মানুষের সৌন্দর্য সাধারণত তার মননে। তবে রূপে, গুণে, ব্যবহারে কবি মুনিরা চৌধুরী ছিলেন স্রষ্টার এক অপরূপ সৃষ্টি।
হ্যাঁ, কবি মুনিরা চৌধুরীর কথাই লিখছি। যেমন বিনয়ী, তেমন স্পষ্টবাদিতা, শালীনতা, সুকণ্ঠী, লাজুক ও নীভৃতচারী প্রদীপ্ত কলমের অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন মুনীরা চৌধুরী। যা সচারাচর দুর্লভ। একইসঙ্গে তিনি জেনে গিয়েছিলেন চিরসত্য, কবি মুনিরার ভাষায় বলতে গেলে ‘মানুষের মনের ভেতরে থাকেন দেবতা, মসজিদ-মন্দির ইটের ভেতরে থাকেন অর্ধ দেবতা’।
ধর্মের এই গভীর সত্যকে মুনিরা চৌধুরী যেমন উপলব্ধি করেছেন, তেমনি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে তিনি ভীষণ গুরুত্ব দিতেন।
কার্ডিফে একদিন দেখা হলো। আমাকে বললেন, ‘জানো, আমি কিন্তু তোমাকে নিজের ছোট বোনের মতোই দেখি।’ আর প্রকৃত অর্থেই তিনি তার মর্যাদা রেখেছিলেন। সমাজের সবার সঙ্গে আমি যেমন মিশতাম না, তেমনি মুনিরাও সবার সঙ্গে মিশতেন না। সমাজে আমাকে যারা নানাভাবে সমস্যায় ফেলার চেষ্টা করেছেন, তিনি তাদের এড়িয়ে চলতেন।
যে সমাজে মানুষ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে, শুধুই সমাজে ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে। সে সমাজে মুনিরা চৌধুরী সম্পর্ক গড়েছেন অনেক কম, তবে হৃদয়ের সত্যতা থেকে ভালোবেসে চিরস্থায়ীভাবে গড়েছেন, হাতেগোনা গুটি কয়েক সম্পর্ক।
যে সমাজে মানুষ মানুষকে তৈল মর্দন করে, ছল ভরে টিকে থাকতে চায়, সেই সমাজে কবি মুনিরা স্পষ্ট ভাষায়, কাব্যিকভাবে সমাজ, রাজনীতির চরিত্র উন্মোচন করে দিতেন, সত্য প্রকাশে ছিলেন সাবলীল।
সংখ্যা নয়, গুণগত মানে তিনি ছিলেন বিশ্বাসী, ছিলেন সাহসী।
আজ দুঃখ হয় এই দেখে যে, খোদ পশ্চিমা বিশ্বে বসবাস করেও মুনিরার প্রতি আমাদের অন্ধ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি দেখে। এমন একজন গভীর বোধের কবিকে মুছে ফেলার নোংরা ফতোয়াবাদী সংকীর্ণ চিন্তা-ভাবনা দেখে।
মুনিরা চৌধুরী সত্য প্রকাশে ছিলেন নির্ভীক। তিনি অকপটে নিজের ফেসবুকে, নিজের লেখা বইয়ে প্রকাশ করে গেছেন নিজের চিন্তাধারা-কথা, যা অধিকাংশ মানুষ লুকিয়ে রাখে সমাজের ভয়ে, পাছে লোকে কিছু বলে।
অথচ এমন একজন গুণীর মৃত্যুর পরে তার ফেসবুকসহ লেখা মুছে ফেলার অপপ্রয়াস কবির প্রতি অবিচার, কবির রচিত সাহিত্যের সঙ্গে ঘোরতর অন্যায়। জুজু বুড়ির ভয় দেখিয়ে এ যেন তাকে দ্বিতীয়বার হত্যা করা।
কবি তার ‘নয় দরজার বাতাস’ কবিতায় লিখেছিলেন,
পাখিদের ঠাণ্ডা লাগছে
আমার প্রাণবন্ধু পাখিরা হিমায়িত হয়ে যাচ্ছে
. চোখের সামনে,
কীভাবে সেলাই করি লাল নীল কমলা রঙের চাদর
আমার হাতখানি যে পুড়ে গেছে।চাঁদের বুড়ি
ছোট ছোট চাদর বানিয়ে দে
আমি পাখিদের শরীরে পরিয়ে দেবো পাখিবস্ত্র,
স্বর্গের পরিধান।
কবিতা পড়ে মনে হয়, তিনি যেন আগে থেকেই জানতেন, তার প্রাণবন্ধুসম পাখিরা হিমায়িত হয়ে যাবে, চোখের সামনে, তিনি কিভাবে তবে জীবনের রঙিন স্বপ্ন আঁকবেন। বরং সেই পাখিদের জন্য স্বর্গের পরিধান তৈরি করতে তিনি নিজেই স্বয়ং চলে গেলেন স্বর্গে।
মুনিরা চৌধুরীর চিন্তা-চেতনায়, পরজন্ম, রাধা কৃষ্ণ, বৃন্দাবন, মেহেকানন্দা নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। কবিতায় বারবার ফুটিয়ে তুলেছিলেন কৃষ্ণকে।
যে সমাজ লোকলজ্জার ভয়ে মুখোশের আড়ালে জীবন যাপন করে, মুনিরা চৌধুরী সেই সমাজে বসবাস করে মুখোশ খুলে সত্যকে প্রকাশ করে গেছেন।