আবহমানকাল ধরে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন মোরালিটির প্রচলন দেখা যায়। আপনি একটা মোরালিটি তৈরি করে মনে করেন, এই মোরালিটি অন্যদের মেনে নিতেই হবে। কিন্তু আপনার কাছে যেটা আদর্শিক, অন্যের কাছে তা না-ও হতে পারে।
ধর্মীয় মৌলবাদীরা নারীদের নিয়ে নানা ফতোয়া দিয়ে থাকেন। সেগুলোকে তারা ধর্মীয় মোরালিটি বলে চাপিয়ে দিতে চান। নানা ফতোয়া দিয়ে নারীদের মোরাল পুলিশিং করে থাকেন। নারীরা ঘর গৃহস্থালির কাজ করবে। নরম কোমল স্বরে কথা বলবে। বাইরে বের হলে বোরকা হিজাব পরবে। এই ফ্রেমে থাকলে সে আদর্শ নারী। এই ফ্রেমে থাকলে সেই নারীর জীবন সুকুমার হতে পারে। আর এই ফ্রেমের বাইরে গেলে সেই নারীর জীবনে ধ্বংস হয়ে যাবে।
মোরাল পুলিশিংয়ের টার্গেট একমাত্রই নারী। নারীকে কন্ট্রোল করার জন্যই মূলত মোরাল পুলিশিং করা হয়ে থাকে। মোরাল পুলিশিং নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজে একরকম, মধ্যবিত্ত সমাজে আরেকরকম আর উচ্চবিত্ত সমাজে এর অন্যরকম ডায়মেনশন।
এসব বাধা যেন নারীদের জন্য। বাধা দেওয়ার জন্য একেকবার একেক অজুহাত তৈরি করা হয়। মেয়েরা স্কুলে যেতে পারবে না। বাধা। মেয়েরা কলেজে যেতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেতে পারবে না। মেয়েরা চাকরি করতে পারবে না। মেয়েরা সামাজিক কোনো কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। বাইরে আড্ডা দিতে পারবেন না। মূলত মেয়েরা কী কী কাজ করতে পারবে, কী কী কাজ করতে পারবে না, সবই ঠিক করা আছে এক অদৃশ্য মোরালিটি দিয়ে।
পৃথিবীতে কিছু ইউনিভার্সেল মোরালিটি আছে। তার মধ্যে একটি হলো মিথ্যে বলা মহাপাপ। কিন্তু কোনো একটি ভালো কাজ বা ভালো উদ্দেশ্যে সম্পন্ন করার জন্যও মাঝে মাঝে মিথ্যা বলতে হয়। আপনার কাছে যেটা ইথিক্যাল বা আইডিয়াল নর্মস মনে হতে পারে আরেকজনের কাছে তা নাও হতে পারে। আপনি যে মোরালিটি বিশ্বাস করেন স্থান-কাল-পাত্রভেদে তার ভিন্নতা থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের মোরালিটি অনেকটা চাপিয়ে দেওয়া। সব মোরালিটিই নারীর জন্যই তৈরি করা।
আমাদের ক্ষমতা কাঠামোয় তুলনামূলক যারা ভালো অবস্থানে আছেন, তারা যে কাউকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিতে চায় মোরাল পুলিশিং দিয়ে। মোরাল পুলিশিংয়ে জেন্ডার লেন্স সবসময় ছিল। পুরুষ নারীকে প্রতিযোগিতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতাকে খর্ব করে। মোরাল পুলিশিংয়ের প্রথম ও প্রধান শিকার হচ্ছে নারী। নারী বলে সে সন্ধ্যার পর বাইরে বের হতে পারবে না। নারী বলে বোরকা হিজাব পরতে হবে। নারী সিগারেট খেতে পারবে না। চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে পারবে না। নারীর চলাফেরা, মুক্ত চিন্তা, ধর্ম, শিক্ষা, কাজের ক্ষেত্রে নিয়ম দিয়ে এমনকী গলার স্বরও মোরাল পুলিশিং দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
