লেখালেখি—কারও কাছে শখ। কারও কাছে নেশা। কারও কাছে পেশা। কারও কাছে আবার সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকারও। মানুষ তার বিনোদনের জায়গা থেকে নিজের মনের মতো কবিতা, গান, ছড়া পদ্যসহ (চারু কলা ও কারু কলার) বিবিধ অনুষঙ্গ থেকে আনন্দ উদযাপন করে। আনন্দ উদযাপনের আরেক নাম বিনোদন।
লেখালেখি একটা শিল্প। যে লেখা বা শিল্প সমাজে দৃষ্টান্তমূলক নতুন অন্বেষা তৈরি করে; সেই লেখা বা শিল্পেরও আছে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। যে লেখা শিল্পমূল্যহীন, সে লেখা একদিনের লেখা। যে লেখার শিল্পমূল্য আছে, সেই লেখা বহুদিনের লেখা। ক্ষেত্রবিশেষে কালোত্তীর্ণও।
কেউ মনের আনন্দে ডায়েরি লিখতে পছন্দ করেন। ছাপানও। আবার কেউ মনের আনন্দে ডায়েরি লিখলেও সেটি ছাপাতে পছন্দ করেন না। কেউ কেউ যে কথা যখনই যেভাবে মনে আসে, সে কথা সেভাবেই তখনই লিখে ফেলতে পছন্দ করেন। যা মনে আসে তা লিখে ফেলার ক্ষমতা অর্জন, একপক্ষের জন্য ক্ষতিকর ও অযৌক্তিক। আরেক পক্ষের জন্য হিতকর ও যৌক্তিক। হিতকর ও যৌক্তিকতার সঙ্গে থাকে নিজের লেখক সত্তাকে যাপন এবং চর্চার সু-অভ্যাস। সুতরাং যখন যা মনে আসে, সেই লেখার যে এনাটমি, তাকে ব্যবচ্ছেদ করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা থাকতে হবে। থাকতে হবে সংশোধন, পরিমিতিবোধ ও বর্জনের ক্ষমতাও। যাই লিখি না কেন, তা যদি নিছক আত্মতৃপ্তি ও আত্মভোজনের নিমিত্তে হয়, তাহলে সেই লেখার কিছু পাঠক পাওয়া যাবে। বাহবা আসবে। কিন্তু ওই লেখার কোনো সাহিত্য মূল্য বা স্থিতিশীলতা নেই। আবেগনির্ভর, দায়হীন অযৌক্তিক কোনো কিছু কোনোকালে শেষ পর্যন্ত পাঠকের আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি।
আমি যা লিখেছি, সেই লেখার সম্পাদনাও গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। যেকোনো জনপ্রিয় লেখক, বিখ্যাত লেখক অথবা প্রজ্ঞাবান ধীমান লেখক; সব লেখক বা আর্টিস্টের ছোটখাটো ভুল থাকতে পারে। থাকেও। কিন্তু ভুল সম্পাদনা করবেন সম্পাদক; একথা খুবই স্বাভাবিক। এটি একজন সম্পাদকের সুসম্পাদনাসহ দায়িত্ববোধের মধ্যেই পড়ে। কারণ জগতে কেউই স্বয়ম্ভু নন। ভুলের ঊর্ধ্বে নন। সম্পাদনার প্রতি, সম্পাদকের পেশা, যোগ্যতা ও দায়িত্বের প্রতি লেখকের থাকতে হবে শ্রদ্ধা ও সম্মান।
আমরা কোনো কিছু সৃষ্টির জন্য সারাজীবন হয়তো বসে থাকবো না। কিন্তু অর্থবহ বা উল্লেখযোগ্য কিছু সৃষ্টির জন্য কিছু অবকাশ, অবসর, একাগ্রতা ও অধ্যবসায় খুবই জরুরি।
কোনো লেখা শেষ করার পর ওই লেখার প্রতি নিজস্ব সম্পাদনা, যোজন-বিয়োজনের অভ্যাস একটি মানসম্পন্ন ভালো লেখার পূর্বশর্ত। অনেকে কোনো কিছু লেখার পর নিজস্ব সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশের কাঙাল হয়ে পড়েন; অদূরদর্শিতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগা লেখকরাই এই কর্মে সিদ্ধহস্ত।
