ক.
ঠিক কবে থেকে, কেমন করে মহীবুল আজিজকে চিনি, আজ আর মনেই করতে পারছি না। কেবল মনে আছে, ৮২-৮৩ সালের দিকে (৮২ সালে আমি এস.এস.সি, পাস করি) আমরা একদল জেদিতারুণ্য ‘ক’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলি। এই দলে মহীবুল আজিজ, আবু মুসা চৌধুরী, এজাজ ইউসুফী, হাফিজ রশিদ খান, সুমন ইসলাম, আহমেদ রায়হান, আসাদ মান্নানের মতো আরও ৫/৬ জন কবি ছিলেন। যদ্দুর মনে পড়ে, মহীবুল ভাইকে সংগঠনটির কোষাধ্যক্ষ করা হয়েছিল। এরপর সারা চাটগাঁ শহরজুড়ে ‘ক’-এর কত কত অনুষ্ঠান! প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলাম আমি।
আসাদ মান্নানের “পা দু’খানা দেখতে দেখতে” কবিতাটি ওই সময়ই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। লালদিঘির তালসুপারির মাঠে চলতো আমাদের তুমুল আড্ডা। নভেলটি রেস্তোরাঁ, বোস ব্রাদার্স, সবুজ হোটেল, মুসলিম হল, শহিদ মিনার–সর্বত্র ছিল কবিতাময়। মহীবুল আজিজ আমার চেয়ে ৪/৫ বছরের বড় ছিলেন। সেই সম্পর্কটি দেখা-অদেখার ভেতর আজও অক্ষুণ্ন রয়েছে। আশির দশকের সেই কবিতাযাপন নিয়ে অন্যত্র আমি দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করেছি। আজ সেই পথে যাবো না। ছাত্র হিসেবে মহীবুল অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন–এই কথা প্রায় সকলেই জানেন। কবি মহীবুল আজিজ কবিতার পাশাপাশি ধীরে ধীরে গল্পকার এবং প্রাবন্ধিক মহীবুল হয়ে উঠতে থাকেন এবং একেবারেই ভিন্ন ঘরানায়।
অত্যন্ত মেধাবী, সৃজনশীল কিন্তু অসচ্ছল এই বন্ধুটির সঙ্গে মহীবুল ভাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন গল্প-কবিতা-সিনেমা বিষয়ে (এক সময় বন্ধুটি লেখাপড়া ছেড়ে দেয়, শুনেছি সে এখন কোর্ট বিল্ডিংয়ে চাকরি করে)। রুচির মিল হলে বন্ধুত্বে কোনো বাধা নেই মহীবুলের
আমাদের দুজনের রাজনৈতিক আদর্শও এক ছিল। ১৯৮৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন (বর্তমানে তিনি বাংলা বিভাগের সভাপতি)। তাঁকে আমি বিভাগে বড়ভাই এবং শিক্ষক হিসেবে পাই। ১৯৮৬ সালে দুলাল দাশ গুপ্ত, বিশ্বজিৎ চৌধুরী আর প্রলয় দেব–তিনজন মিলে নজির আহমদ সড়কে একটি প্রেস চালু করেন। দীর্ঘদিন –প্রায় ৭/৮ বছর আমাদের কবিবন্ধুদের আড্ডার একটি মহাফেজখানা ছিল এটি। এখান থেকেই মহীবুলের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘গ্রামউন্নয়ন কমপ্লেক্স ও নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ’ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটির প্রচ্ছদ কবি খালিদ আহসান করেছিলেন। গ্রন্থটির জন্মের প্রতিদিনের উষ্ণতা, স্বপ্ন আর কথামালা অন্য দিনের জন্য জমা রইলো। প্রায় সমসাময়িক কালেই তাঁর অসাধারণ গবেষণাকর্মটিও গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে দেন আমাদের আরেক কবি বন্ধু ইব্রাহীম আজাদ (আমার জানা মতে তাঁর একটি মাত্র কবিতাগ্রন্থ বেরিয়েছিল –“যখন মুছে গেলো দিগন্ত রেখা” নামে –আমি সেসময় পত্রিকায় বইটির ওপর আলোচনা করেছিলাম)। গুটেনবার্গ আমারও প্রথম বইয়ের মুদ্রক। মহীবুল ভাই দুটো বইই শুভেচ্ছা লিখে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।
