কমলকুমার মজুমদার—একা। একাই তৈরি করেছেন বাংলা গদ্যের একটি ধারা। ছোটগল্প বা উপন্যাস; উভয় ক্ষেত্রেই তিনি অনন্য, তুলনারহিত। গদ্যের যে নিজস্ব ঢং তাকে ধরে বাংলাসাহিত্যে চালু হয়েছে, সেখানেও তিনি একা। তিনি শুরু করেছেন, আবার শেষটাও বলতে গেলে তারই হাতে। তার গদ্য আমাদের চেনা, শেখানো প্রতিদিনের গদ্যের সঙ্গে তো নয়ই, বরং বাংলা সাহিত্যে প্রভাববিস্তারকারী কোনো লেখকের গদ্যের সঙ্গেও খাপ খায় না।
তার গদ্য নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘কমলকুমারের মুখের ভাষার সঙ্গে তাঁর রচনার দুস্তর ব্যবধান আমাদের বিশেষভাবে বিস্মিত করেছিল।’ কমলকুমার মজুমদার গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন। তিনি ছিলেন ছোটকাগজের লেখক, খুঁজেটুজে তার ২৯টি গল্প নিয়ে আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড ১৯৯০ সালে প্রকাশ করেছিল ‘কমলকুমার মজুমদার গল্প সমগ্র’। এই গল্প সমগ্রের প্রথম গল্প ‘লাল জুতো’, এই শুধু গল্প সমগ্রেরই না, কমলকুমার মজুমদারেরও লেখা প্রথম গল্প। ‘উষ্ণীষ’ নামের একটি ছোটকাগজে ভাদ্র ১৩৪৪ সালের সংখ্যায় গল্পটি প্রকাশিত হয়।
গল্পের চরিত্র দুজন। নীতীশ ঘোষ, সেকেন্ড ক্লাস, অ্যাকাডেমি। আর দ্বিতীয় চরিত্র গৌরী, সবে ফোর্থ ক্লাসে উঠেছে। দুজনের মধ্যে ভাব, ঝগড়া নিত্যদিনের। তবে ঝগড়ার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অপ্রকাশ্য ভালোবাসার সুর। বাড়ির লোকেরাও ভাবে, দুটিতে মানাবে ভালো। নীতীশ নিজের জিনিস নিজে কেনার স্বাধীনতা ভোগ করতে চায়। জুতো কেনার প্রয়োজনে দোকানে গিয়ে পছন্দ করে নিজের জন্য একজোড়া জুতো। কিন্তু দামে না মেলায় কেনা হয় না। দোকানেই হঠাৎ এক ভদ্রলোকের হাতে চোখে পড়ে একজোড়া জুতো। ছোট্ট ছোট্ট দুটি জুতো, কোমল লাল চামড়ার। দেখে তার ভারি ভালো লাগে। মনে হয় জুতোজোড়া সেই নরম কোমল পায়ের, যে পা দুখানি আদর করে স্নেহভরে বুকে নেওয়া যায়। সে চরণ পবিত্র, সুকোমল, নিষ্কলুষ।
ছোট ছেলে মেয়ে যদিও সে দুচোখে দেখতে পারে না, তবু জুতাজোড়া দেখার পর নীতীশের মধ্যে জেগে ওঠে পিতৃসত্তা। কল্পনায় যে ভাবতে থাকে, এ জুতো তার ও গৌরীর মেয়ের জন্য। যাকে গৌরী বারান্দায় বসে রূপোর ঝিনুকে দুধ খাওয়াবে। জুতাজোড়ার দাম একটাকা। বাড়িতে এসে জুতোর কথা বলে বৌদিকে। ভাতিজা টুটুলের পায়ে লাগতে পারে বলায় বৌদি পরদিন টাকা দিতে চান। কিন্তু পরক্ষণেই মন খারাপ হয়ে যায় নীতীশের, কারণ কখনোই এ জুতো সে টুটুলকে দেবে না। গৌরীকে জুতাজোড়ার কথা বলায়, সেও টিফিনের বাঁচানো পয়সা দিতে চায়। কিন্তু নীতীশ তা নেবে কেন? মন খারাপ করে চলে যায় গৌরী। এরপর ক’দিন পেরিয়ে যায় টাকা জোগাড়ে।