নিজের লেখা দ্রুত প্রকাশ করা বা না ছাপানোর সংযমও চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। এর জন্য লাগে ধৈর্য, সহ্য, আত্মবিশ্বাস ও সচেতনতা। বাংলাদেশে প্রতি বছর বই ছাপানোর নামে প্রচুর মূষিক প্রসব হয়। দীর্ঘসাধনার কয়েকবছর পর একটি মানসম্পন্ন ভালো বই প্রকাশ করা, দেশ ও জাতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। একটি ঋদ্ধ, মানসম্পন্ন ভালো লেখা এবং একটি ভালো বই যেকোনো দায়িত্ববোধ সম্পন্ন লেখকের কাছেই সন্তানতুল্য। কে না জানে, দ্রুত ও অসময়ে বিকলাঙ্গ, অসুস্থ ও অপুষ্ট শিশু জন্ম দেওয়ার চেয়ে দেরিতে একটি সুস্থ, পুষ্ট শিশু জন্ম দেওয়াই মঙ্গলজনক? কেননা নিছক আবেগে মামুলি কিছু করে ফেলার দায়ভার শেষপর্যন্ত নিজেকেই নিতে হয়। দেখা যায়, সারাজীবন এর অভিশাপ নিজেকেই বয়ে বেড়াতে হয়। এটি একটি সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য ও একজন ভালো লেখকের জন্য খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। সুতরাং যাই করি না কেন, তার প্রতি থাকতে হবে ভালোবাসা ও প্রেম। না হলে তা হয়ে পড়ে ভঙ্গুর।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ‘রচনার শিল্পগুণ’ নামক প্রবন্ধে ‘অর্থব্যক্তি’ ও ‘প্রাঞ্জলতা’ নামক দু’টি সাহিত্যগুণের কথা বলেছেন। বক্তব্যে যা প্রয়োজন, তা-ই সঠিকভাবে বলা অর্থব্যক্তির যোগ্যতা। অন্যদিকে যা বলা হবে তা উপযুক্ত শব্দ তথা বাক্যের মাধ্যমে সহজবোধ্য করে রচনা করা প্রাঞ্জলতা। এ বিষয়ে প্রমথ চৌধুরী ‘সাহিত্যের খেলা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘হীরক ও কাঁচ জমজ হলেও সহোদর নয়।’ অর্থাৎ আমরা হীরাকে কাঁচ ও কাঁচকে হীরা বলে ভুল করার যে বিদ্যমান প্রবণতা আছে; এই উদাহরণ ও যথেষ্ট বলে মনে হয়।
ইউরোপের রেনেসাঁ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাকবি গ্যাটে সারাজীবনের পরিশ্রমে তৈরি করেছেন ‘ফাউস্ট’। দান্তে’র উল্লেখযোগ্য (বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ) কাব্য ‘ডিভাইন কমেডি’র পর পাশ্চাত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য বলে ধরে নেওয়া হয় এই ‘ফাউস্ট’কে। আমাদেরও থাকতে হবে গ্যাটের (কাছাকাছি হলেও) এই সংযম ও যোগ্যতা। আমরা কোনো কিছু সৃষ্টির জন্য সারাজীবন হয়তো বসে থাকবো না। কিন্তু অর্থবহ বা উল্লেখযোগ্য কিছু সৃষ্টির জন্য কিছু অবকাশ, অবসর, একাগ্রতা ও অধ্যবসায় খুবই জরুরি।
তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ বিদ্যার প্রবল অস্থিরতার যুগে আমরা যারপরনাই ঠুনকো আর মামুলি জিনিসের পেছনেই ছুটছি। এই কুহেলিকাও কুজ্ঝটিকার পর্দা সরিয়ে আমাদের নতুন করে পথ চলতে হবে। হঠাৎ করে লেখা প্রকাশের ব্যগ্র আবেগ, নিছক প্রেরণা পরিহার করে তাকে যৌক্তিক ও অর্থবহ আবেগে পরিণত করতে হবে। অন্যথায় সারাজীবন শিল্পের পেছনে ছুটতে ছুটতে শিল্প আর ধরা দেবে না। লেখালেখি-শিল্পের অনবদ্য আকর গ্রন্থ ‘মার্জিনে মন্তব্য’। এই বইয়ে সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, ‘শিল্পের গাড়ি নিছক প্রেরণার চাকায় চলে না। তিনি গায়ক হন, লেখক হন কী চিত্রকর, তার ভেতরে নিদ্রাহীন দুই পুরুষ-প্রতিভাবান শিল্পী আর নিপুণ মিস্তিরি।’ সৈয়দ হকের এই কথাটি লেখকমাত্ররই মনে রাখা উচিত বলে মনে করি।