কথিত আছে—বাঙালি মাত্রই স্বভাবকবি। আর যাদের কবিতা কোথাও না কোথাও-কোনো না কোনোভাবে প্রকাশিত হয়, তারা স্বীকৃত কবি। আবার যারা নতুনদের কবি বলে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন, তারা তথাকথিত ‘বড়’ কবি। তবে কবিতার আবেগ, আদর্শ ও সাহসকে ব্যক্তিজীবনে ধারণ করেন এমন কবি ওই একজন ছাড়া এই সময়ে আর কাউকে দেখিনি। হয়তো আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নেই—এমন আরও অনেকে থাকতে পারেন। তবে প্রবীণদের মধ্যে যাদের চিনি ও জানি, তাদের মধ্যে এই ব্যক্তি অনন্য। চেহারাও দেখতে বুড়ো বাঘের মতো—অহঙ্কার ও আভিজাত্যের মিশেলে অভিব্যক্তিগুলো ব্যতিক্রম। চোখদুটি জ্বলজ্বল করতো। হাসতে শুরু করলে আশেপাশের বাতাস পর্যন্ত কাঁপতে শুরু করতো। তার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না। যা বলতেন, সোজাসাপ্টা। যা করতেন ধুমধাড়াক্কা। ঢেউ ঢেউ কাব্যের টলটলে স্রোতের মতোই একটা জীবনকে ‘যাপন’ করেছেন তিনি। বাংলা কাব্যের এই মহানায়কের নাম রফিক আজাদ।
পানশালার মহাকাব্যিক সন্ধ্যাগুলোয় যতবার তার পা ছুঁয়ে ধন্য হতে গেছি, ততবারই বুকে টেনে নিয়েছেন তিনি। তারপর মাথায় হাত রেখে অনেকবার বলেছেন—‘কাউকে গুরু মানবি না। গুরু মেনে কবিতা লেখা যায় না। মন যা চায়, লিখে ফেল। অত বাছ-বিচার করবি না। কোনটা কবিতা হচ্ছে আর কোনটা হচ্ছে না, সেটা ঠিক করার তুই কেউ না। কে তোকে কবি বলে স্বীকৃতি দিলো আর কে দিলো না, তা নিয়ে মাথা ঘামাবি না। সময় ঠিক করে দেবে সবকিছু। কবিদের অত সংশয়ী হওয়া চলে না। কখনো সাহস হারাবি না। সততার চেয়ে বড় শক্তি আর কিছু নাই। নিজের কাছে সবসময় সৎ থাকবি।’ মুগ্ধ হয়ে কথাগুলো শুনেছি।
প্রতিমাসেই কয়েকবার দেখা হতো আমাদের। বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ জমিয়ে শেষে এসে একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতাম আমরা। তাকে প্রসঙ্গ তুলে দিয়ে নীরব থাকতাম আমি। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যেতেন তিনি। বলার ভঙ্গিটাও ছিল মোহনীয়। হৃদয় নিঙ্ড়ে কথা বলতেন কবি। রফিক আজাদ এখানেই অন্যদের থেকে আলাদা ও অনন্য।
ইতোমধ্যে আমার কবিতার বই বের হলো একদিন। একটা কপি নিয়ে গেলাম পরীবাগের গলিতে, কবির আড্ডাখানা শাকুরায়। কবি রফিক আজাদের প্রিয় পানশালা এটি। পেয়ালায় পেয়ালায় টুং টাং শব্দ, মৃদু হৈহুল্লোড় আর আধো-আধারের শীতাতপ সন্ধ্যাগুলোর কোনো এক সময়ে আমাদের পরিচয় এবং ক্রমেই বেড়ে উঠেছে সে সম্পর্ক। এমনই আরেকটি সন্ধ্যায় আমার দ্বিতীয় কবিতার বইটি হাতে নিয়ে দেখলেন তিনি। আলোস্বল্পতার কারণে বইয়ের নাম পড়তে পারছিলেন না কবি। জানতে চাইলেন—’নাম কী?’ বইয়ের নাম শোনার পর আবারও শুনতে চাইলেন নামটি। দ্বিতীয়বার বলার পর নিজেও একবার বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন বইয়ের নামটি।
তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। সেই ট্রেডমার্ক হাসি—ওহ হো হো হা হা হ। কবি হাসতে শুরু করলে পুরো পানশালা কাপতে শুরু করে। হাসি থামালেন তিনি। ‘নামটা সুন্দর’—ধীরস্বরে বললেন কবি। তারপর বইটি নেড়েচেড়ে দেখার চেষ্টা করলেন। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে তাকে সাহায্য করলাম আমি। লেখক পরিচিতির দিকে চোখ বোলানো শেষে প্রথম ফ্ল্যাপটা মন দিয়ে পড়লেন। তারপর সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন—’ফ্ল্যাপটা কে লিখেছে?’ বললাম—’আমি।’ শুনে আবারও হো হো হেসে উঠলেন তিনি। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন—’সাহস আছে তোর। শোন আর একটা কথা বলি, এটা মনে রাখবি। কখনো কারও কাছে ফ্ল্যাপ লিখিয়ে নিতে যাবি না। নিজের কবিতা, নিজের বই, নিজের চেয়ে ভালো আর কেউ কিছু জানে না। হয় নিজেই লিখবি, নাহয় লেখারই দরকার নাই। কিন্তু একটা ফ্ল্যাপ লেখানোর জন্য কখনো কারও পেছনে ঘুরবি না। নিজেকে অবমূল্যায়ন করে কেউ কবি হতে পারে না। এটা শুধু কবিতার ক্ষেত্রে না, জীবনের সব ক্ষেত্রেই নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলা উচিত। আত্মসম্মানবোধ নষ্ট করে জীবনে সফল হওয়ার কোনো দরকার নাই। ওই সাফল্যে তৃপ্তি পাবি না। ’
বইমেলা, বই প্রকাশ, নতুন কবি ও কবিতা সম্পর্কে কথা বলতে বলতে মিলন ভাই হঠাৎ একদিন ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতার কথা পাড়লেন সেখানে। এটা অন্যদিন। রফিক ভাইকে বই উপহার দেওয়ার কয়েকদিন পরের ঘটনা। মিলন পাঠান নিজেও কবি। তবে গোপন কবি। চুপচাপ কবিতা লেখেন, প্রকাশ করতে চান না। এই লোকের মাধ্যমেই রফিক ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল একদা। হ্ঠাৎ মিলন ভাই জিজ্ঞেস করলেন—’কবিতাটা কি বঙ্গবন্ধুকে ইঙ্গিত করে লেখা?’ শুনেই অট্টহাসিতে কাঁপতে শুরু করলেন কবি। শরীর কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে সেই ট্রেডমার্ক হাসি—হো হো হো হো। হাসি থামিয়ে তিনি বললেন, ‘‘দূর থেকে তাই মনে হয়। অনেকের ধারণাও তাই। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে ঠিক তেমনটা না। আমি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা। কাদেরিয়া বাহিনীর অনেক অভিযানে ছিলাম আমি। বঙ্গবন্ধুকে আমাদের চেয়ে কেউ বেশি ভালোবাসে না। তার ডাক শুনেই টানা নয় মাস রণাঙ্গনে কাটায়া দিছি। কবিতার ওই ‘হারামজাদাটা’ আসলে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে থাকা তেলচাটার দল। বঙ্গবন্ধু তো সব কাজ নিজের হাতে করতো না। যাদের ওপর কাজের দায়িত্বগুলা ছিল তারাই বঙ্গবন্ধুকে ডুবাইছে। অন্যদেরও তারা বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছাতে পর্যন্ত দিতো না। দেশের মানুষ যখন না খেয়ে মরতেছে তখন ওরা ওদিকে দুর্নীতি-মহাজনী করে লুটপাটে ব্যস্ত। বঙ্গবন্ধু সহজ সরল মানুষ ছিলেন। নিজের ভাগের কম্বলটাও পাননি তিনি। সেটা নিয়া প্রকাশ্যে দুঃখও করছিলেন। কবিতাটা প্রকাশ হওয়ার পর এরা আমাকে ধরে নিয়ে গেছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে। তাকে উল্টাপাল্টা বুঝায়া আমাকে শাস্তি দেওয়াটাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু কবিতাটা পড়ার পর বঙ্গবন্ধু পকেট থেকে দুইশ টাকা বের করে আমার হাতে গুঁজে দিলো। তারপর বললো—যা, মন দিয়ে কবিতা লেখো। আমি যখন বের হয়ে আসতেছিলাম, তখন আবার পেছন থেকে ডাক দিলেন আমাকে। শীতের কাপড় ছিলো না। ঠাণ্ডাও পড়ছিলো ভালো। পৌষ অথবা মাঘ মাস ছিল তখন। