বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটটি যখন সুবর্ণভূমিতে ল্যান্ড করছে তখন ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। বিমানের জানালা দিয়ে এয়ারপোর্টের রানওয়ে ছুঁয়ে থাকা ঘাস, মাটি, রোদ যেটুকু দেখা যায়, তাতে স্বজাতি গোত্রের গন্ধ। সবচেয়ে বড় কথা ‘সুবর্ণভূমি’ শব্দটির মধ্যে এতটাই বাঙালিয়ানা ভাব মেশানো যে, বিদেশের মাটিতে ল্যান্ড করছি এমন মনে হলো না প্রথমে। কিন্তু তারপরেই চমক লাগলো। প্যাসেঞ্জার প্যাসেজ দিয়ে বিমান থেকে নেমে আসার সময়ই স্পষ্ট হলো পার্থক্য। ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের প্যাসেঞ্জার প্যাসেজের দুর্বল অবকাঠামো, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের অব্যবস্থার কথা মোটা দাগে মনে করিয়ে দিল—আমরা বিদেশের মাটিতে ল্যান্ড করছি। পাঁচতলা বিশাল এয়ারপোর্টে পা রেখে প্রথমে তো আমাদের থৈ হারানোর দশা! কিন্তু ইমিগ্রেশন, কন্টেইনার থেকে সহজ লাগেজ রিসিভিং সিস্টেম, যানবাহনের সহজলভ্যতা বলে দিল এখানে হারানোর ভয় নেই।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে World Veterinary Poultry Association এর আমন্ত্রণে আমার স্বামী প্রফেসর ড. মো. জালাল উদ্দিন যখন ব্যাঙ্কক গেলেন। তাঁর সঙ্গী হলাম আমি ও আমার মেয়ে নুসাইবা। আমাদের দল অবশ্য মোটে তিন জনে সীমিত ছিল না। সিসিমপুরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. খলিলুর রহমান, তাঁর মিসেস মাহবুবা ইয়াসমীন রুমী, তাঁদের দুই সন্তান আজুয়া, মাহির ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভেটেরিনারী সার্জন ডা. হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ আমাদের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। তো আমাদের আট সদস্যের এই ছোট্ট দল সুবর্ণভূমিতে পৌঁছলে বন্ধুবর রণজিৎ কুমার আমাদের রিসিভ করলেন। বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সিনিয়র সায়িন্টিফিক অফিসার জনাব রণজিৎ কুমার ব্যাঙ্ককের এআইটিতে তখন গবেষণা কাজে নিয়োজিত। সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট থেকে দুটি মাইক্রোবাসে আমরা রওনা হলাম। ব্রামুনগ্রাড, নানা পেরিয়ে গাড়ি এসে থামলো সুকুমভিট soi-3 এলাকায়। soi অর্থ ছোটো রাস্তা বা গলি। রণজিৎ জানালেন, এ গলিতে বাঙালি হোটেল, টেস্টুরেন্ট, সপিংমল; সবই রয়েছে। বিদেশে বসে দেশি খাবারের স্বাদ পেতে চাইলে এই এলাকা ভালো হবে। আমাদের সঙ্গে শিশুরা রয়েছে। বিদেশে বসে দেশি খাবারই আমাদের বেশি প্রয়োজন। আমরা রয়ে গেলাম সুকুমভিটে। বোর্ডার হলাম বাঙালি-পাকিস্তানি ব্যবস্থাপনার এক হোটেল বোম্বেতে। চিরশত্রু পাকিস্তানি আতেথিয়তা গ্রহণ করতে প্রথমে মন না চাইলেও বিভিন্ন সুবিধার কথা বিবেচনা করে আমরা রয়ে গেলাম ওখানেই।
সন্ধ্যায় সুকুমভিটের আশপাশে হাঁটতে বের হলাম। উদ্দেশ্য—বাংলা খাবারের রেস্টুরেন্ট খুঁজে দেখা। স্থানীয় পর্যটন সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া। প্রথমে আমরা যে গলিতে গেলাম, তাকে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এলাকা বললে ভুল হবে না। নাসির আল মাসরি, আল-হোসেন রেস্টুরেন্ট, নেফারতিতি রেস্টুরেন্ট থেকে পাওয়া গেল গ্রিল চিকেনের ঝাঁঝালো গন্ধ। কালো বোরকা পরিহিত মুসলিম মহিলারা বাচ্চাদের হাত ধরে ধরে ঘুরছেন। অসংখ্য স্ট্রিট হকার সেই গলিতে মেয়েদের ছোটো খাটো অরনামেন্টস থেকে সানগ্লাস, স্যান্ডেল, ফলমূল; সবই বিক্রি করছে। মুভেবল ফুটপাথ রেস্টুরেন্টও চোখে পড়ল। ঢাকার রাস্তায় হকারদের দৌরাত্ম্য নিয়ে আমরা নানা কথা বলি। আমাদের সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলতে ছাড়ি না। লজ্জিতই হলাম বলতে গেলে নিজের দেশের ব্যবস্থাপকদের গালি দেওয়ার জন্য। কিন্তু পার্থক্যটা চোখে পড়ল প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও শৃংখলা বজায় রেখে স্ট্রিট হকার এবং ফুটপাথ রেস্টুরেন্টগুলো এখানে ব্যবসা করছে। জানা গেল, সপ্তাহের বিভিন্ন দিন সময় ও স্থান নির্ধারণ করা থাকে ফুটপাথ ব্যবসায়ীদের জন্য। ফুটপাথ ব্যবসায়ীদের আরও দুটি চমৎকার বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ল, সেটি হচ্ছে তাদের স্মার্টনেস এবং যোগাযোগ পদ্ধতি। প্রত্যেকেই পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে সেজেগুজে আছে। বিদেশি বায়ারদের সঙ্গে ব্যবসা করবার মতো প্রয়োজনীয় ইংরেজি বলতে পারছে তারা। পরবর্তী সময়ে ব্যাঙ্ককের অন্যান্য রাস্তায় এ রকম ব্যবসায়ীদের চোখে পড়েছে। প্রথমদিন রাতে বাংলাদেশি মালিকানার রাজধানী রেস্টুরেন্টে গরম ভাত, মুরগির ঝোল, মসুর ডাল দিয়ে আমরা ডিনার সারলাম। খোঁজ পেলাম ‘মনিকা’স কিচেন, ‘আমরা বাংলাদেশি’, ‘রাইজিং সান’ নামক আরও বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের। পরবর্তী দিনগুলোয় মনিকা’স কিচেনই ছিল আমাদের আড্ডা ও ডিনার ও ব্রেকফাস্টের নির্ভরযোগ্য জায়গা।
আমাদের আট সদস্যের দল পরদিন দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। আমার স্বামী প্রফেসর জালাল উদ্দিন এবং ডাক্তার হেমায়েত কুইন পার্ক মেমোরিয়াল হোটেলে সেমিনারে অংশ নিতে চলে গেলেন। আর বাকি ছ’জন আমরা ব্যাঙ্ককের আশেপাশে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। রাইজিং সান ট্রেডিং কোম্পানির ম্যানিজিং ডিরেক্টর সেলিম জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে এ ব্যাপারে আমরা পূর্ণ সহযোগিতা পেলাম। তাঁর ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে তিনি গাড়ি দিলেন, কোথায় কিভাবে বেড়ানো যায় তাও বলে দিলেন। ঠিক হলো, পর পর দুদিন আমরা বিভিন্ন পার্কে ঘুরব।
প্রথম দিন আমরা গেলাম বিখ্যাত সাফারি ওয়ার্ল্ডে। এনিমেল শো, রিভার সাফারি, পর্যটকদের লাঞ্চ টাইম, প্রাকৃতিক পরিবেশে বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি নানান আইটেমে বিভক্ত সাফারি ওয়ার্ল্ড। রিভার সাফারিতে বৈঠাবিহীন নৌকায় চেপে গভীর বনে প্রবেশ করছি আমরা হঠাৎ তেড়ে এলো বন্যপ্রাণী। প্রাণ বাঁচিয়ে এগিয়ে যেতেই দেখা হয়ে গেলো উপজাতি মহিলার সাথে। হঠাৎ প্রবেশ করলাম অন্ধকার গুহায়, যার মাথার ওপর অজগর কুণ্ডুলী পাকিয়ে। তারপরেই ভিজে