স্বৈরাচারী সামরিকজান্তা এরশাদের পতনের আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে। সংস্কৃতিকর্মীদের একজোট করে আন্দোলন বেগবান করার প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯৯০ সালের ২৬ নভেম্বর গড়ে উঠলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। যুগ্মভাবে শিক্ষক মহীবুল আজিজ ও আমি আহ্বায়ক নির্বাচিত হলাম। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সের ছাত্রী। রাজনীতি, নাটক, কবিতা–সব নিয়ে তুমুল ব্যস্ততা আমার। এরকমই এক ব্যস্ত দিনে ক্যাম্পাসে অশোক বড়ুয়া (সভাপতি, চ.বি. ছাত্র ইউনিয়ন) এসে বললেন, তোমার সব কাজ বাদ দাও –মহীবুল ভাই চিঠি দিয়েছেন, পড়ে দেখো। একটা বড় প্যাডে মহীবুল ভাইয়ের টানা সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা–শেলী–শহিদ মিনারে (বিশ্ববিদ্যালয়ের) এখনই (তখন সকাল ১০:৩০ বাজে) একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। নীলু ভাই (কামাল উদ্দীন নীলু স্যার) এস এম সোলায়মানকে নিয়ে আসছেন। আলোচ্য বিষয়–‘স্বৈরাচারের পতনে সংস্কৃতিকর্মীর ভূমিকা’। খুব কষ্টে মাইকের বন্দোবস্ত করলাম। গলা ফাটিয়ে মাইকে ঘোষণা দিতে লাগলাম।
মহীবুল ভাই বললেন –‘নীলু স্যার অনুপম স্যারকে ডাকবেন, আমি অন্য কাকে কাকে আনতে পারি দেখি।’ একে একে সৌরেন বিশ্বাস, ওয়াসী স্যাররা এলেন। কোনো দর্শক-শ্রোতা নেই। অন্য দিকে, শিবিরের মিছিল চলছে। দুই তিন ঘণ্টা সারা বিশ্ববিদ্যালয় তন্ন তন্ন করে কোথাও নীলু স্যার বা এস এম সোলায়মানকে পাওয়া গেলো না। মহীবুল ভাই বললেন, ‘শেলী, ঘোষণা দেন অনিবার্য কারণে…।’ আমি বললাম, ‘না ভাই, আপনি দেন, আপনার কথার গুরুত্বই বেশি।’ তিনি বললেন, ‘এক কাজ করুন, মাইক ফেরত দিয়ে দিন, ঘোষণা ছাড়াই চলে যাই।’ চলে গেলাম।
আরেকবার বাংলা বিভাগে হাসান আজিজুল হক আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এলেন মহীবুল ভাইয়ের উদ্যোগে। অসাধারণ বক্তব্য রাখলেন তাঁরা। ‘বাংলা উপন্যাসের সংকট’ বিষয়ে। মহীবুল ভাই অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন। আমার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হলো তাঁদের।
মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, সৃজনশীল হলেই মহীবুল আজিজের সঙ্গে যে কারুর বন্ধুত্ব হয়ে যেতো, বয়সের তফাত যাই থাকুক না কেন। খোকন নামের আমার এক সহপাঠী ছিল। অত্যন্ত মেধাবী, সৃজনশীল কিন্তু অসচ্ছল এই বন্ধুটির সঙ্গে মহীবুল ভাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন গল্প-কবিতা-সিনেমা বিষয়ে (এক সময় বন্ধুটি লেখাপড়া ছেড়ে দেয়, শুনেছি সে এখন কোর্ট বিল্ডিংয়ে চাকরি করে)। রুচির মিল হলে বন্ধুত্বে কোনো বাধা নেই মহীবুলের। তিনি একটি লিটলম্যাগও সম্পাদনা করতেন।
এরপরের গল্প –মহীবুল আজিজ ধীরে ধীরে আরও বেশি মহীবুল আজিজ হয়ে উঠতে থাকেন।
খ.
