যখন থেকে পড়তে শিখেছি, ঠিক তখনই পাঠ্যবইয়ের চেয়ে আউটবইয়ের প্রতি আগ্রহটা বেশি ছিল। একটা-একটা করে শব্দ ধরে ধরে পত্রিকার শিল্পসাহিত্যের পাতা পড়তাম। আমার জন্মস্থান ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার হোগলাকান্দি গ্রামে। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং থাকায় গ্রামে থাকা হয়নি। আমি পরিবারের বড় সন্তান।
আমার দাদিমা ছিলেন অনন্য সাধারণ মানুষ। তার আদর্শে বড় হয়েছি, তিনি ছিলেন যথেষ্ট জ্ঞানী, ধার্মিক, পরোপকারী এবং বিনয়ী মানুষ। তার তিনটি সন্তানকে সত্তরের দশকে গ্রাজুয়েশন করিয়ে সরকারি চাকরি দিয়েছেন নিজ দায়িত্বে। তিনি আমাদের ঘুম পাড়াতেন বিভিন্ন গল্প, কবিতা শুনিয়ে। আমার বাবা ছিলেন আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষ, সাদাসিধে সৎ জীবনযাপন করতেন। তার একটা লক্ষ্যই ছিল আমাদের মানুষের মতো মানুষ করা, যথেষ্ট পরিমাণ ধার্মিক হলেও তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। খুব গম্ভীর ও স্থির ভাবনার মানুষ ছিলেন বাবা। পার্থিব জীবনে তার তেমন কোনো চাওয়া ছিল না। কোনো বিষয়ে তিনি সীমা অতিক্রম করতেন না। তিনি বলতেন, পৃথিবীতে নিজের বলে কিছুই নেই তো কোন মোহে অন্যায় করবো! আপন আত্মা যখন নিজ নিয়ন্ত্রণে নয়, কিসের প্রতি আশা পুষবো? কখনো তাকে বলতে শুনিনি যে, আমার সন্তান এই হবে, বা এমন হতে হবে।
আমাদের শাসন-বারণ যে বাবা করেননি, সে কথা বলবো না। তবে, তিনি ভিন্ন জগতের মানুষ ছিলেন। তার সঙ্গে কাউকেই আমি মেলাতে পারিনি এই জীবনে। মানুষকে ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে রেখে শুধু ‘মানুষ’ হিসাবে চিনতে শিখেছি বাবার কাছ থেকেই। আমার মধ্যে সাহিত্যপ্রেম আর ধর্মপ্রেম তাই জন্মলগ্ন থেকে। শৈশব থেকেই স্বভাবগত কারণে শান্তশিষ্ট। সবাই যখন খেলতে যেতো, আমি তখন বারান্দায় একা বসে থাকতেই পছন্দ করতাম। সমুদ্র পছন্দ ছিল না। এক অদ্ভুত মায়া ছিল নদীর প্রতি। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলতাম। নিজেকে প্রশ্ন করতাম, উত্তর খুঁজতাম। লুকোচুরি খেলতাম শব্দ-গানে। পরিবারের বাইরে সময় কাটাতে ভালো লাগতো না। বন্ধুও ছিল না তেমন। মা-বাবার বাধ্য ছিলাম খুব। এমনভাবে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি, যেন অনন্যা না হতে পারলেও কিছুটা ভিন্নতর অন্তত হই। সবার ভালোবাসা পেতে নিজেকে নিয়ে ভাবিনি। ছিলামও পুরো পরিবারের মধ্যমণি হয়ে।
নিজের টাইমলাইনে ও সেসব সাহিত্য পেজে লিখতাম। ‘নীল আকাশ সাহিত্য আসর’-এর ক্রিয়েটর জাকারিয়া জাহাঙ্গীর পেজে পোস্ট করা লেখা থেকেই আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করেন।
চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াকালীন রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি তুমুল প্রেম জন্মেছিল। খেলনা কেনার চেয়ে বই আর ফুলের গাছ কেনার প্রতি আগ্রহটা এখনো শৈশবকেই মনে করিয়ে দেয়। আমাদের পরিবারটি একটু ব্যতিক্রম চিন্তাধারার থাকায় যেকোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমরা সবাই উঠোনে জোছনা উদযাপন করতাম। হাসি, আড্ডা, গল্প, গানের ডালি খেলে আমাদের রাত শেষ হতো। আমাদের আর একটা অভ্যাস ছিল, আত্মীয়দের মাঝে চিঠি বিনিময়। প্রতি সপ্তাহে অনেক চিঠি লিখতাম, এই চিঠি লেখা থেকেই লেখালেখির শুরু। আজকের আমি হয়ে ওঠা। বড় চাচার টেবিলে একদিন তার ডায়েরি দেখে চুপিচুপি পড়ে ফেলেছিলাম, সেই থেকে ডায়েরি লেখার প্রতিও আগ্রহ। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে সারাদিনের কার্যক্রম লিখে রাখতাম। সুযোগ পেলেই বড় আপুদের কবিতা, গল্প-উপন্যাসের বই পড়তাম। লাইব্রেরির সদস্য হয়েছিলাম সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময়। এসবই পড়তে পড়তে কখন যে লিখতে শুরু করেছি নিজেও জানি না।
