আমাকে ইটনের লেখা পড়তে আগ্রহী করেন যে মানুষ, তিনি ফোকলোরেও আগ্রহী করেছেন। জহর সরকারের লেখা; বলেছেন, মন দিয়ে অনুধাবন করবে। ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ। পড়তে ভালোবাসি। ওঁর ভয়ে আরও পড়তে হতো। বকতে পারেন, এটা পড়োনি। কী যে করো! প্রতি সপ্তাহে ফোন আসতো। কোনো বইয়ের খোঁজে। অথবা মৃদু ধমক। সমাজসেবা বেশি করছ। ওই কাজ করার লোক আরও আছে। লিখতে পারো। লেখো। পড়ো। গবেষক হিসেবে লেখাও খুব দরকার। খুব দরকার।
২৫ মার্চ শেষ কথা। বললাম, বেরোবেন না। বললেন, কাল একটা সভা আছে। বাংলা একাডেমিতে। তারপর আর যাবো না। সেদিনই অসুস্থ।
বিচিত্র বিষয়ে পড়তেন। ১৫ মার্চ বললেন, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমলকুমার ও আধুনিক কবিতা নিয়ে বইটা পাও কিনা দেখো তো। অনেক খুঁজলাম। পেলাম না। রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমলকুমার মজুমদার বিশ্লেষণে আগ্রহী। ২২ মার্চ বিদ্যাসাগর বিষয়ে একজনের লেখা পড়ে বললেন, আলোচনাটা ঠিক হয়নি। তুমি দেখো তো। আমি বিদ্যাসাগরের প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি পাঠালাম, অন্ধকূপ হত্যা নিয়ে। পরের দিন বললেন, ঐতিহাসিক গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের দুটো বই দেখা জরুরি। একটা বই নেটে পেলাম। পাঠিয়ে দিলাম।
পাঠক দেখবেন, ২২ থেকে ২৫ মার্চ বিদ্যাসাগর নিয়ে কিছু নতুন তথ্য পেশ করেছিলেন। কিছুদিন আগে সবাইকে চমকে দিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় করোনা নিয়ে লিখেছেন বলে। আমি কেন অনেকেই প্রথম জানলেন। তাঁর রঙ্গসমগ্র বই রাখি মাথার কাছে মন ভালো করতে। শিখতে।
আমার প্রিয় অভিভাবকদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কে শাসন করবে, ফোন করে। লেখো। লেখো। চার জন মানুষ আমার পিতৃসম। দুজন চলে গেলেন। বৈশাখ বড় নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। আমার প্রিয় মাস আর কত কষ্ট দেবে?
তিনি তার জ্ঞান, গরিমা, প্রজ্ঞা, সামাজিক চিন্তা, লোকজীবন নিয়ে হয়ে উঠেছিলেন মনীষা ব্যক্তিত্ব। নিজেকে ছাপিয়ে নিয়ে গেছেন অভ্রংলিহ উচ্চতায়।
২০১৩ সেপ্টেম্বর। তখন আমার বাবা খুব অসুস্থ। হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। কিন্তু চিন্তা অনেক। এইসময় প্রাণতোষদা বলেন, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক এসেছেন। আলাপ করা দরকার। আমি এড়িয়ে গেছি। সামনে যেতে চাইনি। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। কেমন রাশভারী মানুষ হবেন। প্রাণতোষদা বলছিলেন, ইনি অন্যরকম মানুষ। কলকাতায় ডাক্তার দেখাচ্ছেন রুবিতে। প্রাণতোষদা নিয়ে গেলেন। বললেন, আমি দুদিন কলকাতায় থাকবো না। আপনি যদি একটু সময় দেন।
কথা বলে অভিভূত। পরদিন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন বলতে। তারপর দিন হার্ট ক্লিনিকে ডাক্তার দেখানো। হাত নিয়ে খুব চিন্তিত। লিখতে পারছেন না। আর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে ডাক্তার দেখিয়ে বললাম, চিন্তা ছাড়ার একটা উপায় আছে। আমি বললাম, পরে বলছি। বেরিয়ে এসেছি। সামনে একটা বাস। বললাম, উঠে আসুন। একটু দ্বিধা নিয়ে উঠলেন। বললেন, ৪০ বছর পর লোকাল বাসে। নামলাম। নেমে চা খাওয়ালাম। ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে। মানে ইটের বেঞ্চে বসে রাস্তার চা দোকানে। তিনি বললেন, তুমি তো আমাকে ছাত্রজীবনে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে। মজার ছেলে তো। এরপর বাজার। আমি ইলিশ কেনায় ঠকতাম। তিনি ইলিশ কেনা চেনালেন। এরপর দুপুরে আমার আবাসস্থলে তিনি আর বেলাল চৌধুরী একসঙ্গে খেয়ে গেলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি।
