সব নাগরিকেরই দেশের প্রতি, দশের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা আছে। এমনকী মানুষ হিসেবেও বুদ্ধিতে, বিবেকে অন্য সব প্রাণী থেকে সে আলাদা। এই মানুষই সৃষ্টি করেছে আজকের সভ্যতা। সেই সভ্যতার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এই সীমাব্ধতাও এক ধরনের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা। স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র আমার কাছে প্রায় অভিন্ন। আমার কাছে সেই স্বাধীনতার কথাটা খুব সাধারণভাবে এমন, ‘আমার দ্বারা যেনো অপরের কোনো ক্ষতি না হয়।’
তার মানে স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছে তা করা নয়। অন্তত মানুষের জন্য স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র এ কথা বলে না। যদি মহাত্মন আব্রাহাম লিঙ্কন-এর কথা বলি, Of the people, by the people, for the people. এখানেও তিনি ব্যক্তি মানুষের গণতন্ত্রের কথা বলেননি। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় গণতন্ত্র হচ্ছে সামগ্রিক জনগণকে নিয়ে। গণতন্ত্র কোনো এককের বিধান নয়। আমার এ প্রসঙ্গকে মনে হতে পারে ধান ভানতে শিবের গীতের কথা। কিন্তু ওই যে সভ্যতা ও তার চর্চায় আমাকে কিছু বিধি-বিধান তৈরি করে দিয়েছে। আমি যা খুশি তা করতে পারি না। আমাকে পোষাক পরতে হয়, আমাকে প্রচলিত আইনের বিধানের ভিতরে থাকতে হয়, রাষ্ট্রের বিধি বিধান মানতে হয়, ধর্মের বিধি বিধানে আমি বন্দি, সামাজিক প্রতিবিধানে আমি জড়িয়ে থাকি, পারিবারিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ।
তার ওপর লেখক, শিল্পীরা হচ্ছেন সমাজে অগ্রগণ্য। চিন্তা ভাবনায় তারা সাধারণের থেকে অগ্রসর। একজন দার্শনিক। তারাই সভ্যতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে দেখান। কখনো সৃষ্টি করেন। বলা যায় সৃষ্টিই তার নেশা, সৃষ্টি তার সাধনা। সামাজিক রীতি-নীতি তাদের হাতেই লিখিত হয়, তাদের রচনায় সৃষ্টি হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, লেখকের লেখার স্বাধীনতা কতটুকু? কিংবা তার চ্যালেঞ্জ কতটুকু?
প্রথমত, একজন লেখকের লেখায় এবং তার নৈতিকতাবোধ তার দৃষ্টিভঙ্গি যেমন প্রকাশ পেয়ে থাকে, তেমনি তার পাঠকের কাছে সে দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে পড়ে বা প্রভাবিত করে। তার মানে লেখক কখনোই একক কোনো সত্তা নন। এই যে তিনি একক সত্তা নন, সে কারণেই তার লেখার স্বাধীনতা তারই চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে আবদ্ধ। তবে, এ সব কিছুই পরিবর্তনশীল; সময় ও বাস্তব অবস্থার প্রয়োজনে। আর একজন লেখককে তার পূর্বসূরিদের জানতে হবে। কোন পথে হেঁটেছিলেন তারা, কোন বাস্তবতায় তারা তা লিখেছিলেন, সেসব বিবেচনা করার মেধা ও শক্তি একজন লেখকের থাকতে হবে। আর লেখক যতটুকু লিখবেন তার চেয়ে ভাববেন, পড়বেন ও জানবেন। কারণ লেখকের ব্যর্থতা একটা সমাজকে যেমন প্রভাবিত করে, তেমনি সমফলতাও সমাজকে সমানভাবে আলোড়িত ও আলোকিত করে।
এখন একজন লেখক কী লিখবেন, কতটুকু লিখবেন, কেন লিখবেন? এই লেখা কি তিনি নিজের জন্য লিখছেন, না কি পাঠকের জন্য লিখছেন, সেটাও বিবেচনার বিষয়। তবে সাধারণত লেখক পাঠকের জন্যই লিখেন। তাই তার স্বাধীনতার সঙ্গে চ্যালেঞ্জও যুক্ত হয়ে যায়। কী সেই চ্যালেঞ্জ?
