‘পাখীতীর্থ দিনে’ কিংবা ‘নদীকূলে করি বাস’ এর কবি মাসুদ খানের দেহ-অতিরিক্ত জ্বর নামীয় গ্রন্থখানা হাতে নিয়ে প্রথমে বিভ্রান্ত হয়ে যাই। নাম দেখে ভেবেছি কবিতার বই। কিন্তু মলাট খুললে জানা যায় এই গ্রন্থখানা কবিতার নয়। লেখক জানাচ্ছেন, ‘কবিতার পাশাপাশি বেশ কিছু লেখা লিখেছি যেগুলি আসলে না-কবিতা-না-কথাসাহিত্য-না-নিবন্ধ-না-জর্নাল…। আবার হয়তো ছুঁয়ে গেছে সবগুলিকেই। সাহিত্যের এই যে নানান জঁর, নানান আঙ্গিক—এদের মধ্যকার ভেদরেখাগুলি ঠিক কী রকম, কিংবা যে অভিন্ন শিল্পত্ব এইসব ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের ভেতর সঞ্চার করে সৌন্দর্য, তার স্বরূপটা আসলে কেমন- সেসবের একটা বোঝাবুঝি, একটা নিরীক্ষার চেষ্টা রয়েছে লেখাগুলিতে। আঙ্গিকের নাম দিয়েছি ‘আলেখ্য’।’
লেখক কথিত এই ‘আলেখ্য’ আসলে ঠিক কবিতার নয়, গল্পেরও নয়, ঠিক প্রবন্ধের বা গদ্যেরও নয়। কবিতা-গদ্যের সমন্বিত কাঠামোর আশ্রয়ে নির্মাণ করা এক ভিন্নার্থিক জগৎ। যে-জগৎ নির্মাণের সবচেয়ে অগ্রগণ্য কবি মাসুদ খান। তারপর চিন্তক মাসুদ খান। এই সমাজের একটি একক অংশের একক প্রতিনিধি মাসুদ খান। ব্যক্তি মাসুদ খান। এতসব মাসুদ খানের সঙ্গে রয়েছে একজন মাসুদ খানের সার্বিক অভিজ্ঞতা, পাঠ, বিবেচনা ও প্রতিক্রিয়া।
কিন্তু এক মাসুদ খানের এতসব পরিচয় বেরিয়ে আসে যে দেহ-অতিরিক্ত জ্বর-এ সে-গ্রন্থখানি পাঠে তাঁর অন্যসব পরিচয় ছাপিয়ে কবি মাসুদ খানের পরিচয়টিই সর্বাগ্রে সামনে চলে আসে। এই লেখাগুলোকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন কবি মাসুদ খানের প্রভাবে অন্যসব মাসুদ খান গৌণ হয়ে যান। তবে এরকম কাঠামোর আশ্রয়ে লেখক একটা বিশেষ সুবিধে আদায় করে নেন। তা হলো যা তিনি বলতে চান তা নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। যখন কবিতা নামীয় কাঠামোর ভেতর থেকে কিছু বলতে চাওয়া হয় তখন একজন কবির মাথায় থাকে তিনি কবিতা লিখছেন। অনেক ভাবনা ও চিন্তা খেলে যায় তাঁর মাথায় কিন্তু ইচ্ছে করলেই তিনি হয়তোবা তা কবিতায় কবিতার মতো করে আনতে পারেন না। ইচ্ছে করলেই এই কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন কোনো কিছু তিনি এখানে জোড়াও লাগাতে পারেন না। ফলে যে ভাবনাটি তিনি কবিতায় বলতে গিয়ে বাধার জন্য বলতে পারছেন না, সে-ভাবনাটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশে তিনি বাধাগ্রস্ত হন। তারপরও তিনি কবিতার কাঠামোয় যখন শেষ পর্যন্ত নিয়ে আসেন, তাঁর ওই ভাবনাটি ততক্ষণে হয়তোবা কবিতার কাঠামোর খোলসে এসে বিকৃত হয় পড়ে। কবিতায় রূপান্তরকরণের এই জটিল বাধা যদি অনতিক্রমণীয় হয় কবির পক্ষে, তাহলে তা প্রকাশহীন থেকে যায়। কিন্তু একজন কবির মাথায় তো অর্থহীন কোনো কিছু খেলে যায় না! সেটা যদি আপাত অর্থহীন মনেও হয় তাও তো প্রকাশের অধিকার রাখে।
কিন্তু কবিতায় রূপান্তরকরণে যদি কবি ব্যর্থ হন, কবিতার সঙ্গে তার ভাবনার যদি যথাযথ মিথস্ক্রিয়ায় ব্যর্থ হন, তাহলে তো কবিতাটিই ব্যর্থ হয়ে যায়। আবার এই ব্যর্থতার দায় যদি কবি এড়াতে চান কবিতাটি না লিখে, তাহলে তো তার ভাবনাটি অপ্রকাশিতই থেকে যায়। এরকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে কবি আসলে মুক্তি নিয়ে নিজের ভাব প্রকাশে এগিয়ে যান। তখন কাঠামোটি গৌণ হয়ে যায়। মুখ্য রূপে হাজির হয় নিজের ভাবনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। মাসুদ খান এই সুবিধেটই নিয়েছেন।
