‘সওগাত ছাড়া আমি কিছু না, আমাকে জানতে হলে সওগাতকে জানলেই হবে’- কাছাকাছি এমন একটা কথা বলেছিলেন ‘সওগাত’-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন।
‘সওগাত’ নামের সঙ্গে আমার পরিচয় স্কুলে। বাংলা প্রথমপত্রে লেখক পরিচিতিতে নানান লেখকের জন্ম, মৃত্যু, উল্লেখযোগ্য লেখা কোথায় প্রকাশিত হতো–এরকম নানান তথ্য জানতে হতো, আসতো পরীক্ষায়। আর আমি এমন এক মানুষ, যে আজীবন বাংলাকে ভয় পেয়েছি। কোনোভাবে পঞ্চাশের কোঠায় নম্বর পেলেই খুশি দেখে কে! টেনেটুনে পাস করা পর্যন্ত আমার বাংলাজ্ঞান সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ কোনোভাবে আমার ধারণা হয়েছিল বাংলা মুখস্থ করার বিষয়, আর মুখস্থ করা কিছুই আমার মাথায় থাকতো না। কিন্তু ‘সওগাত’-এর কথা মনে আছে। ‘বেগম’-এর কথাও।
পত্রিকাটির কথা পড়েছিলাম সম্ভবত নজরুলের পরিচিতিতে। স্কুলজীবন শেষের ষোলো বছর পর তা মনে করা কঠিন। এক বিশেষ কাজে জড়িয়েছি মাস দুয়েক। কাজের জন্য এই পত্রিকা নিয়ে নাড়াচাড়া হলো ভীষণ। গত মাস দুয়েকের প্রায় ষাট শতাংশ সওগাত উল্টেছি বাংলা অ্যাকাডেমি গিয়ে। প্রথম দিন থেকে পত্রিকাটি আমাকে বিস্মিত করে রেখেছে।
১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম সওগাত। বাংলা অ্যাকাডেমিতে পাই ১৯৩৩ থেকে তার পরবর্তী সংখ্যাগুলো। তো ওল্টাচ্ছি একে একে, আর মুগ্ধ হয়ে দেখছি, এত বছর আগের পত্রিকা, অথচ কাগজ, প্রিন্ট, ইলাস্ট্রেশন; সব কিছুতেই কী যত্নের ছাপ! ভিনদেশি লেখক, কবির নাম আমার লেখক বন্ধুদের কাছ থেকে শুনি, উইলিয়াম ফকনার, গার্সিয়া লোরকা, তাদের লেখার অনুবাদ; যারা বাংলা সাহিত্যকে দশকের পর দশক ধরে সমৃদ্ধ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, তাদের লেখা গল্প, কবিতা, ধারাবাহিকভাবে ছাপা হওয়া উপন্যাস; কত আলোকচিত্র, নানান দেশের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ইস্যু নিয়ে কত আলোচনা!
সওগাতের সময়ে অনেক বাঙালি মুসলমান ভাবতো, বাংলা হিন্দুদের ভাষা। এ ভাষা পড়া যাবে না। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন এরকম সময়ে, মাত্র বিশ বছর বয়সে, বাংলা ভাষায় মুসলমানদের পত্রিকা প্রকাশের দুঃসাহসিক উদ্যোগ নেন।
পত্রিকাটি দেখার এক পর্যায়ে সন্ধান পাই ‘বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ’-এর। প্রায় ১৬০০ পাতার একটি বই। বইটিতে এ পত্রিকার যাত্রার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়ে লিখে গেছেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন। কেন তার ভাবনা এলো এমন একটা পত্রিকা করার, প্রভাবশালী মুসলমান বলয়ের কেমন মনোভাবের মুখোমুখি হয়েছেন, তার বিরুদ্ধ সমস্ত সংগ্রাম; যারা সওগাতে লিখতেন, তাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক, কিভাবে লেখা নেওয়া শুরু হলো, তাদের যত বিশেষত্ব। কতটা প্রাণশক্তির অধিকারী হলে ৮৮ বছর বয়েসে এমন একটি বই লেখা সম্ভব?
সওগাতের জন্মের প্রধানতম ড্রাইভ, নাসিরউদ্দিনের জেদ। ছোটবেলায় বই ভীষণ ভালোবাসতেন। লেখার বই, ছবির বই, রঙিন বই! এক বন্ধুর বাড়িতে এমন বই ছিল প্রচুর। বন্ধুটি সনাতনী পরিবারের। একদিন নতুন কিছু বই আনা হয়েছে খবর পেয়ে তিনি গেলেন দেখার জন্য। তার হাত থেকে বন্ধুটি বই কেড়ে নিয়ে বললো, তোমাদের মুসলমানদের কোনো বই নেই কেন? পারলে নিজেদের বই এনে পড়ো। বন্ধুর কথা শুনে নাসিরউদ্দিন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, মুসলমানদের কোনো বই নেই! স্কুলের এক শিক্ষকের কাছে গিয়ে বলেন, মুসলমান কোনো লেখকের বই দিন। শিক্ষক বললেন, মুসলমান লেখকদের বই তো নেই, কিভাবে দেবেন!