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, তোর শীতের কাপড় কই? বললাম, একটা চাদর আছে। বঙ্গবন্ধু তখন একটা কম্বল দিলেন আমাকে। আমি কম্বলটা নিয়া বীরদর্পে বের হয়ে গেলাম। হোহ হোহ হো হো…।’’ আবারও সেই পানশালা কাপানো হাসি।
তারপর অবশ্য বিষয়টা আরও পরিষ্কার করে বললেন রফিক ভাই। তিনি বললেন, কবিতাটা মূলত বিশ্বের নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষদের উদ্দেশে লেখা। কবি সারা দুনিয়া ও সব মানুষকে নিয়েই লেখে। কারণ কবির কোনো দেশ নেই। ধীরস্বরে কথাগুলো শেষ করে কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। তারপর বললেন, ‘এটাই বঙ্গবন্ধু। বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু তোষামোদকারীরা ঘিরে ফেলছিল তাকে। লোকটা আর বাঁচতেই পারলেন না! তিনি থাকলে বাংলাদেশের আজ এই অবস্থা হতো না। এদেশের রাজনীতি নষ্ট হয়ে গেছে।’
এরপর শূন্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি এখনো সেই কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমাই। প্রতি শীতেই একবার বের করি। শীত শেষে আবার ট্রাংকে ঢুকায়া রাখি।’ ধীরে ধীরে কবির চোখে-মুখে রাগের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠল। চিৎকার করে বলতে শুরু করলেন—’যতদিন এই দেশ তেলবাজদের কবল থেকে বের হতে পারবে না, ততদিন এ জাতির কোনো উন্নতি হবে না। রাজনীতি থেকে শিল্প-সাহিত্য-কবিতা—সবখানেই মেরুদণ্ডহীন আর তোষামোদকারীদের জয়জয়কার।’ উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। সেদিন আলোচনা আর বেশি দূর এগুলো না।
শেষের দিনগুলোতে হয়তো খুব বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। একদিন খেয়াল করে দেখলাম সামনের বোতলটার অর্ধেক ভরা। একটা গ্লাস আছে সামনে, তবে সেটা খালি। জানতে চাইলাম—‘রফিক ভাই, আজ এখনো শুরু করেননি নাকি?’ সরাসরি উত্তর দিলেন—’বাদ দিয়া দিসি।’ যতটা না অবাক আমি তারচেয়ে বেশি মনে হচ্ছিল ভুল শুনেছি। বোতলের দিকে ইশারা করে বললাম, ‘তাইলে এটা কী?’ কবি বললেন, ‘পানি, সলিড মিনারেল ওয়াটার। খেয়ে দেখ।’ আমাকে চুপ থাকতে দেখে কবি নিজেই বললেন, ‘ডাক্তার মানা করে দিছে। আমি খুব অসুস্থ। লিভারে সমস্যা। এতদিন আসিনি এজন্য।’ কিছুটা অভিমানের স্বরেই বললাম, ‘সুস্থ্ না হয়ে আবার এখানে আসাটা উচিত হয়নি আপনার।’
কবির চোখের উজ্জ্বলতা নেই আর। বার্ধক্য জয় করা সেই অমিত তেজও নেই কণ্ঠে। কিছুটা মলিন মনে হলো। সচরাচর তাকে কখনো এরকম দেখা যায় না। খুবই শান্ত মনে হলো সারা জীবন আপস না করা এই অদম্য মুক্তিসেনাকে। ম্লান চোখে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে তিনি বললেন, ‘সময় কাটানোর জন্য আসি শুধু। এখন তাই করি। মিনারেল ওয়াটার খাই। বসে থাকি। তারপর চলে যাই। এখানকার কোলাহলটা ভালো লাগে আমার। সন্ধ্যা হলেই মন টানে। বাসায় ভালো লাগে না। চল্লিশ বছরের পুরাতন জায়গা এটা। এখানের হৈহুল্লোড় শুনলেও ভালো লাগে।’
