বাংলা গানের জগতে ‘রজনীকান্তের গান’ সমহিমায় উজ্জ্বল। কবি রজনীকান্ত সেন (জন্ম, ২৬ জুলাই, ১৮৬৫; মৃত্যু ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১০)। তাঁর বিশেষ পরিচয় তিনি কবি, সঙ্গীতকার, সুরকার ও গায়ক। পঞ্চকবির অন্যতম তিনি। পঞ্চকবির বাকি চার কবি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুল প্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তাঁর লেখা ও গাওয়া গানগুলোর মধ্যে সাধনতত্ত্ব, দেশাত্ববোধক ও হাস্যরসাত্মক অনুষঙ্গ বিশেষভাবে বর্তমান। তিনি কান্ত কবি হিসেবে পরিচিত।
রজনীকান্ত সেন ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই বুধবার তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার পাবনা জেলাধীন সিরাজগঞ্জ মহকুমার (বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলা) বর্তমান বেলকুচি উপজেলার ভাঙাবাড়ি গ্রামের সেনবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। রজনীকান্তের পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ও মাতা মনোমোহিনী দেবীর ৩য় সন্তান। রজনীকান্তের বাবা গুরুপ্রসাদ সেন একজন দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনি চারশত বৈষ্ণব ব্রজবুলী কবিতা সঙ্কলনকে একত্রিত করে ‘পদচিন্তামণিমালা’ নামক কীর্তনগ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়া ‘অভয়াবিহার; গীতিকাব্যের রচয়িতা ছিলেন। তাঁর বাবা গুরুপ্রসাদ সেন ওকালতি পাস করার পর প্রথমে মুনসেফ ও পরে সাবজজ হন। অন্যদিকে, তাঁর জেঠতুতো ভাই গোবিন্দনাথ সেন রাজশাহী কোর্টের উকিল হিসেবে খ্যাত ছিলেন। রজনীকান্ত যে পরিবারিক পরিমণ্ডলে জন্মগ্রাহণ করেন সেই পরিবারের আদর্শবাদিতা নিষ্ঠাভক্তি ও সহমর্মিতার কোনোটাই অভাব ছিল না। বাবা ভক্তিমান, জেঠতুতো ভাই হৃদয়বান, মা ভক্তিমতি ও ধর্মপরায়ণা এবং ভাইবোনরা আদর্শবান। রজনীকান্ত সেনের মা মনোমোহিনী দেবী বাংলা সাহিত্যের প্রতি বেশ অনুরক্ত ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে কিশোর রজনীকান্তের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন। এই আলোচনা-পর্যালোচনাই তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
রজনীকান্তের জন্মের সময় তাঁর বাবা কটোয়ায় কর্মরত ছিলেন। তাঁর শৈশবকালীন সময়ে তিনি অনেক জায়গায় চাকরি করেন। রজনীকান্তের শৈশব তাঁর বাবার বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে অতিবাহিত হয়। বাবার প্রথম কর্মক্ষেত্র ছিল নবদ্বীপ। ওই এলাকায় অবস্থানের ফলে রজনীকান্ত নবদ্বীপ অঞ্চলের ভাষা ভালভাবে রপ্ত করতে সক্ষম হন। বাল্যজীবন থেকেই তাঁর মধ্যে কাব্য প্রতিভা ও সঙ্গীতপ্রিয়তার আভাস বিশেষভাবে লক্ষিত হয়। পূজার সময় তাদের বাড়িতে পাঁচালীগান, কীর্ত্তন, যাত্রাগান ও ভক্তিসঙ্গীতের আসর বসতো। শৈশব জীবনে দেখা তাঁদের বাড়ির এসব অনুষ্ঠান তাঁর পরবর্তী জীবনে বিশেষভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।
