শিক্ষিত মানুষ কেমন? তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চেতনা, অনুভব ও অনুভূতি কেমন?
কথায় আছে, ‘মানুষ শিক্ষিত হলে তার চোখ খুলে যায়!’ অনেকদিন ধরে এর অর্থ বোঝার চেষ্টা করছি। পুরোপুরি অর্থ এখনো বুঝে আসেনি। যদি মানুষ শিক্ষিত হওয়ার পরও চোখ না খোলে বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হয়, তাহলে তাদের আমরা শিক্ষিত বলবো?
শিক্ষিতরা যা কিছু দেখেন, তা যদি মানবমঙ্গলের উদ্দেশ্যে হয়, তা হলে তারা শিক্ষিত বলে বিবেচিত হবেন। যারা অনেক কিছু দেখেও দেখেন না বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেন না, তাদের শিক্ষা ব্যর্থ। কারণ শিক্ষা যদি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে না পারে, তাহলে তারা প্রকারান্তে অশিক্ষিত হিসেবেই গণ্য হবেন।
মনীষীরা বলেছেন, যিনি যত বেশি শিক্ষিত, তিনি তত বেশি ভদ্র, নম্র ও সাধারণ। প্রকৃত শিক্ষিতরা ‘স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং’-এর প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে ‘স্ট্যান্ডার্ড অব লাইফ’কেই গুরুত্ব দেন। স্টান্ডার্ড অব লিভিং ও স্ট্যান্ডার্ড অব লাইফের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। অনেকে আবার এই দুটিকে এক কাতারে ফেলে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন।
ধরুন, এক ব্যক্তি অনেক দাম দিয়ে একটি রোলেক্স ঘড়ি কিনলেন। আর অন্য একজন কম দামে একটি ক্যাসিও ঘড়ি কিনলেন। উভয়ের উদ্দেশ্য —সময় দেখা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—বেশি দামের রোলেক্স ঘড়ি ও কম দামের ক্যাসিও ঘড়ি দু’টি কিন্তু একই সময় দেবে। মৌলিক বিষয় হচ্ছে সঠিকভাবে সময় দেওয়া। ঘড়িটির মূল্য কত, দেখতে কেমন—তা কিন্তু নয়। যেমন, কেউ যদি বিএমডব্লিউ গাড়িতে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার পথ পাড়ি দেন, তাহলে কী ঢাকা ও চট্টগ্রামের দূরত্ব কমে যাবে? এখানে গাড়িটি কোন ব্র্যান্ডের তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, দূরত্বই আসল। ঘড়ির দাম, সৌন্দর্য ও গাড়ির ব্র্যান্ডের ওপর ভিত্তি করে জীবনকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে ‘স্টান্ডার্ড অব লিভিং’।
সন্তান বাবাকে জিজ্ঞেস করলো—বাবা আমরা কি এই পথ পাড়ি দিতে পারবো? বাবা বললেন অবশ্যই পারবো। কিছু দূর যাওয়ার পর তারা দেখলো রাস্তায় একটি গাছের ডাল পড়ে আছে।
একদিন ষাটোর্ধ্ব এক শিক্ষিকা ক্লাসে এসে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করলেন ‘I am beautiful’— এটি কোন কাল? একজন ছাত্র উত্তর দিলো, ‘ম্যাডাম এটি অতীতকাল’। ওই শিক্ষার্থী বাক্যের ব্যাকরণগত এড়িয়ে গিয়ে শিক্ষককে তার অতীত মনে করিয়ে দিয়েছে। সে বোঝাতে চেয়েছে–ম্যাডাম আগে সুন্দরী ছিলেন । এখন সুন্দরী নন। তাই এটি অতীত কাল। আমরা মানুষকে বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে মূল্যায়ন করি। প্রকৃতপক্ষে বাহ্যিক সৌন্দর্য আসল সৌন্দর্য নয়। অন্তরের সৌন্দর্য দিয়ে মানুষকে মূল্যায়ন করতে শিখতে হবে।
একটি গল্প মনে পড়ে গেলো। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন সাধারণ মানুষ খুব ইচ্ছেপোষণ করলেন—প্রেসিডেন্টকে দেখতে যাবেন। ইতোমধ্যেই তিনি জেনে নিয়েছেন—তার বাসস্থান থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে একজায়গায় প্রেসিডেন্ট আসছেন। গ্রামের মেঠোপথ ও সাধারণ যানবাহনে চড়ে অনেক কষ্টে যে শহরে স্বপ্নের প্রেসিডেন্ট আসছেন, সেখানে তিনি যেতে লাগলেন। যার সঙ্গে দেখা হয়, তাকেই জিজ্ঞাসা করেন, তারা প্রেসিডেন্টকে কখনো দেখেছেন কি না? প্রেসিডেন্ট দেখতে কেমন? তিনি কি হ্যান্ডসাম? যারা প্রেসিডেন্টকে দেখেছেন, তারা বলেন প্রেসিডেন্ট খুবই অর্ডিনারি, একদম অডিনারি! প্রেসিডেন্ট হ্যান্ডসাম না। কিন্তু লোকটি তবু আগ্রহ হারাননি প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ করতে। অবশেষে দেখা হলো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট তাকে দেখা মাত্রই হাত বাড়িয়ে দিলেন। তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। খোঁজ-খবর নিলেন। কাঁধে হাত দিলেন। লোকটি বললেন, কে বলেছে আমাদের প্রেসিডেন্ট সাধারণ! হ্যান্ডসাম না! দেখতে খুবই অডিনারি! আমার জীবনে আমি এরকম হ্যান্ডসাম মানুষ কখনোই দেখিনি। এই প্রেসিডেন্টে হলেন ভারতের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট, পারমাণবিক মানব ও বিজ্ঞানী এপিজে আব্দুল কালাম। ভারতের প্রেসিডেন্ট এপিজে আবদুল কালাম বলেন, হ্যান্ডসাম ওই জিনিস নয়, যা শুধু মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। হ্যান্ডসাম হল ‘hand to someone’. যিনি অন্যের বিপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, মানুষকে কাছে টানেন, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত হ্যান্ডসাম ও শিক্ষিত।