#কোথায় যাচ্ছি, পথ জানা নেই ॥ রকিবুল হাসান
আমার এক ভগ্নিপতি স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, তিনি কিভাবে যেন আমাদের গ্রাম বিষয়ক আমার একটি লেখা পড়েছিলেন। ছোটবেলা থেকে গ্রাম থেকে দূরে থেকেছি বলেই হয়তো গ্রামের প্রতি প্রবল টান ছিল। কুমার নদীর প্রতি মায়া ছিল, সেটা কি প্রেম? হয়তো বা তারচেয়েও বেশি কিছু। একটা আদর্শ গ্রাম বলতে যা বোঝায়, আমাদের গ্রামটা ঠিক তেমন, ছবির মতো। যাদু কিংবা রূপকথার এক রূপসী মূর্তি। গ্রামের মানুষের জীবনযাপন খুব ভাবাতো। যাই হোক, সেই গ্রাম নিয়েই লিখেছিলাম। সেই লেখাটিই আমায় না জানিয়েই পত্রিকায় ছেপে ছিলেন আমার সেই ভগ্নিপতি। তখন সবে নবম শ্রেণীতে পড়ি। অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ, সঞ্চিতা, বেশকিছু উপন্যাস পড়ে শেষ করেছি। শরৎচন্দ্রের বিশাল রচনাসম্ভার, জীবনানন্দ দাশের কবিতা, সমকালীন লেখকদের লেখা, হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের অদ্ভুত চরিত্রগুলোও খুব ভাবাতো। সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা, কালপুরুষ, মেয়েরা যেমন হয়’; তার ভাবনার ভাঁজে মেয়েদের রূপের চিত্রকল্প এঁকেছি।
রোমিও-জুলিয়েটকে নিয়ে ভাবতাম, হৈমন্তীর জন্য কষ্ট হতো। কোথাও বই দেখলে সেটা তুলে নিতাম হাতে। সে যে বিষয়েরই হোক। পড়ার লোভটা সামলাতে পারতাম না। এই একটা বিষয়ের প্রতি এখনো চরম নেশা আমার।
এসএসসি শেষ করে কলেজে ভর্তি হতেই বিয়ে হয়ে গেলো আমার। হলাম যৌথ পরিবারের বড় বউ। তাদের চিন্তা-চেতনা আমার পরিবারের ঠিক বিপরীত। নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে আমার কলমকে নির্বাসন দিতে হলো। তাদের আমার মতো করে নয়, নিজেকে তাদের মতো করে গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছি। ভুলেই গিয়েছিলাম আমার আমি কে। হ্যাঁ সফলও হয়েছি নিজেকে নিংড়িয়ে সবার মনের মতো হতে। তবে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল আমার স্বপ্নগুলো। পাঠ্যবই ছুঁতেই যেখানে ছিল বাধা, সেখানে আউট বই স্পর্শ করার সুযোগ হয়নি। তবে ভাবনার জগৎ আমার পিছু ছাড়েনি। সুযোগ পেলে বইগুলো নাড়াচাড়া করেছি, ডায়েরি লিখেছি, সীমাহীন সীমা অতিক্রম করেছি।
সময়ের পরিক্রমায় স্মার্ট ফোন ব্যবহারের সুবিধায় ফেসবুক ব্যবহার শুরু করি। স্বাভাবিকভাবেই দুই-এক লাইন লেখা পোস্ট করতে থাকি। বিভিন্ন কবিতা পেজে চোখ বোলাই, পড়ি, এভাবেই চলছিল। আমার দুই-লাইনের পোস্ট দেখে এক লেখক তার পেজে লিখতে বলেন, প্রথমে রাজি হইনি। পরে ভেতরের আমি’র তাড়নায় লিখতে শুরু করি। আবার নিয়মিত হই লেখায় এবং অবধারিতভাবে কবিতাই লিখছি।
নিজের টাইমলাইনে ও সেসব সাহিত্য পেজে লিখতাম। ‘নীল আকাশ সাহিত্য আসর’-এর ক্রিয়েটর জাকারিয়া জাহাঙ্গীর পেজে পোস্ট করা লেখা থেকেই আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করেন। এরপর থেকেই পরিবারের সবাই জানতে পারে যে, আমি আবার লিখছি। প্রথম বইটি খুব আনাড়ি ভাবনায় লেখা, অনেকটাই রবিঠাকুরের আভা ছড়ানো।
আমি লিখতে চাই, এই আমার লক্ষ্য। আমি জানি না, লেখক হতে পেরেছি কি না! সবার মাঝে নিজের লেখা পৌঁছাতে পারবো? তবে যে অব্দি বেঁচে আছি, এই যাত্রা আমি সমাপ্ত করবো না।