পৃথিবীর সভ্যতার পর থেকেই নারীকে নানা মোরাল পুলিশিং দিয়ে গৃহকোণে পর্দা প্রথা চাপিয়ে দিয়ে আটকে রাখা প্রবণতা শুরু হয়েছিল, আজ অব্দি তা বিরাজমান। যেমন ভালো ঘরের মেয়েরা বাজারে যায় না। সন্ধ্যার পর মেয়েরা ঘরের বাইরে যেতে হয় না। যুগে যুগে মোরাল পুলিশিংয়ের ধরন পাল্টেছে। নারীকে কোনো না কোনোভাবে অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে দূরে রাখতে হবে। নারীকে কোনো না কোনোভাবে নিজস্ব ব্যক্তিগত অভিমত থেকে দূরে রাখতে হবে। সিদ্ধান্ত থেকে দূরে রাখতে হবে। নারীকে তার গণ্ডির ভেতর রাখতে হবে, বিজ্ঞান থেকে মেয়েদের দূরে রাখতে হবে। এভাবে নানা অজুহাতে নারীদের সরিয়ে রাখা হয়।
পাঠ্যপুস্তকে জেন্ডার অসংবেদনশীল অনেক শব্দ, বাগধারা কিংবা প্রবাদ প্রবচন সংযোজন করা হয়েছে। যেমন ‘ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন, যদিও বা পৃথক হয় তবে নারীর কারণ’ কিংবা ‘ঝিকে মেরে বৌকে শেখানো’। আমরা ছোটবেলা থেকেই এই প্রবাদগুলোর সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত।
সভ্যতার সব কিছুই এগিয়ে যাচ্ছে সমানতালে। একমাত্র নারীকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। রাষ্ট্র যে মোরালিটি তৈরি করে রেখেছে, সেই মোরালিটির নার্সিং করছে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ। রাষ্ট্র যেহেতু একজন নারীর নিরাপত্তা দিতে পারছে না, তাই সে নারীর জন্য এমন কিছু মোরালিটি তৈরি করে রেখেছে, যার প্রতিফলন আমরা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ থেকে পাচ্ছি। কিন্তু এরপরও কি থেমে আছে নারীর পদচারণা? যারা এগিয়েছেন তারা নিজের চেষ্টায় এগিয়েছেন।
নারীবান্ধব পরিবেশ তো আমাদের দেশে এখনো তৈরি হয়নি। সভ্য জগতে লিঙ্গ নিয়ে আলোচনাই হয় না। একজন ছেলে একা থাকলে যেমন গৃহস্থালির কাজের জ্ঞান থাকা দরকার। রান্না জানা দরকার। তেমনি একা থাকলে সেলাই জানাও জরুরি। একা থাকলে একজন ছেলের শার্টের বোতাম খুলে গেলে সেই বোতাম লাগানোর স্কিলটা যেমন তার থাকতে হয়, তেমনি ঘর গৃহস্থালির অনেক কাজও তাকে করতে হয়। তাই মোরাল পুলিশিং দিয়ে কোনো কাজ লিঙ্গবৈষম্য না করাই শ্রেয়। কারণ লিঙ্গবৈষম্য সব বৈষম্যের সঙ্গে কানেক্টটেড। পারিবারিক বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, শ্রেণী বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্যের সঙ্গেও কানেক্টটেড। এটাকে পুঁজি করে কেউ কেউ ফয়দা লুটছে। লিঙ্গভিত্তিক পরিচয়ে ঊর্ধ্বে উঠে আমি কোন লিঙ্গের, সেটা মাইনর বিষয় হয়ে, আমি যে মানুষ সেটাই প্রধান বিষয় হয়ে ওঠা জরুরি।
যুগে যুগে বিভিন্ন প্রবাদ প্রবচন দিয়ে নারীকে অবদমন করা হয়েছে। অবমাননা করা হয়েছে। প্রবাদকে যদি জীবন অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ধরি, তাহলে নারীর বিরুদ্ধে বলা প্রবচনগুলো খুবই সিগনিফিকেন্ট। প্রবাদ প্রবচন সংগ্রহ করেছেন বহু পণ্ডিত বা ভাষাবিদ। প্রায় দুইশ বছর ধরে প্রবাদ সংগ্রহ করেছেন তারা। সুকুমার সেন কিছু সংকলন করেছেন কিন্তু সেটা ‘মেয়েলী প্রবাদ’ বিষয়ে। ‘বাংলায় নারীর ভাষা’ নামে একটা প্রবন্ধে তিনি যেসব শব্দের উল্লেখ করেছেন, সেগুলো থেকে পুরুষ ও নারীর সামাজিক অবস্থান স্পষ্ট হয়। যেমন, অনাছিষ্টি, লক্ষ্মীছাড়া, আটকুঁড়ো, আড়ি, আদিখ্যেতা, কটুনী, খোঁটা, গাদী, গুমর, গা, ছিরি, ঠমক, ঢঙ, দেমাক, ন্যাকা, পোয়াতি, বিয়েন, বেহায়া, কুট্টি, মিনসে, রাঁড়, রাঁড়ী, সেয়ানা, সোমত্ত, সোহাগ, সই ইত্যাদি।
