কবিরা প্রাকৃতিকভাবে দলবদ্ধ। প্রত্যেক কবি শুনতে পান অন্য কবিদের শব্দসংকেত। সেই সংকেতেই কবি মুনিরা চৌধুরীর আবিষ্কার। কবির অকাল মৃত্যুতে তার কবিতার শব্দগুলো সংকেত পাঠাতে থাকে। জেগে ওঠে কবিরা, জেগে ওঠে তার ভক্তরা। আমরা স্তম্ভিত, অসহায়। কিছু কিছু মৃত্যু যে কান্নার ঊর্ধ্বে উঠে যায়, পাথর করে দেয়; কবি মুনিরা চৌধুরীর মৃত্যুও তেমন। তার মৃত্যু আমাদের অসাড় করে দিয়ে গেছে। তিনি রেখে গেছেন এক বিরাট প্রশ্ন। কবিতা যত বুঝি, কবিকে কি তত বুঝি? বুঝি না বলেই তো আজ কবির এমন করুণ অন্তর্ধান।
মুনিরা চৌধুরী আমার কেউ নন, কাছের বা দূরের কিছুই নন। আবার অনেক কিছুই ছিলেন। নাহলে তার কথা যতবার মনে পড়ছে, ততবার চোখের কোণে কেন জল এসে ভিড় করছে! আমাকে অনেকেই অনুরোধ করেছেন মুনিরা চৌধুরীকে নিয়ে কিছু লিখতে। আমি কী লিখবো! আমার শব্দ-বাক্যগুলো যে জলের ধারা হয়ে গেছে। জলোচ্ছ্বাসের মতো ভেঙেচুরে চুরমার করে দিচ্ছে সব। আমাদের মধ্যে সামান্য এক ভুলের জন্য একে অন্যের থেকে দূরে সরে গেলেও তার কবিতা থেকে দূরে সরে যেতে পারিনি। কবিতার আলোড়নে খুঁজে নিয়েছিলাম তাকে। জীবনঘনিষ্ঠ শব্দ দিয়ে সাজানো সেই শব্দ-বাক্যগুলো, শূন্যতা, হাহাকার, হতাশার এক ক্যানভাস।
কবির সংবেদনশীল মনের অনুরণন, প্রকৃতির সারল্যে অনুরণিত। সৃষ্টির নেশায় উদ্বেল কবি তীব্রতম গভীর বোধে আলোড়িত হতে থাকেন। বাস্তবতার কষাঘাতে তা জর্জরিত হয়। কবিও ধীরেধীর নিস্তেজ হতে শুরু করেন। তখন চাওয়া-পাওয়া কিংবা না-পাওয়ার হিসাব করা কঠিন হয়ে যায়। কবি দিকশূন্য হয়ে পড়েন। টানাপড়েনের জীবনে খোঁজেন বেঁচে থাকার অর্থ। মোহমায়ার আলোছায়ায় বিমূর্ত রূপ এঁকে যান কবিতায়। ‘হেথা নয়, অন্য কোথাও; অন্য কোনোখানে’ কবি খুঁজে বেড়ান জীবনের মায়া, আলো, ভালোবাসা। মুনিরা চৌধুরীর অকাল প্রয়াণে আজ তার ব্যাখ্যা খুঁজতে বসেছি। আদতে কি কবি মানুষ হয়ে জন্মে থাকেন, না কি অন্যকিছু! প্রশ্নগুলো জড়ো হয় থরথরে।
________________________________________________
দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর মৃত্যুর পর ১৮ নভেম্বর মুনিরা চৌধুরীও চলে যান না ফেরার দেশে। ওইদিন কার্ডিফ বিচ থেকে কবি মুনিরাকে উদ্ধার করা হয়। জল কি পারেনি তার সব কষ্ট ধুয়ে-মুছে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার করে দিতে, যে জলের বুকেই চিরতরে ঘুমিয়ে গেলেন কবি! পাড়ি দিলেন মহাকালের পথে। সমুদ্র অবিনাশী রূপ নিয়ে কবিকে কালের গর্ভে তুলে নিলো প্রেমের চিরন্তনী ভাস্বর রূপে।।
________________________________________________
মুনিরা চৌধুরীর মৃত্যুর আগের দিন আমাদের আরেক কবি বন্ধুবর কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতে বজ্রপাতের মতো আরও একটি দুঃসংবাদ আমাদের জর্জরিত করে দিলো। মুনিরা চৌধুরী অকস্মাৎ আত্মঘাতী হয়ে তিরোধান করলেন। হঠাৎ এমন মৃত্যুরহস্য অনেক প্রশ্নের মুখেমুখো দাঁড় করিয়ে দেয় বটে। তবে কি এই দুই কবি কবিতার সূত্রে একে-অন্যকে বেঁধেছিলেন! তাদের একই সময়ে অন্তর্ধান আমাদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে। কল্পনায় ভেসে ওঠে হরিহর দুই আত্মা কবিতার পথধরে হেঁটে যাচ্ছেন। আমরা তাদের কবিতায় সেই যাত্রার রূপরেখা খুঁজে ফিরি। মুনিরা চৌধুরী ১৫ নভেম্বর ফেইসবুকে লিখেছিলেন, ‘আজ আমার কোনো কর্ম নেই/ মেহেকানন্দানদীতীরে কেবলই রোপন করছি বৃষ্টি ও কৃষ্ণদাগ!’ এই লেখার দ্বিতীয়াংশের শেষে যা লিখেছিলেন, তা পড়ে চমকে যাই। তিনি লিখেছেন:
অস্তিত্ব বিলীন হলো
অন্য কোনো সঙ্গ বা অনুষঙ্গে নয়
আমরা এক সঙ্গেই মারা যাবো…
এমন অভিব্যক্তিতে অবাক হই, মুষড়ে যাই। আবার লিখেছেন,
আত্নহারা আমি–বেঁচে থাকবো না কি মরে যাবো
কে ডাকছে আমায়! তুমি না স্বয়ং ঈশ্বর!
দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু ও মুনিরা চৌধুরীর সাহিত্যের পথচলা ছিল একইসঙ্গে। কবিতার পথধরে হেঁটে গেছেন অনেক দূর । কবিতার শব্দ বুনুনে একে অন্যের কাছে ধরা পড়ে যান। অনুভূতি আর বোধের জায়গায় গভীর বন্ধুত্বের রেখাপাত ঘটে। যে অনুভূতি ঐশ্বরিক, চিরন্তনী ও সত্য। সমাজ, সংসার, প্রথা, আইন, ধর্ম কোনোকিছুর ধার না ধেরে সেই অনুভূতিতে সমর্পিত মুনিরা চৌধুরী। যা তার অকাল প্রয়াণে ভাস্বর হয়ে ওঠে। দিব্যচোখে পাঠক, সমাজ স্তম্ভিত হয়ে যায়। কবিতার কাছে পরম আশ্রয়ের স্বস্তি খুঁজতে গিয়ে মুনিরা চৌধুরী নিজেকে নৈবেদ্য করে তোলেন। তার কবিতার ভাব, ভাষা, শব্দে ফুটে ওঠে তারই আবেদন বা আর্তি। দেখা যাচ্ছে অনন্তপথে যাত্রার জন্য একভাবে জানানও দিচ্ছিলেন। কিন্তু লেখকেরা কথাকে কখনোই প্রায় আক্ষরিকভাবে নেয় না এবং না নেওয়াটাকেই সঙ্গত ভাবা হয়। অথচ কবিরা মাঝেমাঝে যে সরল-সোজা করে গভীর সত্যটাই বলে যেতে থাকেন, সেটা অনেক বড় বিপদ ঘটে গেলে, পরে বুঝি। মানুষ এত নিঃশব্দে ভাঙতে থাকে যে, অনেকসময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেরই পাওয়া যায় না।
________________________________________________
আজ তিনি দৃশ্যমান দরজার ওপারে চলে গেছে। তবে, তার কবিত্বশক্তি ও কবিসত্তাই তাকে অমরত্ব দেবে। মুনিরা রয়ে যাবেন আমাদের অনুভবে, শব্দে, বাক্যে, চিন্তায় ও নিমগ্নতায়।
________________________________________________
দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর মৃত্যুর পর ১৮ নভেম্বর মুনিরা চৌধুরীও চলে যান না ফেরার দেশে। ওইদিন কার্ডিফ বিচ থেকে কবি মুনিরাকে উদ্ধার করা হয়। জল কি পারেনি তার সব কষ্ট ধুয়ে-মুছে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার করে দিতে, যে জলের বুকেই চিরতরে ঘুমিয়ে গেলেন কবি! পাড়ি দিলেন মহাকালের পথে। সমুদ্র অবিনাশী রূপ নিয়ে কবিকে কালের গর্ভে তুলে নিলো প্রেমের চিরন্তনী ভাস্বর রূপে।
কবির মৃত্যু নেই। কবির যাত্রা অনন্তের দিকে। সেই যাত্রা পথের আবিষ্কার করি কবির কবিতা দিয়ে। মুনিরা চৌধুরীর এ পর্যন্ত তিনটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কবিতাগ্রন্থ তিনটি যথাক্রমে, ‘মৃতের মাতৃমঙ্গল’, ‘মেহাকানন্দা কাব্য’ ও ‘নয় দরজার বাতাস’। এছাড়া তিনি যুক্তরাজ্যের বাঙালি কমিউনিটিতে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার ধারাবাহিকতায় পূর্ণ উদ্যোমে কাজ করে গেছেন। তারই সূত্র ধরে কার্ডিফে বাংলা একাডেমি গড়ে তোলেন। যার পরিচালক তিনি নিজেই ছিলেন। মুনিরা চৌধুরী যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকেও তিনি স্নাতকোত্তর করেন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা যুক্তরাজ্যে হলেও বাংলা সংস্কৃতিতে বড় করার উদ্দেশে মা-বাবা তাকে লেখাপড়ার জন্য বাংলাদেশে পাঠান। পরবর্তী সময়ে মুনিরা বাংলায় কবিতা ও গদ্য লেখা শুরু করেন। তিনি তিন সন্তানের জননী। তার গ্রামের বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার কানিশাইল। ব্রিটেনে বাংলাদেশি সংস্কৃতি চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা মুনিরা ছিলেন সেখানকার বাঙালিদের কাছে সুপরিচিত। তার মৃত্যুতে প্রবাসী বাঙালিদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে এবং আমরা শোকাসন্তপ্ত।
মুনিরা চৌধূরীর অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিল এক আভিজাত্যের অলঙ্কার। আজ তিনি দৃশ্যমান দরজার ওপারে চলে গেছে। তবে, তার কবিত্বশক্তি ও কবিসত্তাই তাকে অমরত্ব দেবে। মুনিরা রয়ে যাবেন আমাদের অনুভবে, শব্দে, বাক্যে, চিন্তায় ও নিমগ্নতায়। ভালো থাকুন কবি, যেখানেই থাকুন।