ঠিক কবে থেকে সাহিত্যের সঙ্গে প্রেম শুরু হয় মানুষের? কবে থেকে শুরু হয় তার সঙ্গে গভীর প্রণয়? সেই মাতৃগর্ভ থেকেই সম্ভবত। এমন অভাগা কি কেউ আছে যে মাতৃগর্ভে থাকতেই অন্তত দুচারটি ছড়া/লোককথা শোনেনি? শোনেনি কোনো ঘুমপাড়ানি গান? নিদেনপক্ষে জন্মের পর মায়ের কোলে শুয়ে, দাদি, নানি বা তেমন কোনো নিকটজনের কণ্ঠলগ্ন হয়ে শোনেনি সুর আর ছন্দের মনভুলানো কথামালা, রূপকথার গল্প? সে-ও তো সাহিত্যেরই অমূল্য এক অঙ্গ। তার প্রতি প্রেম কি জন্মে না সবারই? বাঁধে না কি নিবিড়, নীরব গাঁটছড়া? জন্মে বৈকি, বাঁধে! তবু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যত বাড়ে জীবনের প্রতি দায়, দেনা, জীবন থেকে উৎসারিত বিষ যত ভারাক্রান্ত করে মানুষের মন, তত ফিকে হয়ে আসে সাহিত্যের প্রতি তার প্রেম, তত ম্লান হয়ে আসে শিল্পের সঙ্গে তার প্রণয় প্রগাঢ়তা, তত আলগা হয়ে আসে বাঁধন। সেখানে মিশে যায় জীবনের বিষ, প্রাত্যহিকতার তীব্র জরা। তাতে বেড়ে যায় জীবনের সঙ্গে সাহিত্যের দূরত্ব, কমে আসে শিল্পের সঙ্গে নৈকট্যের নিবিড়তা। কিন্তু কারো কারো উল্টোটাও হয় আবার। জীবনের প্রতি তাদের বৈরাগ্য আসে, আসে বিতৃষ্ণা। জীবনকে জুয়াজ্ঞান করে তারা মেতে ওঠেন সাহিত্য সাধনায়, শিল্প আরাধনায়। তারা বিরলপ্রজ। তারা শিল্পী, কবি, লেখক, ভাস্কর, চিত্রকর কিংবা আরো আরো অভিধায় অভিষিক্ত হন। তারা যুক্তি নয়, আবেগ নিয়ে চলেন। সাধারণেরা যাদের এককথায় বলে বসেন, পাগল। সাহিত্যের প্রতি এই প্রেম, এই প্রণয় ব্যাকুলতাকে কি শিল্পবোধ বলা যায়? বলা যায় সাহিত্যবোধ? না কি সেটা অন্য কিছু? সে প্রশ্নের উত্তর বোদ্ধাজনেরা দেবেন নিশ্চয়! ধান ভানতে শীবের গীত এবার থাক বরং। মূল প্রসঙ্গে আসি।
মেজভাই বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। হঠাৎ একদিন তার পড়ার টেবিলে বেশ মোটাসোটা একটা বই আবিষ্কার করলাম, প্রচ্ছদটা রঙচঙা, নজরকাড়া, ঝকঝকে মলাট। ততদিনে শরৎ, বিভূতি, বঙ্কিম, নিহাররঞ্জন, ফাল্গুনী, মানিকসহ বাংলাসাহিত্যের রথি-মহারথিদের সঙ্গে কিঞ্চিৎ চেনা-পরিচয় শেষে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গেও ঘটতে শুরু করেছে হৃদয়ের লেনদেন। ভালো-মন্দ চেনার বয়স তখন নয়, পড়ার নেশায় তখন পুরোপুরি বুঁদ, সামনে যা পড়ছে গিলছি গোগ্রাসে। সেই নেশা থেকেই শুরু করলাম পড়া। নাওয়া-খাওয়া ভুলে দম বন্ধ করে পড়েছি ‘আট কুঠুরি নয় দরজা’। লেখক সমরেশ মজুমদারের লেখার সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয় আমার, প্রথম প্রেম। সেই বয়সে অল্পতেই মুগ্ধ হওয়ার সারল্য ছিল, সবারই থাকে সম্ভবত। সমরেশও আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন। তারপর একে একে পড়ে গেছি উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, মৌষলকাল, গর্ভধারিণী, সাতকাহন, আরো আরো আরো, যখন যা হাতের কাছে পেয়েছি পড়েছি গোগ্রাসে। গর্ভধারিণীর শেষটা ভালো লাগেনি, এখানে জয়িতাকে সমরেশ শেষ পর্যন্ত পুরুষতন্ত্রের কাছে বলি দিয়েছেন বলে মনে হয়েছে আমার, যা সমাজে একটি নেতিবাচক বার্তা ছড়াতে যথেষ্ট। সমরেশের যত লেখা পড়েছি এ পর্যন্ত তার মধ্যে আমাকে সবচে মুগ্ধ করেছিল ‘সাতকাহন’।