ক্রিয়া বাক্যাংশ—ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা, বানের জলে ভেসে আসা, বিয়ের ফুল ফোটা, মুখে খই ফোটা, হাঁড়িতে স্থান দেয়া, কেঁদে হাট বসানো, সইপাতানো, পাকা চুলে সিঁদুর পরা, হাঁড়ি ঠেলা, পরের মুখে ঝাল খাওয়া, মাথা কোটা ইত্যাদি। আবার এই প্রবাদগুলো আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। সব প্রবাদেই নারীকে চরমভাবে অপমান করা হয়েছে।
যেমন, ভাগ্যবানের বউ মরে অভাগার গরু। ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন যদিবা পৃথক হয় নারীর কারণ। পতি বিনে গতি নেই। পতির পায়ে থাকে মতি, তবে তারে বলে সতী। পতি হারা নারী, মাঝি হারা তরী। পদ্মমুখী ঝি আমার পরের বাড়ি যায়, খেদা নাকী বউ এসে বাটার পান খায়। জাতের নারী কালো ভালো, নদীর জল ঘোলা ভালো। পুরুষ জিদে বাদশা, নারী জিদে বেশ্যা। রান্ধিয়া বারিয়া যেইবা নারী পতির আগে খায়, সেই নারীর বাড়িতে শিগগীর অলক্ষ্মী হামায়।
এই কয়েকটা প্রবচন যদি বিশ্লেষণ করেন, তাহলে নারীর অবস্থান এই সমাজে ঠিক কী ছিল, তা ধরতে পারা যায়। অনেকে হয়তো মনে করতে পারেন, এগুলো প্রাচীনকালের কথা। মধ্যযুগের এইসব প্রবচন এখন কোনোমতেই রেলিভেন্ট নয়। ওপরে যে প্রবচনগুলোর উল্লেখ করলাম, শুধু এইগুলোই যদি ব্যাখ্যা করি, তাহলে দেখবো, এখনো কতটা প্রাসঙ্গিক।
একজন নারীর স্বামী না থাকলে কী রকম হেনস্থা হতে হয়, তা আমরা সবাই জানি। স্বামীর অধীনস্থ না থাকা নারীরা কি আখ্যা পায় তাও সবাই জানি। পুরুষের জেদ কতটা প্রশংসনীয় আর নারীর জেদ কতটা নিন্দনীয় তাও আমরা জানি। না প্রবচনগুলো কেউ আর এখন গ্র্যাম্য লোকের মতো ব্যবহার হয়তো করে না। কিন্তু এখনো ফেসবুকে নারী বিষয়ক আলোচনায় এইসব প্রবাদ নানান ফর্মে ফিরে ফিরে আসে। প্রবচনগুলো ইলাবরেট করে সমাজ এখনো।
নারী তার নিজ যোগ্যতায়, ‘জিদে বেশ্যা’ হয় এই ধরনের প্রবাদ মাথায় নিয়েও তার নিজের পথে হেঁটে গেছে। সমাজ আর রাষ্ট্র তার কতটা সহযোগিতা করেছে আর কতটা পেছন টেনে ধরেছে সেইসব আলোচনায় না গিয়েও বলা চলে, নারী এগিয়েছে। কিন্তু সেই এগিয়ে চালটা বেশিরভাগই নিজ চেষ্টায়, নিজ মেধায়, নিজ যোগ্যতায়। এখন এইসব ভাষিক রাজনীতি থেকেই বা নারীর মুক্তির উপায় কী? আবহমান কাল ধরে নারীকে এমন সব অমর্যাদাকর ভাষা এবং মোরাল পুলিশিং মোকাবিলা করে আসতে হয়েছে। মোকাবিলা করে আসতে হয়েছে বাজে সব চাপিয়ে দেওয়া রীতি-নীতি। বিপরীতে মুখ খুললে, পুরুষের দোষত্রুটি ধরে কোনো সমাজ এবং কোনো নারী কোনো শব্দ বা ভাষা তৈরি করলে আগের যুগে খনার ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে। কাউকে নারীবাদী বলে হাসি তামাশা করা হয়েছে। নারীর প্রতি মানবিক সম্মানবোধের জায়গাটি এই সমাজে আজ অবধি তৈরি করা যায়নি বলেই এই ধরনের প্রবচনের বিস্তৃত রূপ আজও দেখা যায়।