তারকেশ্বর চক্রবর্তী ছিলেন তাঁর বন্ধু। তাঁর সঙ্গীত সাধনাও রজনীকে সঙ্গীতের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ গড়তে সাহায্য করে। শৈশবে রজনী খুবই চঞ্চল ও সর্বদাই খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু তাঁর নৈতিক চরিত্র সবার আদর্শস্থানীয় ছিল। তিনি খুব বেশি সময় পড়তেন না। তারপরও পরীক্ষায় আশাতীত ফল অর্জন করতে পারতেন। পরবর্তীকালে এ বিষয়ে তিনি তাঁর দিনপঞ্জি বা ডায়রিতে উল্লেখ করেছেন, ‘আমি কখনও বইপ্রেমী ছিলাম না। অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। ’ বিদ্যালয় অবকাশকালে প্রতিবেশীর গৃহে সময় ব্যয় করতেন। সেখানে রাজনাথ তারকরত্ন মহাশয়ের কাছ থেকে সংস্কৃত ভাষা শিখতেন। এছাড়া, গোপাল চন্দ্র লাহিড়ীকে তিনি তার শিক্ষাগুরু হিসেবে পেয়েছিলেন।
রজনীকান্তের এন্ট্রান্স পরীক্ষার আগ থেকে তাদের পরিবারে ভাগ্য বিপর্যয়ের সূত্রপাত হয়। ১৮৭৫ সালে বরিশালের সাব-জজ পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তখন রজনীকান্তের বয়স মাত্র দশ বছর। সংসারের দায়দায়িত্ব ওকালতি পেশায় নিয়েজিত ফলে জেঠতুতো দুই ভাই বরদাগোবিন্দ ও কালীকুমারের ওপর পড়ে। দুর্ভাগ্যবশত ১৮৭৮ সালে বরদাগোবিন্দ কলেরায় আক্রান্ত হয়ে চব্বিশ ঘণ্টারর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। তারা উভয়েই আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। রজনী’র ছোট ভাইয়ের মৃত্যুতে কালীকুমার সে রাতেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াবন্ধ হয়ে মারা যান।
রজনীকান্তের শিক্ষা ও কর্মজীবন সম্বন্ধে জানা যায়, তিনি রাজশাহীর বোয়ালিয়া জেলা স্কুলে ( বর্তমানে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল) ভর্তি হন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে ২য় বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ পাস করেন। তারপর তিনি কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন। ওখানে ভর্তি হওয়ার এক বছর পর ১৮৮৬ সালে তাঁর জেঠতুতো ভাই ও বাবার মৃত্যু ঘটে। পারিবারিক ভাগ্য বিপর্যয়ের মধ্যেই রজনীকান্ত ১৮৮৯ সালে বিএ পাস করে করেন। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে আইন বিষয়ে বিএল ডিগ্রি অর্জন করেন। সংসারের হাল ধরার জন্যে তিনি রাজশাহীতে আইনপেশা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি নাটোর, নওগাঁ ও বরিশালে মুন্সেফ হিসেবে চাকরি করেন। কিছুদিন পর ভালো না লাগায় ১৮৯৫ সালে ইস্তফা দেন। রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় রজনীকান্ত অধুনা মানিকগঞ্জ ঝেলার বেউথা গ্রামের ডেপুটি স্কুল ইনস্পেক্টর তারকনাথ সেনের বিদুষী তৃতীয়া কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। হিরন্ময়ী দেবী রজনীর লেখা কবিতাগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। কখনো কখনো তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুর সম্পর্কে অভিমত ও সমালোচনা ব্যক্ত করতেন। তাঁদের সংসারে চার পুত্র- শচীন্দ্রকান্ত , জ্ঞানেন্দ্রকান্ত, ভুপেন্দ্রকান্ত ও ক্ষীতেন্দ্রকান্ত ও দুই কন্যা -শতদলবাসিনী ও শান্তিবালা। কিন্তু ভুপেন্দ্র খুব অল্প বয়সেই মারা যায়। রজনী দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে এবং ঈশ্বরের ওপর অগাধ আস্থা রেখে পরদিনই রচনা করেন:
তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দুখ,
তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব?
তোমারি দুনয়নে তোমারি শোক-বারি,
তোমারি ব্যাকুলতা তোমারি হা হা রব?
