সদ্যপ্রয়াত কবি মাহমুদ টোকন ২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর তার ফেসবুক টাইমলাইনে লিখেছিলেন,
‘‘এবার ভেবেছিলাম আর হয়তো ফেরা হবে না! মৃত্যু অনেক বেশি শক্তশালী। বার বার সে ফিরে যেতে রাজি নয়। আমারও যে কত কাজ পড়ে রয়েছে, কত…কত কাজ, দায়িত্ব এখনো। নিজের অসমাপ্ত ও অসম্পাদিত লেখা (কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ, আর পত্রিকা সম্পাদনা। সবচে গুরুত্বপূর্ণ আমার ‘রুরাল তথ্যপ্রযুক্তি ও সেবাকেন্দ্র-ঘাট (GHAT) গুলো বাঁচিয়ে রাখা। এত মানুষের ভালোবাসা,
প্রচেষ্টা, প্রার্থনা ও সেবাযত্ন নস্যাৎ করে চলে যাওয়াও লজ্জাকর! কত প্রিয়জনের রক্ত এখন আমার শরীরে, এ জীবন তাদেরও!সার্কেলের শেষ থেরাপি শেষ করে বাসায় ফেরার পরে এবার আগের থেকে বেশি কমপ্লিকেশন দেখা দেয়! অসহনীয় ব্যথা-যন্ত্রণা, কাতরতা।
রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়াসহ, ভীতিজনক ব্লিডিং ইত্যাদি নানা সংকট।জানাতে ইচ্ছে করেনি কাউকে। ভেবেছি নিঃশব্দে প্রস্থানই ভালো। … এপিটাফও লিখে রেখেছি। স্মৃতিজর্জর চোখ শতবার ভেসেছে জলে। … স্মৃতিফলক ঢাকা থাক ভালোবাসাঘাসে!
কী আশ্চর্য, ওষুধ…ওষুধ… ব্লাড নেওয়া ইত্যাদিসহ সেই মানুষের ভালোবাসার অদৃশ্য দেয়াল ঠিকই ঠেকিয়ে দিলো মৃত্যুর দীর্ঘবাহু। বেঁচে গিয়েছি এবারও। অসমাপ্ত কাজের মতো চিকিৎসার পথও সুদীর্ঘ, এপথও হাঁটবো। এগুতে থাকবো প্রমিথিউসের মতো সূর্যের দিকে, আগুন আনার পথে।’’
কবি মাহমুদ টোকন—আমাদের প্রিয় অগ্রজ। তার মৃত্যুসংবাদ শোনার পর লেখাটি আবার পড়লাম। অলক্ষ্যে চোখ ভিজে এলো। এই উচ্চারণ মর্মবিদারি হাহাকারের। একজন কবির সরল ও সাহসী স্বগতোক্তি। আমরা দেখেছি, বেঁচে থাকার প্রবলবাসনা নিয়ে আমৃত্যু তিনি লড়াই করেছেন কোলন ক্যান্সারের সঙ্গে। দৃঢ় মনোবল নিয়ে অকূলপাথারেও তিনি ভাসতে চেয়েছেন। কিন্তু শেষাবধি মৃত্যু তাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছে।
ফ্ল্যাটনির্ভর বৃত্তাবদ্ধ জীবন। হতাশা, আস্থাহীনতা ও নৈতিক অবক্ষয় আভাসে ইঙ্গিতে কবিতায় ভাবনার রসদ জোগায়। কিছু পঙ্ক্তি দ্যুতি ছড়ায়।
টোকন ভাই, হ্যাঁ আপনি এগিয়ে গেছেন সূর্যের দিকে প্রমিথিউসের মতোই। আগুন আনার প্রত্যয়ে আপনার এই স্বপ্নযাত্রায় আমরা উদ্বোধিত হয়েছি সত্য। কিন্তু দেখুন, আমরা সেই সূর্যগামী পথে চেয়ে আছি। আমাদের চোখ যতদূর যায়, ততদূর একজন মহৎপ্রাণ কবিকে খোঁজে। সারল্যে উজ্জ্বল একজন মানবিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিকে খোঁজে। যিনি নিজে কোলন ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে থেকেও সুবিধাবঞ্চিত ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জীবন নিয়ে ভাবতেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাদের জীবনকে আনন্দ ও আলোময় করতে সদা তৎপর ছিলেন।
