সিন্ডিকেট শব্দ থেকে সিন্ডিকেশনের উৎপত্তি। সিন্ডিকেট শব্দটির উৎপত্তি ১৬২৪ সালে। যা দ্বারা মূলত কোনো কাউন্সিল বা প্রতিনিধিদের গোষ্ঠী বলতে বোঝানো হতো। এর উৎপত্তি হয়েছিলো ফরাসি শব্দ ‘syndicat’ থেকে। ফরাসি শব্দ ‘syndicat’ এর আবার উৎপত্তি হয়েছিলো ল্যাটিন শব্দ ‘syndic’ থেকে । যার অর্থ ছিলো- ‘কোন ব্যক্তি বা কোম্পানির সমষ্টি যারা ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতো’। syndicate শব্দটি প্রথম ব্যবহার হয় ১৮৬৫ সালে প্রকাশকদের গোষ্ঠী বোঝাতে। শব্দটি বিশেষ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয় আবার কখনো ক্রিয়া হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বিশেষ্য হিসেবে- The local furniture store is individually owned, but is part of a buying syndicate. ক্রিয়া হিসেবে- Her column is syndicated in 120 papers. এতদিন বিভিন্ন ধরনের সিন্ডিকেট (যেমন- Crime syndicates, Media syndicates, Finance syndicates, Lottery syndicate ইত্যাদি) সম্পর্কে জানা গেলেও সম্প্রতি ‘সাহিত্যে সিন্ডিকেট’ বলেও একটি কথা প্রচলিত হচ্ছে।
সাহিত্যে সিন্ডিকেশন নিয়েও ‘নানা মুনির নানা মত’ রয়েছে। কোন মত গ্রহণযোগ্য; কোন মত গ্রহণযোগ্য নয়- তার বিচারের ভার পাঠকের। তবে সমকালীন সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে বলতে গেলে আমি প্রথমেই বলব, এখন হতাশার কাল যাচ্ছে। নেই কোনো পরিবর্তন, গতানুগতিকতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে সৃষ্টিকর্ম। কবিতায় চরম আকাল যাচ্ছে বলতে দ্বিধা নেই। গত কয়েক মাসে রফিক আজাদ, শহীদ কাদরী ও সৈয়দ শামসুল হক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, মুহম্মাদ নূরুল হুদারা চলে গেলে হাল ধরার মতো তেমন কবির আগমন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
কেন সৃষ্টি হচ্ছে না নতুন কোনো বিস্ময়? কোথায় এসে আটকে আছে সাহিত্যজগৎ। গ্রহণের কাল কাটিয়ে ওঠার উপায় কী? কবিতা ছাড়াও গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধে একই অবস্থা বিরাজ করছে। জ্ঞানগর্ভ আলোচনার পরিবর্তে এখন চাটুকারিতার সংস্কৃতি চলছে। কালোত্তীর্ণ কবিতা, গল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধ পাঠকের হাতে কবে পৌঁছবে?
এত হতাশার কারণ কী? সাহিত্যচর্চার আবহমানতা কোন বাঁধে আটকে আছে? কেউ কেউ দায়ী করছেন পড়াশোনার প্রতি অনীহাকে। সমকালীন কবি বা লেখক দাবিদাররা পড়াশোনার বেলায় আগ্রহী নন। অনেকেই গোষ্ঠীভিত্তিক সাহিত্যচর্চাকে দায়ী করেন। কেউ কেউ সিন্ডিকেট চর্চাকে বেশি দোষারোপ করছেন।
তবে শক্তিশালী কারণ হচ্ছে- সাহিত্যের এমন দুর্দশার জন্য মূলত সিন্ডিকেশনই দায়ী। সাহিত্যচর্চায় ইদানিংকালে তেলবাজদের দৌরাত্ম্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে প্রকৃত সাহিত্যসেবীরা রয়ে যাচ্ছেন উপেক্ষিত। এর মধ্যে ব্যক্তি প্রভাব, দলীয় প্রভাব এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও প্রকট হচ্ছে।
দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা, ছোটকাগজ, সংকলন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেন্দ্রিক পেজ বা গ্রুপ, নামসর্বস্ব সাহিত্য সংগঠন আজকের সিন্ডিকেটের মূল হাতিয়ার। এ ধরনের সিন্ডিকেট সভায় সাহিত্যচর্চার পরিবর্তে পরচর্চা বা তেলবাজির উপাদান বেশি পরিলক্ষিত হয়।
গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে প্রকৃত সাহিত্যকর্মীর কুৎসা রটিয়ে নিজের দল বা গোষ্ঠী ভারী করতে বদ্ধপরিকর এক শ্রেণির সাহিত্যকর্মী। তারা নিজের লেখার মান সম্পর্কে তো জানেনই না বরং অন্যের লেখার মান নিয়ে হয়তো তেলবাচক প্রশংসা কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে দুর্নাম করেন। এমন একটা ভাব করেন যে, তিনি যেন সবজান্তা।
যারা সিন্ডিকেশনের পূজারি, তারা কেবল নিজ দলের লেখকদেরই প্রশংসা ও প্রচার করেন। সমকালীন যে আরও লেখক আছে, তা তাদের তৎপরতা থেকে বোঝার বা জানার কোনো উপায় নেই।
এছাড়া সিন্ডিকেশন ব্যাপকতা লাভ করেছে ভার্চুয়াল জগতেও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে নামসর্বস্ব কিছু সংগঠন। তারা তাদের ফেসবুক গ্রুপে বা পেজে নিজেদের ঢোল পেটাতে ব্যস্ত থাকেন। সাহিত্যকর্মের চেয়ে তাদের ওয়ালে বেশি আলোকচিত্র কর্মের উপস্থিতি বেশি। বর্তমানে এমন চক্র চিহ্নিত করতে ফেসবুকে লগ ইন থাকাই যথেষ্ট। ভার্চুয়াল জগতের বাইরে যদি দেখতে চান তো সাহিত্য-সম্মেলনগুলোর দিকে নজর রাখতে পারেন।
বছর বছর সাহিত্য সম্মেলন, পদক প্রদান, সম্মাননা প্রদান, সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানগুলো এক ধরনের সিন্ডিকেশনের ফল। এখানে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গকে অতিথি করে অর্থ আদায়ের মৌন প্রচেষ্টা চালানো হয়। বিভিন্ন সাহিত্য সম্পাদককে ঢেকে পুরস্কৃত করে সংগঠনগুলো। কাজটা এ আশায় করে থাকে যে, ‘আমার কবিতা বা লেখা যেন আপনার পত্রিকায় ছাপা হয়।’
এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ নূরুল হক তাঁর ‘সাহিত্যের রাজনীতি’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘সাহিত্যসমাজে যখন স্নবরি বা স্ট্যান্টবাজ লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন নির্মোহ, নিরাসক্ত ও নির্লোভ প্রাজ্ঞ ও হৃদয়বান সাহিত্যিকেরা উপেক্ষিত হতে থাকেন।’ কেননা সংকীর্ণ পথ বেয়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য তারা নানা ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেন। এর মধ্যে অন্যতম গোষ্ঠীপ্রীতি বা সিন্ডিকেশন। যদি প্রশ্ন করা হয়—সিন্ডিকেশন সাহিত্যের বিন্যাসে এবং মূল ও বিভিন্ন উপধারা নির্মাণে কতটা ভূমিকা রেখেছে? এ প্রসঙ্গে অনেকেই অনেক কথা বলবেন। কেউ কেউ সিন্ডিকেশনের প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করেছেন। আপনিও হয়তো বা তার সঙ্গে-সঙ্গে একমত হবেন। যদি সেটা ইতিবাচক অর্থে হয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে সাহিত্যিক জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘কতটুকু ভূমিকা রেখেছে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে, ভূমিকা রেখেছে এ-বিষয়ে দ্বিমত নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছে। তবে, দেখার বিষয়, ওই সিন্ডিকেশন সাহিত্যের স্বার্থে, না কি ব্যক্তিস্বার্থে? ব্যক্তিস্বার্থের সিন্ডিকেশন কিছুই করতে পারেনি। রাজনীতি কেবল পৃথক করেছে; সাহিত্যের জন্য তিল পরিমাণও ভালো কিছু বয়ে আনেনি। সাহিত্যের ছোট-ছোট আন্দোলন কিন্তু সিন্ডিকেশনের ফল।’(অলস দুপুর ওয়েবম্যাগাজিন)।
শুভ মৈত্র বলেছেন, ‘আন্দোলন মানে কিন্তু সিন্ডিকেশন নয়। সুররিয়্যালিস্ট মুভমেন্ট বলা হয় কিন্তু তাতে ব্যক্তিরা আলাদাই তো ছিলেন। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হয়নি।’(অলস দুপুর ওয়েবম্যাগাজিন)।