রজনীন্তের কবি ও গায়ক প্রতিভা বিকাশের বিষয়ে এখন আলোচনা করা যেতে পারে। তাঁর কবি ও গায়ক হওয়ার পেছনে তাঁর তারকেশ্বরের বাল্যসহচর ভাঙাবাড়ির তারকেশ্বর চক্রবর্তী অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারকেশ্বর রজনীকান্তের থেকে বছর চারেকের বড়। তারকেশ্বরের কবি প্রতিভায় রজনীকান্ত এতই মুগ্ধ হন যে তিনি যখনই নিজ গ্রাম ভাঙাবাড়ি বিভিন্ন ছুটিছাঁটায় আসতেন, তখনই তারকেশ্বরের সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করতেন। তারকেশ্বরের এমনই কবি প্রতিভা ছিল যে তিনি মুখে মুখে কবিওয়ালদের মতো ছড়া ও পাঁচালী গান তৈরিতে ওস্তাদ। রজনীকান্ত তারকেশ্বরের সান্নিধ্যে এসে মুখে মুখে ছড়া ও পাঁচালীগান রচনা করতে সক্ষম হবেন। তারকেশ্বরের সুমিষ্ঠ কণ্ঠের গান শুনে রজনীকান্তেরও সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। তিনি সঙ্গীত চর্চা শুরু করেন। প্রকৃতপক্ষে, রজনীকান্তের বাল্যবন্ধু তারকেশ্বরই তাঁর সঙ্গীতের গুরু। তারকেশ্বরের লেখা থেকে এ কথার প্রমাণ মেলে। ‘বৎসরের মধ্যে যে নূতন সুর বা গান শিখিতাম, রজনীর সঙ্গে দেখা হইবামাত্র তাহা তাহকে শুনাইতাম, সেও তাহা শিখিত। পরে যখন একটু সঙ্গীত শিখিতে লাগিলাম , তখনও বড়ো বড়ো তাল, যথা চৌতাল, সুরফাঁক প্রভৃতি একবার করিয়া তাহকে দেখাইয়া দিতাম, তাহতেই সে তাহা শিখিয়া ফেলিত এবং ওই সফল তালের মধ্যে আমাকে সে এমন কূট প্রশ্ন করিত যে আমার অল্পবিদ্যায় কিছু কুলাইত না।’
রজনীকান্ত অন্যের লেখা গান না গেয়ে নিজের লেখা গান নিজকণ্ঠে গাওয়ার জন্য বছর পনের বয়স থেকেই তিনি ভক্তিরসাত্মক গান রচনা করতে শুরু করেন। সে সময় রচিত তাঁর দুটো গানের কিছুটা উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে।
নবমী দুঃখের নিশি দিতে আইল।
হায় রানী কাঙ্গালিনী পাগলিনী।।
(মায়ের) চরণ –যুগল, প্রফুল্ল কমল
মহেশ স্ফটিক জলে,
ভ্রমর নূপুর ঝংকারে মধুর
ও পদকমল -দলে ।
শৈশবকাল থেকেই তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও সাবলীলভাবে বাংলা ও সংস্কৃত- উভয় ভাষায়ই কবিতা লিখতেন। তিনি তাঁর রচিত কবিতাগুলোকে গান আকারে রূপ দিতে শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান পরিবেশন করতেন। রজনীকান্তের কবিতাগুলো স্থানীয় উৎসাহ, আশালতা প্রমুখ সংবাদ-সাময়িকীতে অনেকবার প্রকাশিত হয়েছিল। রজনীকান্তের প্রথম কবিতা ‘আশা’ সিরাজগঞ্জ থেকে কুঞ্জবিহারী দে বিএল সম্পাদিত ‘আশালতা’ মাসিক পত্রিকায় ১২৯৭ সালের ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এটাই রজনীকান্তের প্রথম প্রকাশিত কবিতা। ‘আশা’ কবিতার প্রথম স্তবক উদ্ধৃত করা যেতে পারে।
এখানে বল গো একবার!
নরকের ইতিহাস,
দুষ্কৃতির চিরদাস,
মলিন পঙ্কিল এই জীবন আমার
আমারও কি আশা আছে বল একবার।
১৩০৪ সালে রাজশাহী থেকে সুরেশচন্দ্র সাহার সম্পাদনায় ‘উৎসাহ’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার প্রকাশ ঘটে। ‘উৎসাহ’ পত্রিকায় প্রথম বছরে রজনীকান্তের পাঁচটি কবিতা প্রকাশিত। বৈশাখ সংখ্যায় ‘সৃষ্টি- স্থিতি- লয়’ , জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ‘ তিনটি কথা’, আষাঢ় সংখ্যায় ‘ তোমার ও আমার’ ও অগ্রাহায়ণ সংখ্যায় ‘ যমুনা পক্ষে’ প্রকাশিত হয়। এই পাঁচটি কবিতার মধ্যে ‘তোমার ও আমার’ হাসির কবিতা। এই কবিতা লেখার পেছনে একটা ইতিহাস আছে। রাজশাহীতে ওকালতি আরম্ভ করার পর রজনীকান্তের সঙ্গে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (ডিএলরায়) সঙ্গে পরিচয় হয়। ১৩০১ কিংবা ১৩০২ সালের দিকে সরকারি চাকরি উপলক্ষে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রাজশাহীতে অবস্থান করছিলেন। এক সভায় ডিএল রায়ের কণ্ঠে হাসির গান শুনে রজনীকান্ত মুগ্ধ হন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ আমরা ও তোমরা ’ হাসির কবিতা ১৩০২ সালের ‘ সাধনা’ পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায প্রকাশিত হলে রজনীকান্ত ১৩০৪ সালের ‘উৎসাহ ’পত্রিকায় আশ্বিন সংখ্যায় ‘ তোমরা ও আমরা ’ নামে একটি হাসির কবিতা লেখেন। রজনীকান্ত যে দ্বিজেন্দ্রলালের মতো হাসির কবিতা লিখতে পারদর্শী তার দৃষ্টান্ত দিতে গেলে দ্বিজেন্দ্রলালের কবিতার সঙ্গে রজনীকান্তের কবিতাটির উদ্ধৃতি দিতে হয়।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের আমরা ও তোমরা:
