জন্মালে মরতে তো হবেই–এই বাস্তব সত্যটি জন্মানোর পর থেকেই মানুষ খুব কম বলে। মৃত্যুর কথা মানুষ কি আর বলতে চাই বেশি? তবু বলে কেউ কেউ।
প্রথম লাশ দেখার স্মৃতি মনে থাকে কারও? মাঝে মাঝে প্রথম লাশ দেখার স্মৃতিটা আবছা হয়ে ভেসে ওঠে। সেই কত কাল আগের কথা। কলোনিতে পাশের বাসায় রাকিবের বাবাকে কাঠের এক চৌকিতে শুইয়ে রেখেছিল। কলোনির বাচ্চারা ঘেরাও করে দেখছিলাম লোকটাকে। লুঙ্গি পরা, খালি গায়ে, নাক দিয়ে চিকন কেঁচোর মতো রক্ত গড়াচ্ছে। একজন হুজুর কিছুক্ষণ পরপর তুলো দিয়ে আলতো করে মুছে দিলেন, সেই স্মৃতিটাও হুট করে জ্বলে ওঠে স্মৃতির আয়নায়।
আশেপাশে লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে। মৃত্যু হলেই লাশের সামনে দাঁড়িয়ে লোকেরা কিছু কথা যেন বলতেই থাকে। যেন লাশ শুনছে। তাকে খুশি করার এক আপ্রাণ চেষ্টা।
তেমনই রাকিবের বাবার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে লোকে তেমন ভালো ভালো কথা বলতে থাকলো। ‘আহারে লোকটা কত ভালো ছিল’, ‘আহারে লোকটার ঘরে একটা সন্তান এখনো ছোট, তার কী হবে!’ ‘আহারে লোকটা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো, নিশ্চিত বেহেস্ত।’ ‘আহারে লোকটা সৎ ছিল!’
বাচ্চারা ঘেরাও করে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আর শুনছিলাম। কখনো কখনো মনে হচ্ছিল লোকটা গভীর ঘুমে অচেতন। মনে হয়েছিল, এখনই জেগে উঠবে হয়তো, এখনই কথা বলে উঠবে।
এসবের মধ্যে রাকিব এসে হাজির এক কোরআন শরীফ নিয়ে। ইয়াসিন সুরা পাঠে মনোযোগী। বাবার লাশের পাশে বসে গোসল দেওয়ার আগেই ইয়াসিন সুরা পাঠ শুরু করে। হুজুর বলে উঠলেন, গোসল করাইয়া নেক বাবা, পরে পড়ো।
রাকিব কারও দিকে তাকায় না। সে ইয়াসিন সুরা পাঠে মনোযোগী। বয়স আর কত তখন? ফোর বা ফাইভে পড়তো কিংবা তার ওপরে কিংবা তারও নিচের ক্লাসে। ইয়াসিন সুরা আমি আর রাকিব দুজনই মাদ্রাসায় দুপুরে শিখেছিলাম। হুজুর বলেছিলেন, মৃত ব্যক্তির পাশে ইয়াসিন সুরা পাঠ করলে তার মঙ্গল হয়, তার কষ্ট কম হয়, তার গুনাহ মাফ হয়।
কেন পৃথিবীতে আসতে হবে, কেন দুই দিনের এই পৃথিবীতে এত এত সংগ্রাম করে টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে?
আচ্ছা রাকিব কি আমার বন্ধু ছিল? এমন প্রশ্ন হর-হামেশাই মনে আসে। কিন্তু মনে করতে পারি না। আচ্ছা রাকিব এখন কী করে? কোথায় আছে? কিছুই মনে করতে পারি না। ঠিক কখন পাশের বাসা থেকে রাকিবরা চলে গেলো? ঠিক কবে থেকে রাকিবরা এলাকা থেকেই হাওয়া হয়ে গেলো? কিচ্ছু মনে পড়ে না।
মনে আছে রাকিবের মা চিৎকার করে কাঁদছিলেন। বলছিলেন, ‘আমার পেটের সন্তানকে কী জবাব দেবো? সে তো বাপ দেখে গেলো না।’
কী আর্তনাদ, আহারে! কী এক অদ্ভুত এই জীবন-মরণের খেলা।
এটাই তো প্রথম লাশ দেখা। খুব সাধারণ।
আচ্ছা সব লাশ দেখতে কি এমনই হয়?
সব মৃত ঘর কি এমনই হয়?
