বার্ধক্যের উপান্ত বেলায়, স্মৃতির হাতছানি,সে বড়ো মধুর হাতছানি; স্মৃতিরা বারে বারে আসে, ফিরে ফিরে কথা কয়। আর সেই স্মৃতি যদি হয় অবুঝ-আবেগঘন অপরিণত বয়সের, স্পর্ধিত যৌবনের তথা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়, তবে তা অন্তরের গভীর মণিকোঠায় বোধহয় আমৃত্যু জেগে রয়। ১৯৭৩ এর মাঝামাঝি থেকে ১৯৭৯’র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে রোকেয়া হল-এ আমার প্রায় ছ’বছরের আবাসিক জীবন, এমনি এক অন্তর-তাড়িত অনুভূতিময় স্মৃতির অনির্বচনীয় সুখকর নীরব জ্যোতির্ময় সঞ্চয়।
বৈবাহিক সূত্রে কলকাতায় এসে,কর্ম বা পেশাসূত্রে অধ্যাপনায় বৃত হয়েছিলাম আজ থেকে বেয়াল্লিশ বছর আগে। এতো বছরের ব্যবধানেও, আমাকে ভুলে না গিয়ে, বরং আন্তরিক স্নেহসিক্ত মমতায়,আমায় বারংবার স্মরণ করলেন রোকেয়া হল-এর প্রাক্তন ‘গৃহ-প্রভাষক’ সেলিনা আপা (সেলিনা চৌধুরী) এবং ফরিদা আপা (ফরিদা প্রধান), একটি নাতিদীর্ঘ স্মৃতিকথা লেখার জন্য । আমি ধন্য হলাম এক অনাস্বাদিতপূর্ব-ভালোলাগার কৃতজ্ঞতায়। এবং লজ্জিতও হচ্ছি অনিবার্য-বিলম্বের অজুহাত-বর্জিত অপরাধে।
বৃহত্তর অবিভক্ত বাংলায় নারীশিক্ষা এবং সংস্কার-সংকীর্ণতা মুক্ত প্রকৃতার্থেই নারীজাগরণের অগ্ৰদূত, আলোকশিখারূপিনী, মহীয়সী মানবী বেগম রোকেয়ার নামাঙ্কিত রোকেয়া হল-এর আবাসিক ছাত্রী পরিচয়ে আমি গর্বিত, কৃতার্থ ও ধন্য।
যতদূর মনে পড়ে, এই নারী-আবাসনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৩৮ সালে ‘চামেলি হাউস’এ, মাত্র ১২ জন ছাত্রী নিয়ে। ‘রোকেয়া হল ‘ নামকরণ করা হয় ১৯৬৪ সালে। প্রথম প্রাধ্যক্ষা (প্রভোস্ট) ছিলেন মিসেস আক্তার ইমাম (সেলিনা চৌধুরীর একটি দীর্ঘ লেখা পড়েছিলাম কোনো এক সময়ে)।
স্মৃতির সরণী ধরে, এবার নিজের কথায় ফিরে আসি। আমার আদি বাড়ি, বর্তমান মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলায়। আমার উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষাবর্ষ ১৯৭০-৭২; অনার্স এবং এম.এ.-র শিক্ষাবর্ষ যথাক্রমে ১৯৭২-৭৫ এবং ১৯৭৬। কিন্তু তখন যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন-পরিস্থিতিতে নতুন বাংলাদেশে ‘সেশন জট’ চলছিল পরীক্ষায় এবং ভর্তির ক্ষেত্রেও। তাই ১৯৭৩ সালে (সেশন ১৯৭২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তির সুবাদে, ‘রোকেয়া হল’-এ আবাসিক ছাত্রী হবার সুযোগ পেলাম ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি নাগাদ, অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে। তখন আবাসন-চাহিদার তুলনায় সীটের অপ্রতুলতার প্রতিবন্ধকতায়, প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের ক্ষেত্রে, হল-এ স্থিত কোনো আবাসিকের সাথে ‘ডাবলিং’এ (Doubling) থাকার সম্মতিসূচক চিঠি জমা দেবার শর্তে আবাসিক-স্বীকৃতি লাভের অনুমতি মিলতো।
রোকেয়া হল-এর “পুনর্মিলনোৎসব”এ আসতে বললেন ; তাঁর বাসাতেই থাকবার আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলেন সেইসঙ্গে।