কবি মাসুদ খান কবিতার ক্ষেত্রে সৎ থাকতে চেয়েছেন বলেই এই সব চিন্তা প্রকাশের জন্য আলাদা কাঠামো বেছে নিয়েছেন। কবিতার কাঠামোর ভেতরে নিয়ে এসে যেমন কবিতাকে ভারাক্রান্ত করতে চাননি, তেমনি অনেক বক্তব্য যেগুলো সরাসরি কবিতায় বলা যায় না, সেগুলো বলবার আলাদা ক্ষেত্র তৈরি করেছেন।
উদাহরণ হিসেবে আমরা এখানে দুটি রচনা তুলে ধরতে পারি।
‘সাহাদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। মাথায় মারণকল ঠেকিয়ে বাড়ির লোকজনদের বেঁধে রেখে ডাকাতি করছে ডাকাতের দল। এই বিভীষিকার মধ্যে কোনো এক ফাঁকে সাহাদের আদর-কাড়া হোঁদল কুতকুতে ছোট্ট ছেলেটি আতঙ্কিত হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এসে উঠে পড়েছে ভীষণদর্শন এক ডাকাতের কোলে। আঙুল চুষতে চুষতে ঘুমিয়েও পড়েছে একসময়।
পাড়ায় শোর পড়েছে, ভোর হয়ে আসছে, পুলিশ এসে পড়ছে… এদিকে ভ্যাবাচ্যাকা-খাওয়া ডাকাতটি ঘুমন্ত শিশু-কোলে বসেই রয়েছে নির্বোধের মতো.. সাঙ্গাতরা সব পালিয়ে গেছে সেই কখন…’
ডাকাতি
আরেকটা উদাহরণ
‘বাইরের জগৎ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন একদল জংলি মানুষ গহিন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পথ হারিয়ে হারিয়ে দৈবক্রমে সভ্য মানুষের লোকালয়ে এসে পড়েছে। শিশুর কৌতূহল নিয়ে তারা দেখছে সবকিছু। কী সুন্দর সাজানো-সাজানো ঘরবাড়ি! গাছপালাগুলিও কেমন সাজানো-সাজানো! ফল পেকে আছে গাছে গাছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই আধানাঙ্গা অসভ্য মানুষগুলি বাগানের পেঁপেগাছ থেকে পাকা পেঁপে, টমেটোগাছ থেকে পাকা টমেটো ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খেতে শেুরু করে দিযেছে। এদিকে চেঁচামেচি করতে করতে বেরিয়ে আসছে সভ্য মানুষেরা। তাদের এই চিল্লাচিল্লির কারণ বুঝতে পারছে না অসভ্যরা। তারা বরং উদ্দাম খুশিতে, উল্লাসে-ইঙ্গিতে সভ্যদেরকেও ডাকছে সেই আনন্দময় ফলাহরণ ও ফলাহার উৎসবে শরিক হতে। কিন্তু সভ্যরা এসেই বেধড়ক মারতে শুরু করে দিয়েছে। মার খেতে-খেতে জংলিরা করুণ ও বিস্ময়বিস্ফার চোখে তাকাচ্ছে বার বার সভ্য-সুশীল মানুষদের মুখের দিকে। বুঝতে চেষ্টা করছে, কী কারণ হতে পারে সভ্যদের এই অস্বাভাবিক আচরণের। বুঝতে পারছে না।
সভ্য ও অসভ্য
ডাকাতি ‘আলেখ্য’টি কবিতা হিসেবে পাঠ করলে রচনাটির কোনোই অমর্যাদা হয় না। কারণ রচনাটিতে কাব্যগুণের কোনোই ঘাটতি নেই। বাহিরের কাঠামোটিতে হয়তোবা আক্ষরিক অর্থেই আলেখ্য রয়েছে, রয়েছে গল্প। কিন্তু এই আলেখ্য বা গল্পের সারোৎসার কোনোভাবেই কাব্যমূল্যকে নিচে নামিয়ে আনে না। ফলে মাসুদ খান কথিত না-প্রকরণিক অনেকগুলো উক্তির বিপরীতে গিয়ে বলাই যায়, ডাকাতি রচনাটি আসলে কবিতাই।
