সে যেন চুপি চুপি আসে,গোপন প্রেমিকার মতো বুকের কাছে এসে বসে।খুব সংগোপনে তারই জন্য প্রিয়-প্রহরের প্রতীক্ষা।এও এক অসম্ভবের গান।তিনি গেয়েছেন জীবনভর তাঁর কবিতায়, তাঁর লেখায়।তাঁর জীবন সাধনায় অনেক রাগ-বিরাগ প্রেম-বিরহের পাশাপাশি এ এক অসাধারণ অনুভূতি।একে আমি বলি এক দুর্দান্ত রোমান্স।পাওয়ার মাঝে না-পাওয়ার বেদনা। চাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে পাওয়ার অমিল-বেমিল।সবকিছু ছাপিয়ে দিয়েছেন এক অদ্ভুত নেশাতুর ভাবনায়।অদ্ভুত প্রত্যাশার প্রাণ।এ-ও কি সম্ভব? জন্মেই মৃত্যুর আহ্বান!এক জন্মে মৃত্যুর পরম সাধনা!পূর্বাপর জীবনপ্রবাহে যেখানে বারবার আরও কিছুটা সময় বেঁচে থাকার আরও এক দীর্ঘজীবনের প্রত্যাশা করা কথা! গৌতম যখন সাধনা করেন নির্বাণ, পুত্রের মুখদর্শন না করেই ঘর ছেড়ে যান সহজিয়া সাধনে।বাউল দেহের ভেতর বাস করেন নিয়ে পরমাত্মার পরম প্রত্যাশা।নখাগ্র থেকে ত্রিবেণী,কেশপাশ উথাল-পাথাল দেহভর পরমাত্মার খোঁজ। মরণ আর জনম। জনম আর মরণ এবং অবশেষে তার নির্বাণ।তখন তিনি আরাধনা করেন মৃত্যুর। বলেন,মরণ রে/তুঁহু মম শ্যামসমান।’ কে কবে বলেছে কোথায়—মরণ তুমি আমার প্রিয়তমের সমান?
কে কবে বলতে পেরেছে এমন হৃদয় উজাড় করা, হৃদয় হরণ করা কথা—‘তুঁহুঁ নহি বিসরবি, তুঁহুঁ নহি ছোড়বি/রাধা-হৃদয় তু কবহুঁ ন তোড়বি/হিয় হিয় রাখবি অনুদিন অনুখন/অতুলন তোহার লেহ/দূর সঙে তুঁহুঁ বাঁশি বাজাওসি/অনুখন ডাকসি/অনুখন ডাকসি/রাধা রাধা রাধা।’ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে এভাবেই মরণ কবিতায় মৃত্যুকে কৃষ্ণসঙ্গ কামনায় রাধার অধীরতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কৃষ্ণের বাঁশি আর ঘুম হরণিয়া। রাধার পক্ষে কি সম্ভব ছিল কোনো কালে অবহেলা করা? বাঁশি বাজে, মধ্যরাত্রি। মন প্রিয়সঙ্গ অধীর। শিয়রে শাশুড়ি, ননদী পাশে। দুর্লঙ্ঘ্য এই প্রাচীর বরাবর ভেদ করেছে রাধা।যে বাঁশিতে ঝরেছে রাতভর অবিরত রাধা-রাধা নাম, মরণ কি বলা যায় তারে? অধীর প্রেমের এই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গেই বুঝি মিলেমিমে রূপ নেয় মরণ!হতেও পারে, কবির মনোভূমি রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে যদি সত্যি হয়। তবে কি বলা যায়, এই যে মরণের জন্য অধীরতা কিংবা ভালেবাসা কিংবা প্রিয়রূপে অন্তরে ধারণে কিংবা প্রিয়তর হয়ে ব্যাকুল রূপে তার আহ্বান এও কি আবরণ! হতে পারে আভরণ? কবিতার কিংবা কবির হৃদয়ের অবগুণ্ঠন! না অসম্ভব। এ সত্যিই কবিরই ভালোবাসা। এ অলক্ষ্যে ধাবমান অন্য আরও এক জীবনদেবতাই বা বুঝি! যা নিত্য ধাবিত করেছে তারে জীবনের তরে। তাই একই লেখনীতে বসেছে জেঁকে জীবনের জয়গান—‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’
