সম্ভবত ৮৪/৮৫ সাল। ময়মনসিংহ জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার উর্দু ক্লাসের ছাত্র। বেশ কিছুদিন পর আর একজন ছাত্র আমাদের ক্লাসে ভর্তি হয়। বাড়ি গৌরীপুর উপজেলার কোনো এক গ্রামে। স্বভাবে সে পাগলাটে, আত্মভোলা ও একগুয়ে ধরনের। তার বাবা একজন কবি, কবিতা লেখেন। নিতান্ত সহজ সরল, সাদামাটা মানুষ। পরনের তিতি দাগপড়া পুরনো পাজামা পাঞ্জাবি, কোটরাগত চোখ, পাতলা ঠোঁট, সামান্য কয়েক গোছা দাড়ি ও গায়ের তামাটে রঙ দেখে তাকে আমার দরিদ্র মানুষ বলে মনে হতো। কিন্তু কথায়, চলনে-বলনে তার মধ্যে সবসময় কবিতা লেখার অহঙ্কার ও আত্ম মর্যাদাবোধ বিরাজ করতে দেখেছি। তিনি স্হানীয়ভাবে কবি হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ছেলের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য মাদ্রাসায় যখন মাঝে-মধ্যে আসতেন, শিক্ষকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় এমন ভাব প্রকাশ করতেন। আমার শিক্ষকরা বেশ উপভোগ করতেন তার আত্মপ্রসাদ।
আমার সেই সহপাঠীও কবিতা লিখতো। মাঝে মধ্যে মুখে মুখে ছড়া বানাতে পারতো। তার চলাফেরায় উদ্ধতস্বভাব, বেপরোয়া ভঙ্গি। অন্য সহপাঠী দূরের কথা, শিক্ষকদেরও সমীহ করতো না। তার সব ঔদ্ধত্যপনা শিক্ষকরা সস্নেহে দেখেছেন। তাকে নিয়ে সহপাঠী ও শিক্ষকদের সবার মাঝে গৌরব ছিল, তারা একজন কবির সান্নিধ্য পেয়েছেন। সে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। কিন্তু সে আসার আগে শিক্ষক সহপাঠী সবার মনোযোগের কেন্দ্রে ছিলাম আমি। মোটামুটিভাবে গ্রামের মধ্যবিত্ত সামর্থ্যবান পরিবারের ছেলে আমি। একজন চেয়ারম্যান ও রাজনীতিবিদের ছেলে হিসেবে আমার সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে আমি একজন ছোটখাটো কেউকেটা ছিলাম। তার ওপর মাদ্রাসায় আমার অভিভাবক ছিলেন হাফেজ মাওলানা দেলোয়ার হোসেন হুজুর। তিনি আমার ছোট চাচা হাফেজ মাহবুবুল হকের বিশেষ বন্ধু। আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তিনি আবার মাদ্রাসার প্রভাবশালীদের একজন। তার স্নেহ ও আনুকূল্য পাওয়ার অর্থ হলো এই আমিও বিশেষ কেউ। উর্দু ভাষার গল্প ও শের পড়ে আমার দিন ভালোই কাটছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এই উপদ্রব ও অবহেলা কিভাবে সহ্য করি। সেই কবি ও তার কবি বাবার আগমনে আমাকে আর কেউ আগের মতো পাত্তা দিচ্ছে না।
আমার ভেতর অসহায়ত্ব ও ঈর্ষা এসে বাসা বাধে। সহজেই বুঝে ফেললাম অন্য কিছু নয়, তারা কবিতা লিখে, কবি ও লেখক। তাদের গৌরব ও বিশেষত্বের দাবি আছে। তারা অসাধারণ। আমার গৌরব করার কিছু নেই। আমি সাধারণ। সেই ঈর্ষা ও মনোবেদনার উপায় খুঁজতে থাকি। অবশেষে পেয়ে যাই উপায়। আমিও কিছু কিছু লিখি। এমনই দুর্ভাগ্য যে কেউ আমার লেখায় মনোযোগ দেয়নি। উপরন্তু আমি কারও কারও কাছে উপহাসের পাত্র হয়ে গেলাম। যাদের ঈর্ষা করে বালক বয়সে লেখালেখির সূচনা, আজ আর তাদের নাম মনে নেই।
মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার পেছনেও ছোট্ট একটি গল্প আছে। হয়তো অনেকেরই থাকে। আমার আম্মা একইসঙ্গে ধর্মপ্রাণ ও আধুনিক মহিলা ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজপড়াসহ তাসবিহ তাহলিল ও নিয়মিত কোরআন পাঠ করতেন। আব্বার সঙ্গে মাঝে মধ্যে সিনেমা দেখতে যেতেন। আমিও কয়েকবার আব্বা আম্মার সঙ্গে হলে বসে সিনেমা দেখেছি। কিন্তু এই গল্পের পেছনেও কিছু গল্প আছে। আমার আম্মার রূপ ও সৌন্দর্যের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। এটাই শেষ কথা নয়, তাদের প্রথম সন্তান হয় মেয়ে। আশা পরেরবার হয়তো ছেলে হবে। কিন্তু না, পরেরবারও মেয়ে। এভাবে একে একে ছয় মেয়ের জন্ম হলো, ছেলের দেখা নেই। এদিকে আমার দাদা-দাদিসহ, কাকা ফুপু, আত্মীয়স্বজন এলাকার সবাই ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন চেয়ারম্যানের অর্থাৎ আমার আব্বার সংসারে কোনো ছেলে নেই, তা দেখে। সব দোষ আমার মায়ের। অজ্ঞাত কোনো গুণের অভাবে আমার মা গর্ভে কোনো পুত্র সন্তান ধারণ করতে অক্ষম। কাজেই আব্বাকে আবার বিয়ে করালেই কেবল বংশের বাতি জ্বালানো সম্ভব। কাজেই ছয় মেয়ের পর যখন আমার জন্ম হয়, আম্মা তখন হাতে চাঁদের নাগাল পেলেন। সেই চাঁদই যদি আবার হাত ফসকে যাওয়ার উপক্রম হয়, তাহলে মনের অবস্থা কী রকম হয়। অর্থাৎ আমার বয়স যখন মাত্র ৩ দিন, আমি মারাত্মক জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হই। বাঁচা মরার অবস্থা ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দুলছে। উপায়ন্তরহীন আমার মা আল্লাহর কাছে ওয়াদা করলেন বেঁচে থাকলে আমাকে দিনি শিক্ষার জন্য মাদ্রাসায় পড়াবেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন আম্মা, নিষ্ঠার সঙ্গে সেই চেষ্টা করে গেছেন।
কাওরাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৪র্থ শ্রেণী পাস করার পর আমাকে গয়েশপুর আলিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়।
৫ম শ্রেণী পাস করার পর আমাকে ময়মনসিংহ জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। স্রষ্টার সঙ্গে অঙ্গীকার করেছিলেন আম্মা। আমি সেই দায় অনুভব করিনি। নিরন্তর সংগ্রাম করে আমি কওমি মাদ্রাসার পাঠ সাঙ্গ করে চলে আসি। আমাকে আবারও প্রথমে ময়মনসিংহের বিখ্যাত কাতলা সেন মাদ্রাসায়, পরবর্তী সময়ে ত্রিশাল আব্বাসিয়া আলিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। আমি তখন ত্রিশাল মাদ্রাসায় ৭ম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন ক্লাসে স্যারের হাতে আমার এক সহপাঠীর খাতা পড়ে। তিনি সেই খাতায় ছাত্ররচিত কবিতা আবিষ্কার করে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমি আর একবার ঈর্ষার কাছে পরাভূত হলাম। আমিও ক্লাসের খাতায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কবিতা লিখে ভরে ফেললাম। না পারলাম স্যারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, না পারলাম প্রশংসায় সিক্ত হতে। কাজেই সেই চিন্তা বাদ।
কাকার বাসায় যাওয়ার পর টের পাই সজলের কাউকে প্রণাম করতে হচ্ছে না। কারণ সে উচ্চবর্ণের। কিন্তু আমাদের করতে হচ্ছে। সাত দিন সেই বাসা ও প্রতিবেশীদের একান্ত আপন হয়ে পড়েছিলাম।
১৯৯২ সাল। গাজীপুর কাজী আজিম উদ্দিন কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্র। কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। কলেজ ক্যাম্পাস স্লোগানে- স্লোগানে দাপিয়ে বেড়াই। নানাভাবে সুন্দরী সহপাঠীদের মনোযোগ আকষর্ণেরও চেষ্টা করি। আর প্রেমে পড়ার অনুভূতি নিয়ে খাতা ভরে তুলতে থাকি। অবশেষে বিড়ালের কপালে শিকা ছিঁড়ে পড়লো। আমার বড় আপা মফিদা আকবর একজন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। একদিন আমার খাতা গিয়ে পড়লো বড় আপার হাতে। তার আগে একটু বলে নেই, আমি ইতোমধ্যে আপার সংগ্রহে থাকা গল্প, উপন্যাস ও কবিতা গোগ্রাসে পড়তে থাকি। আধুনিক ও জনপ্রিয় লেখকদের লেখা সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা তৈরি হতে থাকে। একদিন কিভাবে যেন আমার লেখার খাতা আপার হাতে পড়ে। আপা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। উদ্যোগ নিয়ে একটি কবিতা জাতীয় দৈনিকে ছাপার ব্যবস্হা করে দেন। পরের দিন যখন কলেজে সহপাঠী ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের পত্রিকায় ছাপানো কবিতা দেখালাম। কেউ কেউ আমাকে অভিনন্দিত করেন, কেউ কেউ অবিশ্বাসের চোখে তাকালো।
৯৫ সাল। আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে খিলগাঁও তিলপা পাড়া বড় আপার বাসায় চলে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতির একটি বিষয় ছিল। কিন্তু তত মনোযোগ নেই। কিছু সময় টিভি প্রোগ্রাম দেখি, তা আর কতক্ষণ। মহল্লায় আমি নবাগত, কোনো বন্ধু বান্ধব নেই। কারও সঙ্গে একটু কথা বলবো, কেউ নেই। তাছাড়া ৯১ সনের ২১ মে আমার এসএসসি পরীক্ষা চলার সময় আম্মা মৃত্যুবরণ করেছেন। গাজীপুরে থাকার সময় সেই শূন্যতা এতটা প্রকটভাবে অনুভব করিনি। ঢাকায় বন্ধু বান্ধবহীন অবস্থা সেই শূন্যতা আমাকে নতুনভাবে গ্রাস করে। উপরন্তু আব্বার আর্থিক দুরাবস্হায় ভীষণ বিষণ্ন হয়ে উঠি। এই অবস্থায় আমি যখন দিশেহারা, আপার আলমারি ভর্তি বই আমাকে নতুন জীবনের সন্ধান দেয়। ডুবে যাই বইয়ের জগতে। নতুন উদ্যমে লেখালেখি শুরু করি। এরই মধ্যে কবি শাশ্বত হাসান সম্পাদিত একটি কাব্য সংকলন নিয়ে আমি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখি। লেখাটি অনেকের কাছে আদৃত হয়। আমি প্রেরণা অনুভব করি। নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়।
আমি জগন্নাথ কলেজে ব্যবস্হাপনা বিভাগে ভর্তি হয়। নতুন জগতে প্রবেশ করি। প্রথমে ভেবেছিলাম নেহাৎ নিরীহ পড়ুয়া ছাত্রদের মতো শুধু লেখাপড়া নিয়ে থাকবো। কিন্তু না, জয়বাংলা ধ্বনি যার রক্তের ভেতর, সে স্লোগান শুনে কতদিন ক্লাসে চুপচাপ বসে থাকতে পারে। আমিও মিশে গেলাম মিছিলের সম্মুখ সারিতে। আর মিরপুরে যে উর্মিকে আমি হারিয়ে এসেছি, সেই ক্ষত কিছু হলেও শুকিয়ে দেয় জেসমিন, রোমানা ইসলাম জেসমিন। না একটু কম বললাম। সেই স্নিগ্ধ প্রলেপ আমাকে দীর্ঘদিন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সহপাঠীদের অনেকে বিশ্বাস করতে চাইতো না আমি লিখি পারি। এই অবিশ্বাস, অবজ্ঞা, অবহেলা আমাকে দমিয়ে দেয়নি। বরং আমাকে উদ্দীপিত ও বেপরোয়া করেছে।