গুলশান হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় নিহত পুলিশ অফিসার রবিউল করিম মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় ‘ব্লুমস কাটিগ্রাম’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেখানে সমাজের অবহেলিত ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের স্বপ্ন দেখতেন। রবিউল করিমের মৃত্যুর পর কবি মাহমুদ টোকন ‘ব্লুমস’-এর সঙ্গে সাধ্যানুযায়ী সহযোগিতা নিয়ে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। আজ স্বপ্নবান এই দুই মহৎপ্রাণ আমাদের মাঝে বেঁচে নেই।
মাহমুদ টোকন ছিলেন একাধারে কবি-ঔপন্যাসিক ও সম্পাদক। উন্নয়ন গবেষক। ১৯৭১ সালের ১১ মার্চ মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলাধীন ভূরঘাটার পূয়ালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দশক-বিবেচনায় মাহমুদ টোকন নব্বই দশকের। ৪৭ বছর বয়সী এই কবি ছিলেন অবিবাহিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে উচ্চতর শিক্ষা শেষে উন্নয়নমুখী নানা কর্মকাণ্ডে তিনি নিজেকে যুক্ত করেছেন। কিন্তু হায়, আজ তিনি ঈশ্বরের দ্রুতগামী ট্রেনের যাত্রী হয়ে গেলেন:
গভীর ঘুমের মতো রাত্রি ভেদ করে
চলে যায় দ্রুতগামী ট্রেন…
যাত্রীহীন নৈঃশব্দ্য স্বর, আমন ধানের গন্ধ
আর কিছু ধ্যানি সারসের মন্ত্র নিয়ে—
চলে যায় ঈশ্বরের ট্রেন
(মৃত্যুজানালা: মাহমুদ টোকন)
হিসেবে মাহমুদ টোকন ঐতিহ্যের অনুগামী। তার কবিতা দর্শনগত ভাবনায় উচ্চকিত। কবিতার স্বর বোধের বিন্যাসে উদ্ভাসিত। সময়সচেতন কবি নিসর্গঘনিষ্ট অলঙ্কারে ব্যক্তিক অনুভূতিকে ছড়িয়ে দেন পাঠকের অনুভবে। নগরবন্দি আধুনিক মানুষের নিঃসঙ্গ অবয়ব তার কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছে। ফ্ল্যাটনির্ভর বৃত্তাবদ্ধ জীবন। হতাশা, আস্থাহীনতা ও নৈতিক অবক্ষয় আভাসে ইঙ্গিতে কবিতায় ভাবনার রসদ জোগায়। কিছু পঙ্ক্তি দ্যুতি ছড়ায়। যেমন:
ক.
স্পর্শের আঙুল থেকে জন্ম নেবে
বিদীর্ণ মালভূমি। স্পর্শ থেকে—
সুদীর্ঘ শেকড়, গেঁথে যাবে মাটির গভীরে…
জন্ম নেবে অন্ধসভ্যতা…জন্ম নেবে-
প্রেম ও ঈশ্বর। (আকাঙ্ক্ষা)খ.
শোকের পাশের ঘরে উৎসব; তুমি আধুনিক! (আধুনিকতা)গ.
নিসর্গ শতনদী, মেঘ-শামীয়ানা…
বিবৃত শিরীষ কিংবা চালতার ফুলে এমন বিষাদঘন মধ্যাহ্নের বিরহ সুন্দর কিংবা ঘাসফড়িং কিষানি আঁচলে… (আমার দেশ)ঘ.
পোড়োবাড়ির মতো—একেকটি ফ্ল্যাট, কবরের মতো নীরবতা।
সম্পর্কহীন শিশুতোষ। মায়ের বহুগামিতা, জনকের আকণ্ঠ নিমজ্জন
কী আশ্চর্য কী তমসাময়। কী আছে সূত্রে গাঁথা—
শিক্ষা নিকেতন? আনন্দ খুনে দল প্রাত্যহিক কথা বেঁচে ফেরে। (মহাত্মন)
মাহমুদ টোকনের কবিতায় মৃত্যুচিন্তা এসেছে নিঃসঙ্গতার মোড়কে। তিনি বুঝতে পেরেছেন নিঃসঙ্গতাই মানুষের নিয়তি যেন। তার মতে,
একা হও…একা হয়ে যাও
বিষাদ রঙিন পাত্রে রাখো।একা হয়ে ওঠা মহৎ উপাসনা…
গর্ভবেদনা এবং ঈশ্বর সঙ্গীবিহীন
এবং আকাশ সত্যি নিরেট একক।মরচে-ইতিহাস দ্যুতিময়
ধ্বস্ত হতে হতে জীবাশ্ম যেটুকু শেষতক…ক্ষয়ে যাও…ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাও
একাকিত্ব অণুবিক্ষণিক…একাকিত্ব বিশুদ্ধ বাসনা।
কিংবা,
জীবন তোমাকে আমি কিনে নেবো ওষুধের দামে;
সে হবে না…অভিনয় ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে
একটি কবিতা তবু অধিক মূ্ল্যবান, নয়?