আমাদের কথাসাহিত্য কী মরে যাচ্ছে? কিছুদিন আগেও এরকম একটি সংকট মিয়ে সরব ছিল আমদের সাহিত্যাঙ্গন। বোধকরি, আজ আর সেটি ততটা ভাবিত করে না সাহিত্যবোদ্ধাদের। কারণ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চল্লিশের দশকে কথাসাহিত্যের যে অভিনব দরোজাটি খুলে দেন, তা এত তীক্ষ্ণ, বহুমাত্রিক, অতলপ্রসারী যে, ক্রমাগত ঘাতপ্রতিঘাতে চরিত্র এবং পাঠক নিজের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে ধস্তবিধ্বস্ত হতে হতে তার অস্তিত্বের নিগূঢ় রহস্যে নিজেই (এবং পাঠকও) আক্রান্ত-বিহ্বল হয়ে পড়ে। আমরা দেখি পূর্বেকার ধারাপথ বদলে কিভাবে বিশ্বমানের একটি সাহিত্যের পথ তৈরি করেন তিনি, মাত্র তিনটি উপন্যাসে। এর মধ্যে ‘চাঁদের অমাবশ্যা’তো বিশ্বসাহিত্যে আজও মাস্টারপিস। পরবর্তী সময়ে পঞ্চাশের দশকের কয়েকজন লেখকের কথাসাহিত্যেও গ্রামমনস্কতা এবং চরিত্রের সমাজ ও সময়ের সঙ্গে বোঝাপড়ার মর্মযাতনাদীর্ণ চিত্র আমরা পাই। শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবু ইসহাক, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী –এরকম আরও কজন সাহিত্যিক গ্রামজীবনের ছবি, চরিত্রের অন্তগূঢ় রহস্য টানাপড়েনে মনোবীক্ষণ করেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আন্তর্জাতিক মানের সেই জটিল জীবন যন্ত্রণাক্লিষ্ট, জিজ্ঞাসাদীর্ণ প্রতীকী সমাজ ও মনোদর্পণের পথে উজ্জ্বল রেখায় দেখা দিলেন হাসান আজিজুল হক।
আশির দশকের গোড়া থেকে যে কয়জন লেখক স্বতন্ত্র ধারায় অগ্রসর হন, তাঁদের মধ্যে মহীবুল আজিজ অন্যতম। যে প্রজ্ঞা আর স্টাইল তাঁর গল্প উপন্যাসের অঙ্গবুননে ব্যবহৃত হয়েছে তা জনপ্রিয় সাহিত্যের ধারা নয়। ফলে সাধারণ পাঠকের জন্য মহীবুলের গদ্য সবসময় স্বস্তিদায়ক নয়। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘গ্রামউন্নয়ন কমপ্লেক্স ও নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ’-এর প্রুফ দেখার সময়, তার আগে ও পরে বেশ কবার পাঠ করার সুযোগ হয়েছে আমার। সে সময়ই এ গ্রন্থের ভাষার বুনন আর ভঙ্গিপ্রকরণ আমাকে আশান্বিত করে তুলেছিল। এই বইয়ে পরবর্তী গ্রন্থের নাম ছাপানো হয়েছে –‘মহারাজার গৃহপালিত পশু ও অনান্য গল্প’। যদিও এই নামে কোনো গ্রন্থই আজও আমরা পাইনি। আজ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলো হচ্ছে ১. গ্রামউন্নয়ন কমপ্লেক্স ও নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ ২. দুগ্ধগঞ্জ ৩. মৎস্যপুরাণ ৪. আয়নাপড়া ৫. বুশ ম্যানের খোঁজে ৬. নীলা মা হতে চেয়েছিল ৭. মুক্তিযুদ্ধের গল্প। দুইটি উপন্যাস ‘বাড়ব এবং যুদ্ধজোড়’।