এরপরই সচিবদের ওপর একচোট নিলেন কবি। শিক্ষক না সচিব—কার মর্যাদা বেশি হবে, তা নিয়ে দেশজুড়ে দুই পক্ষের কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে তখন। কবি সরাসরি বললেন, ‘এই তুলনাটাই ঠিক হয় নাই। সচিবরা পরিশ্রম করে অনেক, সেটা ঠিক আছে। তবে তাদের সুবিধাও আছে। ক্ষমতাও আছে। ক্ষমতার অপব্যবহারও আছে প্রচুর। আর শিক্ষকদের মর্যাদা ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই। শিক্ষকদের সম্মান সর্বোচ্চ হওয়া উচিত। বেতনও বেশি হওয়া উচিত। শিক্ষদের সম্মান দিতে না পারলে কোনোদিন জাতির কপালে ভালো কিছু জুটবে না।
দেশ ও জাতি নিয়ে তার স্বপ্ন ও সংশয়—দুটোই ছিল। পেট্রোল বোমায় মানুষ ঝলসানোর একটা সময় গেছে। কবির মৃত্যুর বছরখানেক আগেই মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছিলো দেশে। এই প্রসঙ্গটা উঠলেই প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়তেন তিনি। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বন্ধ করতে না পারলে বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করতেন কবি। ধর্মকে যারা রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে তাদের ব্যাপারে ‘জারজ’ ছাড়া আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করেননি তিনি। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কার্যকর হওয়ায় বারবার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেন কিন্তু এ দেশের রাজনীতিতে দেশাদ্রোহীদের উত্থানের কারণ হিসেবে ধান্দাবাজ আর আদর্শহীনতার রাজনীতিকে বারবার দায়ী করতেন তিনি। চির উন্নত মম শির বলতে যা বোঝায়, রফিক আজাদ ঠিক তাই ছিলেন। তিনি এভাবে বলতে পারার অধিকার অধিকার রাখেন বলেই আমি মনে করি।
এর মধ্যেই বিদেশ থেকে ঘুরে এলেন কবি। পানশালায় কবির জন্য বরাদ্দ চেয়ারটি অনেকদিন থেকে খালি—কেউ বসে না সেখানে। কবির সার্বিক অবস্থা নিয়ে ফিসফাস শুরু হতো ভেজা সন্ধ্যাগুলোয়। তেমনই এক সন্ধ্যায় জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছেন কবি। নাগরিক ব্যস্ততায় যাব যাব করেও কয়েকদিনেও যেতে পারিনি। হঠাৎ করেই একদিন নিভৃতচারী কবি সৈকত হাবিব ও বন্ধুপ্রতীম রিঙকু অনিমিখের সঙ্গে বরেন্দ্রভূমির কবিতা উৎসব থেকে ফিরে এসে শুনি—স্বাভাবিকভাবে সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন কবি। সন্ধ্যায় সৈকত ভাই দেখে এলেন তাকে। পরদিন রাতে আবারও সবাই গেলাম। দেখা আর হলো না। তার পরেরদিন আবার গেলাম। মৃত্যু নিয়ে কানাঘুষা শুনলাম। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে যাওয়া বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কবি নেই-মোটামোটি নিশ্চিত হলাম সবাই।
কী এক অদ্ভূত অনুভূতিহীনতায় আচ্ছন্ন হয়ে হানপাতাল থেকে বের হলাম আমরা। কিছু জটিল প্রক্রিয়া শেষে মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলো পরের দিন। বাংলা কাব্যের মহানায়কের মহাকাব্যিক প্রস্থানে পানশালার কোলাহল পর্যন্ত নীরব হয়ে গেল সেদিন।