মৃত্যু কেমন করে আসবে আমার এই কর্মচঞ্চল জীবনে, তা নিয়ে কেউ কখনো নিবিড় করে ভাবে? কতটা সময় নিয়ে কত বিষণ্নতা ছড়িয়ে রাখে জীবনে একটি শব্দ ‘মৃত্যু’—তা বোধ করি সবারই জানা। বরাবর মৃত্যু এক বিভীষিকা নিয়ে মূর্তমান। কোনো একদিন আসবে আজরাইল কি অন্য কোনো যমদূত। করবে হরণ এই জীবনভর বয়ে বেড়ানো দেহ থেকে তারে। ফেলে দিয়ে এই অলস-অবস মাটির দেহ চলে যাবে লয়ে চিরপ্রাণ পরমাত্মার দ্বারে। এই তো মরণের ক্ষণ কিংবা মরণের ধারণা। কেউ কি কখনো ভেবেছি—এও এক সাধনযোগ হয়ে বাস করে জীবনেরই একধারে? মরণের লাগিও বুঝি পরম প্রিয়র মতো দিন গোনা! তারেও বুঝি সাজানো যায় কাব্য-কথকতায়!কী অদ্ভুত ভালোবাসায় তারও আরাধনা করা যায়! শেখালেন তিনি, দেখালেন তিনি। আমার প্রাণের ঠাকুর। বললেন, ‘অত চুপি চুপি কেন কথা কও/ওগো মরণ, হে মোর মরণ,/অতি ধীরে এসে কেন চেয়ে রও,/ওগো একি প্রণয়েরই ধরণ!/…তুমি এমনি কি ধীরে দিবে দোল/মোর অবশ বক্ষশোনিতে?/কানে বাজাবে ঘুমের কলরোল/তব কিঙ্কিণি- রণরণিতে।’
আসলে সত্যিটা কী? এই অদ্ভুত প্রেম। এ কি সম্ভব? নয়। সত্যিটাকে পরম করে মেনে নেওয়াই আসল। যদি বলি, এ অবশ্যম্ভাবী, এ বিকট শক্তিধারী, এ অবিনশ্বর, এ নির্দিষ্ট। কবে কে পেরেছে এরে ছাড়ায়ে যেতে? তাই বুঝি স্বীকার করে নেওয়া! স্বীকার করে নেওয়া প্রেমে। স্বীকার করে নেওয়া ভালোবাসায়। স্বীকার করে নেওয়াই তার শক্তি, তার মত্ততা, তার প্রলয় আবাহন।তার নিবিড় ঐকতান। প্রলয়ের বীণা বুকে ধারণ করা বুঝি তার জয়গান আর গীত লেখনীতে ধরা দেওয়া অন্য এক কায়ায় দারুণ প্রাণের নিনাদ।‘তুমি উৎসব করো সারারাত তব বিজয়শঙ্খ বাজায়ে/মোরে কেড়ে লও তুমি ধরি হাত/নব রক্ত বসনে সাজায়ে।’
এই হলো স্বীকারোক্তি। মেনে নেওয়া। নিজেকে সমর্পণ এক অদ্ভুত অলঙ্ঘ্যনীয় শক্তির পায়ের নিচে। সঙ্গে তারেই বরণ করে নেওয়া ফুলের মালায়।একই সঙ্গে গানের বাণীতেও। আমি এই বুঝেছি। এইখানে এসে আমি আমার বোঝাপড়ার একটা প্রায় উপকণ্ঠে পৌঁছেছি—‘প্রেম আকর্ষণে/যত গূঢ় মধু মোর অন্তরে বিলসে/উঠিবে অক্ষয় হয়ে নব নব রসে/বাহিরে আসিবে ছুটি/অন্তহীন প্রাণে/নিখিল জগতে তব প্রেমের আহবানে/নব নব জীবনের গন্ধ যাব রেখে/নব নব বিকাশের বর্ণ যাব এঁকে/কে চাহে সংকির্ণতার কূপে/ এক ধরাতল—মাঝে শুধু এক রূপে/বাঁচিয়া থাকিতে! নব নব মৃত্যু পথে/তোমারে পূজিতে যাব জগতে জগতে।’
