এক.
হইচই কিংবা সমাবেশ করে কবিতা হয় না। আবার কবিতা যে কিসে হয়, সেটাও বলে দেওয়া যায় না। মোটকথা কবিতা যখন হওয়ার যেমন করে হওয়ার হয়ে যায়। হয়ে যাবে। সে জন্য সেকোনো আয়োজনের অপেক্ষা করে না। আর সমাবেশের মঞ্চও প্রত্যাশা করে না। হইচই দেখে দেখে সামনে আসে না। কিন্তু কখন আসে! আবার সেইকথা—সে যখন আসার চলে আসে। নিজের মতো। সগৌরবে। হ্যাঁ, তবে অবশ্যই তার এক ধরনের প্রস্তুতি থাকে। সেটা নিজেকে তৈরি করার জন্য। ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য নয়। নিজেকে বিছিয়ে দেওয়ার জন্য নয়।
২০০০ সালের কোনো এক সন্ধ্যায়। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি। উঁচু গাছের ডালে ডালে উছলে পড়ছে জলের কণা। মনের অজান্তেই বৃষ্টির গভীরে ডুবে যাই। না ভিজেও ভিজে যাচ্ছি—দৌড়ে বেড়াচ্ছি সবুজ ঘাসের স্নিগ্ধ বিছানায়। হঠাৎ করেই মনে হলো—এই যে আমি পরম আনন্দে বৃষ্টি বিলাস করছি। বৃষ্টিকে নিয়ে ভাবছি। হাতের আঙুলে ছুঁয়ে দেওয়া বৃষ্টির কণা নিয়ে উচ্ছ্বসিত হচ্ছি। কিন্তু যার মাথার ওপর চালা নেই।
নিজস্ব ঘর নেই। রাস্তার পাশে কিংবা পরিত্যক্ত বাড়ির পাশে আশ্রয় নিয়েছে, যারা তাদের তো অনেক কষ্ট। বৃষ্টি নিয়ে উচ্ছ্বাস ফুরিয়ে আমার মন বিষাদে ছেয়ে গেলো। কী মনে করে যেন টেবিলের কাছে ছুটে গেলাম। কবিতার আদলে খাতায় এলোমেলা কিছু বাক্য লিখে ফেললাম। তখনো পাঠ্যবইয়ের বাইরে তেমন কেনো বই পড়া হয়নি। কী লিখলাম, জানি না। তবে নিজের ভেতরে যে কষ্টটা জাপ্টে ধরেছিল—লিখতে পেরে মনে হলো সে কষ্ট কিছুটা নেমে গেছে। এরপর মূলত কোনো কিছু নিয়ে কষ্ট পেলেই লেখা হতো। টুকটাক লেখা। কবিতা লেখার চিন্তা থেকে নয়। এরপর আস্তে আস্তে পাঠ্যবইয়ের বাইরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদের কিছু লেখার সঙ্গে পরিচয় ঘটে।
#আমিই আমার কারিগর ॥ রফিকুজ্জামান রণি
বছর খানেক লুকিয়ে লেখা চলে। নিজের মতো কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা—ভাব তৈরি হলে চুপচাপ ডায়েরিতে লিখে রাখি। কাউকে দেখাই না। লজ্জা লাগে। মনে হয়, আমার এই গোপন ভাবনা কেউ পড়ে হয়তো হাসবে। কিংবা বিদ্রূপ করবে। তখন নিজের কাছে খারাপ লাগবে। এরপরও ২০০১ সালের মাঝামাঝি সময় একদিন কয়েকজন বন্ধুকে বলি। দুই-একজনকে দেখাইও। কিন্তু তারা পাত্তা দেয় না। তারা বলে কবিতা লেখা এত সহজ কিছু নয়, এটা অনেক বড় ব্যাপার যেটা আমাকে দিয়ে হবে না। বন্ধুদের তিরস্কারে আমার গতি থামে না। বিকেল হলে সুগন্ধা নদীর তীরে বসি থাকি। বেশিরভাগ সময়ই বন্ধুদের আড্ডা এড়িয়ে একা থাকার চেষ্টা করি। চুপচাপ নদীর স্রোত দেখি। আকাশ দেখি। নদীর ওপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা দেখি। মুগ্ধ হই। নতুন নতুন বই পড়ার চেষ্টা করি।
