সাহিত্যে এখন বিষয়ভিত্তিক লেখার উৎসব চলছে। সম্পাদকরাই বিষয় নির্ধারণ করে দিচ্ছেন, লেখকরা কামলার মতো খেটে যাচ্ছেন। বিষয়টা স্পষ্ট হয় ইদানিং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যেমন, কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। এ মৌসুমে কমবেশি বৃষ্টি হবেই। তাই বৃষ্টিতে ভিজে বৃষ্টি নিয়ে কিছু লেখা তো গতানুগতিক। বরং বৃষ্টিতে ভিজে শীত বা প্রচণ্ড গরম নিয়ে লিখতে পারাটা ব্যতিক্রম কিছু। ফেসবুকে সবাই বৃষ্টি নিয়ে লিখে যাচ্ছেন।
আসলে আমরা বৃত্তের বাইরে যেতে চাই না; চেষ্টাও করি না। না কি পারি না? তাই এখনো রাবীন্দ্রিক ঢঙে কবিতা লিখি, বঙ্কিমি ঢঙে গল্প। ভাবি, একটা মহাকাব্য লিখলেই পেয়ে যাবে নোবেল। বলি কী, পাঠক কি আর সাধে কমে? গ্রন্থ থেকে শুরু করে সিনেমা-নাটকেও একই দশা। এই দশার কষাকষিতে পাঠক মশায়ের আত্মরাত্মা বের হওয়ার উপক্রম।
গল্পটা কবে যেন পড়েছি। সিনেমাটা কোন গল্পের মতো যেন মনে হচ্ছে। অমুক লেখক একই কাহিনি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নতুন মলাটে আনেন। অমুক পরিচালক এমন কাহিনি ছাড়া নতুন কিছু বোঝেন না। একই নাটক কত দেখতে ইচ্ছে হয়। কোনো নতুনত্ব নেই। এমন অভিযোগ পাঠক-দর্শক ও সমালোচকদের। অভিযোগের শেষ নেই। তবে সুরাহাও নেই। কাজ হচ্ছে, সমালোচনা হচ্ছে। গল্প চুরি হচ্ছে, সিনেমা নির্মিত হচ্ছে, পুরস্কার ঘোষিত হচ্ছে, আবার ফিরিয়েও নেওয়া হচ্ছে। চারিদিকে কেবল হচ্ছে। কিন্তু মানসম্মত কিছু হচ্ছে কি?
‘বস্তুত শিল্প মানেই নকল নয় কী?’—কবির একথা আমিও মানি। যেমন, আজ বৃষ্টি হলো। সবাই লিখল, ‘আকাশে হঠাৎ কালো মেঘ। ধেয়ে এলো একঝাঁক বৃষ্টি। আমি ভিজলাম। বাসায় ফিরলাম। গা-গতর মুছলাম। খিচুরি খেতে ইচ্ছে হলো। বউ বা বুয়াকে বললাম। খিচুরি হলো, খেলাম।’
একটা উটকো জ্বালাতনও
এটা একটা সরল অঙ্ক। অঙ্কটাকে জটিল করাটাই শিল্প। সেজন্য প্রয়োজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। যে দৃষ্টি সবার চেয়ে আলাদা। একটু নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও দূরদৃষ্টি প্রয়োজন। তাহলেই লেখাটা শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারে।
সেজন্য বৃষ্টির মাঝেও খুঁজে নিতে হয় আলাদা কোনো উপলক্ষ বা উপকরণ। অফিস বা কর্মশেষের বৃষ্টি আমার কাছে দুর্ভোগ। পকেটে বা হাতে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থাকে। বাসায় ফেরার তাড়া থাকে। ফিরতি পথে বাজার বা কেনাকাটার আদেশ থাকে। নতুন বা নড়বড়ে জুতো জোড়া নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে। কত কিছুই না হতে পারে। কিংবা খোলা আকাশের নিচে প্রেমিকার কাঁধে বাহু থাকে। অনেক পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার ক্ষোভ থাকে। তাই আমার কাছে বৃষ্টি মানে সিনেমার মতো দু’হাত তুলে ভেজা নয়। দামি ফোনটা নষ্ট হওয়ার ক্ষোভ থাকতে পারে। বৃষ্টি মানেই উপভোগ্য সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা কিংবা রাত নয়; একটা উটকো জ্বালাতনও।
আপনি যা তৈরি করবেন; সেটা দ্রব্য হতে পারে। শিল্প নাও হতে পারে। আবেগ দিয়েই নয়, বিবেককেও কাজে লাগাতে হয়। নতুন কিছু খুঁজতে হয়। যার সন্ধান এখনো হোমার থেকে শুরু করে সদ্যপ্রয়াত রফিক আজাদ বা অরুণ সেনরাও দিয়ে যাননি। গল্পে কবিতায় শুধু গ্রামীণ শব্দই নয়, অর্থবহ শব্দ নিন। যা গেঁয়ো ও নাগরিক উভয়ের স্মৃতিকে নাড়া দিতে পারে। বেশ্যার চিরাচরিত রংঢং বাদ দিয়ে ভেতরের করুণ স্বপ্নগুলো দেখুন।