সম্পর্ক ইনক্রিমেন্ট: পুঁজির বিভ্রম
একলা ইমারত তুমি, খসে পড়ে গোপন পলেস্তারা।
(পরিচয়)
২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতার বই ‘আত্মপ্রকাশ’। এরপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে—ছোটদের বই ‘আমার আকাশ আমার নদী’, ‘জমজদিনের ঘ্রাণ’ (কলকাতা থেকে), ‘বিমূর্ত ইস্তেহার (কাব্যগ্রন্থ)’, ‘Liberalism: A Closer Look’ (অ্যাকাডেমিক প্রকাশনা), ‘মাটির স্বর্গ’ (উপন্যাস), ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘রক্তফুলের দিন’।
মাহমুদ টোকন ‘চিরন্তন’ নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদন করতেন। ‘ভাষাসংখ্যা’ ও ‘শোকসংখ্যা’ শিরোনামে দুটি সংখ্যা আমার সংগ্রহে আছে। কিছু কিছ ভালো কাজ, ভালো উদ্যোগ আড়ালেই রয়ে যায়। ঢাকঢোল তেমন একটা পেটানো হয় না বলে জনসমক্ষে খুব একটা আসেও না। ‘চিরন্তন’ও তেমন একটি পত্রিকা। বিষয়ভিত্তিক ম্যাগাজিন হিসেবে এই সময়ের অন্যতম সেরা একটি প্রয়াস এটি। বিষয়ানুগ লেখা নির্বাচন এবং সংগৃহীত লেখাগুলোর বস্তুনিষ্ঠ পরিবেশনা এককথায় অসাধারণ। আমার এই কথায় একধরনের ঔদ্ধত্য কেউ হয়তো লক্ষ করে থাকবেন। কিন্তু ‘চিরন্তন’ ম্যাগাজিন হাতে পেলে আমার বিশ্বাস মন্তব্যটি অতিশয়োক্তি মনে হবে না।
একদিন ধানমন্ডির অফিসে বসে আলাপের ফাঁকে পরিশ্রমলব্ধ বিষয়ভিত্তিক সংখ্যাগুলো প্রকাশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। জবাবে তিনি বলেছিলেন—‘আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে, একদিন আমি থাকবো না। একজন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ হিসেবে এমন কিছু কাজ করে যেতে চাই, যেগুলো উত্তর প্রজন্মের কাছে দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।’
এছাড়া প্রকাশিত ‘শোকসংখ্যা’ নিয়ে অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘‘চিরন্তন-এর শোকসংখ্যা-২০১৭ করা ছিল আমাদের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি গবেষণামূলক তথ্যভিত্তিক সংখ্যা করা বেশ কষ্টসাধ্য যদিও আমরা সব দিক এই সংখ্যায় আনতে পারিনি সময়, স্বল্প জনবল ইত্যাদি কারণে। তবে আগামীতে এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
আমাদের প্রিয়জন, কবি মাহমুদ টোকন। তার অকাল প্রস্থানে আমরা জানাই কুসুমিত শ্রদ্ধাঞ্জলি।
এই সংখ্যায় অনেক নতুন এবং অজানা তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে। সেইসঙ্গে মুজিবের অবস্থান, তার রাজনৈতিক-দার্শনিক-মানবিক প্রজ্ঞা এবং মহত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলোর সন্নিবেশ ঘটেছে।
তাকে হত্যার পেছনের শক্তি ও কারণের বিষয়টিও চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। লেখক সাংবাদিকেরা বিবিধ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন।
একই সঙ্গে একজন নেতার সমাজতান্ত্রিক ও মুসলিম বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা বিশ্ব-নেতৃত্বে বিরল ঘটনা। সঙ্গে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন তাকে সারাবিশ্বে অভাবনীয়রকম জনপ্রিয় করে তোলে। নির্মোহভাবে আমরা এই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। পুঁজিবাদী ও প্রতিক্রিশীলদের ষড়যন্ত্রের বিষয়গুলো গভীরভাবে দেখা ও চিহ্নিত করার প্রচেষ্টাও ছিল।
যুক্ত করেছি মুজিবের অ্যালবাম ‘রয়েছো হৃদয় জুড়ে’ যা মানুষকে বুঝতে সাহায্য করবে কেন মুজিব সাধারণ উচ্চতা ছাড়িয়ে দীর্ঘতর আকাশছোঁয়া এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বাংলাদেশ এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক-সামজিক সংগ্রামের ইতিহাসে।
চিরন্তন শোকসংখ্যা-২০১৭ পাঠকের জন্য ইতিহাসের এক অনবদ্য সংখ্যা হয়ে থাকবে আশাকরি।’’ (২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ফেসবুকে ওয়াল থেকে)।
মাহমুদ টোকন এখন আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার কর্মতৎপরতা এবং স্বপ্নগুলো রয়ে গেছে। ওই তো স্মৃতির অগণিত বাতায়নে মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে আছেন আমাদের প্রিয়জন, কবি মাহমুদ টোকন। তার অকাল প্রস্থানে আমরা জানাই কুসুমিত শ্রদ্ধাঞ্জলি। ওপারে ভালো থাকুন। সবুজের গালিচায় শান্তিময় হোক আপনার আত্মার পরিভ্রমণ।