শিক্ষিত মানুষ জানেন—কিভাবে সমস্যার সমাধান করতে হয়। শিক্ষিতরা পরস্পরকে উদ্বুদ্ধ করেন কাজ করতে-শেখাতে-শিখতে। একদিন এক বাবা তার সন্তানকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। সন্তান বাবাকে জিজ্ঞেস করলো—বাবা আমরা কি এই পথ পাড়ি দিতে পারবো? বাবা বললেন অবশ্যই পারবো। কিছু দূর যাওয়ার পর তারা দেখলো রাস্তায় একটি গাছের ডাল পড়ে আছে। সন্তান বাবাকে জিজ্ঞেস করলো—আমি কি এই গাছের ডালটি সরাতে পারবো? বাবা উত্তর দিলেন, অবশ্যই পারবে, যদি তুমি তোমার সব শক্তি ব্যবহার করতে পারো। সন্তান সাধ্যমতো চেষ্টা করলো কিন্তু কোনোভাবে গাছের ডালটি সরাতে পারলো না। বাবাকে আবার জিজ্ঞেস করলো, বাবা আমি তো পারছি না। বাবা আবার উত্তর দিলেন, পারবে যদি তুমি তোমার সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করো। আবার আপ্রাণ চেষ্টা করলো কিন্তু কোনোভাবেই গাছের টুকরোটি সরাতে পারলো না।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ লার্নিংয়ের তুলনায় আর্নিংকে গুরুত্ব দেন। আর্নিং হলো আমাদের অন্তরের আবেগ। বাস্তবে আমরা সবকিছু নাম ও খ্যাতি অর্জনের জন্য করি।
বাবাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো—আর বাবা একই উত্তর দিলেন। বললেন, হে আমার সন্তান তুমি যে শক্তি ব্যবহার করেছ, তা শুধু তোমার একার। তোমার একার শক্তি হচ্ছে তোমার শক্তির একটি অংশমাত্র। আমি তোমার পাশে আছি কিন্তু গাছের টুকরোটুকু সরাতে তুমি আমার সাহায্য চাইলে না। তোমার শক্তি আর আমার শক্তি দু’টি মিলেই তোমার শক্তি। এককভাবে সমস্যার সমাধান করতে চাইলে সে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। দরকার একে অন্যের সহযোগিতা। পৃথিবীতে কেউ ইন্ডিপেন্ডেন্ট নয়। আমারা কাউকে ডিপেন্ডেন্ট হতেও বলছি না। আমরা সবাই ইন্টার-ডিপেন্ডেন্ট। সহযোগিতা চাওয়া কোনো দুর্বলতা নয়, এক ধরনের বিজ্ঞতা।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমরা মোবাইল, ল্যাপটপে চার্জ আছে কি না—নিশ্চিত হই। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে ওঠার মাধ্যমে আমাদের যে একটি নতুন জীবন শুরু হয়েছে, তা পরিচালিত করার জন্য আমরা নিজেদের চার্জ দিয়েছি কি না, তা বেমালুম ভুলে যাই। আমাদের সারাদিনের জন্য চার্জ করতে পারি ইতিবাচক চিন্তা ও ভালো কাজ করে।
আমরা আর্নিং নিয়ে খুব ব্যস্ত কিন্তু লার্নিং নিয়ে নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ লার্নিংয়ের তুলনায় আর্নিংকে গুরুত্ব দেন। আর্নিং হলো আমাদের অন্তরের আবেগ। বাস্তবে আমরা সবকিছু নাম ও খ্যাতি অর্জনের জন্য করি।
যেকোনো উপায়ে আমরা আর্নিং চাই। টাকা মধুর থেকে মিষ্টি (money is more sweeter than honey). আমি অস্বীকার করছি না—টাকা অর্জন করা খারাপ। জীবনধারণের জন্য অর্থ-সম্পদ অবশ্যই প্রয়োজন। সমাজ সেবার জন্য, ধর্মীয় কাজ ও অন্যের উপকার করতে অর্থ প্রয়োজন। আমি ব্যক্তিগতভাবে আর্নিংয়ের বিপক্ষে নই কিন্তু আমরা আর্ন (earn) করতে করতে লার্ন (Learn) করার কথা ভুলে যায়। Gaur Gopal Das- এর মতে, ‘Life is for growing through not for going through. Going through comes with money and growing through comes by knowledge”.
আর্ন (Earn) ও লার্ন (Learn) শব্দ দু’টির মধ্যে শুধু পার্থক্য ইংরেজি আলফাবেট (Alphabet) এল (L) এর। আর এই এল (L)-এর অর্থ হচ্ছে: ‘L’ is for listen carefully to people who have experiences, listen carefully to people who have knowledge, listen carefully to people who have wisdom and maturity and listen carefully to people who have action. সুতরাং আমাদের স্লোগান হচ্ছে ‘neither earn nor learn, but learn and earn’.