আমরা খাটিয়া বহিয়া আনিয়া দেই গো,
আর, তোমরা বসিয়া খাও;
আমরা দু’পরে আপিসে লিখিয়া মরি গো,
আর, তোমরা নিদ্রা যাও।
রজনীকান্ত সেনের তোমরা ও আমরা:
আমরা রাঁধিয়া বাড়িয়া আনিয়া দেই গো,
আর তোমরা বসিয়া খাও,
আমরা দু-বেলা হেঁসেলে ঘামিয়া মরি গো,
আর খেয়ে দেয়ে তোমরা নিদ্রা যাও
কবি রজনীকান্তও এরপর থেকে হাসির গান লিখতে শুরু করেন। এক সময় তিনি হাসির গানে খ্যাতিও লাভ করেন। হাসির গান ছাড়াও রজনীকান্ত ব্যঙ্গ কবিতা রচনায় পারঙ্গমতা দেখান। এখানে তাঁর লেখা ব্যঙ্গ কবিতার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
বাজার হুদ্দা কিন্যা আইন্যা, ঢাইল্যা দিচি পায়;
তোমার লগে কেমতে পারুম, হৈয়্যা উঠছে দায়।
আরসি দিচি, কাহই দিচি, গাও মাজনের হাপান দিচি,
চুল বান্দনের ফিত্যা দিচি, আর কি দ্যাওন যায়?
কলেজ জীবনের দিনগুলোতে তিনি গান লিখতেন। অভিষেক অনুষ্ঠান ও সমাপনী বা বিদায় অনুষ্ঠানেই গানগুলো রচনা করে গাওয়া হতো। তিনি তাঁর অতি জনপ্রিয় গানগুলো খুবই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে রচনা করতে সক্ষমতা দেখিয়েছিলেন। তেমনি একটি গান রাজশাহী গ্রন্থাগারের সমাবেশে মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে রচনা করেছিলেন:
তব, চরণ নিম্নে, উৎসবময়ী শ্যাম-ধরণী সরসা;
ঊর্ধ্বে চাহ অগণিত-মনি-রঞ্জিত নভো-নীলাঞ্চলা
সৌম্য-মধুর-দিব্যাঙ্গনা শান্ত-কুশল-দরশা?
১৫ বছর বয়সে কালীসঙ্গীত রচনার মাধ্যমে তাঁর অপূর্ব কবিত্বশক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আইন পেশার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ করে সঙ্গীত, সাহিত্য, নাটকে অভিনয় ইত্যাদিতে গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। রজনীকান্তের রাজশাহীতে অবস্থানকালে তাঁর বন্ধু বিখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও স্ত্রীর তাঁকে বিশেষ ভাবে উৎসাহ প্রদান করেন। সঙ্গীতের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের ফলে তিনি ওকালতি পেশায় গভীর ভাবে মনোনিবেশ করতে পারেননি।
স্বদেশী আন্দোলনে তাঁর গান ছিল অসীম প্রেরণার উৎসস্থল। ৭ আগস্ট, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কলকাতার টাউনহলে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিলাতী পণ্য বর্জন ও স্বদেশি পণ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন বাংলার প্রখ্যাত নেতৃবর্গ। ভারতের সাধারণ জনগণ বিশেষত আহমেদাবাদ এবং বোম্বের অধিবাসীগণ ভারতে তৈরি বস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করে। কিন্তু এ কাপড়গুলোর গুণগতমান বিলাতে তৈরি কাপড়ের তুলনায় তেমন মসৃণ ও ভাল ছিল না। কিছুসংখ্যক ভারতবাসী এতে খুশি হতে পারে না। এই কিছুসংখ্যক ভারতীয়কে ঘিরে রজনীকান্ত রচনা করেন তার বিখ্যাত দেশাত্মবোধক অবিস্মরণীয় গান:
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই;
দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।
এই একটি গান রচনার ফলে রাজশাহীর কবি রজনীকান্ত সমগ্র বাংলায় স্বদেশী আন্দোলনের কবি হয়ে ওঠেন। এ গানটি রচনার ফলে পুরো বাংলায় গণ-আন্দোলন ও নবজাগরণের পরিবেশ হয়। গানের কথা, সুর ও মাহাত্ম্য বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করায় রজনীকান্ত খুবই উৎসাহিত হন দেশাত্মবোধক গান লিখতে। স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষেরা গানটিকে লুফে নেন ও কণ্ঠে-কণ্ঠে গীত হয়। পরে তিনি আরও বেশ কয়েকটি একই ধরনের গান লেখেন, আর সেগুলোও জনপ্রিয় হয়।।
আমরা নেহাত গরিব, আমরা নেহাত ছোট,
তবু আছি সাতকোটি ভাই,-জেগে ওঠ!
