রুবী রহমান জন্মেছিলেন ৩ ডিসেম্বর ১৯৪৬ সালে নোয়াখালী জেলার চাটখিলের নিভৃত নোয়াখোলা গ্রামের এক সাংস্কৃতিক পরিবারে। সময়ের বিবেচনায় তিনি ৭৪ শেষ করে ৭৫-এর ভেলা ভাসালেন আয়ুর জলে।
কবি হিসেবে রুবী রহমান উল্লেখযোগ্য, তার অন্যসব পরিচয় ছাপিয়ে। এ পর্যন্ত চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার। সেই অর্থে তিনি বহুলপ্রজ নন। তবে কবিতায় তার নিজস্ব কণ্ঠস্বরটি উৎকীর্ণ রয়েছে। নারীর জীবনবীক্ষণে দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নারীর জীবনোপলব্ধিও অনুরসে যাপিত জীবনের বহু অনুষঙ্গ তার কবিতার বিষয় হয়ে এসেছে।তবু নারীর অভিজ্ঞতা ও অনুভবকে ছুঁয়ে তার উচ্চারণ হয়ে উঠেছে সত্য-সুন্দর ও মানবিকতার পক্ষে। এসব কারণেই তিনি একজন উল্লেখযোগ্য কবি।
যতদূর জানি, লেখালেখির শুরুতে আপনার কবিবন্ধু ছিলেন রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইন, বেলাল চৌধুরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আসাদ চৌধুরীর মতো যশস্বী কবিরা। কী করে যেন এক সময় আমিও আপনার জুনিয়র বন্ধুর স্বীকৃতি পেয়েছিলাম। আমাদের দুজনের পেশা ছিল অধ্যাপনা, আপনি ইংরেজি সাহিত্য আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। সেখানে একটা নীরব সমর্থন ছিল আমার প্রতি। রফিক আজাদের সঙ্গে জীবন সংযুক্ত হলে আপনাদের মতো প্রতিভাবান কবি মহলে আমিও প্রবেশাধিকার পেয়ে যাই। আপনার গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রথম দেখেছিলাম দেশপ্রেমে আলোকিত অপরূপ এক অসাধারণ গুণী মানুষকে। আপনার মর্মের বাণী শুনেই যে আপ্লুত ছিল গভীরভাবে। দেখে মনে হতো স্বর্গের দেব-দেবী ইন্দ্র ও ইন্দ্রানীর মতো আপনারা দুজন অবিচ্ছেদ্য প্রাণ। সাধারণ প্রান্তিক মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের রাজনীতির দর্শনে বিশ্বাসী অসাধারণ আদর্শবান, সৌম্যদর্শন এই মানুষটিকে আমি ইসলাম ভাই বলে ডেকেছি, তার কাছে পেয়েছি অকৃত্রিম, অপার স্নেহ, যা আমাকে তৎকালীন বাস্তবতার নিরিখে সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে পথ চলতে।
আপনার প্রেরণা তো ছিলই কবিতার ঐন্দ্রজালিক মহরতে। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক’ বইটি পড়ে আমাকে বলেছিলেন, দিলারা, তোমার বইটি শেষ না করে ওঠা যায়নি। আপনার এক বাক্যের এই প্রেরণাটুকু বুকে ধারণ করে আজও অনিঃশেষের এই পথে একজন নির্ভীক মোহান্ত পথিক হিসেবে হাঁটছি তো হাঁটছি।
এছাড়া আপনার-আমার কবিতা-গ্রন্থের প্রথম মুদ্রিত যাত্রাটি ছিল আটজন কবির সম্মিলিত এক আড়ম্বরপূর্ণ অভিযাত্রার অংশ। যেখানে এক মলাটের ভেতরেই দ্বৈতসত্তার উন্মোচনে প্রিয় পাঠকেরা পেয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের আরক্তিম কিছু পঙ্ক্তি।
