কাব্যিকতায়:
ধুপ ধাপ করে কারা যেন
সারাটা বিল্ডিং কাঁপিয়ে হাঁটে
সম্ভবত মিছিলে অভ্যস্ত পা
তাই আস্তে হাঁটতে পারে না
ধুপ ধাপ করে কারা যেন
সারাটা দেশ কাঁপিয়ে হাঁটে
স্বাধীনতার যুদ্ধমন্ত্রে ফুল থ্রো করা হৃদয়
তাই এমন আত্মবিশ্বাস, যেন
অনিবার্য তাদেরই বিজয়।
(শব্দশুনি তাদের যারা আসে পায়ে পায়ে)
তারুণ্য যৌবনের প্রতীক-যৌবন, বিদ্রোহের। যৌবন—শৃঙ্খল মুক্তির। এই মুক্তি বোধের, বুদ্ধির, অর্থনীতির। মুক্তি বোধের তীব্র রাজনীতি সচেতন কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করি:
ছ্যামড়ার মক্কর দেইখ্যা বাঁচি না
কথা শুনলে মাথা চক্কও দিয়া ওঠে
আরে ব্যাক্কল
মানুষ জন্মালেই যেমন মানুষ হয় না
তার তয়তদবির লাগে
চেষ্টা চরিত্র আদর যত্ন শাসন শিক্ষা সবকিছু লাগে
তোগো ভাবসাব দেখলি তো মনে হয়
মায়ের প্যাটত থেইক্যাই ডাঙ্গার হয়া বারাইছিস
কথাবার্তা তো কস যেমনু
যাত্রার সেনাপতির মতোন এটেনশন. . .
এহ্
উনি বিঘাপতি ৪০ মণ ধান জন্মাইবেন
শোন শোন
তেত্রিশ ডেসিমলে এক বিঘা
যে দিনকাল
তুই বিঘায় ৩৩ ছটাক ধানও জন্মাইতে পারবিনা
তোক হাল দিলাম জমি দিলাম ধানের বেছন দিলাম
যাহ্ কামলার দামও দিমু. . .
ছালুনে যেমন
হলুদ মরিচ তেল সব দিলা এক নম্বর
খালি লবন দিলানা
ঐ ছালুন মুখে উঠবো? উঠবো না
আছাড় দিয়া ছালুনের পাতিল ভাংবা. . .
ঘটনা একই রকম
সরকার তো সার দিবো না
কেমুন মরদ হইছোস
ভাং দেহি আছাড় দিয়া
সরকারের তরকারির পাতিল.. .
(চ্যালেঞ্জ: এখনো উত্থান আছে)
বহির্বৃত্ত দৃষ্টিভঙ্গির বস্তুগত যে কাজ—উপকরণ কবি সমুদ্র গুপ্ত উপস্থাপন করেছেন, তাঁর কাব্যসত্তায় তা এই আবহমানকালের বাংলা, চিরচেনা শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষ। তাই চিরচেনা উদ্বাস্তু কিশোর জীবনের গভীর দর্শন লালন করে বলতে পারেন তাঁর কাব্যে:
ছোট এক ফাটা ছেঁড়া তালিমারা বস্তা কাঁধে নিয়ে
তারো চেয়ে ছোট্ট এক নগ্নপ্রায় টোকাই
চণ্ড দুপুর বেলা ঝকমকে পথে
সামান্য সামনে ঝুঁকে হাঁটছে
আমি জিজ্ঞেস করলাম তাচ্ছিল্যের সুরে
হেই ছোঁড়া
এরকম ঝকঝকে রাজপথে কি কুড়াচ্ছিস তুই
হাওয়া লাগা ফুলের মতো
ঘাড়টা দুলিয়ে সে জবাব দিলো
যুদ্ধ কুড়াই
যুদ্ধ কুড়িয়ে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসি ওই দুরে
(টোকাই: চোখে চোখ রেখে)
সমাজ ও রাজনীতি সচেতনায় চাপা পড়ে যায় সমুদ্র গুপ্তের প্রেমিক সত্ত্বা। তিনি যে সমাজ, মানুষ, চিন্তা চেতনাকে ধারণ করেন অন্তুরে, সেই বোধে মধ্যবিত্তের কঠিন বাস্তবতায় প্রেমিকার লাল গালে বসা মাছিকে তিল ভেবে বিভ্রান্ত হন। তাই তিনি বলেন:
কারুকার্যময় আলমারির ভিতরে রাখা
সুন্দর পুতুল দেখে হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়ে
আলমারির কাঁচ ভেঙে ফেলেছিলাম
পুতুলের কাছ থেকে ফিরে এসেছিলো রক্তাক্ত ক্ষুব্ধ আঙুল…
যৌবনে
চমৎকার তিল দেখে
হাত দিয়ে ছুঁতে যেতেই
তোমার লাল গাল থেকে
উড়ে গেল মাছি . . .