গেলাম ঝরনাধারায়। যখন একটু ধাতস্ত হলাম, বুঝলাম পুরো পরিবেশটাই আসলে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। আর বন্যপ্রাণী কিংবা উপজাতি মহিলার ডামি এদের চোখে বসানো রয়েছে সিসি ক্যামেরা। অর্থাৎ গভীর অরণ্যে পর্যটককে একাকী পাঠিয়ে পার্ক কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব শেষ করেননি, পর্যটকের সুবিধা-অসুবিধা সবই ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ করছেন তাঁরা।
লাঞ্চ টাইমে যে ডাইনিং হলে খাবার পরিবেশিত হলো সেটিও প্রাকৃতিক ও কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত এক অরণ্যই বলা যায়। সত্যি বলতে এখানকার প্রতিটি আইটেমেই ছিল চমক। রাইজিং সান ট্রেডিং কোম্পানি থেকে আমাদের যে গাড়ি দেওয়া হলো এর ড্রাইভার নেপালি বংশোদ্ভূত গোবিন্দজী অনেকটা গাইডের ভূমিকা পালন করলেন। ফলে তাঁর গাইডেন্সে অত্যন্ত চমৎকার কাটলো সাফারি ওয়ার্ল্ড ভ্রমণ। সাফারি ওয়ার্ল্ডের আরেক আকর্ষণ ছিল ব্যাঙ্ককের বিভিন্ন স্কুলের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। পরদিন সিয়াম পার্কেও তাদের দেখেছি দল বেঁধে আনন্দ করতে। সম্ভবত এটি তাদের শিশু শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অংশ। তো গোবিন্দজী পার্ক দেখানোর পাশাপাশি আমাদের নিয়ে গেলেন বিভিন্ন মার্কেটে। এর মধ্যে জেমস গ্যালারি ভিন্ন এক মাত্রা নিয়ে আমাদের আকর্ষণ করেছে।
খনি থেকে ডায়ম- সংগ্রহের ইতিহাস এবং এর ব্যবহার দেখানোর জন্য যে মিউজিয়াম তৈরি করা হয়েছে সেখানে, তা অভিনব। হালকা আলো আঁধারে খেলনা ট্রেনে চড়ে ডায়মন্ড সংগ্রহের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে সত্যি গা ছমছমে এক ভাব হয়। এরপর মূল গ্যালারিতে প্রবেশ করবার আগে ডায়মন্ডসহ অন্যান্য মূল্যবান পাথরের যে সংগ্রহ প্রদর্শনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তা দেখার পর জেমস গ্যালারি থেকে কেউ কিছু না কিনে বেরিয়ে এসেছে এমনটা মনে হয় ঘটেনি কখনো।
বর্তমান যুগে ক্রেতার মনস্তত্ব বুঝতে পারাটা বিজনেস পলিসির একটা অংশ। ব্যাঙ্ককের জেমস গ্যালারি দেখে আমার মনে হয়েছে বিজনেসের এদিকটা তারা চমৎকারভাবে রপ্ত করেছে। যাই হোক Blue Sapphire, Ruby, Topaz, Sand stone, Aquamarine, Amethyst ইত্যাদি নানান মূল্যবান পাথরের তৈরি গহনা যেমন আছে, সেখানে তেমনি আছে শো পিস, ওয়ালেট, পার্স, ব্যাগ, কসমেটিকসের মতো সামগ্রীও।
পরদিন আমরা ঘুরলাম একটি থিম পার্কে। আমাদের দেশেও আজকাল অনেক থিম পার্ক গড়ে উঠছে। কিন্তু পরিসর কিংবা বৈচিত্র্য সব দিক থেকেই সেগুলো এখনো পিছিয়ে আছে। থাইল্যান্ডের থিম পার্কে সুইমিং পুলের পাশাপাশি স্মোকিং জোন রাখা হয়েছে। মনে পড়ল পাবলিক প্লেসে ধূমপানের শাস্তির বিধান রেখে আমাদের দেশে আইন পাস হয়েছে। কিন্তু সে আইনের কোথাও প্রয়োগ হয়েছে বলে জানা যায়নি। আবার ধুমপানের জন্য এভাবে জায়গাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা আর মানুষের স্বাধীনতায় প্রকৃত বিশ্বাসী হলেই বুঝি এ ধরনের সমন্বয় সম্ভব। যাই হোক, দুদিন ধরে ব্যাঙ্ককের আশপাশ ঘুরে তৃতীয় দিন পাতায়া সমূদ্র সৈকত যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো।