আমরা অন্যের স্বাধীন চিন্তাধারাকে প্রাকৃতিক নিয়মে এগিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারি না বরং পেছনে টেনে তাকে জোর করে একটা সিস্টেমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে দেই। পুলিশ যে কাজ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েও করে না, কিন্তু আমরা সেই মোরাল পুলিশিংয়ের কাজটি করি। নারীদের সব বিষয়ে নাক গলাই। আহা! কী আমার দায়িত্ববান পুরুষ। গায়ে মানে না, আপনি মোড়ল।
সমাজে পুরুষতন্ত্রের যে আধিপত্য, মোরাল পুলিশিং সেই আধিপত্যের জমিনকে সুদৃঢ় করেছে। অন্যদিকে পুরুষেরাও খুবই সামান্য মোরাল পুলিশিংয়ের সম্মুখীন হয়। পুরুষেরা কাঁদে না। পুরুষেরা সব সময় শক্ত থাকতে হয়। কারণে অকারণে রাফ অ্যান্ড টাফ থাকতে হয়। সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভালো ছেলেরা তো এটা করে না। ছেলেরা রান্না করে না। ছেলেরা ঘর গৃহস্থালির কাজ করে না। পরিবারের সবাইকে কন্ট্রোল করার ক্ষমতা দেখাতে হয়। আপাদমস্তক একজন বীরপুরুষ হতে হয়।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অন্য অনেককিছুর মতো মোরাল পুলিশিংও নারীর ওপর আধিপত্য সৃষ্টি করে। মোরাল পুলিশিং প্রতিনিয়ত নারীকে অবমাননা করে। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা ও তার নিরিখে নির্মিত মোরাল পুলিশিং নারীকে নানাভাবে অবদমন করছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে টিকিয়ে রাখতে মোরাল পুলিশিং একটি মুখ্য শক্তি হয়ে উঠেছে।
বইয়ের ভাষা নানা সময়ে সংশোধন বা পরিমার্জন করা হয়েছে। এছাড়া ভাষা নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন ভাষা বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু ভাষায় জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়টি বেশিরভাগ সময়ই থেকেছে উপেক্ষিত। ভাষাও পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে আর নারীকে করেছে হেয়। পাঠ্যপুস্তকে জেন্ডার অসংবেদনশীল অনেক শব্দ, বাগধারা কিংবা প্রবাদ প্রবচন সংযোজন করা হয়েছে। যেমন ‘ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন, যদিও বা পৃথক হয় তবে নারীর কারণ’ কিংবা ‘ঝিকে মেরে বৌকে শেখানো’। আমরা ছোটবেলা থেকেই এই প্রবাদগুলোর সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত।
একজন মানুষকে হেনস্তা করা, সেটা শারীরিকভাবে হোক আর মৌখিকভাবে, কেবল যে নৈতিকতাবিরোধী তাই নয়। বরং সেটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই নারীকে মোরাল পুলিশিং থেকে বিরত থাকুন।
ফলে ছোটবেলাতেই একজন শিশুর মনে ছেলে ও মেয়ে সম্পর্কিত একটি ধারণা তৈরি হয়ে যায়। ছেলে হবে শ্রেষ্ঠ আর মেয়ে হবে পতি বা পুরুষের দাস। ছেলে শিশুর মননে গেঁথে যায়, সে মেয়েদের অবদমিত করবে। আর মেয়ে শিশু ভাবে তাকে এই সমাজের সমস্ত অসঙ্গতি মেনে নিতে হবে। পুরুষ যেভাবে তাকে দেখতে চাইবে সেভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। এই ধরনের চিন্তাগুলো ছোটবেলা থেকেই ভাষার মাধ্যমে শিশুর চিন্তায় ও মননে গেঁথে যায়। তাই বড় হয়েও ছেলেরা মেয়েদের সম্মান করতে শেখে না।