এছাড়া কবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণা, অনুবাদের বইও রয়েছে তাঁর। মহীবুলের বেশিরভাগ গল্পই স্বল্পায়তনের। কিন্তু তার তলেই লুক্কায়িত অতলান্তিক এক জীবনবিভা। তিনি এই সমাজেরই আপাতসধারণ কিছু ঘটনাকে অসাধারণ করে তুলতে গিয়ে মানুষের জটিল, কৌতূহলী, দ্বন্দ্বদীর্ণ স্বভাবের বয়ানে অতন্ত্য মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন। অতি তুচ্ছ একটি বিষয় নিয়ে খেলতে গিয়ে পাঠককেও খেলিয়ে নিয়েছেন। “আলী তারপর সেই জরুরী কথাটি উত্থাপন করে। জনতা সবসময়ই ব্যাতিক্রম চায়, উত্তেজনা চায় এবং এক ধরণের অস্বাভাবিকতা চায় যা তাদের মধ্যে আগ্রহের জন্ম দেয়। আলীই বিষয়টি নির্ধারণ করে যে আগামীকাল ভোরবেলা জনসমাগমের সামনে সে খাদেমের অর্জিত ডিম বিষয়ে একটি সুন্দর গল্প রচনা করবে। খাদেম প্রথমত মিথ্যেকে সায় দিতে না পারলেও আলী যখন জনতার আগ্রহ ও অর্থাগমের প্রশ্নটি চোখের সামনে দেয়াল করে তুলে দিলো খাদেমকে মাথা নাড়তে হল। মাথা নাড়াটি মাটির সঙ্গে সমান্তরাল নয়, ছিল লম্বালম্বিভাবে।” (দ্বীপবাসীদের গল্প)
প্রায় প্রতিটি গল্পেই মহীবুল সময়কে ত্রিমাত্রিক ভঙ্গিতে ধরতে চেয়েছেন। মহীবুলের চরিত্ররা সময় এবং ঘটনার চাপে পিস্ট হয়ে কাহিনির বৃত্তে পাঠককে সংশয়াকুল করে তোলে। সে ক্ষেত্রে তাঁর টান টান ভাষার বুননটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। আরেকটি উদাহরণ দেই –“ইতোমধ্যে পুনঃপুনঃ গমনাগমনের প্রতিক্রিয়ায় সে ক্লান্ত, বিপন্ন। নির্বিকার উদ্যোমহীন সে তাকিয়ে ছিলো বামহাতী ঝোপ্টার দিকে। সমস্ত শরীর নিংড়েও যখন আশানুরূপ উদগম ঘটে না খাদেম যারপর না বিরক্ত ও চিন্তিত হয়ে পড়ে। বিরক্ত- এই আসা যাওয়র পালা আর কতক্ষন ধরে চলে। চিন্তিত -তাহলে তার কপালের লিখন কি আছে! তার ভাগ্যে কোন দুর্ঘটনা লেখা নেই তো! কে জানে! তখনই একবার সেই জিনিসটার দিকে তাকাতে পরশু দিনের ঘটনা মনে পড়ে এবং মুহূর্তেই ঐ ঘটনা ভুলে গিয়ে ফিরে আসে বর্তমানে”। (দ্বীপবাসীদের গল্প)
এইভাবে অসাধারণ এক দৃশ্যকল্পের ভেতর দৃশ্যহীন অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের মার্কেজীয় চিন্তনটি তিনি করেছেন আশির দশকে যা আজ বহুল চর্চিত। কোনও কোনও গল্পের টোটকা, ঝাড়ফুঁক প্রেসক্রিপশন অথবা ঘটনার বর্ণনা রিপোর্টিং আক্রান্ত নিরস হয়ে উঠেছে এ কথা বললেও দোষ হবে না। তবে তাঁর প্রায় সব গল্পগ্রন্থ পাঠান্তে আমার এই বোধ জন্মে যে এটি মহীবুলের একটি নিজস্ব ধাঁচ। মামুন হোসাইন