উনিশ শ চব্বিশ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে আলবার্ট আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর চার পৃষ্ঠার একটি রচনা নোটসহ ইংরেজি থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। সেদিন থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু একজন মহান বিজ্ঞানী হিসেবে বিশ্বের সামনে উঠে আসেন। ওই রচনায় ফোটনের বণ্টন রীতি আলোচিত হয়, যা বোসন পরিসংখ্যন নামে সমধিক পরিচিত। এই বণ্টন পদ্ধতি আইনস্টাইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। আণবিক গবেষণায় বসুর তত্ত্ব প্রয়োগ এবং দৃষ্টিভঙ্গিও বোসন পরিসংখ্যন নামে পরিচিতি লাভ করে অনেক পদার্থবিজ্ঞানীর কাছে। অবশ্য অনেকের কাছে এটি ‘বোস-আইনস্টাইন থিওরি’ নামেও পরিচিত। বোসন পদ্ধতি মেনে চলা কণাকে ‘বোসন কণা’ বলা হয়। অনুরূপ বোসনতত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা ‘পাউলির বর্জননীতি’ থেকে ফার্মি প্রণীত ‘ফার্মি তত্ত্ব’ মেনে চলা কণা ‘ফার্মিওন’ নামে পরিচিত।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে এটা সর্বজনবিদিত যে, একটি কণা হয়তো বোসন অথবা ফার্মিওন। এভাবে অধ্যাপক বসু পদার্থবিজ্ঞানের উন্নয়নের গবেষণায় স্থায়ী আসন সৃষ্টি করে নেন। এছাড়া, তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরিতে। তিনি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র এবং গণিতশাস্ত্রের বিভিন্ন শাখায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ অবদান রাখায় তাকে অসাধারণ পণ্ডিত বলে বিবেচনা করা হয়।
অধ্যাপক বসুর গভীর অনুরাগ ছিল সাহিত্যের প্রতি। তিনি শুধু চিরায়ত বাংলা, সংস্কৃত, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইতালিয়ান সাহিত্যেরই মনোযোগী পাঠক ছিলেন না। তিনি ওই সব ভাষার, বিশেষ করে বাংলা এবং ফ্রেঞ্চ সাহিত্যের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের ব্যাপারেও খোঁজ-খবর রাখতেন। তিনি দুটি বিখ্যাত মাসিক সাহিত্য পত্রিকা কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সাহিত্যগোষ্ঠীর সদস্যও ছিলেন। সবুজ পত্র ও পরিচয়। বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধিতে এ পত্রিকা দুটির অবদান অপরিসীম। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ভাষণ, অভিভাষণ ও বাংলা রচনা সাহিত্য রসে পূর্ণ ও বাক-বৈদগ্ধ্যে সমৃদ্ধ।
গত মার্চ মাসে একটি সুশিক্ষিত সমাজ কর্তৃক আয়োজিত, সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক বসুর স্মরণসভায় তার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানান, ‘অধ্যাপক সত্যেন বসু ছিলেন একজন বিরল প্রতিভা। তিনি অতি সহজেই গণিতের নানা সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারতেন।’ আমার মনে হয় নানা বিষয়ের ওপর সত্যেন বসুর ছিল জন্মগত প্রতিভা, তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার, অসাধারণ স্মৃতিশক্তি আর গভীর ও ব্যাপক আগ্রহ। তিনি চেষ্টাও করেছেন বুদ্ধিমত্তা, স্মরণশক্তি ও আগ্রহের বৃদ্ধিতে।
