[শরীফ এনামুল কবির একাধারে শিক্ষক, রসায়নবিদ ও লেখক। আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি, আজ তার জন্মদিন। এই মহান রসায়নবিদকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন তরুণ কথাশিল্পী হারুন পাশা]
শরীফ এনামুল কবির—বাংলাদেশে যে কয়জন রসায়নবিদ আছেন, তাঁদের একজন। তিনি। তাঁর রসায়ন বিষয়ে গবেষণা পেপার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর উদ্ভাবিত অ্যাপলিকেশন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি যে সমস্ত কম্পাউন্ড তৈরি করেন, এগুলো ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করছে। ভবিষ্যতেও করবে। তাঁর আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে প্রকাশিত রিসার্স পেপারের সংখ্যা তিন শতাধিক। বিজ্ঞানচর্চায় অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলাদেশ অ্যাকাডেমিক অব সাইন্স গোল্ড মেডেল এবং এমওগণি স্বর্ণ পদক। এ পুরস্কার দুটি হলো জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞানীদের জন্য সর্বোচ্চ পুরস্কার। বিজ্ঞানের বাইরেও তিনি লিখেছেন ‘প্রগতির মহাসড়কে বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ। কলামও লিখছেন নিয়মিত। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত আছেন। গবেষণা ও শিক্ষকতার পাশাপাশি পিএসসির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দায়িত্ব পালন করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবেও।
শরীফ এনামুল কবির জন্মগ্রহণ করেছেন গোপালগঞ্জ জেলায়। জন্মের কয়েক বছরে মাথায় বাবাকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন, মায়ের সঙ্গ তাকে সেই শোক কাটাতে কিছুটা সহায়তা করে। তবে বাবা ওপারে চলে গেলেও তিনি তাঁর ভেতর যে স্বপ্ন বুনে গেছেন, সেই স্বপ্ন বড় করতে থাকেন নিজের ভেতর; সেই স্বপ্নই আজ মহীরূহে পরিণত হয়েছে। বাবা চাইতেন যে, ছেলে পড়ালেখা করুক। কারণ তিনি যাপিত জীবনে দেখেছেন—পড়ালেখা না করলে ভাইয়ে ভাইয়েও পার্থক্য তৈরি হয়। তিনি জীবনের তিক্ত অভিভজ্ঞতায় যা শিখে গেছেন, তা ছেলেকে বুঝিয়ে যেতে পেরেছেন।
তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামের অভাবী ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করে, যারা ফোর-ফাইভ পড়ার পর দারিদ্র্যের কষাঘাতে আর লেখাপড়া করতে পারেনি। লাগাম ছাড়া শৈশবকাল ছিল। ওইরকম গার্ডিয়ানও ছিল না, নিজের মতো চলেছেন; যতটা পেরেছেন নিজের জীবনকে নিজেই গুছিয়ে নিয়েছেন। তিনি সাধারণ মানুষ হিসেবেই থাকতে পছন্দ করতেন, এখনো পছন্দ করেন। খুব অল্পতেই খুশি হওয়া মানুষ তিনি। সবচেয়ে বেশি খুশি হন ছাত্রছাত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা তাকে যে সম্মান করে এতেই, এটি তার সবচেয়ে ভালোলাগার জায়গা।
গ্রামের কাঁচা রাস্তা, কাদা-পানি এসবের ভেতর দিয়েই তাঁকে স্কুলে যেতে হতো। হাইস্কুলে যেতেন নৌকা বেয়ে, প্রায় আড়াই মাইলের মতো পথ নৌকা বেয়ে স্কুলে যেতেন; এতে তিনি আনন্দও খুঁজে পেতেন। তারপর তিনি রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন; কলেজে প্রচুর বন্ধু-বান্ধব ছিল, আড্ডায় সময় কেটেছে। তারপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তাঁর লক্ষ্য ছিল জাবিতে ভালো করতে পারলে ভবিষ্যতে হয়তো এখানে শিক্ষকতা করতে পারবেন এবং তা পূরণ হয়েছে।