একজন লেখকের দর্শন ও চিন্তা সমাজকে প্রভাবিত করে। তাই মনে করি, একজন প্রকৃত লেখককে লেখার আগে-পরে অবশ্যই ভাবতে হবে, লেখাটি কতটুকু জনকল্যাণকর কিংবা জনকল্যাণে নয়। তারপরই তা প্রকাশ করবেন।
লেখককে অবশ্যই তিনি যে ভাষায় লিখবেন, সে ভাষা সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। থাকতে হবে বাক্য ও শব্দের প্রয়োগ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা।
নিজের দেশপ্রেম, মানবপ্রেমসহ কৃষ্টি ও কালচারের পাশাপাশি বৈশ্বিক কৃষ্টি ও কালচার সম্পর্কে জানতে হবে। সে মোতাবেক নতুন ও গ্রহণযোগ্য ভাবনা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। অবশ্যই লেখককে বৈশ্বিক জ্ঞানে আপডেটেড হতে হবে। যাকে শুধুই এগিয়ে যাওয়ার কাঙ্ক্ষায় ব্রত থাকতে হবে।
লেখককে হতে হয় সুন্দরের পূজারী। সে কারণে তার লেখায় থাকবে প্রকৃতির বন্দনা। তার আশে-পাশে প্রকৃতির যা যা কিছু আছে, তার সুন্দর শৈল্পিকচিত্র পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে মূর্ত বা বিমূর্তভাবে।
সব সময়ই লেখককে যে বড় চ্যালেঞ্জ নিতে হয় সেটা হচ্ছে, দেশের অর্থনীতি, রাজনৈতিক অবস্থান, ধর্মীয় অবস্থান, মানুষের মনোজগত, অনুভূতিপ্রবণতা, সামাজিক ও পারিবারিক প্রচলিত বিধি বিধান ও বিশ্বাস। যা কখনো কখনো সমাজে, রাষ্ট্রে মানুষে মানুষে নানাভাবে পার্থক্য গড়ে দেয়। তবে লেখককেই তার দূরদৃষ্টি চিন্তা ও চেতনা, সততা, নৈতিকতা ও সাহসী লেখার মাধ্যমে বাস্তব পরিবর্তন ঘটাতে হয় এসব ব্যবস্থার। যা অবশ্যই কল্যাণকর, আধুনিক ও জনমুখী হতে হবে। এজন্য লেখককে যুগে যুগে, শাসকের, সমাজের ও ধর্মীয় নেতাদের আক্রোশে পড়তে হয়। এমনকী জীবনও দিতে হয়। তবু লেখকের দায় সে সব বৈতরণী পার হতে হয় শক্ত ও কৌশলের কলমে। সেখানে প্রকৃত লেখক কখনো এ সব শক্তির কাছে আপস বা নত স্বীকার করে না। করতে নেই। এটাই লেখকের স্বাধীনতা, আবার এটাই চ্যালেঞ্জ। আজকে মানুষের সভ্যতা সৃষ্টিতে যদি লেখকদের ভূমিকা থেকে থাকে, তবে তাকে এগিয়ে নিতে এই চ্যালেঞ্জ অতীতের মতো বর্তমানেও নিতে হবে। লেখক যেমন কোনো গোষ্ঠীকে খুশি করার জন্য লিখবেন না তেমনি কোনো গোষ্ঠীকে অযাচিত আঘাতও করতে পারেন না। তার দায় সামগ্রিক। এ সামগ্রিকতা লেখককে ধারণ করতে হবে। সমাজের সব কূপমুণ্ডকতা, কুসংস্কার, অন্ধকার দূর করতে হবে লেখককেই। আমরা জানি লেখক ও শিল্পীরা পথ দেখিয়ে দেন, রাষ্ট্র সে পথে এগিয়ে যায়।
সে কারণেই আমি যা লিখবো বা আমার মনে যেভাবে লেখা আসবে, সেভাবেই প্রকাশ করার ক্ষেত্রে লেখককে ওপরের চ্যালেঞ্জ এবং একইসঙ্গে লেখকের সামগ্রিক দায়বদ্ধতাও বিবেচনা করে তা প্রকাশ করা উচিত। শুধু পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য লেখা একজন লেখককে লেখক হিসেবে পূর্ণতা এনে দেয় না, কখনো দেয়নি। লেখককে অবশ্য সব লোভ ও ক্ষমতার ঊর্ধ্বে উঠে সত্য ও আধুনিক মানসিকতাকে তুলে ধরতে হবে। আলোকিত করতে হবে মানবিক সব সত্তাকে। সব অবক্ষয়ের অন্ধকারে আলোর সার্চ লাইট ফেলে আলোকিত পথে এক সহনশীল যাত্রায় সবাইকে যুক্ত করার প্রয়াস নিতে হবে। লেখক তো ভবিষৎদ্রষ্টা ও একজন প্রকৃত দার্শনিক। কারণ একজন লেখকের দর্শন ও চিন্তা সমাজকে প্রভাবিত করে। তাই মনে করি, একজন প্রকৃত লেখককে লেখার আগে-পরে অবশ্যই ভাবতে হবে, লেখাটি কতটুকু জনকল্যাণকর কিংবা জনকল্যাণে নয়। তারপরই তা প্রকাশ করবেন।