জগন্নাথে ভর্তি হওয়ার আগেও আমার একটি জগৎ ছিল। ত্রিশাল আব্বাসিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ৮ম শ্রেণী পাস করে চিরতরে মাদ্রাসার পাঠ চুকিয়ে দিলাম। ৮৯ সনে শ্যামলী জহুরী মহল্লার বাদশাহ ফয়সাল ইনস্টিটিউটে ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। মিরপুরে মেঝো আপার বাসায় থাকি। দুলাভাই এমদাদুল হক মিরপুর ইসলামিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (শিল্প-সাহিত্য ও মননের কাগজ কাশপাতার প্রকাশক)। আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মরহুম মেজবাহ উদ্দিনর বাসা। তার পাঁচ ছেলে মেয়ের ভেতর সবার ছোট মেয়ে ইশরাত তারাম্মুন উর্মি। ডাক নাম মিমি। দুলা ভাইয়ের স্কুলে ৭ম শ্রেণীতে পড়ে। সে ৭ম শ্রেণী, আমি নবমে। হালকা পাতলা গড়নের মেয়েটি স্বভাবে নাক উচু ভাব। আরও দুজন শিখা ও শিউলিকে নিয়ে যখন রাস্তা দিয়ে হেটে যেতো, মনে হতে যেন গরবিনী রাজহাঁসের ভঙ্গিতে চলছে আপন মনে। তাদের গাছে ফুটে থাকা শিউলি ফুল পড়ে ছিল অনাদরে। আমরা দুষ্ট বখাটে কিশোরের দল সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠেছি ‘উল্টাও-পাল্টাও একটাই নাম মিমি’। সেই সময় টেলিভিশনে মিমি চকোলেটের এমন একটি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো। না, সে কোনোদিন উচ্চবাচ্য করেনি। আমরা প্রতিদিন তার অবহেলার কাছে পরাস্ত হতে থাকি। আমরা কিশোরের দল নিজেদের মধ্যে বাজি লড়ি যে তার মুখোমুখি হতে পারবে, সেই-ই সিকান্দার। আমি সাহস দেখিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর, তার আর পর নেই। এভাবে চললো অনেকদিন। একদিন তাদের তিন বান্ধবীর সঙ্গে হঠাৎ রাস্তায় দেখা। তাদের অতিক্রম করে যাওয়ার সময় তিন বান্ধবীর একজন শিউলি। সে আমাকে বলে এভাবে নয় রাধাচূড়া ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। কিন্তু আমি তো আবাল, না জীবনে কোনো দিন দেখেছি রাধাচূড়া ফুল, না শুনেছি নাম। এত আমার কাছে সপ্তসাগর সেঁচে মুক্তা খোঁজার মতো অবস্থা। তবু হাল ছাড়ার পাত্র নয়।
একদিন লেটার প্যাডের ২০ পৃষ্ঠার মধ্যে ১৯ পৃষ্ঠার এক চিঠি লিখে ফেললাম। পাতায় পাতায় স্বরচিত কবিতার ছত্র লিখে নিজের আবেগ প্রকাশ করি। ধুরু ধুরু বুক নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কোনোরকমে চিঠি তার হাতে গুজে দিয়ে চলে যাই। নিতে চায়নি, কিছুটা তাচ্ছিল্য ও বিরক্ত সহকারে নেয়। একদিন, দুইদিন পার হয়ে যায় কোনো উত্তর পাচ্ছি না। আমি মহাফাঁপরে পড়ে গেলাম। তিনদিন পর বিকাল বেলায় ছাদে উঠি। সেও তাদের ছাদে এলো। আমার সঙ্গে ছাদে আরও দুই-একজন ছিল। আমি তাকে চেয়ে দেখলাম। সে কি আমার দিকে তাকিয়েছে? কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। তার মাঝে কোনো অভিব্যক্তির প্রকাশ নেই। না বিরক্ত, না অনুরক্ত। কিছুক্ষণ পর নেমে গেলো। কিছুক্ষণ পর ছোট বোন বাঁধনকে সঙ্গে নিয়ে আবার এলো। অল্প সময় থেকে নেমে গেলো। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ছাদে যারা ছিল, সবাই একে একে নেমে গেলো। আমি বিষণ্ন মনে বসে আছি একা। হঠাৎ কানে এলো শুনুন, পেছনে তাকিয়ে দেখি, সে ছাদের কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আশা নিরাশার দোলাচালে কোনোরকমে টলতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
উল্লেখ্য দুই ছাদের দূরত্ব মাত্র দুই আড়াই হাত। মুখোমুখি দাঁড়াতেই অনুযোগ কখন থেকে অপেক্ষা করছি, আর আপনি শাহানার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। শাহানা দুলাভাইয়ের কাজিন। সেই সম্পর্কে আমার বেয়াইন। বাসাটি শাহানাদের। আমরা ভাড়া থাকি। তার সঙ্গে সম্পর্ক ইয়ার্কি ও রসিকতার। যাই হোক, উর্মি আমার দিকে একটি গোলাপ ও চিঠি বাড়িয়ে দেয়। সে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে স্টেডিয়ামের দিকে হাটতে যায়। আমাকেও সেখানে থাকতে বলে। সেই শুরু। তারপরের টুকু রোমিও-জুলিয়েটের গল্প।