বিজ্ঞানচর্চা শুরু করেন যখন তিনি এমএসসির ছাত্র তখন থেকে। তাঁর বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক ছাত্র জীবন থেকেই ছিল। তিনি প্রথমে মানবিক শাখার ছাত্র ছিলেন, পরে এইচএসসিতে এসে বিজ্ঞানের ছাত্র হন। এখন তো নাইন থেকেই বিজ্ঞান কিংবা মানবিক বা ব্যবসায় শাখা নির্ধারিত হয়, তখন এমন ছিল না। তারপর এমএসসিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন, এটিই তাঁর বিজ্ঞানচর্চার পথকে সুগম করে। সুগম করে এজন্য যে, এই রেজাল্ট তাকে এমন একটি পেশার দিকে নিয়ে যায় যেখানে তিনি সব সময় পড়ালেখার পথেই থাকতে পান, পড়তে পারেন, পড়াতে পারেন; নিজেকে বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত অনুসন্ধানে নিমগ্ন রাখা সহজ হয়। তিনি নিজের বিভাগেই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য বিদেশে যান; ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জার্মানি, সুইডেনে ১৩ বছর কাটিয়েছেন, শিখেছেন, দেখেছেন; রসায়নবিদ হবার স্বপ্নের পথে এ সবই সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
তিনি করছেন একাডেমিক গবেষণা, অ্যাপলিকেশনও আছে, যা বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি ব্যবহার করছে ভবিষ্যতের পরিকল্পনায়। তিনি যে সমস্ত কম্পাউন্ড তৈরি করেন এগুলো ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করবে।
তাঁর প্রধান ঝোঁক বিজ্ঞানধর্মী গবেষণা করা; গবেষণাধর্মী কাজই বেশি রসায়ন বিষয়ে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল ও জাতীয় জার্নাল মিলে মোট তিনশ’ বিশটি গবেষণাধর্মী লেখা প্রকাশিত হয়েছে। পিএইচডি করিয়েছেন এ পর্যন্ত পঁচিশজনকে; নিজের ল্যাবরেটরিতেই কাজ করিয়েছেন; এম.ফিল করিয়েছেন তিন জনকে। এমএসসি থিসিসে সুপারভাইজ করিছেন দুই শ’ জনকে। এখনও আট-দশজন পিএইচডি ছাত্র আছেন ল্যাবরেটরিতে কাজ করছেন। এমএসসিতে তাঁর তত্ত্বাবধানে গবেষণা করছে আটজন ছাত্র। তিনি সন্তুষ্ট রসায়নবিদ হিসেবে, রসায়নের গবেষক হিসেবে, রসায়নের ছাত্র হিসেবে। বই লিখেছেন ‘প্রগতির মহাসড়কে বাংলাদেশ’ শিরোনামে। এছাড়াও তিনি শিক্ষা, রাজনীতি, দেশের উন্নয়ন বিষয়ে নিয়মিত কলাম লিখছেন।
তিনি মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর জন্মের দ্বিতীয় আঁতুড় ঘর। তাঁর বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারব, আমার মতো জাবিকে আর কেউ-ই ভালো বাসতে পারবে না। হৃদয়ে মিটার লাগিয়ে যদি পরীক্ষা করা যেত তাহলে নিশ্চিতভাবে আমিই প্রথম হতাম।’ বিভিন্ন কাজে তাঁকে প্রত্যেকদিন ঢাকায় যাতায়াত করতে হয়, কিন্তু ঢাকায় তিনি থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। তাঁর ফ্যামিলিও এটি সমর্থন করে না, ফ্যামিলি চায় ঢাকায় যে কয়দিন কাজ থাকে সেখানে যেন অবস্থান করেন। কিন্তু তিনি ফিরে আসতে চান এই বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাকি জীবনটা এখানেই কাটাতে চান।
নিজের কাজ এবং ব্যস্ততার কারণে গ্রামের সাথে তাঁর আর যোগাযোগ নেই। তাঁর কাছে জাবিই বাড়ি, জাবিই ঘর; জাবির সুখেই তিনি সুখি হন, এর দুঃখেই তিনি দুঃখিত। জাবিকে তিনি এই এশীয়-উপমহাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখতে চান। তিনি মনে করেন, জাবি এগিয়ে যাচ্ছে, যাবে, আমাদের বর্তমানেও জাবি এগিয়ে যাবে; বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ যারা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যারা, তারা সব কিছুকে ভুলে গিয়ে জাবিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