ব্যাঙ্কক থেকে ১৭৫ কিমি দূরে পাতায়া। আমরা ঠিক করলাম সারাদিন পাতায়া ঘুরে এসে সুকুমভিটেই রাত্রি যাপন করব। যথারীতি গোবিন্দজী তাঁর মাইক্রোবাসটি নিয়ে হাজির হলেন। ট্রাভেল এজেন্সির নিয়োজিত ড্রাইভার। প্রতিদিন কোনো না কোনো পর্যটক দলকে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ানো এটাই তাঁর চাকরি। কিন্তু অসম্ভব পেশাদারিত্ব ভদ্রলোকের কাজের মধ্যে। কখনো কোনো বিরক্তি বা ক্লান্তি স্পর্শ করতে দেখিনি তাঁর চেহারায়। আচরণে ভদ্র এ মানুষটির সঙ্গে আমাদের টিমের প্রতিটি সদস্যের অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ভদ্রলোক হিন্দি স্পিকিং হলেও বাংলা বুঝতেন চমৎকার। তো গোবিন্দজীর গাড়ি সকাল সাড়ে সাতটায় এসে হাজির হলো আমাদের হোটেলের সামনে। সেদিন মনিকাতে আমাদের নাস্তা করা হলো না। গোবিন্দজী জানালেন চনবুরি পেরিয়ে বেশকিছু ইন্ডিয়ান ফুড রেস্টুরেন্ট আছে, সেখানেই সকালের নাস্তা সেরে নেওয়া যাবে। তাই হলো। ব্যাঙ্কক থেকে পাতায়ার দিকে ছুটলো গাড়ি। ১৭৫ কি.মি. রাস্তার প্রায় পুরোটাই দু’পাশে ফেঞ্চ দেওয়া। ফোর লেনের হাইওয়েতে কোথাও কোনো বাধা বিপত্তি পেলাম না। ফলে নিরবচ্ছিন্নভাবে মাইক্রোবাস এগিয়ে চলল।
এখানে একটি কথা না বললেই নয়, তা হলো এক সপ্তাহের ট্যুরে থাইল্যান্ডে কোথাও কোনো গাড়ির হর্ন শুনতে পাইনি আমরা। শহরের ভেতর অল্প স্বল্প যানজট থাকলেও তা সাউন্ডলেস। আর হাইওয়ে তো সম্পূর্ণ যানজট মুক্ত। ফলে ব্রেকলেস ড্রাইভিং কিংবা রাস্তা পারাপারের ঝুঁকি কোনোটিই সেখানে নেই। মনে পড়ল টাঙ্গাইল থেকে রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করতে পথে-পথে কত বাজার হাট পেরোতে হয় আমাদের! তো পেটে চোঁ চোঁ ক্ষিদে যখন জানান দিচ্ছে, আমরা এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে থেমে লুচি তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। রেস্টুরেন্টের শিখ ম্যানেজারের আতেথিয়তা গ্রহণ শেষে আবার শুরু হলো যাত্রা। মাত্র ঘণ্টা দু’য়েকের ভেতর পাতায়া বিচে আমরা পৌঁছে গেলাম।
পাতায়ার নীল জলরাশির ওপর তখন সকালের সূর্যরশ্মির বিচ্ছুরণ হচ্ছে। কিন্তু সত্যি বলতে কী এই প্রথমবারের মতো হতাশ হলাম আমি। ছোট্ট সৈকত, ছিমছাম, গোছানো। কিন্তু সাগর কন্যা তার সৌন্দর্য দিয়ে আমাকে আকৃষ্ট করতে পারল না। কক্সবাজারের দীর্ঘ সৈকত তখন আমার স্মৃতিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। খলিল ভাই বললেন, পাতায়ার সৌন্দর্য দেখতে হলে কোরাল আইল্যান্ডে যেতে হবে। স্পিড বোটে সে জার্নি বেশ রোমাঞ্চকর। আমাদের দলের ভেতর মতভেদ দেখা দিল। সাঁতার জানি না যারা, তাদের সামুদ্রিক এ অভিযানে অংশ নেওয়া ঠিক হবে কি না! শেষ পর্যন্ত দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তই বলবত রইল।
