বালক ভুল করে নেমেছে
ভুল জলে
বালক পড়েছে ভুল বই
পড়েনি ব্যাকরণ, পড়েনি মূল বই
—রফিক আজাদ
ভুল জলে নেমে পড়া ভুল বালকের জন্য কি এক মর্মছেঁড়া হাহাকার নেমে আসে বুক জুড়ে! ব্যাকরণ পড়াই হলো না, মূল বইও। তবু ভুল বই ধরে ধরেই চলে গেল এতটা কাল! চলে গেল! চলে গেলেন কবিতায় জীবন পার করা নির্ভুল বালক রফিক আজাদ! বসন্তে এসেছিলেন তিনি, চলেও গেলেন বসন্তে।
বসন্তছোঁয়া জন্মের জন্যই বুঝি তাঁর কবিতা এত বসন্ত-মাখা! ভালোবাসা তাঁর কাছে এমনই এক সঞ্জীবনী—যা পেলে তিনি শুধরে নিতে চান ‘জীবনের ভুলগুলি’। কিন্তু জীবনের ‘ভুল বইগুলো’ই তো তাঁকে রফিক আজাদ করেছে। ‘ভুল বই’ থেকে পাঠ নিয়ে নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে যাওয়া কথার পরেও মুখোমুখি বসে থাকা।’ প্রেম নিয়ে এ রকম উপলব্ধি তুলনারহিত। এই উপলব্ধি এতটাই চেতনপ্রবাহী, এতটাই প্রভাবসঞ্চারী যে, কবিতার লাইন থেকে মানুষের মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে আজ প্রায় প্রবাদের মর্যাদা পেয়েছে। কবি কতটা বিস্তারী হলে এ রকম হতে পারেন, এর উজ্জ্বল উদাহরণ কবি রফিক আজাদ।
তিনিই প্রথম ‘অপেক্ষা’ এবং ‘প্রতীক্ষা’ শব্দ দুটোকে আভিধানিক অর্থ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। পার্থক্য গড়িয়ে দিয়েছেন। দেখিয়েছেন শব্দ দুটি কিভাবে আভিধানিকতা থেকে পৃথক হয়ে ভিন্নতর দ্যোতনা নিয়ে হাজির হয় । রফিক আজাদের হাত দিয়েই রচিত হলো ‘অপেক্ষা’ আর ‘প্রতীক্ষা’র ভিন্নার্থিকতা।
কবি রফিক আজাদের জন্ম টাঙ্গাইলে। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘অসম্ভবের পায়ে’। এরপর একে-একে প্রকাশিত হয়েছে ‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’, ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’, ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’, ‘বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে’, ‘বিরিশিরি পর্ব’, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ‘কবিতা সমগ্র’, ‘হৃদয়ের কী বা দোষ’, ‘কোনো খেদ নেই’ ইত্যাদি। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার ১৯৮১, লেখক শিবির পুরস্কার-১৯৭৭, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার-১৯৮১, কবিতালাপ পুরস্কার-১৯৭৯, কবি আহসাব হাবীব পুরস্কার-১৯৯১, কবি হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কার-১৯৯৬, একুশে পদক-২০১৩।
তিনি শুধু ভালোবাসার কথাই বলেন না। সম্মুখযোদ্ধা এই কবি ঠিকই উপলব্ধি করেন ‘দেয়ালে দেয়ালে অনীবার্য অন্ধকার,’। সেই অন্ধকারের স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে দেখেন বিভৎস্য সত্যের আচ্ছাদন। মানুষের মৌলিক উপলব্ধির গভীর জগতে তিনি চলে যান। পাঠ করেন নির্মল সত্য। এই সত্য তাঁকে বলতে বাধ্য করে ‘ভাত দে হারাম জাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’। এরকম আগ্রাসী মনোভাবের মাধ্যমেই তিনি ইঙ্গিত করেন মানুষের পৃকৃত মৌলিক স্বাধীনতার কথা। ভৌগলিক স্বাধীনতাই একমাত্র মুক্তির মাধ্যম নয়। অর্থনৈতিক মুক্তি এখানে এক গুরুত্বপুর্ণ অনুষঙ্গ।
শেষাবধি মানুষেরা হিংসা দ্বেষ ভুলে পরস্পর সৎ প্রতিবেশী হবে
তাঁর আরেক কালজয়ী কবিতা ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’। পনেরোই আগস্টের মর্মন্তুদ ঘটনা তাঁকে খুব তাড়িয়ে ফিরছিল। তিনি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না একটুও। তখন রাজধানী থেকে বের হয়ে তিনি চলে যান চুনিয়া গ্রামে। তারপর লেখেন—‘চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনে প্রাণে/ নিশিদিন আশার পিদিম জ্বেলে রাথে/ চুনিয়া বিশ্বাস করে/ শেষাবধি মানুষেরা হিংসা দ্বেষ ভুলে/ পরস্পর সৎ প্রতিবেশী হবে।’ কতদিন আগে লেখা কিন্তু আজও কী সম-সাময়িক! একেই বোধহয় বলা হয় কবির তৃতীয় নয়ন। যে নয়ন দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন দূর ভবিষ্যতের সমূহ অসম্পুর্ণতা। তাই আশার কথা শোনাতেও তিনি ভুলে যাননি। একজন প্রকৃত কবির কাজ শুধু অন্ধকারের রপ বর্ণনা করাই নয়, অন্ধকারের আচ্ছাদন আবিষ্কার করে আলোর কথা বলা, আশার কথা শোনানোও তাঁর পবিত্র কাজ। রফিক আজাদ সেই কাজটিই করেছেন আজীবন। এক জীবন তিনি ব্যয় করলেন শুধু কবিতার জন্যই। তাঁর প্রত্যাশার বাস্তব রূপ আজ বড় বেশি প্রয়োজন। আজকের এই বিভক্ত সমাজ একতায় আশাবাদী হতে চায়।
স্বাধীনতার পরও আমাদের দেশকে অতিক্রম করতে হয়েছে অনেক ক্রান্তিকাল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর যখন ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি উচ্চারণেও এক রকম নিষেধাজ্ঞা ছিল, সে-সময় তিনি লিখলেন, ‘এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে/ সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে/ বত্রিশ নম্বর থেকে/ সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে।’
এরকম সাহসী ছিলেন তিনি। এই সাহসী মানুষটি ধীরে ধীরে এগুতে থাকলেন গভীর থেকে গভীরতর নিদ্রার দিকে। এতটাই গভীরতর সে-নিদ্রা যে সেখান থেকে ফিরলেন না। চলে গেলেন। চলেই গেলেন!
কী ভাষা থাকতে পারে আমাদের তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর!