আমরা অতিক্রম করছি এক ভয়াল সময়। আমাদের অসাম্প্রদায়িক জাতীয় অনুষ্ঠানে চলে গ্রেনেড হামলা, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ অনুষ্ঠানও বাদ যায় না। বিশেষ করে ঢাকাবাসী ভুগছেন চরম নিরাপত্তাহীনতায়। তারা ভয়ে-আতঙ্কে রয়েছেন পথে-ঘাটে-কর্মস্থলে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে; এমনকি নিজগৃহও। নিরীহ বিদেশি-নাগরিক থেকে শুরু করে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত সাধারণ ধর্মভীরুও রক্ষা পাচ্ছেন না জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের আক্রমণ থেকে। বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন, দেশের সমাজচিন্তক, মুক্তচিন্তক থেকে শুরু করে নিপাট ভদ্রলোকও। হত্যাকারীরা একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সটকে পড়ছে বাধাহীন-নির্বিঘ্নে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ধরতে পারছে না, ক্ষেত্র বিশেষে ধরছেও না। অপরাধ বিশ্লেষকরাও একমত হবেন—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব পালনে শৈথিল্যের কারণেই এসব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও হত্যাকাণ্ড ঘটছে। এ সব হত্যাকাণ্ড মূলত এক ধরনের অশনিসংকেত—জাতিকে মেধাশূন্য করার। মুক্তমত প্রকাশের পথেও এটি বড় বাধা হয়ে উঠেছে এই মুহূর্তে ।
বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের হত্যা করার পেছনে অর্থনৈতিক কিংবা আদিপত্য বিস্তারের দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের বেশির ভাগ লেখক-বুদ্ধিজীবী-সমাজচিন্তকই স্রেফ নিজেদের বিবেকের তাড়নায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। তাদের হত্যা করে খুনিরা কোনোভাবেই আর্থিক দিক থেকে লাভবান হবেন না—এ নিয়ে দ্বিমত বা ভিন্নমতেরও কোনো সুযোগ নেই।
অন্য সব হত্যাকাণ্ডের চেয়ে দেশের মুক্তমনা ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখকদের হত্যার ঘটনা জনমনে সন্দেহের সৃষ্ট করে সহজে। নিশ্চয়, বুদ্ধিজীবী-সমাজচিন্তকরা ট্র্যাডিশনাল ক্রিমিনালদের টার্গেট হতে পারে না। কারণ, ট্র্যাডিশনাল ক্রিমিনালরা মানুষকে খুন করে, ছিনতাইকালে, আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে কিংবা চাঁদাবাজির জন্য। ক্ষেত্র বিশেষ অপহরণের পরও। সেসব ক্ষেত্রে কিলারদের স্বার্থ থাকে প্রধানত অর্থনৈতিক। তাদের লক্ষ্য পূরণ হলে তারা প্রায়-ই হত্যা করে না আক্রান্ত ব্যক্তিকে। কিন্তু কখনো ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তি প্রবল বাধার সৃষ্টি করলে, তখন তারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে খুন করে।
কিন্তু বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের হত্যা করার পেছনে অর্থনৈতিক কিংবা আদিপত্য বিস্তারের দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের বেশির ভাগ লেখক-বুদ্ধিজীবী-সমাজচিন্তকই স্রেফ নিজের বিবেকের তাড়নায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। তাদের হত্যা করে খুনিরা কোনোভাবেই আর্থিক দিক থেকে লাভবান হবেন না—এ নিয়ে দ্বিমত বা ভিন্নমতেরও কোনো সুযোগ নেই। আর এসব ক্ষেতে খুনিরাও হত্যাকাণ্ডের পরপর নির্বিঘ্নে সটকে পড়েন; তারা নিহত-আহতদের কোনো টাকা-পয়সা কিংবা মূল্যবান কোনো সামগ্রীতে হাত দেন না। এ থেকেও প্রমাণীত হয় এই খুনিরা কোনোভাবেই ট্র্যাডিশনাল খুনি নন। তারা বিশেষ উদ্দেশ্যে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেন। এখন প্রশ্ন উঠছে—কী সেই উদ্দেশ্য? যে উদ্দেশ্য সফল করতে গিয়ে তারা দেশের নিরীহ, শিক্ষিত, প্রজ্ঞাবান মানুষদের এভাবে হত্যা করছেন? খুনিদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে হলে, আগে তাদের আটক-গ্রেফতার করতে হবে। এরপর বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করালেই জানা যাবে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য।
এ সব ঘটনায় সরকারির দলের মন্ত্রী-এমপিসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা তর্জনি তোলেন সরাসরি বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দিকে। বিরোধী দলও একই পাল্টা অভিযোগ তোলে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। মাঝখানে যারা এসব ঘটনা তদন্ত করে, রহস্য উদ্ঘাটনসহ অপরাধীদের শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি দাড় করাবেন, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য-কর্মকর্তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকেন।
ব্লগার-লেখক হত্যাকাণ্ডের সূচনা ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। গণজাগরণ মঞ্চকর্মী আহমেদ হায়দার রাজিব এমন নিশৃংস হত্যাকাণ্ডের প্রথম শিকার। ওইদিন ব্লগার রাজিব হায়দার মিরপুরে নিজ বাড়িতে খুন হন। ওই ঘটনার পর কেটে গেছে দুই বছর। তারপর আবার শুরু— চলতি বছরের অমর একুশের গ্রন্থমেলার সময় ২৬ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক, মুক্তমনা ব্লগার অভিজিৎ রায়কে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে খুনিরা। ৩০ মার্চ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান, ১২ মে অনন্ত বিজয় দাস এবং ৭ আগস্ট নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় খুন হন। অবশ্যই এর আগে হামলার শিকার হন ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন। তিনি দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরও আগে, প্রথাবিরোধী লেখক ভাষা বিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদও হামলার শিকার হন। সে যাত্রা বেঁচে উঠলেও শেষপর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানেন। প্রতিবারই হয় আনসারুল্লা বাংলা টিম, না হয় আনসার বাংলা নামে কোনো না কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে। বাদ যায়নি সর্বশেষ ৩১ অক্টোবর সংঘটিত ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যাকাণ্ডের পরও। যথারীতি আগের হত্যাকাণ্ডগুলোর মতো এবারও দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে আনসার আল ইসলাম নামে একটি জঙ্গিগোষ্ঠী।
আর এসব ঘটনায় সরকারির দলের মন্ত্রী-এমপিসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা তর্জনি তোলেন সরাসরি বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দিকে। বিরোধী দলও একই পাল্টা অভিযোগ তোলে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। মাঝখানে যারা এসব ঘটনা তদন্ত করে, রহস্য উদ্ঘাটনসহ অপরাধীদের শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি দাড় করাবেন, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য-কর্মকর্তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকেন। তারা ঘটনার তাৎক্ষণিকতা ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের বক্তব্য-পাল্টা বিবৃতিতে এতটা বিভ্রান্ত হয়ে যান যে, তার রেশ কাটতেই অনেক নদীতে অনেক জল গড়িয়ে যায়। এরপর তদন্তশ্লিষ্টরা যখন থিতু হয়ে সংঘটিত ঘটনার দিকে মনোযোগ দেওয়া শুরু করেন মাত্র, তখনই ঘটে আরও একটি বা একাধিক হত্যাকাণ্ড। শেষপর্যন্ত তদন্তকার্য বারবার বাধাগ্রস্তই হতে থাকে। আর সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ক্ষতিগ্রস্তরা বুঝে-না বুঝে বিচারব্যবস্থাকে দায়ী করতে থাকেন। কেউ কেউ তো প্রকাশ্যেই বলেন, বিচারহীনতার কারণেই একের পর এক এসব হত্যাকাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। যারা আদালতকে পরোক্ষভাবে দোষারোপ করে যান, তারা হয়তো জানেন না, বিচার পেতে হলে, বিচার প্রার্থী হলেই কেবল চলে না, বিচারপ্রক্রিয়াকে সাক্ষ্য-তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষের। পুলিশ মামলার প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-তথ্য-প্রমাণ আদালতে উপস্থিত করে রাষ্ট্রপক্ষকে মামলা পরিচালনায় সহযোগিতা করবে। তবেই বিচারপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে—এমন ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড বিচারহীনতা নয়, বরং নিরাপত্তহীনতার কারণেই সংঘটিত হচ্ছে। যারা বিচারহীনতার দোহাই দেন, তারা হয়তো নিরাপত্তার বিষয়টি খেয়াল করেন না। অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা ঢাকার জন্যই বিচারহীনতার অজুহাত দেখান। এ প্রসঙ্গে যে বিষয়গুলো রাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবাইকে মনে রাখতে হবে, সেগুলো হলো—
১। কেন ব্লগার-লেখক-প্রকাশকদের খুন করছেন খুনিরা?২। খুনিদের পরিচয় কী?৩। খুনিদের আর্থিক, রাজনৈতিক আশ্রয় কারা দিচ্ছেন, কেন দিচ্ছেন?
