সুরাইয়া সুলতানা শিখা। আমার শিখা আপা। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগে শিখা আপা আমার বড় বোন ছিলেন। তাকে নিয়ে কলেজ জীবনে একটি কবিতা লিখেছিলাম। শিরোনাম, ‘ভালোবাসার একমুঠো জুঁই’। কবিতাটি এখানে তুলে ধরছি।
মমতাপুরের মমতার সাথে কথা ছিল
ছেঁড়া কাঁথার ওপর একমুঠো স্নেহের জুঁইফুল বুনে দেবো
বিশ্বাসী ভালোবাসা শব্দহীন হয়ে জেগে উঠবে
কচিপাতার মতো সবুজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে;
সূর্যাস্ত যেমন নীরব ভাষায় চেয়ে থাকে কিছুটা সময়
সুন্দর হৃদয়ের রমণী মমতার ভেতরে
একমুঠো শাদা অভিমানে…মমতাপুরের সুরাইয়া সুলতানা শিখার দুচোখে
স্নেহের মুঠিমুঠি শাসন-সুদূর নীলিমায়
ছোটখাটো কোনো এক সুন্দর সংসার সংসদে,
আমি যেন সে সংসার সংসদের শাদা এক চড়ুই।মমতাপুরের মমতার বুকের নিচে ছোটখাটো এক খড়ের ঘরে
শুয়ে থাকি চিরকাল—করি বসবাস সুঘ্রাণ আতরি রুমালে।দেখেছিলাম উঁকি মেরে একদিন
একমুঠো কোমল মাটির মতো হৃদয় তার
বহুদিগন্তের পথ সাঁতরিয়ে অবমেষে—সূর্যাস্ত রঙচঙের পুকুরে
রূপালি মৎস্যের পিঠের মতো তার চিকচিকে ওড়ানার আঁচল
ধরে বললাম, ‘এতো তুমি খুঁজেছি তোমারে বহুদিন’।তাকালো মমতাপুরের মমতা স্বচ্ছ কাঁচের মতো উজ্জ্বল দুচোখে
কাজল ছিল কিছুটা—
শাসনের ভঙ্গিতে ইশারাতে চোখ মেলে কহিল
‘তোর চেয়ে খুঁজেছি তোরে আমি— তোর চেয়ে আগে’।নেমে এলো সন্ধ্যা—ঝুপঝাপ হৃদয়ের চালে
স্নেহের রাশি রাশি বাদলধারা
সকলের আড়ালে খুব চুপি চুপি তার বুকের দরজা খুলে
মমতার নরম পালঙ্কে ঘুমিয়েছি সেই আমি
ভালোবাসার একমুঠো জুঁইফুল হয়ে…
আজ সেই শিখা আপা নেই। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। এরপরও এটিই যে এখন চরম বাস্তব, তাও মানতে হচ্ছে। শিখা আপাকে আমি সব সময়ই বড় বোন মান্য করেছি। শ্রদ্ধা করেছি। সম্মান করেছি। সে কারণেই তার স্বামী প্রফেসর ড. রজিকুল ইসলামকে ‘দুলাভাই’ ডাকি। এখনো ডাকি।
এত আন্তরিকতা দিয়ে আমাকে আর কেউ খুলনায় যেতে বলবেন না। হয়তো কখনো আমার খুলনা যাওয়াও হবে। কিন্তু শিখা আপার মায়াবী মুখটা আমি আর দেখতে পাবো না।
জানি না কী কারণে শিখা আপা আমাকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। আদর করতেন। আমিও আপন বড় বোনের মতো বরাবর মেনে এসেছি। আমি যখন অনার্সের ছাত্র, তখন কুষ্টিয়া থেকে আমার প্রথম কবিতার বই ‘অনিয়ম চুম্বনের সিঁড়ি ধরে’ বের হয়। ১৯৯১ সালে। সেই বইয়ে শিখা (সুরাইয়া সুলতানা শিখা) আপাকে নিয়ে একটা কবিতা ছিল। তাকে নিয়ে লিখেছিলাম। বই প্রকাশের আগে তিনি জানতেন না। বই প্রকাশের পর যখন তার হাতে দিলাম, পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে তাকে নিয়ে লেখা ‘ভালোবাসার একমুঠো জুঁই’ কবিতাটি চোখে পড়তেই আনন্দে কেঁদে ফেলেন। বলেছিলেন, ‘তুই আমাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিস! তাও আবার বইয়ে! ভাই তুই অনেক বড় হ। তোর জন্য এই দোয়া আমার।’ কথাগুলো আজ খুব মনে পড়ছে। মনটা কেঁদে উঠছে।
ড. রজিক ভাই যখন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন, তখন আমি যতবার কুষ্টিয়া গেছি, ততবার তাদের বাসায় গেছি। গেট থেকেই জোরে ডাক দিতাম, ‘আপা, দরোজা খোলেন।’
‘রকিব আইচে’ বলেই দরোজা খুলেই বলতেন, খাবার টেবিলে বয়। আমি গেলেই এটা ছিল তার প্রথম কথা। তারপর কত কথা, অনেক রাত অবধি।
ড. রজিক ভাই একসময় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেন। তারপর থেকে আমার যোগাযোগে বড় রকমের ঘাটতি ঘটে গেলো। কখনো কখনো আপার সঙ্গে মোবাইলফোনে কথা হয়েছে। তাও খুব কম। প্রত্যেকবারই আপা বলেছেন, খুলনায় আপাকে দেখতে এলে না তো!
বলেছি, আসবো আপা। একদিন হুট করে এসে আপনাকে চমকে দেবো। আমার আর যাওয়া হয়নি। তাকে চমকেও দেওয়া হয়নি। তিনিই আমাদের চমকে দিয়ে চলে গেলেন, চিরকালের মতো।
আপাকে দেওয়া কথাটা আমার আর রাখা হলো না। অপরাধবোধ হচ্ছে। খারাপ লাগছে। কান্না পাচ্ছে। এত আন্তরিকতা দিয়ে আমাকে আর কেউ খুলনায় যেতে বলবেন না। হয়তো কখনো আমার খুলনা যাওয়াও হবে। কিন্তু শিখা আপার মায়াবী মুখটা আমি আর দেখতে পাবো না।
পরম করুণাময় আল্লাহ তা’লা, তুমি আমার বোনের আত্মার শান্তি দাও। তাকে বেহেস্ত দান কর। আমিন।