পুরাতন সব লেখা বাদ দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করলাম। পাঠের ব্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নিজের লেখা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম। তখন আড্ডা প্রকাশের মাধ্যমে লিটলম্যাগ আন্দোলনে যুক্ত হই। পরিচয় ঘটে তখনকার সময় বরিশালের প্রবীণ-তরুণ কবিদের সঙ্গে।
২০০২ সালে একটা কিশোর নাটক লিখে ফেলি। কবিতার প্রতি বন্ধুদের আগ্রহ না থাকলে নাটকে বন্ধুদের আগ্রহ দেখতে পাই। তাদের সহযোগিতা ও অশংগ্রহণে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।
২০০২ সালে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পর লেখায় আগ্রহী আরও কিছু বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় ঘটলো। তার মধ্যে একজন হেলাল বিন হানিফ। এখন সীমান্ত হেলাল নামে লেখালেখি করে। ওর সঙ্গে সাহিত্য-বিষয়ক আড্ডা হতে থাকে। নতুন নতুন বই পড়ার পরিকল্পনা করি আমরা। এরই মধ্যে দেয়ালিকা প্রকাশের দায়িত্ব পেলাম। দেয়ালিকার সম্পাদক হিসেবে লেখা জোগার করা-সম্পাদনা-প্রকাশ করায় আরও লেখায় উৎসাহীদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। সতীর্থ সীমান্ত হেলালসহ অনেক বন্ধুর নিয়ে পত্রিকা প্রকাশের চেষ্টাও করলাম। যদিও একসংখ্যা প্রকাশ হয়ে সে পত্রিকা আর আলোর মুখ দেখেনি। এমন লিখতে লিখতে একদিন মনে হল—লিখে রেখে দিলে কী হবে! এগুলো প্রকাশ করতে হবে। ২০০২ সালের শেষের দিকে একটি লেখা প্রকাশিত হলো। এরপর থেকে বিরতি দিয়ে লেখা প্রকাশ হতে লাগলো।
২০০৬ সালের দিকে ব্যক্তিগত পাঠস্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম—এতদিন আমি নিজের লেখা লিখিনি। যা লিখেছি তা আমার পাঠ প্রভাবিত। সেটা নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছায়া। পুরাতন সব লেখা বাদ দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করলাম। পাঠের ব্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নিজের লেখা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম। তখন আড্ডা প্রকাশের মাধ্যমে লিটলম্যাগ আন্দোলনে যুক্ত হই। পরিচয় ঘটে তখনকার সময় বরিশালের প্রবীণ-তরুণ কবিদের সঙ্গে। তরুণদের মধ্যে—অনিন্দ্য দ্বীপ, রেশমা পপি, মোহাম্মদ জসিম, তুহিন ওসমান, রিয়াজ আহমেদ, হাসান মেহেদী, কিং সউদ, মিছিল খন্দকার, আগন্তুক মাহফুজ ও মাহমুদ মিটুলের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা হতে থাকে। অগ্রজদের মধ্যে—তপংকার চক্রবর্তী, আসমা চৌধুরী, মুস্তফা হাবীব, নয়ন আহমেদ, মনিরুজ্জামান ফরিদ, সাইফুল আহসান বুলবুল, কাশেম নবী, হেনরী স্বপন ও মোশতাক আল মেহেদী। যা পরবর্তী লেখায় নিজেকে তৈরির সময় হিসেবে অবদান রেখেছে বলে আমি বিশ্বাস করি।
দুই.