এ পূজার। এ পরম প্রত্যাশার। এ মৃত্যু, এ নিশ্চিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু কেন এত প্রিয়? কেউ কি জানি তার কিছু। যে প্রিয়সঙ্গ এসেছিল নেমে একদিন পরম প্রদোষে গীত সুধা নিয়ে তার জীবনে, প্রভাতে, যে রবারবর কাব্যে সাধনায় দিনমান তার বিকাশে নিজেরে দিয়েছে উজাড় করে পায়ের কাছে, সে নিশিদিন-নিশিদিন বিরাজে আমার প্রাণের ঠাকুরের ব্যাপৃত জীবনে| জীবনের শেষ প্রবাহ অবধি, অবগুণ্ঠনে এক নিবিড় মৃত্যুর কাছে সঁপে দিয়ে নিজের জীবন। এক অধরা মাধুরী হয়ে জীবনের শেষ বেলায়ও। তারই জেরই অবাধ বিস্তৃতি লয়ে বসেছেন তিনি সাজায়ে । নিজের দেহ মাথা থেকে সৌরকপাল অবধি এঁকেছেন তার ছবি নিজেরই তুলিতে। আমি দেখেছি তারে যে ছবিতে তারই সাড়া পেয়ে এসেছি এ যাবতকাল যাপিত জীবনের লিপি গীত বাণীগুলিতে। অধরা। বিষন্ন। জীবন জীবন জুড়ে। প্রেমে পড়েছেন অজস্র । কাদম্বরী থেকে আন্না । আন্না থেকে ওকাম্পো। কোথাও তবু এতটুকু ম্লান হয়নি তারই ছায়া। স্বেচ্ছায় যিনি মৃত্যুরে দিয়েছেন রাজর্ষি সঙ্গ । মৃত্যু যারে গেছে লয়ে সঙ্গে আর যারে রেখে গেছে তারে দিয়ে গেছে বুঝি বা অসীম প্রেমের প্রচুর স্বাদ।গাইতে জীবন ভরে জীবনজুড়ে মৃত্যুর সঙ্গে তারই সঙ্গলাভ। এও তো এক দারুণ প্রেম। দারুণ এক রোমান্স সে বিদূষীর তরে।
এইভাবে মৃত্যু বিহার করেছে তাঁর কাব্যে। তাঁর কাব্য তার জীবন থেকে আলাদা করার নয়। তাই মৃত্যুর কিছুদিনও আগে এঁকেছেন নিজের যে আবক্ষ ছবি। তার দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে বিশাল মাথা আর কপাল। খুব সাদাসিদে চোখে যারে আড়াল করে। গভীরে তাকালে দেখা যায়, কোথা থেকে এক সুগভীর কলরোলে ছলছল এক ঝরনা নেমে এসেছে তাঁর কপাল বরাবর। যার নাম দিয়েছেন নির্ঝরীনি। যে কবিতা প্রথম প্রদোষে বৌদির সঙ্গে বদলে নিয়েছিল তার রূপ। ধরেছিল নতুন করে কায়া। ফেলে দিয়েছিলেন তারই ইচ্ছেয় প্রথম প্রায় ষোল লাইন।আর তারপর থেকে শুরু করেছিলেন, ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর/কেমনে পশিল প্রাণের পর/কেমনে পশিল গুহার আঁধারে/প্রভাত পাখির গান।’