পাতায়া থেকে ১৭ কি.মি. দূরে কোরাল আইল্যান্ড। যেতে হবে স্পিড বোটে। এখানেও গোবিন্দজী গাইডের ভূমিকায়। আমাদের দরদাম করা লাগল না। তিনি ঠিক ঠাক করে দিলেন বোট। একই বোটে সঙ্গী হলেন ভারতীয় বেশ কয়েক জন নাগরিক। লাইফ জ্যাকেট পরে নিলাম প্রত্যেকেই। সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বোটের ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। নীল জলরাশি কেটে সফেদ ফেনা সৃষ্টি করে করে এগিয়ে চলল বোট। সে কী দুলুনি সেই নৌকার। ওপরে নির্মল নীলাকাশ আর নিচে অবারিত নীল ঢেউ।
অনেকে উত্তেজনায় ক্যামেরায় ক্লিক করছেন। কিন্তু বোটের দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা যাত্রীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে অতিমাত্রায় সতর্ক। তারা কিছুতেই চলন্ত বোটে যাত্রীদের নড়াচড়া করতে দেবে না। এমনকি নৌকায় ক্যাপাসিটির চাইতে একজন যাত্রীও যেন বেশি না হয় সে ব্যাপারেও তাদের বেশ সতর্ক থাকতে দেখা গেলো। গুম গুম আওয়াজ তুলে ছুটে চলল বোট। নিজের বুকের ভেতরও ঢিপ ঢিপ আওয়াজের শব্দ পেলাম। ১০ মিনিট পর সাগরের মাঝখানে এক জেটিতে ভিড়লো বোট। এখানে প্যারাসুটে উড়ে সমুদ্র দেখেন পর্যটকরা। লক্ষ করলাম ভারতীয় পর্যটকদের মধ্যে এক বিশাল অংশ মহিলা যাঁরা প্যারাসুটে চড়ে আকাশে উড়াল দেয়ার খেলায় মেতেছেন। নিজেদের বেশ দুর্বলই মনে হলো ওঁদের কাছে। আমরা কেবল ঘুরে ঘুরে ছবি তুললাম।
আবার ডাক পড়ল বোটে চড়ার। এবার বোট এসে থামল এক দোতলা লঞ্চের পাশে। এখানে চলছে স্কুবা ড্রাইভিং। সাগরতলের জগৎ দেখতে নেমে পড়ছেন অনেকে। সেখানে কিছুক্ষণ থামার পর মূল গন্তব্যে চলল বোট। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সাদা বালুচরে এসে থামল বোট। স্বচ্ছ নীল পানিতে পা ডুবিয়ে নেমে এলাম বোট থেকে। সারি সারি পেতে রাখা হয়েছে চেয়ার আর রৌদ্র থেকে বাঁচার জন্য ছাতা। ছোট্ট বিচ, পরিচ্ছন্ন। সমুদ্রে দাপাদাপি করবার জায়গাটুকু নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে চিহ্নিত করা।
এখানে এসে মনে হলো শুধু এশিয়া নয়, পৃথিবীর সব মহাদেশের মানুষের এক মিলন মেলা এটি। ছেলে, বুড়ো, যুবক, যুবতী সবাই সমুদ্র স্নানের নামে যেন আদিমতায় মেতেছে। প্রকৃতির বিশালতার কাছে এভাবেই হয়তো মানুষ নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। আমার টিমের সব সদস্যের মোবাইল, ব্যাগ ইত্যাদি পাহারা দেওয়ার বাহানায় আমি রয়ে গেলাম ছাতার নিচে। উদ্দেশ্য নিজের মতো করে প্রকৃতিকে অনুভব করার চেষ্টা।
দৃষ্টি মেলে দিলাম দূর থেকে দূরে। কিন্তু দৃষ্টি বেশিদূর এগোলো না। ঘুরে ফিরে মনে এলো রঙিন ঝিনুক ছড়িয়ে থাকা কেয়া গাছের সারির ফাঁকে সেন্টমার্টিনের দীর্ঘ তট। আমরা কেন পারিনি সারা পৃথিবীর মানুষদের সেখানে নিয়ে যেতে! অথচ কত সামান্য সম্পদ নিয়ে পাতায়া সেটা পেরেছে। আমি যখন এসব নিয়ে ভাবছি, তখন আমার মেয়ে নুসাইবা ওর বাবার সঙ্গে সমুদ্রে দাপাদাপি করে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে গেছে। মধ্য দুপুর। ক্ষিদেও লেগেছে প্রচুর। টিমের সবাই পরনের ভেজা কাপড় কোনো রকমে পাল্টে আবার বোটে উঠে এলো। ততক্ষণে সমূদ্রে জোয়ার শুরু হয়েছে।