কমলকুমার মজুমদারের গল্পসমগ্রের ভূমিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলা কথাটি ধার করে বলা যায়, কমলকুমার মজুমদারের প্রতিটি গল্পই বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ। এই ধরনের গল্প বাংলা সাহিত্যে আগে লেখা হয়নি।
অবশেষে টাকা জোগাড় হয়, কিনে আনে জুতাজোড়া। সারাবাড়ি হাসিতে উচ্ছলিত। ছেলে না হতেই জুতা। হৈ হৈ পড়ে যায় বাড়িতে। গৌরির টাকা না নেওয়ায় সেও কদিন আসেনি এই বাড়ি। এখন হৈ-হুল্লোড়ে সেও দাঁড়ায় জানালার কাছে। যেন তাকে কেউ ডাকে। সহসা চিরপরিচিত ইশারায় এগিয়ে আসে গৌরী। নীতীশ তার হাতে তুলে দেয় জুতাজোড়া। জুতাজোড়া দেখে গৌরীর মাঝেও জেগে ওঠে বহু জনমের সঞ্চিত মাতৃস্নেহ-মাতৃত্ব। জুতাজোড়াকে চুম্বন করে সে নীতীশের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় রক্তিম হয়ে জানতে চায়, কার জন্য গো?
-তোমার পুতুলের?
-ওমা! তা হতে যাবে কেন? তুমি এনেছ নিশ্চয় তোমার ছেলের?
-আচ্ছা, বেশ দুজনের।
-হ্যাঁ। অসভ্য, বলে গ্রীবাটাকে পাশের দিকে ফিরিয়ে নিজের মধুর লজ্জাটা অনুভব করলে। লাল জুতোজোড়া তখনো তার কোলে, যেন মাতৃমূর্তি।
প্রথম গল্প থেকেই কমলকুমার মজুমদার নিজের স্বাতন্ত্র্য, নিজের স্টাইল তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। ভাষা নিয়ে তার যে নিরীক্ষা, গদ্যভঙ্গিতে যে আলাদা বাক নির্মাণের সচেতন চেষ্টা এবং সফলতা, তার প্রথম গল্পের ভেতরেই তা স্পষ্ট। সেইসঙ্গে তিনি যে গল্প বলার বিষয়ের ক্ষেত্রে অন্যদের থেকে আলাদা, তাও স্পষ্ট করে তুলেছিলেন। তবে পরবর্তী সময়ে ভাষার ক্ষেত্রে তিনি যে স্টাইল নির্মাণের দিকে ঝুঁকেছিলেন, তারও রেশ প্রথম গল্প থেকেই টের পাওয়া যায়।
একজন শিশুর ভেতরেও যে একজন বাবা, একজন মা ঘুমিয়ে রয়েছে, তারই সার্থক প্রকাশ লালজুতো। কৈশর পেরিয়ে আসা অথচ যৌবন না ছোঁয়া দুটি কিশোর-কিশোরীর রাগ-অনুরাগের ভেতর দিয়ে যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন গড়ে ওঠে, সেই দিকটি তুলে এনে কমলকুমার মজুমদার শুধু একটি গল্পই বলেননি, বরং মানবমনের বৈচিত্র্যময় রহস্যকে অনাবৃত করে দেখিয়েছেন, একটি শিশুর কল্পনার মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের সম্পর্কের সেতু গড়ে ওঠে।
কমলকুমার মজুমদারের গল্পসমগ্রের ভূমিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলা কথাটি ধার করে বলা যায়, কমলকুমার মজুমদারের প্রতিটি গল্পই বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ। এই ধরনের গল্প বাংলা সাহিত্যে আগে লেখা হয়নি।