এখন তো
চর্তুদিকে দেখতে শুনতে
চলতে ফিরতে শুধু বিভ্রান্ত হই. . .
ভেজা ঠোঁট দেখে যখন ভাবি
চুম্বনের এই বুঝি উৎকৃষ্ট সময়
ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিয়ে যেতেই দেখি
ঘৃণা যেন জমাট চাঁচের মতো
কঠিন জমেছে
(বিভ্রম: স্বপ্নমঙ্গল কাব্য)
সমকাল, সমকালীন বিষয় এবং আপাত দৃশ্যমান উপাদানই সমুদ্র গুপ্ত’র কাব্য বিষয়। মনোজগতের অন্তুর্গত কোন দ্বান্দ্বিক চিত্র তিনি নির্মাণ করেন নি। আবেগতাড়িত এই উদগীরণ সর্বদাই শিল্পসম্মত হয়ে ধরা দিয়েছে এটা বলা যাবে না। তবে সমকালীন বিষয়কে ধারণ করে যে শিল্পময় প্রয়াস তাই কবি সমুদ্র গুপ্তকে করেছে পাঠকনন্দিত। শিল্পের যে নিজস্ব একটা ভাষা আছে যা সংজ্ঞায়িত করা সম্ভবপর না হলেও হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব। সেই ভাষার রহস্যময়তা ধরা দিয়েছে তাঁর হাতে। মানবতাবাদের উপলব্ধি তাঁর কাব্যশরীর ধারণ করে আছে তাতেই তাঁর সার্থকতা।
কাজেই আলো আঁধারের অস্পষ্টতা থেকে সরিয়ে সমুদ্র গুপ্তের কবিতা বরাবরই বক্তব্য প্রধান এবং স্পষ্ট। ষাটের কবিতার বিভিন্ন আঙ্গিকের মধ্যে তাঁর একমুখী প্রতিবাদমুখর পঙ্ক্তিই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে পাঠকের কাছে। ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের চিরাচরিত অপূর্ণতা থেকে বলেন:
রাবনের যদি দশটা মাথা না থেকে
আর দুইখানা হাত বেশী থাকতো
কুটিলতা পরাশক্তির সমাবেশ এবং
স্বজনের বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও
নিশ্চিত রাবণেরই জয় হতো. . .
আমারো যদি আর দুটি হাত বেশী থাকতো
আমি নিশ্চয়
খাদ্য সংগ্রহ এবং লড়াই ছাড়া
কবিতা লেখা এবং পাট করে চুল আঁচড়ানোর কাজে
অতিরিক্ত হাত দুটি ব্যবহার করতে পারতাম. . .
কিন্তু এখন
খাদ্য উপার্জন এবং লড়াইকে পাশ কাটিয়ে
একমাত্র হাত জোড়াকে
শিল্পচর্চায় লাগানো ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়েছে।
(৮০ দশকের কবিতা: চোখে চোখে)
ব্যক্তিগত বাস্তবতার এই বিভেদ সত্ত্বেও সমুদ্র গুপ্ত জীবনকে ধারণ করেছেন শিল্পে। আপাত বিচ্ছিন্নতার মাঝেও তিনি এক আবেগায়িত চিত্র নির্মাণ করতে পেরেছেন। এখানেই সার্থকতা কবির-কাব্যের-শিল্পের।