এক কান দুই কান করতে করতে আমার উনিশ পাতার চিঠির প্যাডের গল্প পুরো মিরপুরের ২ নম্বর সেকশনে চাউর হয়ে যায়। বিশেষত স্কুলের সমবয়সীদের নিকট আমি রীতিমতো হিরো। রাত ৮টার সময় কিংবা ১০ টার সময় টিভি সংবাদের বিরতিতে সে মা বোনের সঙ্গে রাস্তায় হাঁটতে আসে, তাকে শুনিয়ে আমি আমার বন্ধুকে বলি তুই কাল সকাল ১১টার সময় রাস্তার মোড়ে থাকবি কিংবা অন্য কোথাও। সে আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। পরের দিন সময়মতো ঠিক জায়গায় এসে হাজির হয়ে যায়। এভাবে চলে অনেক দিন।
আবেগ হলো প্রেমের প্রাণ শক্তি। কৈশোরের প্রেম হলে কোনো কথাই নেই। যেমন আবেগ থাকে তেমনি অল্পতেই অবিশ্বাস তৈরি হয়। আর একটি কথা মেয়েরা সহসা অন্যের প্রেমকে সহজে নিতে পারে না। উপরন্তু সে যদি সুন্দরী হয়, তাহলে কোনো কথা চলে না। শাহানা খুব সুন্দরী ছিল। তার স্বপ্নজুড়ে সুইজারল্যান্ড। তার কারণও ছিল বিক্রমপুরের ব্যবসায়ী পরিবারের এই মেয়ের দুই দুলাভাইসহ অনেক আত্মীয় স্বজন সুইজারল্যান্ড প্রবাসী ছিল। আমাকে প্রায়শ প্রশ্ন করতো মাসুম ভাই, (আমার ডাক নাম) আপনি সুইজারল্যান্ড যাবেন না? বলেই চোখ বড় বড় করে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। সেই চোখে কোনো রহস্য ছিল কি না, আমি তার পাঠোদ্ধার করতে যাইনি। কিন্তু তাতে কি? উর্মি তা মানতে চাইবে কেন? ছাদে উঠে সে যখন ছাদে আমার সঙ্গেও কেউ একজন আছেন, হাসছে, গল্প করছে, আমার মোটা মাথায় এত কিছু ঢোকেনি। মেয়েদের ঈর্ষা কি মারাত্মক বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, আগে বুঝতে পারিনি। যখন তা টের পেয়েছি, তখন নিরাময়ের অযোগ্য। অবশ্য আমরা আবার বন্ধু হয়েছিলাম। সেটি অন্য গল্প। নগর সংস্কৃতি, নগরের সভ্যতা ও উদারতার নানারকম ডালপালা থাকে। উর্মি, জেসমিনসহ আরও কেউ কেউ আজও আমার লেখায় জীবন্ত।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। জগন্নাথ কলেজে লেখাপড়ার সময় আমি লেখালেখিতে সিরিয়াস হয়ে উঠি। কিছু দিন পর আমি একটি সুযোগ পেয়ে যাই। আমার আপা মফিদা আকবর সেই সময় ইত্তেফাকে চাকরির পাশাপাশি কম সার্কুলেশনের জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী দেখতেন। একটি পর্যায়ে পরিস্হিতি এমন দাঁড়িয়ে যায় যে ইত্তেফাকে কাজ করলে অন্য কোনো মিডিয়ায় কাজ করা যাবে না। তাই বাধ্য হয়ে আপাকে সাহিত্য সাময়িকীর কাজটি ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু সম্পাদক আপাকে ছাড়তে চাননি। এমন অবস্থায় আমাকে ডামি দায়িত্ব দেওয়া হয়। আপা বাসায় আমাকে সমস্ত কাজ বুঝিয়ে দেন। আমি অফিসে গিয়ে সেটআপ করি। এভাবে চললো কিছুদিন। আস্তে আস্তে কিছু কাজের অভিজ্ঞতা আমারও হয়। এরই মধ্যে কিছু লেখকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। কবি শাশ্বত হাসান সেই সময় সোনালী ব্যাংকের হেড অফিসে চাকরি করতেন। আমার অফিসও মতিঝিলের দিলকুশা। হেঁটে গেলে বড়জোর দুই মিনিট সময় লাগে। আমি প্রায়শ সেখানে আড্ডা দিতাম। তাকে ঘিরে কবি হাসান পারভেজ, ইমরান আহমেদ, বাবুল তালুকদার প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একই সময় আপার মাধ্যমে গাজী আলমগীরের সঙ্গে পরিচয়। গাজী ভাইয়ের লেখার মান যায় থাকুক তিনি একজন সাহিত্য সংস্কৃতি সংগঠক ছিলেন। কথা নামে একটি কাগজ সম্পাদনা করতেন। গাজী ভাই যৌথ একটি কাব্যগ্রন্হ প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে আরও কয়েকজনের মধ্যে আমারও কয়েকটি কবিতা ছাপা হয়েছিলো। এটি আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। অবশ্য পরে আর আমার মনঃপুত হয়নি।
আমার কাছে নিয়মিত আসতেন ছড়াকার মানসুর মুজাম্মিল। তিনি আমাকে এক শুক্রবারের সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবের উল্টো দিকে তোপখানা রোডে রাইটার্স ক্লাবে নিয়ে যান। এখানে নিয়মিত বসতেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা। তাকে ঘিরে তরুণ কবি লেখকদের নিয়মিত আড্ডা জমে উঠত। মাঝে মধ্যে আসতেন নিশাত খান, রেজাউদ্দিন স্টালিন, মাসুদুজ্জামান প্রমুখ। প্রায় নিয়মিত উপস্হিত ছিলেন কবির হুমায়ুন, ওবায়েদ আকাশ, জ্যোতি পোদ্দার, মাইন মজুমদার, রথোরাফিসহ অনেকে। রাইটার্স ক্লাব থেকে শাহবাগের আড্ডায় ৯৮ সাল থেকে নিয়মিত হই।