ডাক্তার ক্ষেত্রমোহন দাস, ফিজিক্যাল মেডিসিনের ডাক্তার। পরদিন গেলাম তার পছন্দের হোটেলে। কথা হলো পড়াশোনা নিয়ে। পড়াশোনার ব্যাপ্তিতে মুগ্ধ। বিচিত্র বিষয়ে পড়াশোনা। মহাদেব প্রসাদ সাহাকে দেখেছি। আলাপ হয়নি। ভয়ে। আর দুজন পড়ুয়া পণ্ডিত দেখেছি, সৈয়দ শাহেদুল্লাহ ও তরুণ সান্যাল। তৃতীয় জন শামসুজ্জামান খান। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ যাওয়া। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে বলতে। বাংলা একাডেমিতে। তার সূত্রেই আলাপ কিছু প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে। মাজহারুল ইসলাম, ওসমান গনি, অনন্ত উজ্জ্বলদের সঙ্গে। বাংলা একাডেমির বহু মানুষ স্বজন হয়েছে তার সুবাদে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে দেখার সেতুও তিনি। সূত্র ফরিদ আহমেদ। বাংলাদেশ বইমেলা সোহরাওয়ার্দী প্রাঙ্গণে করার পেছনে ছিল তার ভূমিকা।
বিচিত্র বিষয়ে তার পড়াশোনা। ফোকলোর বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস তুলে ধরতে উদ্যোগ নেন। গোলাম মুরশিদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’ এক ঐতিহাসিক দিকনির্দেশী কাজ। এছাড়া ‘প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ’ এক নতুন পথের চিহ্নবাহী। সুরসিক মানুষ। ‘বাংলাদেশের রঙ্গসমগ্র’ রসিক বুদ্ধিমান বাঙালি জাতিকে চিনতে ও বুঝতে সহায়ক। বঙ্কিম ত্রুটিবিচ্যুতিসমেত একজন অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ লেখক, বিশ্বাস প্রগাঢ় ছিল তার।
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে তার আগ্রহে পরিপূর্ণ সভাস্থলে আমি এই বিষয়ে বক্তব্য পেশ করি। সভাপতিত্ব করেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। বাংলাদেশ-ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াকিবহাল এই মানুষ চাইতেন উপমহাদেশ হোক ধর্মনিরপেক্ষ। ক্রিকেট নিয়ে কিশোরসুলভ উচ্ছ্বাস ছিল। বাঙালি জাতির জনক শেখমুজিবুর রহমানের ভক্ত এই মানুষ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের কথা বারবার বলতেন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়া চীন’ প্রকাশে রাতদিন কাজ করেছেন।
কলকাতা বইমেলায় এলেই খোঁজ করতেন নতুন নতুন বইয়ের। ২০২০ সালৈ শেষ আসা কলকাতায়। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের একটা ভালো জীবনীর খোঁজে বহু স্টলে ঢুঁ মেরেছি দুজনে। গোলাম মুরশিদ ও বেলাল চৌধুরীকে নিয়ে আলাদাভাবে এসেছেন আমার বাসস্থলে। আড্ডা হয়েছে বহু। ২০২০ সালে বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক হলেন কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী। তার সঙ্গে এক জায়গায় ছিলেন। দেখেছি পরস্পরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক। যা আজকের দিনে বিরল নজির।
আমার পিতার মতো অভিভাবক ছিলেন। তাকে সালাম ও শ্রদ্ধা। তিনি তার জ্ঞান, গরিমা, প্রজ্ঞা, সামাজিক চিন্তা, লোকজীবন নিয়ে হয়ে উঠেছিলেন মনীষা ব্যক্তিত্ব। নিজেকে ছাপিয়ে নিয়ে গেছেন অভ্রংলিহ উচ্চতায়।