গ্ৰামের সবুজ প্রকৃতির অকৃত্রিম গন্ধ গায়ে মেখে,সদ্য উঠে আসা একটি আনাড়ি মেয়ে আমি। ঢাকায় এসে প্রথম আশ্রয় (প্রায় মাস তিনেক) মিললো, আমাদের পারিবারিক-স্বজন , তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী ফণি মজুমদারের মিন্টো রোডের বাড়িতে। তাঁরই ভাইঝি, গীতালিদির সহযোগিতায়,তার বান্ধবী ও সহপাঠী, তরী আপার (তহুরা খাতুন) কাছ থেকে পেলাম ‘ডাবলিং’-এ থাকার আনুষ্ঠানিক সম্মতিপত্র। অবশেষে মেইন বিল্ডিং-এর এক নম্বর রুমে এসে তো উঠলাম, কিন্তু থাকবো কোথায়! কার সঙ্গে ! এ যে কেবলই অনাত্মীয় নীরব উপেক্ষা! রুমের তিনজনই আমার অনেক সিনিয়র; এম.এ. উত্তীর্ণা , এম.এড. শিক্ষার্থী।
বাস্তবে, প্রথমাবস্থায় কিছুদিন ঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে শোবার ঠাঁই হলো, আর লম্বা বারান্দার এক কোণে মাদুর বিছিয়ে বন্দোবস্ত হলো পড়াশুনার। বাকী দু’জন রুমমেট, সাজেদা আপা ও পারুল আপা (পরবর্তীকালে প্রখ্যাত নাট্যকার সেলিম আল দীনের স্ত্রী। বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা) আমার প্রতি সদয় হলেন—-ওদের দুজনের খাট জুড়ে দিয়ে আমাকে ওদের শয্যাসঙ্গী করে নিলেন। (পারুল আপা, আপনজনের মতো করে সর্বক্ষণ আগলে রাখতেন আমায়।বড়ো গভীর মমতায় ভালোবেসেছিলেন তিনি ; সেই আত্মিক সম্পর্ক আরো গাঢ়-গভীর রূপ নিয়েছিল এবং তাঁর প্রয়াণ অবধি তা বহমান ছিল।)। ক্রমে তরী আপার সাথেও সম্পর্ক স্বাভাবিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে; এবং ধীরে ধীরে আমার ‘হোম সিকনেস’-এর প্রাবল্য প্রশমিত হতে শুরু করে।
আবাসিক জীবনে তিনবার কক্ষ/ বিল্ডিং বদল হয়েছে আমার। অনার্সের পুরো সময়টা কেটেছে মেইন বিল্ডিং-এর এক নম্বর এবং বর্ধিত ভবনের ৬৩ নম্বর রুমে। ‘অনার্স বিল্ডিং’এ থাকার সুযোগ আমার হয়নি বটে, তবে ‘রোকেয়া হল’-জীবনের বেশির ভাগ সময় ‘অভিজাত’ মেইন বিল্ডিং-এ থাকতে পারাটাও কম সৌভাগ্যের কথা নয়। বর্ধিত ভবনে এসে রুমমেট হিসেবে পেলাম নূরজাহান, আশালতা ও রীণাকে ; পরে সাবিনাকে (ক্যান্সারের থাবায় অকালে প্রয়াত হয়েছে ও)। পাশের রুমে, ইরা ও গীতশ্রী ছিল। নূরজাহানের সঙ্গে স্নেহপূর্ণ আন্তরিক মননশীল বন্ধুত্ব এখনো বহমান; সংযোগ রয়েছে বাসন্তীর সঙ্গেও। আমার দুর্দিনের বান্ধব হয়ে উঠেছিল পঞ্চাশ নম্বর রুমের রেণুদি তো বটেই, এছাড়াও জাহানারা আপা এবং ফরিদা আপাও (ওরা দুজনেই আর বেঁচে নেই)।
এরপর মেইন বিল্ডিং-এর ১৪নম্বর রুমে এসে দীপ্তিদি ও মিষ্টিদিকে পেলাম—ওদের দুজনের সাথেই দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কে স্থিত হলেও, দীপ্তিদি কর্মরত অবস্থায় চলে গেলেন অকালে। জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় মনে পড়ে কতো বন্ধুর মুখ : রেখা গুহ,রেখা গুণ, শিশু আপা, ঝর্ণা, শ্যামলী,তাপসী, জুবিলী, কমলা, শেলী, শেফালী আপা,কানিজ…নাম ভুলে যাওয়া আরো অনেকের স্মৃতি ভেসে ওঠে ; ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়, “স্মরণের তীরে তির্যক হয়ে ক্লান্ত নয়নে কাপে…।”