বলতে দ্বিধা নেই, আমার সে মুগ্ধতা কাটেনি আজও। সেজন্য যদি সাহিত্যের ধ্বজাধারীদের থেকে সাহিত্যবোধহীনতার খেতাব জোটে, তাতে সামান্যতম শোচনাও করব না কখনো। সাতকাহনের দীপাবলি আমাকে নতুন করে জীবনকে চিনতে শিখিয়েছিল সেই বয়সে। যখন শরৎ আমাকে শিখিয়েছেন পতিব্রতা স্ত্রী হতে, প্রেমের অমর উদাহরণ হয়ে অত্যাচারী, নিপীড়ক প্রেমিকের জন্য একমুখী প্রেমে অধীর হতে, তখন সমরেশ যেন আমার চোখে হাজির হলেন নতুনতর এক বার্তা নিয়ে। তখন সেটা নতুনই মনে হয়েছিল বটে! প্রথা ভেঙে ঋজু হতে, অসহায়ত্ব ছুড়ে দিয়ে সাহসী হতে শিখেছি তখন দীপাবলির হাত ধরে। দীপাবলির সঙ্গে পায়ে পায়ে হেঁটেছি শিলিগুড়ির চা বাগান, বন-জঙ্গল, জলপাইগুড়ির পথঘাট, ক্রমশ কলকাতা হয়ে ভারতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। এই ভ্রমণ আমাকে ক্লান্ত করেনি কখনো, করেছে সাহসী, দৃঢ়। গতানুগতিকতাকে প্রবল উপেক্ষায় পাশ কাটিয়ে, পুরুষতান্ত্রিকতার প্রচল প্রথাকে তুমুল অবজ্ঞায় পায়ে মাড়িয়ে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার যে সাধনা, দীপাবলি একা নয়, তার সঙ্গে সে সাধনায় নিবিড় একাগ্রতায় অংশ নিয়েছি আমিও, নিয়েছে আমার মতন আরো অগণিত পাঠক। তাতে তাদের মানসিক পঙ্গুত্ব টুটেছে বহুলাংশে, চিন্তায়, চেতনায়, তারা হতে শিখেছে পরিপূর্ণ একেকজন মানুষ, মানসিক গঠনে যারা হয়েছে দৃঢ়, আত্মপ্রত্যয়ী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেখানে নারীদের মানসিক পঙ্গুত্বকে জিইয়ে রাখতে প্রতি পদে জাল বুনতে তৎপর, শরৎচন্দ্রীয় একমুখী প্রেমের আদর্শ প্রতিমা বানিয়ে পূজার ছলে সনাতনী প্রথার চিতায় তুলতে খড়্গহস্ত, দীপাবলি সেখানে, সেই সমাজের মুখে এক মোক্ষম চপেটাঘাত, এক দুঃসাহসী প্রতিবাদ। সাতকাহন তাই সংস্কারমুক্ত, প্রথাবিরোধী মানুষের মনে বেঁচে থাকবে বহুকাল, তথাকথিত সাহিত্যবাদ্ধাদের চণ্ড চোখরাঙানিকে তুচ্ছ করে এ সমাজে জন্ম দেবে আরো বহু দীপাবলির, যার উজ্জ্বল আলোয় একদিন ছানি কাটিয়ে স্পষ্ট পথ দেখবে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন, পক্ষাঘাতগ্রস্ত সমাজ।
ভারতের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নকশাল আন্দোলন। নকশালপন্থী একদল তরুণ বিপ্লবী সমাজের আরামপ্রিয়, ভোগবাদী মধ্যবিত্তের শ্রেণিচেতনায় এবং বোধে নাড়া দেয়ার মাধ্যমে নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখেছিল, সমাজ বদলে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে নেমেছিল পথে। তাদের সে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়েছিল অচিরেই, অনিমেষের মত অনেকের জীবনেই তাতে নেমে এসেছিল অন্ধকার। এই নকশাল আন্দোলন এবং তার ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে সমরেশের উত্তরাধিকার ট্রিলজি অসামান্য ভূমিকা রাখে পাঠকের কাছে।
আঙরাভাসা নদী, খুঁটিমারির জঙ্গল, স্বর্গছেঁড়া চা বাগান, ডুয়ার্সের চা বাগান, জলপাইগুড়ির প্রকৃতি সমরেশ এত মমতায় এঁকেছেন যে, পাঠক সেখানে নিজেকেই দেখতে পায় অনিমেষের ছায়ার আড়ালে, নিজেকেই কল্পনা করে নেয় মাধবীলতার প্রতিচ্ছবির অন্তরালে। সমরেশকে যারা পড়েছেন, তাদের কাছে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি তথা ভারতের প্রত্যন্ত যেসব অঞ্চল উঠে এসেছে তার লেখায়, সেসব অঞ্চল মোটেই অপরিচিত নয়। বরং তাদের মনে এসব অঞ্চলের প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি জন্মেছে প্রগাঢ় প্রেম, গভীর ভালোবাসা। একজন লেখকের জন্য এটাও কি কম প্রাপ্তি একজীবনে?
সমরেশ বিদায় নিয়েছেন। জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন সমরেশ। সমালোচকদের জন্য রেখে গেছেন তার বিপুল শব্দভাণ্ডার আর অখণ্ড অবসর। তারা সমালোচনা করবেন, সমরেশ ছোট না কি বড় লেখক, তার পাঠকদের সাহিত্যবোধ আছে কি নেই, সে নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলবেন, ফেসবুক গরম করবেন, তাতে সমরেশের কিছুই আসবে যাবে না, তার লেখার প্রতি, তার প্রতি পাঠকের প্রেম তাতে একটুও কমবে না। সমরেশ বেঁচে থাকবেন তার লেখায়, অগুণতি পাঠকের ভালোবাসায়।