কিন্তু ‘সভ্য ও অসভ্য’ আলেখ্যটিকে কবিতা বলা যায় না। এখানেও আক্ষরিক অর্থেই আলেখ্য রয়েছে। গল্প রয়েছে। কিন্তু তা কবিতার আড়ালের গল্প হয়ে ওঠেনি। কবিতার ভেতরে নিহিত সহজাত গতিরও অভাব রয়েছে এখানে। কিন্তু যে আলেখ্যটি তিনি লিখেছেন তা যেন সভ্যতার সংজ্ঞার নিরিখে নির্ধারিত সভ্য ও অসভ্যের পাঠাতীত ব্যকরণ। সভ্যরা যা করছে তা তাদের জগৎ ও অভিজ্ঞতা থেকে সঠিক। প্রতিরোধ ব্যবস্থার আইনি প্রক্রিয়া না মেনেই তারা বেধড়ক পেটাতে শুরু করছে অসভ্যদের। কিন্তু অসভ্যদের কাছে সভ্যদের এই আচরণটাই অসভ্য। কারণ তাদের অভিজ্ঞতার নিরিখ দিয়ে তারা বিচার করছে। এখন দুই পক্ষকেই যদি ঠিক বলি তাহলে যে ঘটনাটা ঘটলো তাকে ঠিক বলি কী করে? ফলে দেখা যাচ্ছে দুই পক্ষের কাছেই তাদের অন্যপক্ষের আচরণকে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কেউ কাউকে বুঝতে পারছে না।
এই রচনাটিকে যদি সভ্য ও অসভ্যের তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে ধরি, তাহলে এর একটা প্রয়োগিক চিত্র তুলনা করা যায় আমাদের বর্তমান রাজনীতির সঙ্গে। এখানে যে দুটি পক্ষ দৃশ্যমান তা প্রতীকের আড়ালে আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মনে করিয়ে দেয়।
মাসুদ খান এই রচনার কাঠামোর মাধ্যমে দেখাতে চাইলেন কবিতার কাঠামোর বাইরে এসে প্রতীকের সাহায্যে কিভাবে বক্তব্য তুলে ধরতে হয়।
কবিতায় চিন্তা থাকে। চিন্তার প্রতিফলনও থাকে। চিন্তাটা যদি দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়ে তখন কবিতাটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদি চিন্তাটা দর্শনের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে, কবিতার সঙ্গে আত্মিকভাবে মিলে যায় এবং কবিতা-কাঠামোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠে—তখন কবিতা অধিকতর গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। সমকাল তো বটেই। দূরকালেও এগুলো আলোচিত হয় কারণ এগুলো একমুখী নয়। বহুমুখী। ক্লোজ এন্ডেড নয়। ওপেন এন্ডেড। কবিতার ভেতরে এ রকম উপাদানের সমাবেশ থাকলে পাঠকও কবিতার ভাবনার সঙ্গে, কবির ভাব জগতের সঙ্গে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।
দেহ-অতিরিক্ত জ্বর-এর লেখাগুলোর শরীর ও আত্মায় এই সব উপাদানের মাসুদ খানীয় প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। এসব করতে গিয়ে তিনি একটি বিশেষ ধারাপদ্ধতির দ্বারস্থ হয়েছেন। যেমন তিনি প্রথমে সাধারণের চোখ দিয়ে দেখা শুরু করেন। তারপর সে-চোখটি আর সাধারণ থাকে না। হয়ে ওঠে কবির চোখ। কিন্তু পরক্ষণেই কবির চোখও এখানে স্থির না হয়ে, হয়ে ওঠে সন্দেহপ্রবণ পর্যবেক্ষণের উদগাতা।
এভাবে সরল চোখ, কবির চোখ এবং ধনাত্মক চিন্তার উদগাতা হিসেবে সন্দেহপ্রবণ চোখের সম্মিলন ঘটে। এসবের সংশ্লেষে পথমে যা উঠে এসেছে তা হলো সরল চোখের প্রচলিত ধারণার প্রশ্নবিদ্ধ রূপ। কবির চোখ সরল চোখকে নিয়ে যখনই সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছে তখন দার্শনিক উপলব্ধিরও শুরু হয়েছে। পার্থক্য হলো এই দার্শনিক উপলব্ধি কবিকে নিয়ে যুগল হয়েছে। কখনো কবির চোখ দার্শনিক চোখের ওপর প্রভাবিত করেছে, কখনো দার্শনিক চোখ কবির চোখকে শাসন করেছে।
এইসব বহুমুখী প্রভাবের মিথস্ক্রিয়ায় দেহের জ্বর বেড়ে গেছে। হয়ে উঠেছে কবিতারিক্ত কাব্যময় দর্শনের খেল।