বাংলা চলচ্চিত্র আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটির নাম সত্যজিৎ রায়। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে এখন পর্যন্ত তাঁর পরিচালিত ছবিগুলো একেকটি ইতিহাস হয়ে রয়েছে। তিনি ছিলেন একাধারে যুগসচেতন চলচ্চিত্রকার, লেখক, কাহিনিকার, সঙ্গীত পরিচালক, গল্পকার ও নাট্যকার।
সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রটি একটা প্রবল ভূমিকম্পের মতো ভারতীয় চলচ্চিত্রের গৃহীত কাঠামোকে চূর্ণ করেছে। ‘পথের পাঁচালী’ নব বাস্তববোধ দর্শক ও সমালোচকদের হতবাক করেছিল। এই ছবিই একদিন সত্যজিৎ রায়কে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করে তুলল। ২ মে সত্যজিৎ রায়ের ৯৫ তম জন্মবার্ষিকী। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের অবিভক্ত বাংলার কোলকাতায় ১৯২১ সালের ২ মে জমিদার উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সত্যজিৎ রায় ছিলেন প্রখ্যাত ছড়াকার সুকুমার রায় ও সুপ্রভা রায় –এর সন্তান।
সত্যজিৎ-এর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন আর পিতা সুকুমার রায় ছিলেন বিশ্বকবির পরম স্নেহভাজন। বালক সত্যজিৎকে কৈশোর বয়সে ‘মানিক’ নামেই চিনতেন রবীন্দ্রনাথ। দশ বছর বয়সে অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য সত্যজিৎ তার মায়ের সঙ্গে গেলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে।
কবি সত্যজিতের খাতার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন, ‘এটা থাক আমার কাছে; কাল সকালে এসে নিয়ে যেও।’ কথামতো মানিক পরের দিন গেল। কবিগুরু খাতাটা সত্যজিৎকে দিয়ে সুপ্রভা রায়ের দিকে চেয়ে বললেন, ‘এটার মানে ও আরেকটু বড় হলে বুঝবে।’ খাতা খুলে বালক সত্যজিৎ আট লাইনের ভূবনজয় করা কবিতাটা দেখল।
বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছে সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।
একটানে আটটি লাইন আবৃত্তি করে থামলেন সত্যজিৎ। তার মা জানতে চাইলেন লাইনগুলোর মানে বুঝেছে কি না। অল্প মাথা ঝাঁকিয়ে সত্যজিতের জবাব, ‘কিছুটা’।
সত্যজিৎ রায় সম্ভবত বালক বয়সেই বিশ্বকবির এই আটটি লাইন মনের অজান্তেই গভীরভাবে ধারণ করেছিলেন। ফলে ফর্মে আন্তর্জাতিক হলেও বিষয়ে প্রচণ্ডমাত্রায় দেশজ হতে পেরেছেন আর একটানে বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্বের চলচ্চিত্র কাতারে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন।
সত্যজিৎ রায় পিতাকে হারিয়েছেন মাত্র আড়াই বছর বয়সে। একটি স্কুলে চাকরি করতেন তার মা। ১৯৩৬ সালেই তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত চর্চায় মনোযোগী হন সত্যজিৎ। তার আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ছবি পরিচালনা ও পরিচালক। ইতোমধ্যে পুদভকিনের চলচ্চিত্রের তাত্ত্বিক দিক সর্ম্পকে দুটি বই পড়ে ফেলেছেন তিনি এবং সেই সময়ে বৃটেনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পত্রিকা সাইট অ্যান্ড সাউন্ড-এর গ্রাহকও হয়েছেন তিনি।
সাইট অ্যান্ড সাউন্ড পত্রিকার চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখাগুলো তাঁকে কিভাবে আলোড়িত করেছে, তা বলতে গিয়ে পরবর্তী জীবনে তিনি লিখেছেন, ‘যেন একটা নতুন জগতের দরজা খুলে যাচ্ছে আমার চোখের সামনে। নজর করে দেখছি যে, ক্যামেরাটাকে কোথায় কিভাবেকাজে লাগানো হচ্ছে, কোন দৃশ্য কোথায় ‘কাট’ করা হচ্ছে, ছবির গল্পাংশ কিভাবেউম্মোচিত হচ্ছে আর কী কী সেই বৈশিষ্ট্য যা একজন পরিচালকের কাজকে আর একজনের কাজ থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়।’