একবার তাদের গ্রামে বৈশাখী মেলা। বিপুল হৈ চৈ, আনন্দ, সার্কাস, খাবারের ঘ্রাণ! কিন্তু বাড়িতে বাড়িতে এসে মাইকিং করে গেলো, যেন কোনো মুসলমান ওই মেলায় না যায়। কারণ সেখানে পুতুল নাচ হবে। আরও নানান বিষয়, যা মুসলমানদের জন্য হারাম। কেউ যদি নিষেধ অমান্য করে মেলায় যায়, তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। নাসিরউদ্দিন নিষেধ অমান্য করতেন, ধরা পড়তেন, শাস্তি পেতেন, তবু মেলায় যাওয়া থেকে বিরত হতেন না। মেলায় নির্মল আনন্দ খুঁজে পেতেন। সব মানুষের এই মিলনমেলায় আনন্দের ভাগ নেওয়ায় কেন মুসলমানদেরই শুধু পাপ হয়ে যায়, তিনি মানতে পারতেন না।
মুসলমানদের লেখা চাই, পত্রিকা চাই, গোঁড়ামির অবসান চাই। তিনি ভাবতেন। দিন যেতে থাকে। অর্থনৈতিক অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিল না। এসময় মারা গেলেন তার বাবা আবদুর রহমান। বাবার কারণে বাংলার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল তার। সমকালের গড়পরতা মুসলমানদের মতো ভাবতেন না তার বাবা। সবাই যখন সন্তানদের আরবি, ফার্সি শেখাতে ব্যস্ত, তখন বাবা শেখাতেন বাংলা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যদিও শুরু হয় একটি ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয়ে। বাবার মৃত্যুর পর বড় সন্তান হওয়ায় নাসিরউদ্দিনের পড়ালেখায় বাধা পড়ে। পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার ভার পড়ে তার ওপর।
প্রথমে একটি স্টিমার কোম্পানিতে স্টেশন মাস্টারের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপর স্কুলের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে বন্ধুর পরামর্শে ইন্স্যুরেন্সের ব্যবসা শুরু করেন। অর্থনৈতিক অবস্থা ধীরে ধীরে ভালো হতে শুরু করে। সওগাতেরও যাত্রা শুরু হয়।
নাসিরউদ্দিন চাঁদপুরের পাইকারদী গ্রামের ছেলে। সে সময়ে ওখানে ভালো কোনো প্রিন্টিং প্রেস ছিল না। নিজের পত্রিকার ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবেন না, তাই চাঁদপুর থেকে কলকাতা গিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকেন। সময়টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। ভালো কাগজ পাওয়া খুব কঠিন এবং খরচ সাপেক্ষ। অতিরিক্ত দাম দিয়ে পত্রিকার জন্য কাগজ আনাতেন।
এরপর লেখা সংগ্রহের পালা। মুসলমানদের কাছ থেকে লেখা আদায় করতে পারলেন না প্রথম দুটি সংখ্যায়। সনাতনী লেখকরা এগিয়ে এলেন। তৃতীয় সংখ্যা থেকে লেখা দিতে শুরু করলো মুসলমানরা। নাসিরউদ্দিন চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিমের দ্বন্দ্ব দূর হোক। ছোটবেলা থেকে ধর্মের কারণে যে দ্বন্দ্ব তিনি দেখে এসেছিলেন, মানতে পারেননি। পত্রিকাটির মাধ্যমে তার সমাজের, মুসলমানদের সংস্কারের যাত্রা শুরু হয়।
সওগাতের পর বার্ষিক সওগাত, সাপ্তাহিক সওগাত, শিশু সওগাত ও সবচেয়ে সাহসের পরিচয় ছিল মহিলা সওগাত প্রকাশ করা।
নাসিরউদ্দিনই প্রথম কোনো পত্রিকায় নারীদের ছবি ছাপলেন। সেসময়ে মুসলিম নারীদের চেহারা দেখানো নিষিদ্ধ। নারীদের ছবি ছাপার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান সমাজ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া এলো। কে যেন বললো, নাসিরউদ্দিন যে নারীদের ছবি ছাপান, পারবেন তিনি নিজের স্ত্রীর ছবি ছাপতে? তিনি ছাপলেন তার স্ত্রীর ছবি।