বিনয় মজুমদার পড়ার পর আমার চিন্তাধারার পরিবর্তন হতে থাকে। ব্যতিক্রম ভাবনার লেখাগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকি,
ভিন্নধারায় লেখা শুরু করি। অনেকটা খোলামেলা শব্দে কিছুটা আড়াল করে লিখি। এজন্যও সম্মুখীন হতে হয়েছে বহু প্রতিকূলতার। নারী লেখক যেন একটা গালির মতো। নারীর পক্ষে হাজার হাজার শব্দ লেখা সাহিত্যিকগণই নারী লেখকদের প্রতি আড়চোখে তাকান। যেকোনো সাহিত্য আড্ডায় যেখানে ১০জন পুরুষ লেখক, সেখানে একজন নারী লেখকের উপস্থিতিতে কিছুটা অস্বস্তিকর পরিবেশও তৈরি করে। অনেক নারী লেখা শুরু করে বটে কিন্তু টিকে থাকতে পারে না। পরিবার, সমাজ এবং তথাকথিত লেখকদের কারণেই। এমন পটভূমিতে নিজের জন্য এক চিলতে জায়গা তৈরি করতে যথেষ্ট ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়েছে।
হ্যাঁ, উৎসাহ যে পাইনি তা নয়, এরইমধ্যে সৌভাগ্যক্রমে ভালো মানুষের সাথেও সাক্ষাৎ হয়েছে। স্থানীয় লেখকদের এক প্ল্যাটফর্মে আনতে বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গে অনিচ্ছায় জড়িয়ে পড়ি। যদিও সেখানে টিকে থাকতে পারিনি, তবে ইচ্ছাটা রয়েই গেছে। তৃণমূলে নিভৃতে থাকা লেখকদের পরিচিত করিয়ে দেওয়ার, মফস্বলের স্কুল-কলেজে পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীদের সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলার কাজ এখনো করে যাচ্ছি। জানি না, কতটা পারবো। কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
‘শব্দকাহন’ নামে একটি লিটল ম্যাগের সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছি, ‘ক্যাওস’ নামে একটা অনলাইন সাহিত্য পোর্টালের প্রবন্ধ ও গদ্য সম্পাদনা করছি। সাহিত্যবিষয়ক যেকোনো কাজের প্রতি আমার আগ্রহ সাধ্যের চেয়েও বেশি।
#আমিই আমার কারিগর ॥ রফিকুজ্জামান রণি
আমাদের পরিবার সাহিত্য অনুরাগী হলেও আমার লেখালেখি কিছুতেই সহজভাবে নিতে পারেনি। একজনই ছিলেন যিনি আমায় উৎসাহ দিয়েছেন, তিনি আমার বাবা। তিনি যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, তখন সত্যিই অসহায় হয়ে পড়লাম। আমি নারী, যথেষ্ট ধার্মিক; এরপরও কেন এই সাহিত্য পাড়ায় ঘোরাফেরা আমার! কেন আমায় লেখতে হবে! এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বড় ক্লান্ত হয়ে যাই প্রায়ই। প্রথম দিকে পাশের মানুষটা উৎসাহ না দিলেও নিরুৎসাহিত করেনি। পরে তিনিও অন্যদের দলে নাম লেখালেন। আমার গন্তব্য আরও দুর্যোগময় হতে শুরু করলো। কাছের মানুষগুলো ক্রমে ক্রমে দূরে সরে গেলো, সবাইকে নতুনভাবে জানলাম। এমন কোনো প্রতিকূল বিষয় নেই, যার সম্মখীন হইনি লেখালেখির জন্য। আমাকে এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়াতে হয়েছে লেখালেখি, না সংসার; কোনটা চাই? এরমাঝেও আমি লিখছি, এতবড় একটা সংসার সামলিয়েও, সবার প্রতি সবটা দায় পূর্ণ করে দিন শেষে, রাতের শেষ প্রহরে একটু সুযোগ পেলেই লিখি। দিনে একটু পড়ার সুযোগ না পেলে বইয়ের সারির দিকে একবার চোখ বুলাই। একটা বই অন্তত বালিশের নিচে না রাখলে কিছুতেই চোখ বন্ধ করতে পারি না। রান্না করি। তার মাঝে দুই লাইন ভাবি। কখনো সুযোগ হয় তা লিপিবদ্ধ করার। কখনো বা হারিয়ে যায়। আমি লিখতে চাই, এই আমার লক্ষ্য। আমি জানি না, লেখক হতে পেরেছি কি না! সবার মাঝে নিজের লেখা পৌঁছাতে পারবো? তবে যে অব্দি বেঁচে আছি, এই যাত্রা আমি সমাপ্ত করবো না।