কবি হিসেবেও আপনার নাম শুনি সর্বত্র কিন্তু তখন পর্যন্ত আপনার কোনো বই প্রকাশ পায়নি। চার পুরুষ, চার নারী কবির কবিতা নিয়ে চারটি বইয়ের মলাটে ছবিসহ আবদ্ধ হলাম আট জন কবি। আপনার সঙ্গে বাকি অর্ধেক কবি আসাদ চৌধুরী, আমি যুক্ত হলাম রফিক আজাদের সঙ্গে—এভাবে এক মলাটে নারী-পুরুষ দুজনের কবিতা নিয়ে ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হলো ভালোবাসার কবিতার চারটি বইয়ের একটি সেট।
প্রকাশনা জগৎ ও কবিদের মধ্যে ব্যাপক সাড় পড়েছিল অভিনব এই প্রকাশনার উদ্যোগটি, যার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কবি রফিক আজাদ। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে প্রকাশিত হলো আপনার একক কাব্যগ্রন্থ। যার নামকরণের মধ্যেই ছিল অধিচর্চিত জীবনানন্দ দাশের গন্ধময়এক উদ্ভাস। ‘যে জীবন ফড়িঙের’।
শুধু মন্ময় শব্দের কবি নন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, প্রতিবাদী একজন জীবনসংগ্রামী নারীর অন্য নাম আজ কবি রুবী রহমান।
এরপর ‘কান পেতে আছি, মৌমাছি’, কী সব চমৎকার নামে বই বের হয়েছে আপনার! সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থটি আপনার একমাত্র পুত্রসন্তান ‘তমোহর’নামে প্রকাশিত হয়েছে। ভালোবেসে যে কোনো মা তার সন্তান-সন্ততির নামে বই লিখতেই পারেন কিন্তু নেপথ্যে যে বিয়োগান্তক করুণ ট্র্যাজিক কাহিনির পরিনাম আপনাকে দিয়ে এই গ্রন্থটি লেখাতে পেরেছে, তার বর্ণনা দেওয়া এবং শোনা দুটোই খুব দুঃসহ আজও। আমাদের প্রত্যেকের জন্যে। পত্রিকায় প্রকাশিত বিয়োগান্তক সেই ঘটনার সামান্য একটু আলোকপাত করছি, যা আপনাকে কোট করেই সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে।
‘‘গণতন্ত্রী পার্টি ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি মো. নূরুল ইসলাম ও ছেলে ইসলাম তমোহরের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড দাবি করে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চেয়েছেন কবি রুবি রহমান। বুধবার (৪ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ দাবি জানান।’
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে রুবি রহমান বলেন, ‘২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে গিয়ে নির্বাচনের মাত্র ২৬ দিন আগে আমার ছেলে এবং স্বামী নূরুল ইসলাম রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় এক রহস্যজনক দহনে মারা যান। এই ঘটনার ১১ বছর পার হয়েছে। তদন্তকারী সংস্থা ও তদন্ত কর্মকর্তার বদলি হয়েছে বহুবার। বর্তমানে তদন্তের ধীরগতিতে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন।’’
পাঁচ বছর সংসদ সদস্য থেকেও আপনি বিচার পাননি। বিচারের বাণী সর্বত্রই নিভৃতে কেঁদেছে, আজও কাঁদে।
২০১৮ সালে স্বামী ও পুত্রহত্যার বিচার চেয়ে যে সভাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন সেই সভার প্রধান অতিথি, শোকার্ত আপনি সেখানে সভাপতি। তার রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গী, সতীর্থরাও উপস্থিত ছিলেন।