অথবা মনিরা কায়েসের চেয়ে এ ক্ষেত্রে তাঁর গল্প অনেক মিতবাক। উইট আর প্রতীকে কথা বলা তাঁর একটি সহজাত প্রবণতা। শ্রেণি সচেতন মহীবুল আজিজ গ্রাম, মফস্বল এবং নগর কেন্দ্রিক মানুষের দ্বন্দ্বজর্জর, জিজ্ঞাসাদীর্ণ, আত্মউন্মোচক যে ব্যাপক জীবনযাপন ও দর্শন আমাদের সামনে সংবেদী ভাষায় রূপায়ন করেন তা পাঠান্তে পাঠক খুব একটা স্বস্তিতে থাকতে পারেন না –এক হাহাকার ছাড়া।
এই আপাতসরল চরিত্রগুলোর অতলান্ত রহস্য, দ্বন্দ্ব, হৃদয় সংবেদ পাঠককে এই পরিচিত গ্রাম বাংলার অথবা নগরের জীবন বিচিত্রা অতিক্রম করে এমন এক মনোরাজ্যে নিয়ে দাঁড় করায় যেখানে পাঠক অন্তহীন এক সংঘাতে বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হতে থাকেন।
গোয়েন্দা রিপোর্টিংয়ের ধাঁচে লেখা ‘নৃতাত্ত্বিক’ গল্পটিও সার্থক হয়ে উঠতে পেরেছে –যদিও গল্পটির টান একমুখীন। তবু মানুষের গড়া যে রাষ্ট্র, সেই রাষ্ট্রই মানুষের জীবনকে কীভাবে অনিরাপদ করে দেয় –তারই চিত্র উঠে এসেছে ছোট্ট একটি খুনের ঘটনায়। এই গল্পটির কাব্যিক বর্ণনার বহু উদাহরণ টানা যায়। আমি শুধু গল্পের কাসেদ নামক এক রাজনৈতিক কর্মীর বিষয়ে লেখকের বর্ণনায় দুটি লাইন তুলে ধরছি “হাতুড়ি পেটায় বুঝি কেউ দড়াম দড়াম! একবার তাকায় পেছনে একবার উপরে আধভাঙ্গা চাঁদের দিকে। তারপর এই কার্তিক মাসের সান্ধ্যোত্তর ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়ায় শুষ্ক ঠোঁট ক্ষুধার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে যুগপৎ সে দুটি রেখা লক্ষ্য করল বালিতে”। লেখক একটি মুহূর্তকে বা একটি বিন্দুকে ঘিরে তাঁর গল্পের বৃত্ত তৈরি করেছেন। ১৯৮৬ সালে রচিত এই গল্পটি তৎকালের সামরিক রাষ্ট্রের কথা মনে করিয়ে দেয়।
মহীবুল আজিজের প্রতিটি গল্পগ্রন্থে অন্তত একটি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক গল্প থাকে –যার শুরু তাঁর প্রথম গ্রন্থ থেকেই। প্রথম গ্রন্থের নাম গল্পটিতেও মুক্তিযুদ্ধোত্তর শহিদ জননীর ব্যথাদীর্ণ এক করুণ উপাখ্যান পাই আমরা। বেরিয়ে এসেছে এদেশীয় সুবিধালোভীর মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঘৃণ্যচিত্র। স্বামীহারা একজন অসহায় শহিদ জননী সমাজের দুষ্টচক্রের হাতে কীভাবে নিজের শেষ সম্বলটুকুও হারিয়ে ফেলে এবং রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষিত গ্রাম উন্নয়ন কমপ্লেক্সের কর্মীদের স্বার্থের শিকারে পরিণত হয় –তার করুণ কাহিনি এই গল্প। গল্পের বয়ান বুনন এবং সংযম, সমাজবীক্ষা আর সাহসিকতা আশির দশকেই অগ্রসর পাঠকের নজর কেড়েছে। নবিতুনের