২০১৪ সালে রুটি-রুজির তাগিদে ঢাকায় চলে আসি। কোনো করপোরেট ক্যারিয়ার তৈরির উদ্দেশ্যে নয়; লেখালেখিকে চালিয়ে যাওয়ার সহযোগী হিসেবে কোনো কাজ করার ইচ্ছায়। কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লেখালেখি চলতে থাকে। কিন্তু বরিশালে যেমন একটা সার্কেল তৈরি হয়েছিল। ঢাকায় এসে পূর্ব-পরিচিতদের সঙ্গেও আর তেমন বন্ধুত্ব গাঢ় হয়নি। কেন হয়নি সে অন্য এক প্রসঙ্গ। বারবার কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন—নিজের বিশ্বাস ধরে রাখার প্রচেষ্টা লেখালেখিকে কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্তু নিজের সঙ্গে আপস করার ইচ্ছা কোনো কালেই আমার ছিল না। এখনো নেই। সে কারণে নিজের রচিত পথেই নিজে হেঁটেছি। হাঁটছি। বাদ-বাকি সব প্রলোভন, ফাঁদ অস্বীকার করেছি সবসময়।
আমি লিখি সেটা আমার পরিবারের সদস্যরা জেনেছে অনেক পরে। যখন পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হওয়া শুরু করেছে তারপর থেকে। বাবা রেগে মেগে শাসন করলেন। মা কিছু বললেন না। কিন্তু চোখ-মুখের ভঙ্গিতে বোঝালেন, এটা বাদ দেওয়াই ভালো। কিন্তু আমি বাদ দিতে পারলাম না। রেজাল্টও উল্টোপথে চলতে লাগলো। তবে, একজন নতুন লিখিয়ের পাশে পরিবারকে না পেলেও একজন নিম্নগতির ছাত্রের পাশে পরিবারকে পেয়েছিলাম। যে কারণে অ্যাকাডেমিক পড়াটা শেষ করতে পেরেছিলাম। আর লেখালেখির কারণে সমাজিক ক্যারিয়ার বা ভালো রেজাল্ট না করতে পারার রাগ সম্ভবত মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হওয়ায় বাবা-মা কিছুটা হলেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
আমি মনে করি—লেখালেখিটা আমার কাছে অক্সিজেনের মতো। লেখালেখি আমাকে যেমন মানুষ হিসেবে তৈরি হতে সাহায্য করছে। তেমন বাঁচিয়ে রাখছে।
রেজাল্টের পরপর শিক্ষক নিবন্ধনে পাস করে একটা কলেজে জয়েন করার পর হয়তো কিছুটা মনে মনে খুশিও হয়েছিলেন। কিন্তু সেই খুশিটা বেশি দিন ধরে রাখতি পারিনি। কারণ কলেজের চাকরিটা আমি খুব অল্প সময়ই করেছিলাম। এরপর আবার সেই ছন্নছাড়া জীবন। গন্তব্যহীন দৌড়! কিন্তু লেখাটা চলেছে। গোপনে অথবা প্রকাশ্যে। ততদিনে দু’টি কবিতার বইও প্রকাশিত হয়েছে। সেটা পরিবারের কারও কাছে তেমন গুরুত্ব পায়নি একমাত্র সাহিত্য সমোঝদার ছোটমামা ছাড়া। তারপর আরও একটা একটা করে বই প্রকাশিত হয়েছে। আমি তাদের কাউকে বলিনি। তারাও কেউ খবর রাখেনি। পরিবার কিংবা আত্মীয় স্বজনদের কাউকে উপহার দেওয়াও হয়নি। কারণ আমার ক্যারিয়ারে বাবা-মা কিংবা আত্মীয়-স্বজনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। ছোটবেলায় পড়ালেখা কিংবা ভালো রেজাল্ট দেখে আমার কাছে তাদের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল তার ধারেকাছেও যেতে পারিনি। সে কারণে আমার এই জগৎটাকে তাদের কাছ থেকে কিছুটা দূরে রাখি! আমার প্রথম বইটি খুঁজলে হয়তো গ্রামের বাড়িতে আমার বইয়ের আলমিরায় পাওয়া যাবে। আর কোনোটি বাড়িতে থাকার সম্ভবনা নেই। এখন অনলাইনের কারণে উপজেলার দু-একজন মাঝে মধ্যে নক দেয়। অনলাইনে আমার লেখা দেখেছে। কিংবা পড়েছে। কিন্তু সেটা কখনোই আমার বাবা-মার চোখের সামনে আসে না। আমিও যেমন তাদের ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে শতশত মাইল দূরে থাকি কিংবা খুব কাছে থাকি। আমার লেখা কিংবা বইগুলোও হয়তো তাদের কাছে না থেকেও অনেক কাছে থাকে! আর আমি ও আমার লেখা অনেক দূরে থেকেও যেন পরিবারেরই অংশ হয়ে থাকে।
তিন.