প্রসঙ্গ বদলাই। কী যে বোকা ছিলাম তখন! অপরিণত বয়সের অপরিপক্ক বুদ্ধিতে, সঠিক খবর না জেনে-বুঝেই, কারো মুখের কথা বিশ্বাস করে, কাল্পনিক অলীক-নির্যাতিতার পাশে দাঁড়াতে গিয়ে জবরদস্ত্ ধাক্কা খেয়েছিলাম একবার—- যার সুদূরপ্রসারী প্রভাবে ও পরিণামে আমার মা’কে রোগশয্যা পর্যন্ত নিতে হয়েছিল।
এক অবিস্মরণীয় ঘটনায়, বোকামির আর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ মনে পড়ছে। চিরাচরিত অভ্যেস আমার, লিখতে-পড়তে বসলে বাকি সবকিছু ভুলে যাওয়া। বিশেষত,তাত্ত্বিক কিংবা তথ্যসংযোগে মস্তিষ্কচর্চিত কিছু লিখতে বসলে, বিস্মৃত হতাম চারপাশের যাবতীয় ঘটনা ও প্রতিবেশ। একবার অনুশীলনী (Tutorial) পরীক্ষায় নীলিমা আপার সঙ্গে (ড.নীলিমা ইব্রাহিম) স্নেহপূর্ণ বাজি ধরে ‘পুনশ্চ’ কাব্যের Textনির্ভর নোট লিখছিলাম অনেক রাত অবধি জেগে, নিরিবিলি সময় নিয়ে। ঐ রাত্রে, সেই সময়েই, বর্ধিত ভবনের দুটি মেয়ের প্রতিহিংসামূলক অনুল্লেখিত মারাত্মক আচরণ চরম পর্যায়ে পৌঁছোলে, গোটা ‘হল ‘ জুড়ে তুমুল হইচই-চীৎকার-চেঁচামিচি শুরু হয়— যার সমাধানে অতো রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নাকি সদলবলে ছুটে আসতে হয়েছিল। আমি এসবের বিন্দুবিসর্গও জানতে পারিনি; কারণ আমি তখন ‘পুনশ্চ’ কাব্যের মধ্যে শুধু আকণ্ঠ ডুবে নয়, একেবারে অবগাহনে নিমজ্জিত হয়ে আছি। একসময় আমার লেখা শেষ হলো (ততক্ষণে অবশ্য গণ্ডগোলও থেমে গেছে)। অতএব, অতো রাতে রুমমেটরা হাট করে দরজা খুলে রেখেছে দেখে, ওদের আচরণে আমিও কিঞ্চিৎ বিস্মিত এবং বিরক্তও। আমার কথা শুনে ওরা ততোধিক বিস্মিত, আমার মস্তিষ্ক বিকৃত বা অসুস্থ ভেবে। এবং স্থূলার্থে আমাকে ‘বদ্ধউন্মাদ’ খেতাবসহ,এক বালতি জল আমার মাথায় ঢালার হুকুমও দিয়ে দিল তারা। তবে নীলিমা আপা ঐ পরীক্ষায় আশাতীত ভালো নম্বর দিয়েছিলেন,পরম বিস্ময়ে ।
প্রাসঙ্গিক আর একটি ছোট্ট বোকামির কথা বলে, বোকামির পর্ব শেষ করছি।
তখন সবে অনার্সে ভর্তি হয়ে, রোকেয়া হল-এ ঢুকেছি। লাইব্রেরিতে যেতে পারছি না, আমার মন ছটফট করছে অগণিত গ্ৰন্থরাশির দরজায় পৌঁছে যেতে। কিন্তু লাইব্রেরী-কার্ড এখনও হাতে পাইনি, প্রভোস্টের স্বাক্ষর হয়নি বলে।হল-এর অফিসে গিয়ে সে’কথা বলতেই, একজন স্টাফ কৌতুক করে বললেন : ‘যান না, পাশেই তো প্রভোস্ট আপার কোয়ার্টার, সই করিয়ে নিয়ে আসুন।’ আমি ওদের কৌতুকের অর্থ না বুঝেই, ভর দুপুরে বোকার মতো আপার কোয়ার্টারে গিয়ে হাজির হলাম, কার্ডে সই করাবার জন্য। আপা তখন সম্ভবত দুপুরের আহারান্ত-বিশ্রাম থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে এলেন। সম্মুখে আমাকে দেখে এবং আমার আবেদন শুনে ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন: “অফিসের কাজ বাসায় কেন , আর কেনই বা তুমি নিজে এসেছো?” ধমকটা এমন জোরে দিলেন যে, আমার বোকামিটা এবার বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারলাম। আসলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে, ‘রোকেয়া হল’-জীবনে, আমার সর্বাধিক আনন্দিত সময়-যাপন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারসহ, বিভিন্ন গ্ৰন্থাগারকে ঘিরে ( বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরী, পাবলিক লাইব্রেরী, বাংলা একাডেমীর গ্ৰন্থাগার, ভারতীয় তথ্যকেন্দ্র ইত্যাদি)।এরজন্যেও সামাজিকভাবে কিঞ্চিৎ মূল্য দিতে হয়েছিল আমাকে।
রোকেয়া হল -এ , আবাসিক ছাত্রী হিসেবে ঢুকে প্রথমেই প্রাধ্যক্ষা (প্রভোস্ট) রূপে পেয়েছিলাম ড.নীলিমা ইব্রাহিমকে (তিনি তখন বাংলা বিভাগেরও বিভাগীয় প্রধান এবং বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক)। শেষের দিকে পেয়েছিলাম এক ভীষণ মমতাময়ী মানবীকে ; তিনি ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. রাজিয়া খান আমিন।
আমার সময়ে, গৃহ-প্রভাষকরা ছিলেন : মাকসুদা আপা, রওশন আপা,সাহেরা আপা, ফরিদা আপা, সেলিনা আপা, সালমা আপা, মরিয়ম আপা প্রমুখ। তবে ফরিদা আপা’র স্নিগ্ধ মমতাময়ী রূপ এখনও মনে দাগ কেটে আছে। কতো না মিষ্টি করে, আমার দু’একটি গ্ৰাম্য অভ্যাসকে, পরিবর্তিত নাগরিক জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিখিয়েছিলেন তিনি। সেলিনা আপার অবদানও অন্তরে গেঁথে আছে। একবার আমাদের বাড়িতে ভয়ানক ডাকাতি হওয়ার প্রেক্ষিতে, আমার সাময়িক আর্থিক দুরবস্থার কথা তাঁকে জানাতেই, তিনি ফরিদা আপা’র সঙ্গে পরামর্শ করে, আমার ঐ সময়ের একমাসের ‘ফুড চার্জ ‘ মওকুফ করে দিলেন। দুর্দিনের এ’সব উপকার কী ভোলা যায়!
২০১৮সালের ১৬ই ডিসেম্বর, কলকাতার ‘বাংলাদেশ উপদূতাবাস’এর অনুষ্ঠানে দেখা হয়ে গেল রওশন আপা’র সাথে।সে কী ভীষণ খুশির মুহূর্ত আমাদের! রোকেয়া হল-এর “পুনর্মিলনোৎসব”এ আসতে বললেন ; তাঁর বাসাতেই থাকবার আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলেন সেইসঙ্গে।
স্বদেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা, রোকেয়া হল-এর প্রাক্তন ও বর্তমান অগণিত আবাসিকবৃন্দ ; সবাই ভালো থাকুন স্ব স্ব জীবন-চর্যা নিয়ে।
আমাদের সময়ে , রোকেয়া হল-এর মাসিক ‘ফুড চার্জ’ ছিল ৫৫/৫৬ টাকা।এই টাকাতেই মিলতো সকালের হালকা টিফিন সহ দুপুরের ও রাতের পর্যাপ্ত আহার। এছাড়া প্রতিমাসে দু’বার করে ‘ফিস্টের’ ব্যবস্থা ছিল—১৫তারিখে ‘সেমি ফিস্ট’ আর মাসের শেষদিন ‘ফুল ফিস্ট’— ‘ফুল ফিস্টের’ আইটেম তো, বিয়েবাড়ির ভোজকেও যেন হার মানায়। পরে যখন ক্যাফেটারিয়া সিস্টেম চালু হয়, তখন প্রতি মিল-চার্জ ধার্য করা হয়েছিল দু’টাকা করে, নগদে।
যে ইলিশ মাছ এখন দুর্মূল্য খাদ্যবস্তু, সেইসময়ে একঘেয়ে-বিরক্তিকর ইলিশমাছ দেয়া বন্ধ করার দাবিতে,ডাইনিং হল-এর দেয়ালে পোস্টার পর্যন্ত সাঁটিয়েছিল ছাত্রীরা।
ভাবা যায় !
হল-এর সীট ভাড়া ছিল তিন টাকা।কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয় আজ!