সন্তান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছে। তার স্বামী দিনের পর দিন ধুঁকে ধুঁকে মরেছে। কেউ খোঁজ রাখেনি। অথচ আজ সরকারের লোক এসে একশত টাকার নোট বের করে দিয়ে বলছে –“আমরা সরকারের লোক”“তোমার স্বামীর রেখে যাওয়া জমিতে চাষ দেওয়া হবে সরকারি খরচে। ফসলের মালিক তুমি” তারপর তারা টিপসই নিয়ে যায়।
সরকারি অনুষ্ঠানে নবিতুনের খাওয়ার বর্ণনাটি কী অসাধারণ! –“একটি ভাঙাচোরা বাক্সে যেমন করে ঘরের সমস্ত কাপড় চোপড় ঢোকাবার চেষ্টা করেছিল একদিন মধ্যরাতে নবিতুন প্রথম গুলির শব্দ শুনে, বহুদিন পর আজ তেমনিভাবে বেছে বেছে উপাদেয় খাদ্যে পেটটি ভরাল খুব করে”।
কোনও কোনও গল্প পাঠ প্রচল ধারায় নয় বিধায় পাঠক বিরক্তির শিকার হবেন। কিন্তু মহীবুলের গল্প নিবিড় পাঠ দাবী করে।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘হোমো সেপিয়েন্স’ গ্রন্থের আরেকটি উজ্জ্বল গল্প। অত্যন্ত চমৎকারভাবে ম্যাজিক রিয়ালিজমে আক্রান্ত পটভূমিতে সময় এবং চেতনাপ্রবাহকে ধারণ করেছেন তিনি বহুবিস্তারি দুয়ারে। গল্পের একেবারে শেষ স্তবকটি এরকম -“আজও মা মেয়েকে শোনায় গল্প। সে গল্পে বর্তমান বলতে কিছুই থাকে না। ভবিষ্যৎ বহু আলোকবর্ষ দূরে। কেবল অতীতের ঢাকনা খুলে যায় আর সেখান থেকে মানুষেরা অন্ধকার ফুঁড়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে বিচিত্র সব অবয়ব আকৃতি নিয়ে। ফরিদা তনিমাকে রিপভ্যান উইংকেলের গল্প শোনায়।”
অন্যদিকে ‘অপারেশন’ গল্পটিও মুগ্ধ করবে পাঠককে। এমন স্বাদু এর ভাষা –মাত্র সাড়ে চার পৃষ্ঠার এই গল্পটি মানসিক সমস্যার অত্যন্ত ইতিবাচক একটি সমাধানে শেষ হয়েছে। কাহিনিটি একমুখী হলেও আনন্দদায়ক। একজন মানুষ মেন্টাল ডিসঅর্ডারে চলে গেলে কীভাবে তার চিকিৎসক তাকে বিভ্রান্তিমুক্ত করেন –তার অনবদ্য কাহিনি এই গল্প।
আত্মউন্মোচক, বিশ্লেষণীবোধের সাথে সূক্ষ্ম রসবোধ তাঁর সহজাত। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং যোগাযোগ রক্ষা করা যে অত্যন্ত জটিল একটি বিষয় –মহীবুল তা জানেন। এই আপাতসরল চরিত্রগুলোর অতলান্ত রহস্য, দ্বন্দ্ব, হৃদয় সংবেদ পাঠককে এই পরিচিত গ্রাম বাংলার অথবা নগরের জীবন বিচিত্রা অতিক্রম করে এমন এক মনোরাজ্যে নিয়ে দাঁড় করায় যেখানে পাঠক অন্তহীন এক সংঘাতে বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হতে থাকেন। তিনি মানবজীবনের গভীর পর্যবেক্ষক। তাই সম্পর্কের হাত ধরে আন্তঃসম্পর্কে পৌঁছে যাই আমরা। এ কারণেই মহীবুল আজিজের গল্প একপাঠে ফুরিয়ে যায় না। এখানেই তাঁর মহত্ত্ব।