আব্দুল্লা জামিল বলেছেন, ‘সিন্ডিকেশন সাহিত্যে অবদান রাখছে কি না বা কোনো ধারা সৃষ্টি করছে কি না, তা প্রশ্নবিদ্ধ। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, গোষ্ঠীর স্বার্থেই বরং সিন্ডিকেশনের সৃষ্টি হয়। এতে অনেক প্রতিভাবান সাহিত্যিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’(অলস দুপুর ওয়েবম্যাগাজিন)।
তাই বলা যায় যে, গোষ্ঠীচর্চা কাউকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে না। সমকালীন গোষ্ঠীভিত্তিক চর্চা তো কোনো ফর্মও সৃষ্টি করতে পারেনি। কেবল নিজের বলয়ের মধ্যে রেখে নিজের পাণ্ডিত্য জাহিরের ব্যবস্থামাত্র। এর পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করছেন সাহিত্য সম্পাদকরা। সমকালীন দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতাগুলো তেলমর্দনের উত্তম ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। একজন সাহিত্য সম্পাদককে ঘিরেই গড়ে উঠছে সিন্ডিকেশন। অস্বীকার করার উপায় নেই।
এ সুযোগটা হাতছাড়া করতে চান না ছোটকাগজ সম্পাদকরাও। তারাও বহুজাতিক কোম্পানির ছত্রচ্ছায়ায় কাগজের খরচ উঠিয়ে অন্যান্য সাহিত্য সম্পাদকের গুণকীর্তণে নিজেকে ব্যাপৃত করছেন। যাকে ঠিক বিনিময় প্রথা বলা যায়। ‘তুমি আমার লেখা প্রকাশ করো। আমি তোমার লেখা প্রকাশ করি।’ যারা এ শিষ্যত্ব অর্জন করতে ব্যর্থ হলো, তাদের কবিখ্যাতি তো দূরের কথা; কবিস্বীকৃতি পাওয়ারও অধিকারটুকু রইল না। এজন্যই হয়তো কবি শামসুর রাহমান তাঁর একটি কবিতার মধ্যে ‘সাহিত্যপাতার জঘন্য সম্পাদক’ বলে অভিহিত করেছেন।
সম্প্রতি কবি রনজু রাইম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘একুশ শতকের অভিনব ধান্ধার নাম সাহিত্য পুরস্কার। যারা এই পুরস্কার দেয় তারা নষ্ট; যারা এই পুরস্কার নেয়, তারা পথভ্রষ্ট।’ কথাটি তিক্ত হলেও বাস্তব সত্য। তিনি আরও বলেছেন, ‘মধ্যযুগে বিত্তবানদের পৃষ্ঠপোষকতায় সাহিত্য রচনা করতো একদল লেখক; একুশ শতকে বিত্তবানদের ঘিরে থাকে একদল অলেখক।’ আসলে এরই নামই সিন্ডিকেশন।
রনজু রাইমের কথার প্রত্যুত্তরে কবি ও কথাসাহিত্যিক বীরেন মুখার্জী বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক অতীত থেকে এ প্রবণতা জোরেসোরে শুরু হয়েছে বলে ধারণা করছি।’ ফরিদ আহমেদ দুলাল বলেছেন, ‘তার মানে যুগে যুগে লেখকরা তোষামোদের দায়িত্ব পালন করে গেছেন? মিথ্যে নয় একেবারে; দু’চারজন যে প্রতিবাদ করেননি, তাও তো নয়। বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের সমাজে লেখকদের তেমন কোনো মর্যাদা নেই।’ কবি আবু হাসান শাহরিয়ার বলেছেন, ‘একুশ শতকে কিছু বিত্তবান নিজেরাই যা-তা লেখালেখি করেন।’
এভাবেই সিন্ডিকেশনের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। বিত্তবানদের ঘিরে আছে চাটুকার। চাটুকারকে ঘিরে আছে তেলবাজ। তাদের সমন্বয়ে তৈরি হচ্ছে গোষ্ঠী। যে গোষ্ঠী সাহিত্যের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। ধরে ধরে যত অকবি-অলেখককে পুরস্কার-সম্মাননা দিয়ে কবি-লেখক নাম জুড়ে দিচ্ছেন। যারা এখন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত নিজের নামের প্রচারণায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। যেখানে কাজের প্রসঙ্গ গৌণ। নামটাই যার কবিসর্বস্ব।
এই সিন্ডিকেশন সাহিত্যের সমৃদ্ধি বা উন্নতি বয়ে তো আনবেই না বরং সত্যিকারের সাহিত্যকর্মীকে বিতশ্রদ্ধ করে তুলবে। তাই বলতে চাই—সাহিত্যের জয় হোক, সিন্ডিকেশন নিপাত যাক।
মন্তব্য