সেই সময় ছবির ডিসটিংটিভ কোয়ালিটি ফিনিশ দেখে সত্যজিৎ আলাদা করতে পারতেন এমজিএম থেকে প্যারামাউন্ট বা ওয়ার্নার থেকে টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্সের ছবি। সেই সঙ্গে ফোর্ড এবং ওয়াইলার, বা কাপরার সঙ্গে স্টিভেন্স এর মতো পরিচালকের ছবির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধরে ফেলতেন। শেষ জীবনে সেই কিশোর সময়ের কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি বারবার বলতেন, ‘দিস ওয়াজ প্রেসাইজলি দ্য পয়েন্ট হোয়ার মাই ইনটারেস্ট টুক এ সিরিয়াস টার্ন।
সত্যজিৎ রায়’রা শতকে একবারই জন্মান, তারা পদক পাওয়ার জন্য কাজ করেন না, তারা নিজের মনের তাগিদে, সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের তাগিদে কাজ করে যান।
১৯৩৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়ার পর সত্যজিৎ ঠিক করেছিলেন সাহিত্য নিয়ে পড়বেন। কিন্তু ভারতের প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ পিতৃহীন বন্ধুপুত্রকে সাহায্য করার ইচ্ছায় সুপ্রভা রায়কে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সত্যজিৎ যদি অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে বি.এ পরীক্ষা দেয়, তাহলে তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান স্ট্যাটেটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের মুখপত্র সংখ্যা পত্রিকায় চাকারির সুবিধা হতে পারে।
‘চাকরি’ এই শব্দ বিধবামায়ের একমাত্র সন্তনের পক্ষে নিশ্চয় বড় লোভনীয় ছিল। ফলে সত্যজিৎ অনেকটা বাধ্য হয়েই অর্থনীতিতে অনার্স নিয়েছিলেন। কিন্তু অর্থনীতি তার ভালো লাগত না। স্রেফ মুখস্থ বিদ্যার জোরে একটা সেকেন্ড ক্লাস নিয়ে সত্যজিৎ রায় অনার্স পাশ করেন।
মা’য়ের ইচ্ছায় ১৯৪০ সালে ১৩ জুলাই শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ভর্তি হন সত্যজিৎ। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর যে বিশেষ দু’জনের স্নেহ সত্যজিৎ সারাজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেন তারা হচ্ছেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়।
শান্তিনিকেতন তাঁকে দুটি বিষয় শিখিয়েছে, ছবি দেখা এবং প্রকৃতিকে চেনা। ফলে ভীষণ বাস্তববাদী কবিত্বহীন মন নিয়ে তিনি শান্তিনিকেতনেই খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর ভবিষ্যতের যাত্রাপথ। তিনি বলেছেন, ‘দ্য প্লেস হ্যাড ওপেনড উইনডোস ফর মি। ইট হ্যাড ব্রট টু মি অ্যান আওয়ারনেস অফ আওয়ার ট্রাডিশনস হুইচ আই নিউ উড সার্ভ অ্যাজ এ ফাউন্ডেশন ফর এনি ব্রাঞ্চ অফ আর্ট দ্যাট আই উইশড টু পারস্যু।’ এখানেই ভবিষ্যতের এক শিল্পীর গড়ে ওঠার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আড়াই বছর শান্তিনিকেতনে চিত্রকলার শিক্ষগ্রহণ করে অধ্যক্ষ নন্দলাল বসুর অনুমতি নিয়ে কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হওয়ার বাসনায় তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন।
এর তিনমাস পরে ১৯৪৩ সালের ১ এপ্রিল সত্যজিৎ চাকরি পেলেন বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমার-এর জুনিয়র ভিসুলাইজার আর্টিস্ট হিসেবে। ১৯৪৮ সালে নাগাদ সত্যজিৎ ডি জে কিমার আর্ট ডিরেক্টর হয়েছিলেন। এর মধ্যে চলচ্চিত্র সংক্রান্ত পড়াশুনার জন্য মাঝে মধ্যেই যেতেন ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরফেশন লাইব্রেরিতে। সেখানেই পরিচয় হয় বংশী চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে।