খলিল ভাই দুষ্টুমী করে বললেন ‘তুমি তো জলে নামলে না। এবার সমূদ্র নিজেই তোমাকে ভেজাবে’। কথাটার মর্ম বুঝলাম। পাতায়ার মূল বিচে যখন বোট থেকে নামছি, তখন সমূদ্রের পানি ক্রমেই ফুলে ফেঁপে উঠছে। বোট থেকে নেমে তটে যেতে যেতে কোমর পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেলাম। পায়ের নিচে ভীষণ স্রোত। সেই স্রোতে পেরিয়ে প্রায় অর্ধভেজা হয়ে মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য চলে এলাম ভারতীয় রেস্তোরাঁয়। বুফেতে থরে থরে খাবার সাজানো। ক্ষিদের চোটে সবাই গোগ্রাসে গিললাম সে মজাদার খাবার।
এরপর সুকুমভিটে ফেরার পালা। গোবিন্দজী মাইক্রোবাস নিয়ে হাজির। ফেরার পথে একটি বৌদ্ধ মন্দির আর লুকডড সুপার মার্কেটে কিছু কেনাকাটা করে আমরা সেদিনের মতো ফিরে এসেছিলাম। পরবর্তী দু’দিন ব্যাঙ্ককের মার্কেটগুলো ঘুরতে গিয়ে লক্ষ করেছি, এখানে বেশ রিজনেবল হোলসেল মার্কেট যেমন আছে তেমনি আছে অত্যন্ত বিলাস বহুল সপিং মল। কমিউটার ট্রেন, বাস, ট্যাক্সি, অটোরিক্সা সব কিছুর সমন্বয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা মানুষের একদম নাগালের মধ্যে। দেখা গেছে প্রায় প্রতিটি ভবন বা প্রতিষ্ঠানে ব্যাঙ্ককবাসী তাদের নিজেদের দেবতার মন্দির স্থাপন করে রেখেছে। কিন্তু পাশাপাশি সহবস্থানে রেখেছে মসজিদকেও। জনস্বাস্থ্য অর্থাৎ খাবারের মানের প্রশ্নে তারা আপোষহীন। আবার অন্যের মতাদর্শকে শ্রদ্ধা জানাতে নিশ্চিত করেছে হালাল ফুড কর্নার। মনে হয়েছে মানুষের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে প্রতি বিন্দুতে যেন রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা স্থাপিত হয়েছে সেখানে।
যেদিন ফিরে আসবো সেদিন এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগে সুকুমভিটের এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গেলাম বাচ্চাদের জন্য কিছু খাবার কিনতে। চকলেট, বিস্কুট, স্যুপ, কেক জাতীয় কিছু খাবারের প্যাকেট ট্রলিতে নিয়ে আমি কাউন্টারে জমা দিচ্ছি। কাউন্টারে দায়িত্বে থাকা থাই তরুণী দুটো স্যুপের প্যাকেট আমাকে সেলফে ফিরিয়ে দিতে ইঙ্গিত করলেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখি স্যুপের ইনগ্র্যাডিয়েন্টের মধ্যে রয়েছে পর্ক, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য খাওয়া নিষেধ। আমার মাথার স্কার্ফ দেখে সে হয়তো নিশ্চিত হয়েছে যে আমি মুসলিম। একজন সাধারণ সেলস গার্লের এ ধরনের দায়িত্ববোধ দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। কেবলই মনে হলো, একটি আদর্শ সিস্টেম মানুষকে কতটা ভেতর থেকে জাগায়! আমাদের কাছে যেটা স্বপ্নই রয়ে গেলো চিরকাল। ব্যাঙ্ককের রাস্তায় কোথাও দেখিনি সেখানকার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিজ্ঞাপনের নির্লজ্জপনা। শুধু সুবর্ণভূমি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের প্রবেশ পথে রাজা ভূমিবলের প্রমাণ সাইজের ম্যুরাল। সেখানে লেখা রয়েছে- Long live the king His Majesty king Bhumibol Aulyadej. মনে মনে বললাম প্রিয় রাজা আপনারা যা পেরেছেন, আমরা তা পারিনি। আপনি আমাদের শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।