এমনকি স্কুলছাত্র অবস্থায় সত্যেন বসু তার শিক্ষকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তার গণিতপ্রতিভা দিয়ে। তিনি শুধু পাঠ্য বইয়ের সব উদাহরণই সমাধান করতেন না বরং সমধর্মী অন্য বইয়ের গাণিতিক সমস্যাগুলোও তিনি সম্পাদন করতেন সম্ভাব্য সব উপায় অবলম্বন করে। তার আরেকটি গুণ ছিল, তিনি যা সমাধান করেছেন সেগুলোর সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সমাধান করা এবং সূত্রাবদ্ধ করা। যাদের এসব গাণিতিক সমস্যা সমাধানের অভিজ্ঞতা আছে তারা জানেন, কাউকে পাণ্ডিত্য অর্জন করার জন্য অবশ্যই সম্ভাব্য সবরকমের সমাধানের চেষ্টা করতে হয়। এ জন্য তাদের উচিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা কিভাবে এগুলো সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে কোনো পরিচিত সমস্যা থেকে চিহ্নিত করা যায়। যেন আঘাতের পদ্ধতিটি সহজে অনুমান করা সম্ভব হয়। এটি গণিতের বিভিন্ন শাখার সমস্যা সমাধানের বিশ্বপরিচিত একটি পদ্ধতি।
তিনি সমাধান করেছেন তা তিনি করেছেন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে
ছাত্রজীবনে সত্যেন বসু কোনোদিন গাণিতিকি বিশ্লেষণ করেননি। তিনি এগুলো শিখেছেন এস.সি. কারের কাছে। হোয়াইটেকারের কয়েক খণ্ডের বিশাল বই মডার্ন এনালাইসিস গ্রন্থের যে কপিগুলো তার কাছে ছিল, সেগুলোর মার্জিনে তিনি অসংখ্য মন্তব্যে ভরে তুলেছেন। সেখানে তার কিছু পরামর্শধর্মী মন্তব্যও ছিল যে, তিনি এ বইয়ের সবগুলো সমস্যার সমাধান করেছেন। আর প্রতিটি সম্পাদন করেছেন নানা পদ্ধতিতে।
পরবর্তী জীবনে যখনই তিনি কোনো উচ্চতর গণিত, গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান, পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নের সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করেছেন, তখনই তিনি সমস্যার গভীরে কয়েকদিনের জন্য ডুবে যেতেন। কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের জন্যও এমন হতো। যখন বিষয়টা সম্পূর্ণরূপে তিনি কয়েকটি উপায়ে সমাধান করতে পারতেন, যখন সন্তুষ্টি লাভ করতেন তখন তিনি চিন্তাস্রোতে থামাতেন এবং কাজ বন্ধ করতেন। না হলে তা চলতেই থাকত। এ ধরনের চর্চার ফলে তিনি গাণিতিক সূত্র শেখার এক নতুন উদ্ভাবনকুশল অনুষদ উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হন। মৌলিক সূত্রের সাহায্যেই তিনি এটা করতেন। এই মৌলিক সূত্র থেকেই তিনি মাঝে মাঝে সব কিছু খুঁটিনাটি হিসাব করতেন বই বা কোনো জার্নালের সাহায্য ছাড়াই। এটা তাকে প্রবল আত্মবিশ্বাস এনে দেয়; যা কিছু তিনি সমাধান করেছেন তা তিনি করেছেন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে। সত্যিই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি সমস্যাগুলো সমাধান করেছেন নিজস্ব উদ্ভাবনী পন্থায়। কখনো করেছেন সোজাসুজি কিন্তু দীর্ঘ সময় নিয়ে। এটা বলা হয়ে থাকে যে পরিণত বয়সে প্রখ্যাত গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট এই পন্থা অবলম্বন করতেন। নোটস অন কোয়ান্টাম মেকানিকস বইয়ের ভূমিকায় জানা যায় ফার্মিও একই পন্থায় কাজ করতেন।
যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের খয়রা অধ্যাপক তখন তাকে দেখা যেত এক বা একাধিক সমস্যার সমাধান নিয়ে সম্পূর্ণ ব্যস্ত থাকতেন। কখনো সন্নিহিত গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান অথবা গণিত, কখনো পদার্থবিজ্ঞানের সূক্ষ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং কখনো রসায়নের বিষয় নিয়েও তিনি এভাবে গভীরভাবে ডুবে থাকতেন। এ সময় এক্সরে গবেষণাগার এবং রাসায়নিক গবেষণাগার তার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। তার ছাত্র-ছাত্রী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা জানান যে, সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে খুব কম সময়ই গণিত বা বিজ্ঞানচিন্তা মুক্ত হয়ে থাকতে দেখা যেত। এমনকি পর পর কয়েকটি দিনও তাকে এমন অবসর দেখা যায়নি। যদি কখনো কয়েকদিনের জন্য এমন অবসর ঘটেই থাকে, তখন তিনি বন্ধু বা সহযোগীরা যে সব কাজ করেছেন সেগুলোর সমস্যা নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করতেন।
একটি কঠিন সমস্যার সমাধান শেষ করার পরে আরেকটি সমস্যায় ডুব দেওয়ার মাঝখানের সময়ে তাকে হালকা কোনো কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখা যেত। এ সময় যে কোনো বয়সের, যে কোনো পদমর্যাদার যে কোনো লোক তার সঙ্গে মুক্তভাবে কথা বলার সুযোগ পেতেন। তার কাছের লোকদের অনুযোগ যে, এ সময় তাকে বেশ অলস এবং হালকা বিষয় নিয়ে আড্ডা দিতে দেখা যেত। কিন্তু তার সহযোগী-সহকর্মী এবং শিক্ষার্থীরা জানেন যে, তিনি যখন কাজে ডুবে যেতেন তখন তার সঙ্গে অন্য কোনো বিষয়ে পাঁচ মিনিট কথা বলা খুবই কঠিন ছিল। এ সময় তিনি যা বলেন তাদের শুধু তাই শুনতে হতো। যেন তিনি উচ্চস্বরে চিন্তা করেন।
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর গভীর ভাবনা ও অধ্যবসায় ছিল বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে। তার শিক্ষার্থী ও সহযোগীরা মুগ্ধ হয়ে নোট করতেন, যে সব বিষয়ের প্রতি একজন শিক্ষক এবং গবেষক হিসেবে তাদের গবেষণার আগ্রহ জন্মানোর জন্য তিনি উদাহরণ দিতেন সে সব বিষয়ের সঙ্গে তার উল্লেখ-উদ্ধৃতি, বিজ্ঞানের উন্নতির বর্ণনার কোনো সংযোগ বা সম্পর্ক থাকত না।
তিনি হালকা বিষয়েও আড্ডায় মেতে উঠতেন
সত্যেন্দ্রনাথের ধারে কাছে যারা যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তারা তার সাহিত্যপ্রীতির কথা জানেন। একদিন সন্ধ্যায় তিনি বাল্মীকির মূল সংস্কৃত রামায়ণ পাঠ করছিলেন। তার একজন সহযোগীকে তিনি বোঝালেন, ‘আমি সংস্কৃত ভাষায় বাল্মীকির মূল রামায়ণ পাঠ করছি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে, কৃত্তিবাসের অনুবাদ রামায়ণের সঙ্গে এর পার্থক্যগুলো চিহ্নিত করার জন্যে।’ প্রায়ই তাকে দেখা যেত সদ্য প্রকাশিত ফরাসি বইয়ের মধ্যে গভীর অভিনিবেশে নিমজ্জিত থাকতেন। স্কুল বয়সের বন্ধু প্রয়াত অধ্যাপক নীরেন রায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলেন, ”রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাসটি যখন একটি বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল তখন অধ্যাপক বসু, আমি এবং কয়েকজন বন্ধু কিস্তিগুলো প্রতি মাসে সতর্কভাবে পড়তাম, পরে আমরা বিশ্লেষণ করতাম এবং পরের কিস্তিতে কী ঘটবে তার পূর্বধারণা করতাম। আমাদের প্রত্যেকের পূর্বধারণাগুলো কাগজে লিখে রাখতাম। পরের মাসে পত্রিকাটি বের হলে উপন্যাসটির পরের কিস্তি পড়ার সময় মিলিয়ে দেখতাম আমদের ধারণা মতো উপন্যাসটির উন্নতি ঘটছে কিনা। এভাবে আমরা তখন উপন্যাস পড়তাম।’ এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় অধ্যাপক বসু বিজ্ঞান গবেষণায় যে পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন সাহিত্যেও সেই পদ্ধতির ব্যবহার করতেন। এটি যেকোনো বিষয়ে জ্ঞানের সাধারণ স্তর থেকে স্বাধীনভাবে উন্নতি করার একটি পদ্ধতি। এতে নিজের পূর্বধারণাগুলো অন্যদের পূর্বধারণা এবং বিষয়ের ক্রমোন্নতি মিলিয়ে দেখার সুযোগ ঘটে।
অধ্যাপক বসু একজন ভালো সঙ্গীতবিদও ছিলেন। উচ্চমানের সঙ্গীত শোনার জন্য কৈশোর-তারুণ্য থেকেই তিনি রাতের পর রাত জাগতে পারতেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে দূরে যেতে কোনো দ্বিধা করতেন না। তিনি এসরাজ ভালো বাজাতে পারতেন। তিনি রাতে সবার আগে ঘুমাতে যেতেন; উঠতেনও সবার আগে। অনেক সময় তিনি ভোর রাত, এমনকি দুইটা-তিনটার সময় উঠতেন। যখন তিনি কোনো বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তামগ্ন থাকতেন তখন সাধারণত দুইটা-আড়াইটার সময় উঠে যেতেন। অন্য সময় দুইটার দিকে উঠে এসরাজ বাজাতেন। যখন তিনি ঢাকা থাকতেন তখন তার এই অভ্যাস ছিল। অনেক সময় তিনি তার নিজস্ব পদ্ধতিতে সঙ্গীতের সুর নিয়ে গবেষণা করতেন। নতুন করে তিনি সুর সৃষ্টি করতে চেষ্টা করতেন। তিনি সম্পূর্ণ সচেতনভাবে এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে শেখার চেষ্টা করতেন, যেমন স্বভাব ছিল তার গবেষণা ক্ষেত্রে।
এটা অস্বীকার করা যাবে না যে অধ্যাপক বসু ছিলেন ভীষণ মেজাজি, ব্যক্তিতান্ত্রিক এবং স্পষ্টত শৃঙ্খলাহীন; এমনকি বিজ্ঞান সাধনা ও গবেষণায়ও। যারা তাকে একটু দূর থেকে দেখতেন শুধু তারাই না, কাছ থেকে দেখেছেন এমনকি তার সহযোগীরাও অভিযোগ করতেন যে তিনি অলস, হালকা বিষয়ে আড্ডায় মেতে ওঠেন এমনকি কিছুই না করে সময় অপচয় করতেন। অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন হয়েও তিনি এমনভাবে সময় কাটান, তার কিছু করা উচিত। তবে একজনের গভীর অনুধ্যান থেকে দেখা যায় প্রত্যেকর কাজ, সাধনা এবং গবেষণা নিজস্ব পদ্ধতিতেই চলে। অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, মাতৃভূমির প্রতি অগাধ প্রেম গড়ে তুলেছে তাকে রুচিশীল, স্বকীয় মানসিক সামর্থ্যবান এবং তাকে করেছে দৃঢ় কিন্তু কোমল সৌহার্দপূর্ণ ব্যক্তি এবং অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন জন্মগত দান কিন্তু তার কঠোর শ্রম, সাধনা ও দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় তাকে বানিয়েছে যা তিনি আমাদের নিকট পরিচিত। এভাবে তিনি একজন মানুষ হয়ে, হয়ে ওঠেন মহানবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, সঙ্গীতবিদ এবং সবগুলো গুণের অধিকারী।