জাবিকে একটি পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি উপাচার্য থাকার সময় ১০টি ডিপার্টমেন্ট খুলেছেন, খুলেছেন ২টি ইন্সটিটিউট; প্রতিষ্ঠা করেছেন ওয়াজেদ মিয়া গবেষণাগার, যা দরকারি ছিল। ২০০৯ সালে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সময় পৃথিবীব্যাপি মন্দা চলছিল, এখন যেমন উন্নয়নমূলক ফাণ্ড ভীষণভাবে সহজলভ্য, সরকার শত কোটি টাকা মঞ্জুর করছেন, কিন্তু সেই সময়টায় টাকা পাওয়া খুবই কঠিন ছিল। তিনি সেই মন্দার সময়েও আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর ফান্ড সরকার থেকে আনার জন্য। তিনি কিছুটা হলেও সফল হয়েছেন এ ব্যাপারে। তিনি জাবিকে সম্পূর্ণ সেজনজট মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়েছিলেন, র্যাগিং প্রথা নিষিদ্ধ হয় তাঁর সময়কালেই। তিনি ডিপার্টমেন্টওয়াইজ পরীক্ষা থেকে শুরু করে ফ্যাকাল্টিওয়াইজ পরীক্ষা শুরুর ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর মতে, ‘অনেক কিছু করেছিলাম জাবির উন্নয়নে; এক এক করে বলতে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে যে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উন্নয়নমূলক কী-কী কাজ করেছি। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, জাবির উন্নয়নে আমার প্রচেষ্টা ততদিন থাকবে।’ তাঁর উপাচার্য থাকাকালীন সময় হল জাবির ইতিহাসে ‘স্বর্ণযুগ’; এত কাজ ও উন্নয়ন এর আগে হয়নি, আগামী ৫০ বছরেও হবে কি না, সন্দেহ আছে।
তাঁর ভাষ্য, ‘প্রধানত আমাদের দেশে ভালো গবেষক আছে, কিন্তু গবেষণার সুযোগ, মন-মানসিকতা, পারিপার্শ্বিকতাও একটি ইমপরটেন্ট ফ্যাক্টর। একজন বা দুজন যারা গবেষণা করছে, তারা দেখছে যে আর কেউ গবেষণা করছে না, তারা নিরুৎসাহিত হয়। প্রফেসর হতে যে কয়টি গবেষণা প্রবন্ধ লাগে, লেখে; প্রফেসর হওয়ার পর তো আর গবেষণা প্রবন্ধ লাগে না। অতএব এই দিকটিতে যদি প্রশাসন, সরকার দৃষ্টি দেয় তাহলে ভালো হয়। যারা ভালো গবেষণা করবে তাদের ইনকারেজ করতে হবে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে। চায়নায় আছে, ভালো গবেষণা করলে, নামকরা জার্র্নালে লেখা প্রকাশ করলে একটা এ্যামাউন্ট বেতনের সঙ্গে যোগ হয়ে যায়। ইন্ডিয়ায় আছে, ইন্ডিয়ার আইএটির একজন ডিরেক্টর আছেন, তাঁর সাথে পরিচয় আছে, তিনি বলছেন যে, একস্ট্রা ৫০ হাজার রুপি বেশি পায় ৫ বছর; পরে এই ৫ বছরের মধ্যে আরো কি গবেষণা পাবলিশড করল তা সাবমিট করলে কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে না তার কাজের ধারাবাহিকতা আছে, তাহলে আবার পাবে রুপি। উপহার বল বা বিভিন্নভাবে ইনক্রিমেন্ট হোক, আলাদা বেতন-স্কেল হোক, এই সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। কাজেই শিক্ষকরা ইনকারেসড হবে গবেষণা কাজে।’
সরকারকে শিক্ষকদের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। শিক্ষকদের যদি আলাদা বেতন স্কেল না থাকে, শিক্ষকদের যদি সংসার না চলে, তাহলে তারা কেমন করে গবেষণা করবে সারাদিন-সারারাত। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকরা সকালে যায়, রাতে আসে। আর আমাদের এখানে তো শিক্ষকরা সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন আসে এমনও শিক্ষক আছে। তিনি মনে করেন এটিকে শিক্ষকতা বলে না, এভাবে তো গবেষণা হতে পারে না। তিনি মনে করেন, নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকের একটি আলাদা ডেফিনেশন আছে; গবেষকও বিভিন্ন ধরনের আছে, রিয়াল সেন্সের যারা গবেষক তারা তো সারাজীবন ধরেই গবেষণা করে যাবে; আর সিজনাল বার্ডের মতো যে, আমার যে কয়টা পেপার লাগবে, সেই কয়টা করে শেষ; এরকম করে গবেষণা হয় না। অন্তরের ভেতর না ঢুকলে গবেষণা, লেখাপড়া হয় না।