শামসুর রাহমান (জন্ম : ২৩ অক্টোবর ১৯২৯-মৃত্যু : ১৭ অগাস্ট ২০০৬) ব্যক্তিজীবনে আপাদমস্তক শহুরে ছিলেন। তাই কবিতায় তিনি নগরকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার বলার ভঙ্গি ও কবিতার উপকরণ তাই স্বভাবসুলভ নগরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। নগরের হতাশা, কৃত্রিমতা, অন্তঃসারশূন্যতা, প্রেম-ভালোবাসা, ব্যস্ততা, যান্ত্রিকতা ইত্যাদি উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। আলোচ্য ‘জন্মভূমিকেই’ কবিতাতেও এসব দিকগুলো উঠে এসেছে।
তাঁর ‘জন্মভূমিকেই’ কবিতার মাধ্যমে স্বদেশ দেখেছেন, দেখেছেন নগর জীবনের সংকট। এ কবিতাটি কবির ‘যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ ‘জন্মভূমিকেই’ কবিতাটি তুলে ধরা যাক :
শহরে রোজ ট্রাফিক গর্জায়,
চতুর্দিকে চলছে কী হুজুগ;
কত চৈত্র, কত শ্রাবণ যায়,
তোমাকে আমি দেখি না কত যুগ।অথচ দেখি নিমেষে আজকাল,
একলা ঘরে যখনই চোখ বুঝি।
খাটিয়ে রাঙা কল্পনার পাল
তোমার কাছে গিয়েছি সোজাসুজি।তোমাকে দেখি তালদীঘির ঘাটে,
শারদ ভোরে দূর বেদাগ নীলে;
তোমাকে দেখি ফসলছাওয়া মাঠে,
চিলেকোঠায়, দূর চলনবিলে।তোমার চোখ, তোমার কেশভার
ঝলসে ওঠে আমার চোখে শুধু।
কে আশাবরী শোনায় বারবার,
হৃদয়ে জ্বলে স্মৃতির মরু ধূ ধূ।বৃথাই আমি তোমাকে কাছে চাই;
হিংস্র দিন, স্বৈরাচারী রাত
আমাকে রোজ পুড়িয়ে করে ছাই—
পাই না আর তোমার সাক্ষাৎ।তোমার কাছে শিখেছিলাম বটে
বাঁচার মানে নতুন করে মেয়ে।
এখন শুনি নানান কথা রটে,
সত্য গেছে মিথ্যাতেই ছেয়ে।রটনা জানি নেহাৎ একপেশে,
স্বপ্নেও যে তোমার দেখা নেই।
কিন্তু মেয়ে তোমাকে ভালোবেসে
হৃদয়ে চাই জন্মভূমিকেই।
[জন্মভূমিকেই, যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে (১৯৮৪)]
প্রথমে প্রকরণগত আলোচনা করা যাক। কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। ৭টি স্তবক রয়েছে। প্রতি স্তবকে ৪টি করে পঙ্ক্তি রয়েছে। কবিতাটি ৫-মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে নির্মিত। ৫+৫+২ মাত্রার ছন্দবিন্যাসে এ-কবিতার অনেক স্থানে মধ্যখণ্ডন হয়েছে। মধ্যখণ্ডনে ক্লান্তি আসে না। শব্দচয়নে কোথাও ক্লান্তিকর মনে হয়নি। ছন্দের বাঁধন এতটুকু আলগা হয়ে যায়নি। অন্ত্যমিলও লক্ষ করা যায় (প্রতি স্তবকের ২য় ও চতুর্থ ছত্রে)। ছন্দবিন্যাস ও অন্যান্য উদাহরণ ও নমুনা হিসাবে প্রথম স্তবক তুলে ধরি:
শহরে রোজ/ ট্রাফিক গর/জায়, (৫+৫+২)
চতুর্দিকে/ চলছে কী হু/জুগ; (৫+৫+২)
কত চৈত্র,/ কত শ্রাবণ/ যায়, (৫+৫+২)
তোমাকে আমি/ দেখি না কত/ যুগ।(৫+৫+২)
জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘উপমাই কবিত্ব’। তিনি চিত্রকল্পকে উপমা হিসেবে ধরতে চেয়েছেন হয়তো। কারণ তাঁর কবিতায় চিত্র ও চিত্রকল্পের ছড়াছড়ি। উপমাসহ বিভিন্ন অলংকারের মাধ্যমেই চিত্রকল্প নির্মাণ করা হয়। ফলে জীবনানন্দ দাশের এ মনোভাবের একটু সংশোধন করার প্রয়োজন দেখা দিলো। ফলে পরবর্তী অনেক কবি বা আলোচক চিত্রকল্পকে উপমার জায়গায় প্রতিস্থাপন করলেন। শামসুর রাহমান বলেন, ‘প্রতীক-চিত্রকল্পই কবিত্ব’। তাঁর কবিতায় এ বক্তব্যের প্রমাণ মেলে। শামসুর রাহমানের আলোচ্য কবিতায় চিত্র বা চিত্রকল্প নির্মাণে বেশ মুন্সিয়ানা দেখা যায়। ‘প্রতীকী’ কবিতা চিত্রকল্পের সর্বোচ্চ ব্যবহার বলে ধরা হয়। প্রতীকী হিসেবেও কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তালদিঘির ঘাটে, বেদাগ নীলে, ফসলছাওয়া মাঠে, চিলেকোঠায়, দূর চলনবিলে, তোমার কেশভার, খাটিয়ে রাঙা কল্পনার পাল, ঝলসে ওঠে আমার চোখে শুধু, হৃদয়ে জ্বলে স্মৃতির মরু ধূ ধূ ইত্যাদির মতো শব্দ-শব্দগুচ্ছ পাঠকচিত্তকে মোহিত করে। ‘সত্য গেছে মিথ্যাতেই ছেয়ে’ প্রতীকী হিসেবে বহুমাত্রিক অর্থ উন্মোচিত করে। ‘হৃদয়ে চাই জন্মভূমিকেই’ ছত্র স্বদেশ ও মাতৃভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। হিংস্র দিন, স্বৈরাচারী রাত ইত্যাদির মতো শব্দগুচ্ছের প্রয়োগ নতুনত্ব এনেছে, পাঠকের রুচিকে পুনর্জন্ম দেবে।
একজন কবির কবিতা আলোচনা করার সময় দুটি বিষয় মাথায় রাখা হয়। কবিতার প্রকরণগত গুণ এবং কবির মানস দিক। প্রকরণগত আলোচনার পর কবির মানসলোক আলোচনা করা যাক। একটি কবিতায় দুটি বিষয়েই যারা সফল, তারা সফল-বড় কবি। পাঠকের নিকট জন্মান্তরে স্থান করে নিতে পারেন। একটা শহর ছোট না বড় তা আয়তন দিয়ে পরিমাপ করা যায় না, করতে হয় সেখানকার মানুষের স্বপ্ন দিয়ে। শহর তো তা-ই যা তার নাগরিকরা তাকে বানায়। নগরসভ্যতার পচন ও অবক্ষয় রাহমানকে ভাবিয়ে তুলত, গভীরভাবে ব্যথিত করত। ঢাকা শহরকে মনে হতো মরুভূমির মতো নিঃসঙ্গ। অনেক কবিতায় মিশে আছে কবির তীব্র বেদনা ও ক্ষোভ প্রকাশ হয়েছে ঘৃণায়, কবিতার পাশাপাশি রাজপথেও :
শহরে রোজ ট্রাফিক গর্জায়
চতুর্দিকে চলছে কী হুজুগ;
কত চৈত্র, কত শ্রাবণ যায়
তোমাকে আমি দেখি না কত যুগ।
(জন্মভূমিকেই)
ঢাকার কাব্যজগতের স্বনামধন্য বরেণ্য কবি হিসেবে তার সময়ের সম্মান অর্জন করেছেন রাহমান। কী রাষ্ট্র, কী বি-রাষ্ট্র, কবিতা আড্ডা, কবির জন্মদিন, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, প্রকাশনা উৎসব, বইমেলা, বৈশাখী মেলা সবক্ষেত্রে শামসুর রাহমান ছিলেন প্রধান আকর্ষণ। তিনি কবিতা নিয়ে কথা বলতেন। নগরজীবনের দ্বন্দ্ব, নৈরাজ্য, অসঙ্গতি প্রেম, বিরহ সবকিছু ধারণ করেছেন তিনি কাব্যভাষা নির্মাণে। নগরের হতাশা, বেদনা, অপ্রাপ্তি নিয়ে কবিতার কয়েক ছত্র
বৃথাই আমি তোমাকে কাছে চাই
অত্যাচারী দিন, স্বৈরাচারী রাত
আমাকে রোজ পুড়িয়ে করে ছাই
পাই না আর তোমার সাক্ষাৎ।
(জন্মভূমিকেই)
‘সত্য গেছে মিথ্যাতেই ছেয়ে’ বলে কবি শামসুর রাহমান বর্তমানের অন্ধকারের দিকগুলো দেখাতে চেয়েছেন। সত্য ও সততা সমাজে খুব কমই দেখা যাচ্ছে। ভণ্ডামি, কপটতা বা ছদ্মবেশই এখন প্রধান নিয়ামক। এসবে আধিক্যতা এত বেশি যে, সত্য আর মিথ্যাকে প্রভেদ করা খুবই কঠিন। জীবন জটিল ও কুটিল হয়ে উঠেছে এসবে। কবি বলেন,
তোমার কাছে শিখেছিলাম বটে
বাঁচার মানে নতুন করে মেয়ে।
এখন শুনি নানান কথা রটে,
সত্য গেছে মিথ্যাতেই ছেয়ে।
বিশ্বকবিতার আধুনিক ও নগরের কবি টি এস এলিয়ট নগর সংকট তুলে ধরেছেন। আমাদের শামসুর রাহমানের অনেক কবিতার প্রধান উপাদান নগর, নগরসভ্যতা। তাঁর কবিতায় নগরের উপাদানের আধিক্যজনিত তাকে নাগরিক কবি বলা হয়। স্বদেশ, স্বাধীনতা ও বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে রাহমানের কবিতা সামনে এসেছে। তিনি প্রেমিকাকে পাশে রেখেই প্রিয় জন্মভূমিকে হৃদয়ে ধারণ করতে চান।
‘কিন্তু মেয়ে তোমাকে ভালোবেসে
হৃদয়ে চাই জন্মভূমিকেই।’