শাহবাগে যেদিন প্রথম পা রাখি, সেদিন আমি এতিম লেখক। কাউকে চিনি না, জানি না। পাঠক সমাবেশের সামনে একা দাঁড়িয়ে আছি। ওবায়েদ আকাশ রাইটার্স ক্লাবের ক্ষীণ সম্পর্কের সূত্র ধরে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। তারপর ক্যাফে এলির আড্ডা। লোক-এর জমজমাট আড্ডা জমে ওঠে। আবু হাসান শাহরিয়ার, কামাল চৌধুরী, সমুদ্র গুপ্ত, আলমগীর রেজা চৌধুরী, অসীম সাহা, শামীমুল হক শামীম, শামীম রেজা, মাহবুব কবির, রহমান হেনরী, জাফর আহমেদ রাশেদ, অলকা নন্দিতা, মুজিব মেহদী, মজনু শাহ, জাকির তালুকদার, জীবন নজরুল, নজরুল কবির, তারেক মাহমুদ, বদরুল হায়দার, তপন বাগচী, টোকন ঠাকুর, প্রত্যয় জসীমসহ অনেকের সঙ্গে পরিচয় হৃদ্য সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। শওকত হোসেন, মাসুদ হাসান, মাসুদ পথিক, সজল সুফিয়ান, সাইম রানা, শাহনেওয়াজ বিপ্লব, নাভেদ আফ্রিদি, মোহন্ত কাবেরী, রথো রাফির সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা হয়। এরই মধ্যে বগুড়া থেকে আমীর খসরু স্বপন একদিন এসে হাজির হয়। তারই সূত্রে কুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা হয়। এরই মধ্যে কবি আলমগীর রেজা চৌধুরী, সুজাউদ্দিন কায়সার, শাহাদাত বুলবুল, বাবুল তালুকদার প্রমুখ বিকাল সন্ধ্যায় ওসমানী উদ্যানে আড্ডায় মিলিত হন। কিভাবে যেন মাঝে মধ্যে আমিও তাদের ভাবের জগতে শামিল হতে থাকি।
একই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মান্না লেখক চক্র নামে প্রতি শুক্রবার একটি সাহিত্য আড্ডা হতো। প্রধানত অমিতা চক্রবর্তী, আমিনুল রানা, দোলা, আল্পনা মনস্বিতা ছিল নিয়মিত আয়োজক। আমি, ওবায়েদ আকাশ ও জ্যোতি পোদ্দারও সেখানে মাঝে মধ্যে উপস্থিত হতে থাকি।
৯৯ সালে কলকাতা বইমেলা থিম কান্ট্রি বাংলাদেশ। বইমেলা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই উপলক্ষে লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও প্রকাশকদের একটি বিশাল বহর প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়। এই বিষয় নিয়ে আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে তুমুল আড্ডা শুরু করি। ওবায়েদ আকাশ, জ্যোতি পোদ্দার, সুফিয়ান সজল আমরা চার বন্ধু একমত হয়, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী অনেকের তুলনায় কবি, লেখক হিসাবে আমরা বড়। তাদের লেখায় প্রাণ নেই, চিন্তা নেই, দেশ নেই, আবেগ নেই। আমরা নিরীক্ষাপ্রবণ লেখায় আঙ্গিক, বিন্যাস ও চিন্তায় নিজস্বতা সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। পাঠক যদি প্রশ্ন করে, সত্যি আমরা একটা কিছু কিছু করেছি কি না? তাহলে উত্তর হলো অন্তত আমরা তাই মনে করতাম। ছিল উদ্ধত স্বভাব, ছিল প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠিতদের অস্বীকার করার প্রবণতা। এই কারণেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে বসে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের পিণ্ডি চটকাতাম। যাই হোক, আমরা শেখ হাসিনার কলকাতা সফরসঙ্গীদের মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। প্রতিবাদ হিসেবে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরাও কলকাতা বইমেলা যাবো। সিদ্ধান্ত নিয়ে পরের দিন রাতের বেলা নাইট কোচে আমরা রওনা হই। এ ক্ষেত্রে জ্যোতি পোদ্দার ও সজল সুফিয়ানের আগ্রহ ছিল বেশি। সজলের ভাষ্য ছিল, জনপ্রতি ১০০০ টাকা হলে আসা-যাওয়াসহ কলকাতায় ৭ দিন অবস্থান করা যাবে। আমাদের ভেতর ১ জন ২৫০০ টাকা, একজন ২০০০ টাকা একজন ১৫০০ টাকা, একজন মাত্র ১০০০ টাকা সম্বল নিয়ে কলকাতা রওনা হয়ে যাই। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কাকডাঙ্গা হয়ে আমরা সীমান্ত পার হই।
পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া দালালকে কিছু দিয়ে জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। দালাল আমাদের শিয়ালদা স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তার দায়িত্ব শেষ করে। তারপর পড়ে যাই অকুল পাথারে। সারাদিন ভ্রমণ করেছি। পকেটে টাকা থাকার পরেও ভয়ে কিছুই কিনে খেতে পারছি না। আমরা একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে কলকাতা বইমেলা যাই। বইমেলায় প্রবেশের পর আমরা যে যার ব্যাগ রেখে একটি কার্পেটের ওপর বসে পড়ি। সারাদিনের ক্লান্তি ও ক্ষুধার পর আমরা চারজনই ঘুমিয়ে পড়ি। আধাঘণ্টার মতো ঘুমিয়ে ছিলাম। এমন সময় এদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন নওগাঁর জাহিদ আনোয়ার। জাহিদ ভাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নওগাঁ জেলার সমন্বয়কারী। সেই সুবাদে তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। তিনি আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে বৃত্তান্ত জানলেন। চা নাস্তা খাওয়লেন। আমরা মেলা ঘুরে দেখলাম। জয় গোস্বামীসহ অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়। মেলা শেষ রাতে থাকব কোথায়? আমাদের কাছে যে টাকা আছে, তাতে ৭ দিন থাকতে গেলে হোটেল ভাড়া দিয়েই শেষ হবে। খাওয়া মেলায় ঘোরার কোনো পয়সা থাকবে না। এই অবস্থায় জ্যোতি পোদ্দার বললো, কলকাতার শহরতলী শ্যামনগরে তার কাকার বাসায় থাকা যাবে। শিয়ালদা স্টেশন থেকে আধঘণ্টা জার্নি করে যেতে হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, তার কাকা অত্যন্ত কম্যুনাল। মুসলমান ছেলেদের তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে আমরা পরিচয় গোপন করার সিদ্ধান্ত নেই। সজল সুফিয়ান হয়ে গেলো সজল চক্রবর্তী, ওবায়েদ আকাশ হয়ে গেলো আকাশ মন্ডল। কেবল আমার বেলায় সমস্যা। জ্যোতি প্রস্তাব করে সোহাগের সঙ্গে কিছু একটা যুক্ত করে নেওয়ার জন্য। আমি বললাম, আমার আব্বা আমাকে বিপ্লব ডাকেন। কাজেই আমি বিপ্লব সাহা। বুঝতে পারিনি সাহা উচ্চবর্ণের নয়।
কাকার বাসায় যাওয়ার পর টের পাই সজলের কাউকে প্রণাম করতে হচ্ছে না। কারণ সে উচ্চবর্ণের। কিন্তু আমাদের করতে হচ্ছে। সাত দিন সেই বাসা ও প্রতিবেশীদের একান্ত আপন হয়ে পড়েছিলাম। চলে আসার দিন কান্নার রোল ওঠে। কেউ বুঝতে পারিনি জ্যোতির তিন বন্ধু মুসলিম। শুধু আন্না নামের একটি মেয়ে বুঝতে পেরেছিল। আমি যখন জ্যোতিকে প্রশ্ন করি চন্দন কাঠ দিয়ে কী হবে? বোকার মতো করা এই প্রশ্ন আর কেউ শুনতে না পারলেও আন্না ঠিক শুনেছিল। সে আমার কিংবা আমাদের সন্মান ক্ষুণ্ন করেনি। আমরা যেদিন চলে আসি, সেদিন কান্নার রোল উঠেছিল। মেলায় গ্রাফিত্তি, হাওয়া ৪৯, রক্তমাংসসহ অনেকগুলো লিটলম্যাগের স্টলে যাই। কলকাতার লেখকদের একটি ধারণা তৈরি হয়। অনেকে তাদের বই ও ম্যাগাজিনের সৌজন্য কপি দেয়। আমরা আমাদের পছন্দের বই কিনি।
এই সময়ের ভেতর ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, সংবাদ, আজকের কাগজ, মুক্তকণ্ঠের খোলা জানালা, ভোরের কাগজ সাময়িকী ও পাক্ষিক শৈলী, বাংলাবাজার, বাংলার বাণী ও দৈনিক বাংলার সাময়িকীতে আমার নিয়মিত গল্প, কবিতা ও বুক রিভিউ ছাপা হয়। এভাবে একসময় আমার ভেতর পূর্ণাঙ্গ লেখকসত্তার বোধ সৃষ্টি হয়। আমি নিজেকে লেখক হিসেবে মনে করি। কিন্তু প্রিয় পাঠক একথা বলার পরেও আমি কি লেখক সত্তার উন্মেষপর্ব চিহ্নিত করতে পেরেছি?
বাংলাদেশের ফেরার দিন বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। ট্রেনে আমরা মুছলেন্দপুর স্টেশনে নামি। কিভাবে তারা যেন বুঝে ফেলে আমরা অনুপ্রবেশকারী। আমাদের দেখেই বিরূপ মন্তব্য করতে শুরু করে। জিপ গাড়ির ছাদে চরে রওনা হই। সহযাত্রীরা কিভাবে বুঝে ফেলে আমরা বাংলাদেশে যাবো। কিছুদূর যাওয়ার পর বিএসএফ আমাদের গাড়ি থামিয়ে চেক করে। আমাদের প্রত্যেকের ব্যাগে ছিল কাপড়, বই, ম্যাগাজিন ও বইমেলার টিকিট। ব্যাগ তল্লালি করে। সজল তাদের উত্তরে জানায় ‘বুক ফেয়ার ছে আয়া’। গাড়ির সব যাত্রীকে একপাশে আমাদের ৪ জনকে আরেক পাশে দাঁড় করিয়ে রাখে। দাঁড় করিয়ে রাখা আনুমানিক সেই ১০ মিনিট কেটেছে চরম উৎকণ্ঠা-উদ্বেগে। আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না, আমাদের গ্রেপ্তার করা হলো, না ছেড়ে দেওয়া হবে। এক সময় জিপে ওঠার অনুমতি দেওয়া হলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। জিপ ছুটে চলছে। একসময় গন্তব্যে নামি। এবার হেলিকপ্টারের পালা। অর্থাৎ একটি সাইকেলের সামনে পিছনে যাত্রী ও চালকসহ তিনজন যাতায়াত করে থাকে। আসার পথেও আমরা এরকম হেলিকপ্টারে সওয়ার হয়ে দালালের বাড়ি থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে ছিলাম। সাইকেল চড়ে একটি রাস্তার বাঁক পর্যন্ত পৌছার পর হঠাৎ গুলির শব্দ শুনতে পাই। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে একটি বাড়ির আড়ালে আত্মগোপন করি। পরে জানতে পেরেছিলাম, সেটি একটি মুসলিম পাড়া এবং তারা আমাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। আমরা যেদিন বাংলাদেশে আসার জন্য সীমান্ত পার হচ্ছিলাম, সেদিন ছাত্রদল নেতা সজল হত্যাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে হরতাল ডাকা হয়েছে। এই কারণে বিএসএফ ও বিডিআরের মধ্যে সীমান্ত চোরাচালান ও লোক পারাপার সংক্রান্ত যে গোপন চুক্তি ছিল, তা স্থগিত হয়ে যায়। এদিকে সেদিন দালালের পিসি মারা যায়। সে আমাদের এক মুসলিম পরিবারে রাত্রি যাপনের ব্যবস্হা করে।