এখনো সমাজে যেসব গালিগালাজ প্রচলিত, সব নারীকে উদ্দেশ্য করেই। জেন্ডার অসংবেদনশীল এসব প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা, শ্লোক ও শব্দগুলো যদি শুধুমাত্র বইপুস্তকে সংরক্ষণ করা থাকতো এবং ভাষা নিয়ে যারা কাজ করছেন বা যাদের এ সম্পর্কে জানার আগ্রহ আছে তারাই কেবল এই সংরক্ষিত বইগুলো পড়তো তাহলে সমস্যা সৃষ্টি হতো না। তাতে অ্যাকাডেমিক পড়াশুনা করতে গিয়ে অন্তত জেন্ডার অসংবেদনশীল এই ভাষাগুলোর সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটতো না এবং সমাজে অবলীলায় এসব শব্দের ব্যবহার কমে যেতো।
আবার কিছু কিছু শব্দ অত্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক। যেমন ‘বাপ কা বেটা’-এই শব্দের মধ্য দিয়ে পুরো সুনাম বা খ্যাতি চলে যায় বাবার কাছে। মানে ছেলে ভাল কিছু করলে তখন সে হয় বাবার ছেলে। আর খারাপ করলে হয় মায়ের মতো। যেমন, ‘চোরের মায়ের বড় গলা।’ কিছু শব্দ কেবল নারীর জন্য। নারীকে সতী হতে হবে। সমাজ মনে করে, সতীত্ব পুরুষের জন্য নয়। তাই ছেলেরা বিয়ে করার সময় কুমারী মেয়ে খোঁজে।
কোনো কোনো ধর্মগ্রন্থও নারীর সতীত্ব বজায় রাখার পক্ষে। বাংলা অভিধান প্রণেতারাও ভাষায় জেন্ডার সংবেদনশীল শব্দ ব্যবহার করেননি। যেমন ‘সতী’ শব্দটির অর্থ বাংলা অ্যাকাডেমির অভিধানে এভাবে করা হয়েছে, সাধ্বী, পরিব্রতা, স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষে আসক্ত নয় এমন, হিন্দু পুরাণের দক্ষ কন্যা, শিবানী, স্বামীর মৃত্যুতে সহগামিনী স্ত্রী। আর ‘সতীত্ব’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে: যৌন পবিত্রতা, সতী স্ত্রীর ধর্ম।
সমাজের দৃষ্টিতে যৌন পবিত্রতা বা সতীত্ব শুধুমাত্র নারীর জন্যই।
আমাদের সমাজে মেয়েলি আর পুরুষালি শব্দের অর্থের মধ্য দিয়েও নারী ও পুরুষের প্রকৃতিগত ভিন্নতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। মেয়েলি কথাটি দিয়ে মেয়েদের আবেগী, যুক্তিহীন, কোমল ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলো জানান দেওয়া হয়। অন্যদিকে পুরুষালি শব্দটি দিয়ে পৌরুষ, শক্তি, ক্ষমতা প্রকাশিত হয়। এর অর্থ হলো মেয়েরা আবেগ নিয়ে থাকবে, কোমল হবে। এ কারণে যখন কোনো ছেলে কোমল আচরণ করে তখন তার স্বভাবকে মেয়েলি স্বভাব বলে উপহাস করে সমাজ।
শুধু নিরক্ষর নয়, অধিকাংশ শিক্ষিত পুরুষও নারীকে অবমাননা করার মতো শব্দ ব্যবহার করেন। তবে সম্প্রতি এদেশে জেন্ডারের ধারণা গড়ে উঠেছে কিছুটা। আর নারীরাও প্রতিবাদী হয়ে ওঠার কারণে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে।
প্রাচীনকাল থেকেই এই জনপদে নারীকে কেবল আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। নারী মানেই যে শৃঙ্খলিত এক প্রাণহীন বস্তু। তাই ভাষা-পোশাক-শিক্ষা-ধর্ম-বর্ণ; সব ক্ষেত্রেই নারীকে বৈষম্যের চরম শিকার হতে হয়েছে। একজন মানুষকে হেনস্তা করা, সেটা শারীরিকভাবে হোক আর মৌখিকভাবে, কেবল যে নৈতিকতাবিরোধী তাই নয়। বরং সেটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই নারীকে মোরাল পুলিশিং থেকে বিরত থাকুন।
লেখক: উন্নয়নকর্মী