কেন ব্লগা-লেখক-প্রকাশক খুন হচ্ছেন—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের একটু পেছনে তাকাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময়, বিজয় যখন দ্বারপ্রান্তে ঠিক তখনই, পাকিস্তানি হানাদারদের এ দেশীয় দোসররা দেশের সেরা শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে নিয়ে হত্যা করেছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু ওই পাকিস্তানি দোসররা রয়ে গেছেন। তারা নানা কৌশলে ও কারণে-অকারণে সুযোগ পেলেই মুক্তমনা-সমাজচিন্তকদের হত্যা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাদের সেই স্বাভাবিক স্বভাবের কারণেই বলা যায়—ব্লগার লেখকদের খুন করে তারা দেখেছেন, তাতেও সমস্যার সমাধান হয়তো হচ্ছে না। ব্লগার লেখকের মৃত্যুর পর, তাদের আদর্শ মুছে যাচ্ছে না। পরন্তু তাদের আদর্শে নতুন করে উজ্জীবিত হচ্ছে অনেকে। আর এই উজ্জীবনে সহযোগিতা করছেন প্রকাশকেরা, বই ছাপিয়ে। তাই এবার হয়তো সে কারণেই প্রকাশকদের ওপরই খুনিদের খড়্গ নেমে এলো।
এ কারণে খুনিদের পরিচয় আর তাদের আশ্রয়দাতাদের প্রকৃত পরিচয় জনগণ কোনোদিনও জানতে পারে না। কিন্তু হত্যাকাণ্ড যারা-ই ঘটাক, যে উদ্দেশ্যেই ঘটাক, জনগণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতাকেই দায়ী করবে। একই সঙ্গে এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে জড়িতদের রাজনৈতিক পরিচয়, আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতাদের পরিচয় জানারও চেষ্টা করবে।
খুনিদের পরিচয় অনুসন্ধান করে বের করার আগেই একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বরাবর বিবৃতি দিয়ে আসছে। এদিকে সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশকর্তারা প্রথমে কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে সন্দেহের তালিকায় রাখলেও দিন ঘুরতে না ঘুরতেই সে সন্দেহের তীর ছোঁড়েন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে। এ কারণে খুনিদের পরিচয় আর তাদের আশ্রয়দাতাদের প্রকৃত পরিচয় জনগণ কোনোদিনও জানতে পারে না। কিন্তু হত্যাকাণ্ড যারা-ই ঘটাক, যে উদ্দেশ্যেই ঘটাক, জনগণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতাকেই দায়ী করবে। একই সঙ্গে এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে জড়িতদের রাজনৈতিক পরিচয়, আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতাদের পরিচয় জানারও চেষ্টা করবে।
একথা বলা অসঙ্গত হবে না—আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পেছনে প্রধানত দায়ী পুলিশ। অপরাধীরা একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাচ্ছে, অথচ পুলিশ তাদের আটক-গ্রেপ্তার দূরের কথা, অনেক সময় সন্ধানই দিতে পারে না। ফলে জনগণ মনে করে, পুলিশি গাফলতির কারণেই অপরাধীরা আসকারা পেয়ে যাচ্ছে। একই কারণে পুলিশের মধ্যে জবাবদিহিতাও কমে গেছে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী তো বটেই, বিরোধী দলকেও মনে রাখতে হবে—সন্ত্রাসী লালন-পালনের মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। আইনের শাসন বিঘ্নিত হয়। এ কারণে পাল্টাতে হবে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। না হলে কখনোই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। এ লক্ষ্যে সরকারকে যেমন পদক্ষেপ নিতে হবে, তেমিন দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে বিরোধী দলগুলোকেও। ব্যত্যয়ে নাগরিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এর দায়ভার নিঃসন্দেহে সরকারকেই নিতে হবে। বিরোধী দলগুলোও এ দায় এড়াতে পারবে না। আমাদের রাজনীতিকদের মনে রাখতে হবে, নগর পুড়লে দেবালয়ও এড়ায় না। আর সরকারকে মনে রাখতে হবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইনি তৎপরতা কমে গেলেই পেশাদার সন্ত্রাসী-খুনিরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। হত্যাকাণ্ডের পর ঢালাওভাবে প্রতিপক্ষ দলের নেতাকর্মীদের ওপর দোষ চাপালে প্রকৃত অপরাধীরা কখনোই ধরা পড়বে না।
মুক্তমনা লেখক, বুদ্ধিজীবী, সমাজচিন্তককে খুন করার মাধ্যমে ভিন্নমত দমন করে জঙ্গিদের তথাকথিত আদর্শ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাও এক ধরনের মানসিক রোগ। মানসিক বিকারগ্রস্ত না হলে, মানুষকে হত্যা করে, মানুষের আদর্শকে নিশ্চিহ্ন করার স্বপ্ন দেখা কোনো সুস্থ-বিবেকবান মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়।
অপরাধ দমনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধি, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধে উৎকর্ষ সাধনসহ জনগণকে প্রচলিত আইন সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। কেবল আইন প্রণয়ন করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অপরাধ দমনে মার্চপাস্ট করালেই সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল হবে না। প্রচলিত আইন, নাগরিক আচরণ, নাগরিকের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। সে দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেই।
বাকি থাকলো অপরাধীদের শাস্তি প্রসঙ্গ। তাদের শাস্তি প্রসঙ্গে প্রথমেই প্রথাগত আইনবিশেষজ্ঞরা বলবেন—উগ্রপন্থী-জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যদের আইনের আওতায় এনে অপরাধের ধরন হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। এ বিষয়ে সংশোধনবাদী আইনজ্ঞরাও সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করবেন না। তবে, তারা অন্য একটি উপায় বাতলে দিতে পারেন। সেটি হলো—হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া কিলারদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলেও, যারা সরাসরি জড়িত নন, কিন্তু সমর্থক, নৈতিক ও আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে আসছেন এ সব খুনিকে, তাদের আগে চিকিৎসা করানো উচিত। কারণ, মুক্তমনা লেখক, বুদ্ধিজীবী, সমাজচিন্তককে খুন করার মাধ্যমে ভিন্নমত দমন করে জঙ্গিদের তথাকথিত আদর্শ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাও এক ধরনের মানসিক রোগ। মানসিক বিকারগ্রস্ত না হলে, মানুষকে হত্যা করে, মানুষের আদর্শকে নিশ্চিহ্ন করার স্বপ্ন দেখা কোনো সুস্থ-বিবেকবান মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। এ বিষয়ে নিশ্চয় মনোবিজ্ঞানী-মনোচিকিৎসক-সংশোধনবাদী অপরাধ বিজ্ঞানীরাও একমত পোষণ করবেন। একজন দুজন অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দণ্ড দিয়ে তাদের হীনআদর্শ সমূলে বিনাশ করা যাবে না। বরং তাদের শনাক্ত করে, যথাযথ আইনের আওতায় এনে, সুচিকিৎসার ব্যবস্থা আগে করতে হবে। এবং তা করতে হবে সরকারকেই। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব পথভ্রষ্ট জঙ্গির ওপর কড়া নজরদারি বাড়াবে, সন্দেহ হলেই আটক করে আইনি ব্যবস্থা নেবে। এর জন্য চাই, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দাসংস্থার মধ্যে নিবিড় সমন্বয়।
মন্তব্য