এখানে একটি কথা বলা দরকার। পরিস্থিতির কারণে আমরা দালালকে চুক্তির অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। পর্যাপ্ত অর্থ নেই। রাতে খাবো কী? বাড়ির মালিক একবার খাবারের কথা বলেছিলেন, ছিল লোকদেখানো। গাঁয়ের ছোট বাজার। আমাদের গ্রামবাংলার বাজারের মতো তার হতশ্রী চেহারা। আমরা শুকনো মিষ্টি ও পাউরুটি দিয়ে রাতের ক্ষুধা নিবারণ করি। সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল রাতে ঘুমোতে গিয়ে। আমাদের থাকার ব্যবস্হা হয়েছিল ঘরের বারান্দায়। সেটি কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু কয়েকদিন আগে সেখানে হয়তো ছাগল রাখা হতো। কিছু খড় বিছিয়ে তার ওপর শতচ্ছিন্ন ময়লা কাঁথার শয্যার পাতা হয়। কাঁথার দুর্গন্ধ ও ছাগল চ্যানার (প্রস্রাব) তীব্র ঝাঁজে গা গুলিয়ে ওঠার উপক্রম হলো। তার সঙ্গে যুক্ত হলো মশার কামড়। এই অবস্থায় গাদিলা পাতার বিড়ি টেনে ঘুমিয়ে না ঘুমিয়ে রাত অতিবাহিত করি। পরের দিন সকালবেলা দালাল আমাদের পার করে দেওয়ার জন্য বিএসএফের সঙ্গে বিশেষ বিহিত করে। তারপরেও বিএসএফের চোখ এড়ানোর মিথ্যে ভান করে ক্ষেতের উঁচু আইলের আড়ালে প্রায় ১ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে নদীর ঘাটে পৌঁছি। ছোট্ট ইছামতী নদীর মতো এত সুন্দর নদী জীবনে কম দেখেছি।
আমরা যখন মাঝ নদীতে, তখন একজন বলছে, এটা হলো নোম্যান্সল্যান্ড। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সীমানা, এটি বাংলাদেশের নয়, ভারতেরও নয়। এখানে বাংলাদেশের বিডিআর কিংবা ভারতের বিএসএফ, যে কাউকে গুলি করে বলে দিতে পারে, এরা হলো অনুপ্রবেশকারী, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী। পাসপোর্ট ও ভিসা না থাকায় কোনো জবাবদিহিও করতে হবে না। এই প্রথম নোম্যান্সল্যান্ডের অর্থ বুঝলাম। কিন্তু এত অসহায় নিজেকে আর কোনো দিন লাগেনি। নৌকা থেকে নামার পর আমার চোখ থেকে আনন্দাশ্রু ঝরতে থাকে। জীবনে এই প্রথম স্বদেশের মর্মার্থ বুঝলাম। এই জায়গায় একটি সুন্দর সুখস্মৃতি আছে। নদীর পারে এক তরুণীর দেখা পাই। এত সুন্দর কোনো নারী বাকি জীবনে আর দেখব কি না, আমার জানা নেই। কিছু পথ আসার পর স্হানীয় এক দালাল পাসপোর্ট, ভিসা না থাকায় আমাদের ভয় দেখাচ্ছিল। তার জন্য কিছু করুণাই জন্মেছিল মাত্র।
আমরা কপর্দক শূন্য অবস্থায় বাংলাদেশে ফিরি। কাকডাঙ্গা গ্রামে আমরা সজলের এক মামার শ্বশুর বাড়িতে উঠি। সেখানে দুপুরে খাবার খেয়ে বিদায় নেই। গৃহকর্তা আমাদের একটি ভ্যান গাড়ি ঠিক করে দেন ৩০/৩৫ মাইল দূরবর্তী সাতক্ষীরা শহরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। সাতক্ষীরা শহরে সজলের বাসা। সেখানে পৌঁছে আমরা ভ্যান ভাড়া দেবো এবং ঢাকা যাওয়ার খরচের ব্যবস্হা করব। কারণ মামা বাড়ির লোকজনকে তো আর এ কথা বলা যায় না, আমাদের পকেট একেবারে ফুটো একটি পয়সাও। রিকশা ভ্যানের চালক ৫/৬ মাইল পর একটি স্হানীয় বাজারের কাছে এসে সাতক্ষীরা না আসতে গোঁ ধরে বসে। সে বলে তাকে বাজার পর্যন্ত আসতে বলা হয়েছে। কাজেই সে আর একটুও অগ্রসর হবে না। আমরা তাকে অনুরোধ করি সাতক্ষীরা পর্যন্ত আসার জন্য। তার এককথা, সে আসবে না। একপর্যায়ে তাকে ধমক ও হুমকি দেই। এতে করে কাজ তো হয়ই নি, উপরন্তু সে বাজারের লোকজন জড়ো করে ফেলে। বাজারের লোকজন বৃত্তান্ত শুনে এবং আমাদের পরিচয় পেয়ে আমাদের বিশ্বাস করে। তারাও আমাদের হয়ে ভ্যানচালককে অনুরোধ করে। কিন্তু তার এককথা, সে আসবে না। কার্যত সে ভয় পেয়েছিল। স্হানীয় লোকজন তাকে ভাড়া পরিশোধ করে দিতে বলে। টাকা থাকলে তো, ভাড়া দেবো। তখন স্থানীয়রা আরেকটি ভ্যান ঠিক করে দেয়। সেই ভ্যানচালকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আগের ভাড়া পরিশোধ করি। আবারও টাকা নিয়ে বিকালের চা নাস্তা করি, সিগারেট কিনি। সাতক্ষীরা পৌঁছে তার যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করে তাকে আরও কিছু বখশিশ দিয়ে বিদায় করি।
পরদিন সকাল বেলা সাতক্ষীরার ডিসি সাইফুল ইসলামের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করি। উল্লেখ্য, ভারতে যাওয়ার আগে আমরা তাকে মৌখিকভাবে জানিয়েছিলাম। সেই কারণেই মূলত দেখা করতে যাওয়া। ঘটনাচক্রে তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। ৮৬ সনে তিনি গফরগাঁওয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। সেই সুবাদে আমার আব্বার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। সরকারি কাজে এলাকায় এলে কয়েকবার আমাদের বাড়িতে এসেছেন।