সেই গান সেই প্রাণ কাব্যভাবনার প্রদোষ প্রত্যুষ থেকে মধাহ্ন গোধূলি পেরিয়ে পৌঁছেছে এক অন্তিম দীঘল রাত্রিতে। তারপর বহুরাত্রি একাকী অবসন্ন অপেক্ষমান চির প্রয়াতের তরে। দীর্ঘ দীর্ঘ একাকি বিনিদ্র যাপন শেষে হয়তো পেয়েছিলেন এক উদ্ভিন্ন অমর সৌরলোক। আর তাই মৃত্যুরে এত ভালোবেসে, এত কাছে চেয়ে এত প্রাণে এঁকেছেন প্রেয়সীর আসঙ্গ লাভের যাতনা, কিংবা বেদনা কিংবা গৌরব কিংবা বিরহযাপন। কে জানে এর সত্যাসত্য রূপ! কে জানে তার কথা? কে বলবে তার ভাষা? তিনি এক, তিনি দুই। একে দুই সত্তা। চির প্রবহমান এক নর আর এক নারী। সম্মিলনে ক্রম উদ্ভাসিত হয়েছেন এক ঊর্ধ্বতর মহাসত্তায়। অবগাহন করেছে পাঠক তাঁর কবিতা কিংবা কাব্যপাঠে এক অসাধারণ সাবলিমিশনে।‘হেথায় যে অসম্পুর্ণ সহস্র আঘাতে চূর্ণ/বিদীর্ণ বিকৃত/কোথাও কি একবার সম্পূর্ণতা আছে তার/জীবিত কি মৃত/জীবনে যা প্রতিদিন ছিল মিথ্যা অর্থহীন/ছিন্ন ছড়াছড়ি/মৃত্যু কি ভরিয়া সাজি তারে গাঁথিয়াছে আজি/অর্থপূর্ণ করি…’।
তবু মৃত্যু তাঁর কাছে এক অসাধারণ। এক অন্য অস্বাদন। এক হৃদয়হরণ,উন্মার্গ চেতনা। এক সুন্দর শিল্পবাসনা। কে না বলবে এই কথাগুলো পড়লে, ‘চৈত্রমাসের হাওয়ায় কাঁপা দোলনচাঁপার কুঁড়িখানি/প্রলয় দাহের রৌদ্রতাপে বৈশাখে আজ ফুটবে জানি/যা কিছু তার আছে দেবার/শেষ করে সব নিবি এবার/যাবার বেলায় যাক চলে যাক বিলিয়ে দেবার নেশায় মেতে/আয় রে ওরে মৌমাছি আয় আয়রে গোপন মধুহরা/চরম দেওয়া সঁপিতে চায় ওই মরণের স্বয়ম্বরা।’
মৃত্যু তাঁরে চিরকাল ভুলায়েছে এক ভুবন ভোলানো রূপে। জানিনা কী তার অনুপ্রাণ? কী তার মহত্তর যোগ! কোথায় তার গভীর গাঁটছড়া, কোথায় তার কলতান? কোথায় নিকষে জ্বেলেছিল আলো কোনোদিন। যা মানব কিংবা কবিরে আক্রান্ত রেখেছে অধীর, কোন সে অমরাবতী! কিন্তু তিনি দেখেছেন তার কোনো এক অধরা মোহনরূপ। কার বুকে মানিক জ্বেলে তাঁর কাছে পেয়েছিল সে বীভৎস মৃত্যু এক চির সৌন্দর্যের রূপ। চিরকাল যা জনম কিংবা জীবনের সমান রূপে-অর্থে-ধ্যানে-কর্মে-কাব্যে বয়ে গেছে সমান্তরাল। কোথাও দেখিনি তাঁর কদর্যের ছায়াখানিরেও। বরং জন্মের ক্ষণ যেন আলো করেই তাঁর জীবনে চিরকাল বহমান এক মোহনরূপ। সে আমার প্রাণের ঠাকুরের মৃত্যুচেতনা। জন্মের সব ঋণ তাই শোধ করেছেন মৃত্যুতে। তার গুণে তার গানে তার জয় পতাকা বহন করেছেন এক অপূর্ব সুন্দররূপে।মোহন সে রূপ,অনির্বচনীয় তার সুধা। পান করে করে পার হলো এতবেলা। তবু সে নেশার ঘোর কাটেনি আজ অবধি। জানি না কাটবে কি সে নেশা মরণে আমারই—‘তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে!/জানি না কি মরণ নাচে, নাচে গো ওই চরণমূলে!/শরৎ আলোর আঁচল টুটে কিসের ঝলক নেচে উঠে/ঝড় এনেছ এলোচুলে/কাঁপন ধরে বাতাসেতে/পাকা ধানের তরাস লাগে, শিউরে উঠে ভরা ক্ষেতে।/জানিগো আজ হা হা রবে তোমার পূজা সারা হবে/নিখিল অশ্রু সাগর কূলে/মোহন রূপে কে রয় ভুলে।’