দু’জন সিদ্ধান্ত নিলেন কলকাতায় একটি ফিল্ম সোসাইটি সংগঠিত করবেন। সমমনা চলচ্চিত্রে আগ্রহী কিছু যুবক নিয়ে ১৯৪৭ সালের ৫ অক্টোবর যাত্রা শুরু হয় ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির। পঁচিশজন সদস্য নিয়ে সোসাইটি-টি গঠিত হয়।
যে পথের পাঁচালী ছবি করে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র পরিচালনার জগতে নিজের স্থান করে নেন, সেই পথের পাঁচালী’র কাহিনিটা একটু নাটকীয়ভাবে তাঁর জীবনে আসে। সত্যজিৎ যে কোম্পানিতে চাকরি করতেন, সেই কোম্পানি থেকে বাংলা সাহিত্যের সব সুন্দর বইগুলো একেবারে সাধারণ পাঠক বা কিশোরদের উপযোগী করে নতুন সংস্করণে ছাপা হতো। আর এই সব বইগুলির প্রচ্ছদ থেকে ছবি আঁকার দায়িত্ব পড়তো সত্যজিৎ রায়ের ওপর।
একদিন কোম্পানীর ডি কে গুপ্ত সত্যজিৎকে ডেকে বললেন, পথের পাঁচালীর এক কিশোরপাঠ্য সংস্করণ বের হবে এবং এর ছবিগুলো তাঁকে আঁকতে হবে। সময়টা ছিল ১৯৪৫ সাল। সত্যজিৎ তখনও পথের পাঁচালী পড়েননি। ব্যপারটা শুনে ডি কে গুপ্ত তাঁকে স্নেহের ধমক দিলেন এবং জানিয়ে দিলেন, এই বইয়ের কাহিনি থেকে একটি সুন্দর চলচ্চিত্র হতে পারে। সত্যজিৎ তিনশত পৃষ্ঠার মূল বই পড়ে ফেললেন। পড়ে শুধু তিনি অস্ফূট স্বরে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘অপূর্ব’! তারপরই কাহিনিটা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
১৯৪৯ সালে বিখ্যাত ফরাসী চলচ্চিত্রকার জ্যঁ রেনোয়া কোলকাতায় এলেন তাঁর ছবি ‘দ্য রিভার’ এর লোকেশন দেখতে। তখনই রেনোয়ার সঙ্গে পরিচয় হয় সত্যজিতের। রেনোয়া যতদিন কোলকাতায় ছিলেন সেই দিনগুলোতে সত্যজিৎ প্রতি শনিবার রেনোয়ার কাছে আসতেন। দিনটাই ছিল তার সাপ্তাহিক ছুটি। রেনোয়াকে সত্যজিৎ প্রথম বলেছিলেন পথের পাঁচালী নিয়ে ছবি করার। রেনোয়া শুধু বলেছিলেন, ‘তোমার বাংলায় যে ঐশ্বর্য আছে, সেটাই ব্যবহার কর। নিছক হলিউডের ছবির নকল করার কথা কখনো ভাববে না। তবে পাশ্চাত্য জ্ঞান অবশ্যই গ্রহণ করবে।’
আটত্রিশ বছর পর সত্যজিৎকে ফ্রান্সের সবচেয়ে সম্মানীয় বেসামরিক পুরস্কার লিজিয়ন অফ দ্য অনার দেওয়ার জন্য স্বয়ং ফরাসী রাষ্ট্রপতি ফ্রাঁসোয়া মিতেরা ছুটে এসেছিলেন কলকাতায়। সেই সময় এক প্রশ্নের উত্তরে সত্যজিৎ জানিয়েছিলেন, ফ্রান্সের জ্যঁ রেনোয়া তাঁর প্রিন্সিপাল মেন্টর।
নিশ্চিন্দিপুরের গরিব পুরোহিত হরিহরের পরিবারের কাহিনি যেমন গ্রাম বাংলার অসংখ্য মানুষের কাহিনি। হরিহরের স্ত্রী সর্বজায়া, কন্যা দুর্গা, পুত্র অপু এবং দুঃসম্পর্কের ইন্দির ঠাকুরণকে নিয়ে আবর্তিত কাহিনির মাঝে-মধ্যে যে ডিটেইল সত্যজিৎ রায় ব্যবহার করেছেন তা সত্যিই ভারতীয় ছবিতে পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। শাপলা পাতার ওপর ফড়িঙের খেয়ালি নৃত্য, জল-পতঙ্গের ছন্দোবদ্ধ গতি, আকাশ ভাঙা বৃষ্টি কিংবা বর্ষণক্ষান্ত রাত্রির শেষে ভাঙ্গা রান্না ঘরে চিৎ হয়ে থাকা মরা ব্যাঙ পূর্বে কখনো এত সূক্ষ্মভাবে ভারতীয় দর্শকরা দেখেনি।
সত্যজিৎ রায়’রা শতকে একবারই জন্মান, তারা পদক পাওয়ার জন্য কাজ করেন না, তারা নিজের মনের তাগিদে, সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের তাগিদে কাজ করে যান।
চলচ্চিত্রের এই মহান কারিগরের জন্মদিনে তাঁর প্রতি রইলো শ্রদ্ধাঞ্জলি।