অবিস্মরণীয় মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতে দেখেছি ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট। (আমি তখন বর্ধিত ভবনের ৬৩ নম্বর রুমের বাসিন্দা।) নতুন বাংলাদেশের প্রথম ‘চ্যাঞ্চেলর’ , রাষ্ট্রপতি ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানের শুভ পদার্পণ ঘটবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা শ্রেণিবদ্ধভাবে ভলাণ্টিয়াররা , প্রস্তুত হচ্ছিলাম তাঁকে ‘গার্ড অফ অনার’ জানাতে। কিন্তু ভোর হতে না হতেই, রেডিও’তে মুহুর্মুহু দুঃসংবাদ বুলেটিন…। এর পরের খবর-ঘটনা সবাই জানেন। বিষয়টি বিস্তৃত আলোচনা সাপেক্ষে…। অতএব থাক।
০২.
শুনতে পাই, রোকেয়া হল-এর
প্রবেশ-দ্বার সহ, হল-অভ্যন্তর এখন নব কলেবরে, মনোরম অঙ্গসজ্জায় সেজে উঠেছে। চারটি ভবনের নামকরণ হয়েছে—-‘শাপলা ভবন’ , ‘চামেলি ভবন’ , ‘অপরাজিতা ভবন’ এবং ‘৭মার্চ ভবন’ ; আর মেইন বিল্ডিং-এর নামকরণ হয়েছে ‘ফয়জুন্নেছা ভবন’ । মোট কক্ষ সংখ্যা -৫২০ ; আবাসিক ছাত্রী সংখ্যা -কম/বেশি ২৭০০ । সংযুক্ত ছাত্রীসংখ্যা -আনুমানিক ৭০০০ । আর অফিস ঘর পেরিয়ে উন্মুক্ত চত্বরে স্থাপিত হয়েছে মহীয়সী বেগম রোকেয়ার সুউচ্চ পূর্ণাবয়ব মূর্তি।
তবু মন ঘুরে ফিরে দেখতে পায় , মধ্যাড়ম্বরে সজ্জিত অডিটোরিয়াম ঘরে ‘Rag day’-র ভীষণ মনোগ্ৰাহী-আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান ; পরীক্ষার আগের রাতে মস্তিষ্কের বিশ্রাম প্রয়াসে টিভি দেখার খেয়াল ; মন খারাপ হলে, রাতের আবছা-অন্ধকারে শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে বসে নিজের সঙ্গে কথা বলা ; ২১শে ফেব্রুয়ারি ভোরের আলো ফোটার আগেই, রোকেয়া আপা’র(ভি.পি.) হাঁকডাক পদব্রজে নগ্নপায়ে মিছিলে যাবার—- এমনি কতো স্মৃতি ভীড় করে আসে মনে:
“কত কথা পুষ্পপ্রায় বিকশি তুলিতে চায়/কত অনুরাগে …।”
এমনি কতো অম্ল-মধুতে মাখা,হরষে- বিষাদে মেশা, স্মৃতির সাঁকো বেয়ে ‘অন্তবিহীন পথ ‘পেরিয়ে , সুদীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর, কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ‘বিদ্যাসাগর মহিলা কলেজে’ অধ্যাপনা শেষে, আজ আমিও জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে দাঁড়িয়েছি আধি ও ব্যাধিকে সঙ্গী করে। অনুষঙ্গ রূপে রয়েছে , শিকড়ের ঋণে আকণ্ঠ ডুবে থাকার প্রতীকী অবলম্বন— বাংলাদেশের মননশীল ও ও গবেষণাধর্মী সাহিত্য চর্চায় নিরন্তর- নিরলস মনোনিবেশ প্রয়াস ; (পিএইচ.ডি. , ডি.লিট.সহ)।
বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগতিতে, Facebook-এর সহায়তায়, সহপাঠী- সহযোদ্ধা, শিক্ষক-শিক্ষিকা সহ অনেকের সাথেই যোগাযোগের, যান্ত্রিকভাবে ফিরে দেখার সুযোগ ঘটেছে।
স্বদেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা, রোকেয়া হল-এর প্রাক্তন ও বর্তমান অগণিত আবাসিকবৃন্দ ; সবাই ভালো থাকুন স্ব স্ব জীবন-চর্যা নিয়ে।
ঐতিহ্যবাহী ‘রোকেয়া হল’ গর্বে- গৌরবে ও মহিমায় সমুন্নত থাক্ , চিরদিন-চিরকাল নারী জাগরণের দিশারী হয়ে।