নারীদের লেখা স্বনামে ছাপা হতে থাকলো। ‘বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ’-এ নাসিরউদ্দিন লিখেছেন, ‘‘যেদিন ‘নারী সওগাত’-প্রথম ছাপা হয়, সেদিন পত্রিকা অফিসে নারীসংখ্যা কেনার জন্য মোল্লাদের ভিড় জমে যায়।’’ অফিসের জানালা দিয়ে তিনি মজা দেখছিলেন।
১৯৪৭ সালে শুরু করেন ‘বেগম’। এই বেগম বাংলা ভাষায় প্রথম নারীদের পত্রিকা। তিনি প্রতিনিয়ত ভাবনার সমস্ত সংকীর্ণতা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। বহুবার নিজের জীবনকেও ফেলেছেন হুমকির মুখে। জানতেন যেকোনো সময়ই তাকে হত্যা করা হতে পারে। কিন্তু নিজের ভাবনাকে ছড়িয়ে দেওয়া থেকে কখনো বিরত হননি মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন।
১৯৩৩ সালে কলকাতায় ‘সওগাত কালার প্রিন্টিং প্রেস’ চালু করলেন। ১৯৫০ সালে যখন সপরিবারে ঢাকার নারিন্দায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন, তখন প্রেসও ঢাকায় নিয়ে এলেন। এরপরের সমস্ত সওগাত ঢাকা থেকেই ছাপা হতো।
কয়েকটি টুকরো চিত্র:
১। কিছুদিন আগে দেখার সুযোগ হলো মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের ঢাকার ৩৮ শরৎগুপ্ত রোড, নারিন্দার সেই বাড়ি। যা এখন ‘নাসিরউদ্দিন স্মৃতি ভবন’। এই বাড়ি একইসঙ্গে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই ও নূরজাহান বেগমেরও বাড়ি। বর্তমানে জাতীয় ঐহিত্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট।
২। বাড়ির ভেতরে যখন প্রবেশ করলাম, কী শিহরণ! প্রগতিশীল যত বড় বড় মানুষের নাম শুনি, প্রায় প্রত্যেকের আনাগোনা ছিল এখানে একসময়। তাদের ছায়াস্মৃতি মিশে আছে এখানে বাতাসে।
৩। দেখার সুযোগ হলো সওগাত প্রেসও। ঠিকানা, ৬৬, পাটুয়াটুলী। ১৯৩৩-এ কলকাতায় চালু হওয়া প্রেস মেশিনটা শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে। বাকি মেশিনগুলো এখনো চালু, প্রিন্ট চলছে! বিখ্যাত ‘বেগম’ পত্রিকা এখান থেকে এখনো প্রকাশিত হয়।
৪। সওগাত প্রেসে দেখা হয়েছিল দীর্ঘদিনের পুরনো কর্মচারী জনাব মোহাম্মদ হেলালের সঙ্গে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সঙ্গে আছেন সওগাত প্রেসের। গলায় কিছু সমস্যা হওয়ায় কথা বলতে পারেন না ঠিকমতো। তবে নিজ থেকে বহু কিছু দেখালেন। কোথায় কাজী নজরুল ইসলাম বসেছিলেন। কোথায় নাসিরউদ্দিন বসতেন, নূরজাহান কোথায় বসতেন, ঠিক কোন জায়গাটায় ‘বেগম ক্লাব’ ছিল। ক্লাবের বড় একটা অংশ এখন ভেঙে পড়ে আছে, আগাছায় ভরা।
৫। প্রেসটি দেখলে বোঝার উপায় নেই কত শত মানুষের কর্মসংস্থান, লেখক-পাঠকের আনাগোনায় কত জমাট আড্ডার স্থল ছিল এই প্রেস।
১৮৮৮ সালের ২০ নভেম্বর এই কীর্তিমান পৃথিবীতে আসেন।মাত্র বিশ বছর বয়সে সওগাত প্রকাশ শুরু করেছিলেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন। দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে ১৯৯৬ সালের ২১ মে, ১০৫ বছর বয়সে তিনি পরপারে যাত্রা করেন। বাঙালির মানসিক বিকাশ ও নারী জাগরণের স্মারক পত্রিকাটি ছিল তার আজীবনের ধ্যান। একশ বছরেরও আগে এমন এক পত্রিকা প্রকাশে কী বিপুল উদ্যম, মেধা ও সাহসের প্রয়োজন ছিল, ভেবে থমকে যাই। তিনি সেই প্রয়োজন মিটিয়ে যুগোত্তীর্ণ হয়েছেন। ১৩২তম জন্মদিনে তাকে স্মরণ করছি।
শুভ জন্মদিন, মহাপ্রাণ মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: সংবাদচিত্রী, শিক্ষক, গবেষক সাহাদাত পারভেজ