বিক্রিকে মুখ্য বিষয় ধরে আমি কখনোই বই প্রকাশ করি না। আমি চাই না কোনো রকম পাঠপ্রস্তুতি নেই এমন পাঠকরা আমার বই পড়ে তাদের সময় নষ্ট করুক। আমি চাই আমার লেখাগুলো এমন কিছু মানুষ পড়বে যাদের অন্তত কিছুটা পাঠ প্রস্তুতি আছে। আমি বিশ্বাস করি একেক লেখকের লেখা পড়ার জন্য পাঠকের একেক রকম পাঠ প্রস্তুতি থাকতে হয়। কারণ স্বচ্ছ ইমেজের লেখা পড়ার প্রস্তুতি নিয়ে কখনো কেউ নীরিক্ষাধর্মী লেখা হজম করতে পারবে না। শুধু শুধু তার সময় নষ্ট করবে। বলবে এই লেখকের লেখা কিচ্ছু হয় না। হাবিজাবি লেখে। আমি কোনো লেখককে অসম্মান করতে চাই না। কারণ আমি এটা বিশ্বাস করি যে, প্রত্যেকে তার মতো। সবাই নিজের মতো করে ইমেজ তৈরি চেষ্টা করেন।
#কোথায় যাচ্ছি, পথ জানা নেই ॥ রকিবুল হাসান
কারও ইমেজে পাঠক কানেকশন তৈরি করতে পারে আবার কারওটা পারে না। তাই বলে আমরা সে লেখককে অস্বীকার করতে পারি না। কিংবা সাইড করে রাখতে পারি না। আর নীরিক্ষায় সব সময়ই একটা রিস্ক থাকে। তারপরও প্রতিটি লেখায় নিজেকে আলাদাভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা থাকে আমার। কখনো আবার উপস্থাপন শৈলীর চেয়ে ভাবনার জায়গাটা বড় করে দেখার চেষ্টা করি। নিজের ভেতরের নিজেকে ভেঙে আবার নিজেকে তৈরি করি। কিন্তু মঙ্গলগ্রহ কিংবা শুক্র-শনির গল্প আমি বলতে পারি না। আমি নিজস্ব ডুব-সাঁতার কিংবা চিন্তার দৌড় নিয়ে ছুটতে পারি। যতদূর মন যায়। যতদূর চিন্তা যায়। তবে সেটা অবশ্যই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে। আমি মানুষের জীবন আঁকতে চাই। কিংবা কেবলই আমার জীবন! যা দেখা যায় কিন্তু আবার দেখা যায় না। আবছা আলোর গহীনে।
আমার আটটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এরমধ্যে কবিতার বই, অলৌকিক স্বপ্নের যৌথ বিবৃতি (২০১৩), সাইরেন (২০১৫), কালো হাসির জার্নাল (২০১৬), মাথার এপ্রোন (২০১৯ )। গল্পের বই লাবণ্য দাশের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর (২০২০)। উপন্যাস গুহা (২০১৯), সহবাস (২০২১)।
প্রায় এই দেড় যুগের জার্নি পেরিয়ে লেখক হয়ে উঠেছি কি না, বলতে পারি না। তবে প্রতিটি নতুন লেখার পর সেই প্রথম লেখার মতোই তৃপ্তি পাই। ভালো লাগে। বলা যায় ভালো থাকার জন্য—বেঁচে থাকার জন্য লিখি। না লিখতে পারলে অসুস্থ হয়ে যাই। আমি মনে করি—লেখালেখিটা আমার কাছে অক্সিজেনের মতো। লেখালেখি আমাকে যেমন মানুষ হিসেবে তৈরি হতে সাহায্য করছে। তেমন বাঁচিয়ে রাখছে।