আপনি মানেন বা না-ই মানেন, শিল্পোত্তীর্ণ সাহিত্যের জন্য শিল্পের কাছে দায়বদ্ধতা প্রয়োজন। আপনি যে মাধ্যমেই কাজ করেন না কেন, পাঠক কিংবা দর্শকের কাছে জবাবদিহিতা থাকতে হবে। যদি বলেন, ‘পাঠকদের কাছে দায়বদ্ধতা থাকতে হবে কেন? লেখক লিখবেন নিজের মতন। পাঠকদের মন জুগিয়ে লিখলে আর লেখক হওয়া কেন, এর চেয়ে উকিল হলে ভালো। মক্কেল যা চায়, তাই করবে।’ আমি বলি কি, ‘পাঠকের জন্যই লেখকের জন্ম। পাঠকের মাঝেই লেখক বেঁচে থাকবেন। সমর্থক বা দর্শকের কাছে যদি ক্রিকেটারদের দায়বদ্ধতা থাকতে পারে, জনগণের কাছে যদি সরকারের দায়বদ্ধতা থাকতে পারে, তবে পাঠকের কাছে লেখকের দায়বদ্ধতা থাকবে না কেন? পাঠক টাকা দিয়েই বইটা কিনবেন। প্রতিপক্ষকে ঠকিয়ে ভালো উকিল হওয়া যায়, তবে পাঠককে ঠকিয়ে ভালো লেখক হওয়া যায় না।’
ইদানিং ফেসবুকে সাহিত্যচর্চা হচ্ছে। ভালো কথা। ডিজিটাল যুগে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে মনে রাখবেন, ফেসবুকের স্ট্যাটাসভিত্তিক সেলিব্রেটি হয়ে লাভ কী? সেটাকে আমি সাহিত্য বলি না। বলতে পারি কথোপকথন। তাৎক্ষণিক তৃপ্তি হয়তো পাওয়া যেতে পারে। তবে তার স্থায়ীত্ব নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আসল কথা হচ্ছে, পাঠকের অন্তরে প্রবেশ করতে হবে। তথাকথিত বিক্রি বাড়ানোর চেয়ে পাঠক বাড়াতে হবে। হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরক’ হাত ঘুরতে ঘুরতে মলাট খুলে যেতে দেখেছি। বই বিক্রি নিয়ে লেখককে ভাবতে হবে কেন? ওটা প্রকাশকের হাতেই ছেড়ে দিন। নাকি বইয়ের পেছনে লেখকেরও লগ্নি থাকে বলে তাকেও প্রচারে বেরোতে হয়। লেখা কি পণ্য বা প্রচার কেন্দ্রিক হওয়া জরুরি? সাহিত্যকে পণ্য ভাবলে খুব কয়েকজন সেলিব্রেটির কাছ থেকে প্রচারপত্র লিখে সাহিত্য পাতায় কিংবা বিজ্ঞাপন বিভাগে পাঠিয়ে দিন।
প্রকাশের বিষয়টা আপাতত না ভাবলেও চলবে
মনে রাখবেন, লেখা প্রকাশ হওয়ার আগে সেটা সত্যিকারের লেখা হয়ে উঠেছে কি না, তা ভাবার প্রয়োজন আছে। কোনো পত্রিকার সাহিত্য পাতায় আপনার লেখা প্রকাশ হয়নি বা কোনো বইমেলায় বই আসেনি বলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আপনি মনের আনন্দে লিখে যান। প্রকাশের বিষয়টা আপাতত না ভাবলেও চলবে।
দেখুন, মৃত্যুর আগেও জীবনানন্দ দাশকে কেউ কবি হিসেবে অতেটা চিনতেন না। যতটা না পরিচিতি পেয়েছেন মৃত্যুর পর। এখন জন্মের শতবছর পরে এসে জীবনানন্দ জীবন্ত ও বিরাজমান। তাই বলছি, পাঠকের কাছে পৌঁছতে হবে লেখককে। তা নাহলে লেখকের সার্থকতা কোথায়? লেখকতো অনেকেই। স্মরণীয় হতে পেরেছেন ক’জন।
সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ রাখবেন, বই কিনে খুশি করা পাঠকের চেয়ে কট্টর সমালোচকও অনেক ভালো। বইটা অনেক সুন্দর, এক কথায় কেউ বলে দিল আর আপনি দিব্যি আনন্দে চলে এলেন। ব্যাপারটা ওখানেই চুকে গেল। বহুলপঠিত বিষয়টি যে বইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তা সংখ্যায় কম হলেও যুগে যুগেও তার পুনর্মুদ্রণের দাবি রাখে।
একটা সিনেমা আমরা বহুবার দেখি আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় বলে। তেমনি একটা বইও বারবার পড়ব, যদি মনটাকে আঁকড়ে ধরতে পারে। হোমার যদি অন্ধ হয়ে বিখ্যাত ইলিয়ড-ওডেসির জন্ম দিতে পারেন, তবে আপনি তো অন্ধ নন। আমার মনে হয়, হলধর নাগ আপনাদের সঠিক জবাবটা হয়তো দিতে পেরেছেন। তাঁর কাছে আমি অতি নগণ্য, অতি তুচ্ছ। দেখেছেন, তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়া একজন মানুষ কি নিরলসভাবে সাহিত্যচর্চা করছেন! এ থেকেই প্রমাণ হয় শিল্প বা সাহিত্যচর্চায় প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শিল্পবোধ, সৃষ্টিশীল মেধা ও মনন।
ডিগ্রিধারী, পদকধারী লেখকদের চেয়ে হলধর নাগের গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। হলধর নাগের সৃষ্টিকর্মের ওপর পাঁচজন গবেষণা করে ডিগ্রি নিয়েছেন। তারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে হলধর নাগের ওপর প্রবন্ধ তৈরি করেছেন। আর হলধর নাগ রয়ে গেলেন সাদামাটা। তাই বলি, আমাদের প্রত্যেককেই শিল্পের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। পাঠকের অন্তরে প্রবেশ করতে হবে।