রজনীকান্ত সেন এক পর্যায়ে প্রার্থনা সঙ্গীত ও সাধন সঙ্গীত রচনায় নিজেকে উৎসর্গ করেন।
তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে,
তব পুণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে৷
তাঁর লেখা এই প্রার্থনা সঙ্গীতটি কালজয়ী আসন লাভ করে। আজও এই প্রার্থনা সঙ্গীতটি প্রাসঙ্গিক, সর্বকালীন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকবে। এছাড়া তিনি ‘ওরা , চাহিতে জানে না, দয়াময়’, ‘ কতভাবে বিরাজিছ বিশ্ব মাঝারে’, ‘আর কতদিন ভবে থাকিব মা’ ইত্যাদি সাধন সঙ্গীত লেখেন। কবি রজনীকান্তের কবিতা ও গান হাস্যরস, দেশাত্মবোধের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভগবৎপ্রেমের সাগর পানে ছুটেছে, তা আমরা বুঝতে পারি তাঁর সাধন আঙ্গিকের গানের সুর ও ভাষার মধ্য দিয়ে। কবি ও গায়ক রজনীকান্ত ১৩১৫ সালের ২১ অগ্রহায়ণ কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের নবগৃহ প্রবেশোৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে সাহিত্য সাহিত্য গবেষক ও পণ্ডিত দীনেশচন্দ্র সেনের আতিথ্য গ্রহণ করেন। ওই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে রজনীকান্ত সৃষ্টির বিশালতা ও সৃষ্টির সূক্ষ্ণতা বিষয়ক দু’খানা গান পরিবেশন করেন। রজনীকান্ত এ অনুষ্ঠান সম্পর্কে তাঁর রোজনামচায় লেখেন, ‘এই গান শুনে রবি ঠাকুর আমাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন।, আমি দীনেশকে সঙ্গে করে রবি ঠাকুরের বাড়ি তারপর দিনসকাল বেলা যাই। সেইখানে তিনি আবার ঐ গান শোনেন, শুনে বলেন যে, বহির্জগত সম্বন্ধে আর একটা করুন।’
কবি ও গায়ক রজনীকান্ত বুঝেছিলেন, ‘যাঁরে মন দিলে ফিরে আসে না’- সে মন তিনি তাঁরই রাতুল চরণে সমর্পণ রচিত হয়েছে তাঁর হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে। তারই অভিব্যক্তি আমরা লক্ষ করি তাঁর এই একান্ত প্রার্থনায়:
কবে, তৃষিত এ মরু ছড়িয়া যাইব
তোমারি রসাল নন্দনে;
কবে, তাপিত এ চিত, করিব শীতল,
তোমারি বরুনা- চন্দনে!
১৯০৯ সালে রজনীকান্ত’র কণ্ঠনালীর ক্যান্সার শনাক্ত হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯১০ তারিখে ইংরেজ ডাক্তার ক্যাপ্টেন ডেনহ্যাম হুয়াইটের তত্ত্বাবধানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ট্রাকিওটোমি অপারেশন করান। এতে তিনি কিছুটা আরোগ্য লাভ করলেও চিরতরে বাকশক্তি হারান। অপারেশন পরবর্তী জীবনের বাকি দিনগুলোয় হাসপাতালের কটেজেই কাটাতে হয়। ১১ জুন, ১৯১০ তারিখে রজনীকান্ত সেনকে দেখার জন্য হাসপাতাল যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জানা গেছে, এ উপলক্ষে হাসপাতালে বসেই রজনীকান্ত একটি কবিতা রচনা করেন:
আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছে, গর্ব করিতে চূর,
তাই যশ ও অর্থ, মান ও স্বাস্থ্য, সকলি করেছে দূর?
ঐগুলো সব মায়াময় রূপে, ফেলেছিল মোরে অহমিকা-কূপে,
তাই সব বাধা সরায় দয়াল করেছে দীন আতুর;
বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে দিয়ে ১৯১০-এর ১৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে আটটায় রজনীকান্ত সেন ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর অমর সৃষ্টি তাঁকে চিরভাস্বর করে রাখবে।