একমাত্র কন্যা মৌটুসিও ছিল। আমেরিকা প্রবাসী কন্যা মাঝে মধ্যে মায়ের জন্যে দেশে আসে আবার তার কর্মস্থলে তাকে চলে যেতে হয়। একাকী সংগ্রামেও আপনি মহাভারতের সেই একলব্য যেন। শুধু মন্ময় শব্দের কবি নন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, প্রতিবাদী একজন জীবনসংগ্রামী নারীর অন্য নাম আজ কবি রুবী রহমান।
একাকী পথেই চলছে আপনার এই আত্মিক-সংগ্রাম। রাজনীতির দাবানলে অকালে হারানো পুত্র ও প্রিয় জীবনসঙ্গী স্বামীর আত্মার শান্তি প্রার্থনা করে। সেদিনের সেই অনুষ্ঠান থেকে ফিরে বিষাদে বিহ্বল আমি ‘কবি রুবী রহমান’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলাম অদ্ভুত এক অনুভূতির জারক রসে নিমজ্জিত নির্মোহ সত্য উন্মোচনের আকূতি থেকে।
প্রিয়দর্শিনী, মিতকথনে এক অপূর্ব শৈলীর বক্তা, অপরূপা আমাদের রুবী আপা, কবি রুবী রহমান এতদিন ছিলেন শুধুই কবি, সেই কবি রক্তের দুই নদী পেরিয়ে হলেন নবম জাতীয় সংসদের সদস্য।
মহিলা আসন-২৭ থেকে মনোনীত সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্যও হলেন চোখের জল সামলে নিয়ে।
প্রিয় স্বামী ও একমাত্র পুত্র তমোহরকে হারিয়ে তিনি দেশ ও দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে, তাদের সার্বিক অবদান মূল্যায়নে আত্মনিয়োগ করে কাজে ডুবে থাকলেন উপায়ান্তরহীন সেইসব রক্তাক্ত পাঁচিলঘেরা দিনে। রাজনীতির মধ্যে দিয়ে তিনি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভালোবাসা পেলেন, নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে ভুলতে চাইলেন হৃদপিণ্ডের তুমুল ক্ষত।
আমৃত্যু এই ক্ষত শুকোবার নয়, তবু আজকের এই বিশেষ দিনটি হয়ে উঠুক কবিতার দিন। সাহিত্য সতীর্থের দিন। আপনি আবার জেগে উঠুন, দুহাতে লিখুন আপনার দুঃখ-বেদনা এবং কষ্ট-কথনের কাব্যকথা। ভালোবাসার কথা। আমরাও যে খুব ভালোবাসি আপনাকে। আপনি আমাদের অভিবাদন গ্রহণ করুন কবি। আপনাকে নিয়ে রচিত আমার কবিতাটি হোক আপনার জন্মদিনের পুষ্পার্ঘ্য।
কবি রুবী রহমান ॥ দিলারা হাফিজ
(শ্রমিক নেতা নূরুল ইসলামের স্মরণে)
একদা তোমার রূপে একদিন ফুটেছিলো তরল আগুন
ভেতরে প্রবহমান বেজেছিলো কবিতার অমৃত সঙ্গীত
বাঙ্ময় বিষাদে তুমি আজ এক উদ্বেলিত শোকের মূর্চ্ছনা
নির্গত লাভার লাল দহনে পুড়ছে অদিনের অন্ধকার
শ্যামল কবিতা ছাড়া এই সন্তাপে কে দেবে তোমাকে সান্ত্বনা
কোথায় জুড়োবে আর প্রাণ, স্পর্শহীন প্রাণের অসীম জল,
তোমার মূরতি আজ তুমিহীন,শরাবের গানের গজল
হারিয়ে সন্তান, প্রিয়সখা নিজেকে সঁপেছ আজ অতিদূর
শূন্যতার ঐ উদ্যানে, গোপন আত্মার এক নিরামিষ ভোজে
বিচারের বাণী কেন তবু কাঁদে আজো এই নিভৃতে একাকী?
শ্রমিকের রক্ত-ঘামে আজো দেখো সব শকুনের উড়াউড়ি
শোষণের ইতিহাস ভুলে তাই অযথা সে বাজায় খঞ্জনা?
বিদ্ধবাণে হায়েনারা হাসে, যেন ক্রীতদাসের ক্লিন্ন আকূতি;
অনাদি, তোমার রূপে একদিন ফুটেছিল তরল আগুন
ভেতরে প্রবহমান বেজেছিল কবিতার অমৃত সঙ্গীত
প্রকৃত সত্যের কাছে অনড়, হার না মানা হেমলক হাতে
তুমি আজো পাশে আছো জনতার,অবিনাশী কবিতায়;
সত্যের-সরোদ তুমি জেগে ওঠো হিরণ্ময় আলোর মিছিলে।