কলকাতা বইমেলা আমাদের চিন্তা-চেতনা দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে একধরনের স্পৃহা ও উদ্যম সৃষ্টি করে। ৯৯ সালে ওবায়েদ আকাশ সম্পাদিত সাহিত্য ও চিন্তাশিল্পের কাগজ ‘শালুক’ প্রকাশিত হয়। একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘শালুক’ এখন বাংলা ভাষার অনিবার্য ছোটকাগজ। ২০২১ সালে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় শিল্প-সাহিত্য ও মননের কাগজ ‘কাশপাতা’। সেই সময় কবি শামীম রেজা আজকের কাগজের সাহিত্য সাময়িকী সুবর্ণরেখা সম্পাদনা করতেন। সুবর্ণরেখা সমাদৃত হয়েছিল। যেদিন সুবর্ণরেখা বের হতো সেদিন কাগজের বিক্রি বেড়ে যেতো। শামীম ভাই সুবর্ণরেখার পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে শূন্য দশকের কবিতা সংখ্যা করেছিলেন। আমার কবিতাটি ছিল লিড কবিতা। ২০২১ সালে আমি ও আমার বড় আপা মফিদা আকবর আবারও কলকাতা যাই। কলকাতার প্রতিক্ষণ অফিসে সাধন চট্টোপাধ্যায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, ভগীরথ মিশ্র, আফসার আমেদ, অমর মিত্র, মানসী কির্ত্তুনীয়াসহ ৭০ দশকের গল্পকারদের নিয়ে একটি বৈঠকি আয়োজন হয়। আমি সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করি। সুবর্ণরেখা বৈঠকির ছবিসহ লেখাটি ছেপে ছিল। সেই সময় সুবর্ণরেখায় নামে বেনামে প্রতি সপ্তাহে লেখা ছাপা হতো।
তখন মাসে একদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে লেখক আড্ডা হতো। সেখানে প্রথিতযশা লেখকদের পাশাপাশি তরুণ লেখকগণও নিয়মিত হাজিরা দিতেন। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সান্নিধ্য ছাড়াও উত্তম ভোজনের ব্যবস্হাও ছিল। এভাবেই একদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রের সদস্য হই। কিছুদিন পরেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ২৫ পূর্তি আয়োজন। কী ভেবে যেন আব্দুল আবু সায়ীদ স্যার আমাকে পূর্তি অনুষ্ঠানের কিছু দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
এই সময় প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করে বিকাল সন্ধ্যায় অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের আড্ডায় হাজির হই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনি স্যারের কথা। যেন সক্রেটিস কিংবা প্লেটোকে ঘিরে বসে আছে একদল শিষ্য। অবশ্য শিষ্য হওয়ার ন্যূনতম যে যোগ্যতা থাকতে হয়, আমার তাও ছিল না। কিন্তু কথায় বলে সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। আমার অবস্থাও হলো তাই। একসময় দুই-একটি প্রশ্ন আমিও করতে থাকি। এদিকে স্যার দীর্ঘদিন পর কিশোর তরুণদের উৎকর্ষধর্মী মাসিক পত্রিকা আসন্ন পুনরায় প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। আসন্ন পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পায় শিশু সাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম। আমাকে দেওয়া হয় সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব। ছয়টি সংখ্যার কাজে যুক্ত ছিলাম। একই সময় দৈনিক যুগান্তর প্রকাশিত হয়। আবু হাসান শাহরিয়ার পত্রিকা বের করার বিষয়ে অনেক অবদান রেখেছেন। আমাদেরও কিছু দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ধরে নিয়েছিলাম যুগান্তরে আমার একটি কাজ নিশ্চিত। এরই মধ্যে নাসরিন জাহানের উড়ুক্কু উপন্যাস নিয়ে আমি একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখি। ক্রুশকাঠে কন্যা, উড়ে যায় নিশিপক্ষীসহ বেশ কয়েকটি উপন্যাসের রিভিউ লিখি। স্বভাবত তার সঙ্গে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সময় শিল্প প্রতিষ্ঠান বি আর বি গ্রুপ ইউটিভি নামে একটি বেসরকারি চ্যানেল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। হেড অব ম্যানেজারের দায়িত্ব পায় যুবদা। অর্থাৎ নাট্যজন খালেদ খান। যুবদা নাসরিন আপার বাল্যবন্ধু। তিনি আমার একটি চাকরির জন্য সুপারিশ করেছিলেন। দেখা গেলো যুগান্তর কিংবা ইউটিভি কোথাও আমার চাকরি হয়নি। ইউটিভি আজও আলোর মুখ দেখেনি।
এই সময়ের ভেতর ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, সংবাদ, আজকের কাগজ, মুক্তকণ্ঠের খোলা জানালা, ভোরের কাগজ সাময়িকী ও পাক্ষিক শৈলী, বাংলাবাজার, বাংলার বাণী ও দৈনিক বাংলার সাময়িকীতে আমার নিয়মিত গল্প, কবিতা ও বুক রিভিউ ছাপা হয়। এভাবে একসময় আমার ভেতর পূর্ণাঙ্গ লেখকসত্তার বোধ সৃষ্টি হয়। আমি নিজেকে লেখক হিসেবে মনে করি। কিন্তু প্রিয় পাঠক একথা বলার পরেও আমি কি লেখক সত্তার উন্মেষপর্ব চিহ্নিত করতে পেরেছি?