‘সামান্য কিছু জলজগুল্ম দেখেই জানতে পারেন তিনি/ সমুদ্রের সমস্ত সংলাপ,/ লিখতে পারেন তিনি এক টুকরো সুবজ শৈবালে/ সাগরের সকল গল্প’ (কবি: বিকেলবেলা, নলেজ হোম, ১৯৮১)। কলাম লেখা ও মৌলিক গবেষণার আড়ালে সৈয়দ আবুল মকসুদ যে কাব্যচর্চা করেন, তা জানতে পেরে বিস্মিতই হতে হয় বৈকি। তাই অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে তাঁর কবিতার ভেতরে ঢুকে যাই। দেখি একজন স্বপ্নবিদ্ধ কবিকে, যিনি অন্তর্লোকে ধারণ করেন তীব্র রোমান্টিকতা। ‘প্রেমিক পাঠান কবরী গুচ্ছ/ জবাব আসে লাল গোলাপ,/ কেউ লিখলেন কাঁঠালিচাপা/ এলো বেলির এনভেলাপ।’
বিকেলবেলা ছাড়াও তাঁর আরও একটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে ‘দারা শিকোহ ও অন্যান্য কবিতা’ ( স্টুডেন্ট ওয়েজ, ১৯৮৭)। একক মলাটবদ্ধ কবিতাসকলের ভূমিকায় তিনি জানাচ্ছেন, ‘কবিতা আমার প্রথম প্রথম ভালোবাসা। জীবনের প্রথম লেখাটিই আমার একটি কবিতা—তা সে কবিতাটি যত অকবিতাই হোক।.. আমার হাজার হাজার পৃষ্ঠা গদ্যের চেয়ে আমার কোনো কবিতার একটি পঙ্ক্তির মূল্য, অন্তত আমার নিজের কাছে, বেশি।’ (ভূমিকা: সৈয়দ আবুল মকসুদের কবিতা, আগামী প্রকাশনী, ২০১২)। বোঝা যায় কবিতা নিয়ে তাঁর গভীর অনুরাগ আর অভিনিবেশের কথা।
মানবাধিকার, পরিবেশ ও সামাজিক আন্দোলনের শীর্ষ এই নেতার সুকঠোর অবস্থান যেমন যেকোনো শাসকগোষ্ঠীর অবস্থান নড়বড়ে করে দেয়, তেমনি থামিয়ে দেয় সকল অন্যায়কারীর অন্যায়ী আকাঙ্ক্ষা ও অপপ্রয়াস। এগুলোর আড়ালে এক প্রবল প্রেমিক সত্তার পরিচয় পাই তাঁর কবিতায়। প্রেমের কবিতাতে তিনি অতুলনীয়। সুকঠিন যক্তি, প্রবল দ্রোহীময় কাট কাট কথার কলামগুলোর কোনো ছোঁয়াই এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আবদুল মান্নান সৈয়দ জানাচ্ছেন, ‘জীবনের যে এক সূর্য-কণা প্রেম, প্রেমের যে এক সূর্য-কণা বিচ্ছেদ, বিচ্ছেদের যে এক সূর্য-কণা কবিতা সৈয়দ আবুল মকসুদ তা সাক্ষরিত করে রাখলেন।’ (সত্তরের একজন কবি, দৈনিক সংবাদ, ০৪ অক্টোবর, ১৯৮১)।
বাংলা সাহিত্যের ক্ল্যাসিকধর্মী গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ‘সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য’ এবং ‘ঢাকার বুদ্ধদেব বসু’ এই ধারায় মৌলিক সংযোজন। জীবনী গ্রন্থ ‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’ অবিস্মরণীয় মৌলিক কর্ম। একজন মানুষ কিভাবে ইতিহাসের অংশ হয়ে যান এবং কিভাবে ইতিহাসকে প্রভাবিত করেন তারই অনুপু্ঙ্খ বিবরণ উঠে এসেছে এই গ্রন্থে। একজন মানুষের জীবনী বলতে গিয়ে তিনি সমসাময়িক ইতিহাস ও ঘটনা যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তা অভিনব; বিরল। তাঁর গ্রন্থসংখ্যা চল্লিশের কাছাকাছি। লিখেছেন ভ্রমণকাহিনি ‘জার্মানীর জর্নাল’। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বাঙালি, বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত¦ ও দর্শন, ভাসানী কাহিনি, গোবিন্দচন্দ্র দাস, অরণ্য বেতার: স্বাধীন বাংলা বেতারকর্মীদের প্রথম জবানবন্দী, গান্ধী মিশন ডায়েরি ইত্যাদি।
বিভিন্ন ডামাডোলের ভেতরে একজন লেখককে প্রায়শই তাঁর মৌলিক ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরে যেতে দেখি। সৈয়দ আবুল মকসুদ আন্দোলনের সম্মুখে থেকে বা সংহতি প্রকাশ করে বা কলাম লিখে সময়পাত করলেও তিনি তাঁর মৌলিক ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে চলেন। একজন প্রকৃত লেখকের চালিকাশক্তি এরকমই হওয়া উচিত। আপাত কিছু সমসাময়িক প্রতিবাদী লেখার কারণে যেন প্রকৃত সিরিয়াস লেখার ক্ষতিসাধন না হয়, সে প্রত্যাশা আমরা করজোড়ে তাঁর কাছে করতেই পারি।
তাঁর আরেকটি কবিতা, ‘রবি সোম প্রভৃতি বাদেও পৃথবীতে আছে/ আরো একটি অষ্টম বার,/গ্রীষ্ম বর্ষা ছাড়াও বিশ্বে রয়েছে আরো এক/ সপ্তম ঋতুর সংসার।/ পৃথিবীর সব ঘর্মাক্ত জটিল মানুষের/ শুধু সাতটি বার,/ তা ছাড়া রয়েছে লুকানো আরো একটি দিন/ শুধু ভালোবাসার- (অষ্টমবার ও সপ্তম ঋতু: বিকেলবেলা)। লুকানো নয়, আজ এমন এক প্রকাশিত দিন যে-দিনে প্রিয় লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাঁর স্বপ্নের সপ্তম ঋতুর সংসার, শুধু হোক ভালোবাসার। জন্মদিনে তাঁর জন্য শুভকামনা।