নিস্তব্ধতা নেই, কোলাহলে ভরপুর মৃতদের ঘর। শুধু লাশটাই নীরব, আর কেউ যেন নীরবতা পালনে ব্যস্ত নেই। কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ে, কেউ আড্ডায় উপচে পড়ে, কেউ কেউ তর্কে-বিতর্কে মশগুল।
বড় হতে হতে এক অদ্ভুত মানসিক যন্ত্রণায় পড়ে যাই। কোনো লাশ দেখলে আর ঘুম হয় না। কোনো স্বজনের লাশ দেখে ঘুমাতে পারি না। স্মৃতিপট থেকে স্বজনের সব স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে যায়। শুধু স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেই নিথর দেহ। শুধু চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাদা কাপড়ে মোড়ানো সেই পরিচিত মুখ।
ভালো লাগে না।
মানুষ লাশ হওয়ার পর তাকে কবর দিতে হয়। প্রথম কবর দেওয়া দেখি দাদি মারা যাওয়ার পর। দেখলাম, মাটিতে শুইয়ে দিল দাদুকে। তারপর বাঁশের ছোট টুকরা দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশ কোনাকুনি ঠেক দিয়ে তার ওপর মাটি দেওয়া হয়। এক অন্ধকার অমানিশায় চিরদিনের জন্য একজন মানুষকে রেখে আসার যে বেদনা, তার মহত্ত্ব কি বোঝে সবাই? অবশ্যই বোঝে। কারণ মানুষ তো শেষ পর্যন্ত জীবনের পক্ষেই রায় দেয়। সে কাঁদে কিন্তু পরক্ষণেই জাগতিক কাজে লিপ্ত হয়ে ওঠে। সেও ভুলে যায় একদিন ওই ঘরে তাকে যেতে হবে। একদিন তাকেও একলা রেখে আসা হবে।
আসলেই কি সবাই মৃত্যু ভুলে থাকে? থাকতে পারে?
মাটিতে শুইয়ে দেওয়ার পর স্বজনরা চল্লিশ কদম এগিয়ে আসার পরই নাকি হাজির হয় মনকির-নকির।
ইসলাম ধর্মে আছে।
জীবনের সব হিসাব-কিতাব নেওয়া শুরু হয়।
আচ্ছা দুনিয়াতে রেখে যাওয়া হিসাব-কিতাবগুলো কি শেষ হয়? যিনি রেখে যান অঢেল সম্পদ, সেই সম্পদের হিসাব কি শেষ হয়? অথবা যিনি দরিদ্র, তার পরিবারও কি হিসাব মেলাতে ব্যস্ত হয় না?
হয়তো নিশ্চয়ই।
তাহলে হিসেব শেষ হলো কী করে?
না কি এই সম্পদ কিংবা দারিদ্র্যের ভেতর একজন ব্যক্তি অনুপস্থিতি তৈরি হয়। শুধু একজন নেই। এর বেশি কিছু নয়। হিসাব তো চলতে থাকে, চলবে।
ওই যে জানাজার আগে আপন মানুষ বলে না কয়েকটা কথা?
‘আপনাদের কাউকে যদি তিনি মনে কষ্ট দিয়ে থাকেন তবে মাফ করে দিয়েন, কারও যদি তার সঙ্গে লেনদেন থাকে তবে আমাদের পরিবারকে জানাবেন আমরা শোধ করে দেবো।’
আচ্ছা বেঁচে থাকতে লোককে যারা কষ্ট দিয়েছিল, তারা কি মাফ চায়?
মাফ চাইলেও কি মাফ পায়?
বেঁচে থাকতে লোকটা যার কাছে টাকা পেত সে টাকা কি উদ্ধার হয়?
এসব তো জানা হয় না কখনো!
আচ্ছা মানুষ মরে কেন?
এমন প্রশ্নও তো কত করেছি কতবার।
কেউ বলে, মরণ আসলে মরবে। কেউ বলে, মৃত্যুই তো চূড়ান্ত নিয়তি। কেউ বলে, মৃত্যুর স্বাদই তো নিতে হবে সবাইকে।
কিন্তু কেউ তো মৃত্যু কেন হবে, এই প্রশ্নেরই উত্তর দিলো না। কেন পৃথিবীতে আসতে হবে, কেন দুই দিনের এই পৃথিবীতে এত এত সংগ্রাম করে টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে?
আচ্ছা সব ধর্মের শিশুরা তো মায়ের গর্ভেই বেড়ে ওঠে। তবে মৃত্যুর পর দেহটির সঙ্গে কী হবে তা নির্ধারণ করে দেয় ধর্ম? মায়ের গর্ভের কি কোনো ধর্ম নেই?
এই রঙিন পৃথিবীতে আসতে কোনো মানুষ চেয়েছিল? সে এলো, আবার তাকে চলেও যেতে হবে। এটা কেমন নিয়ম হলো?
এই যে করোনাকালে মানুষ মরছে। ধুঁকে-ধুঁকে। কেউবা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসছে। কেউ কেউ ফিরে আসার আনন্দে বিভোর। বলছে, আর একটু হলে তো মরেই যেতাম।
আচ্ছা, তারা কি আর মৃত্যুর কাছে ফিরে যাবে না?
মৃত্যুই যখন শেষ গন্তব্য তবে ‘এইবারের মতো বেঁচে গেলাম’ বলার স্বাদ আছে তাহলে! আরও কটা দিন পেলো তারা।
কেন এই আনন্দ?
সম্পর্ক।
সম্পর্কের ভেতর, স্বজনের ভেতর আরো কিছু দিনের স্বাদ। এই সম্পর্কের মায়াজালে জড়িয়ে থাকা মানুষ এক নিশাচর প্রাণীর মতো এই দুনিয়ায় সংগ্রাম চালায়।
দুনিয়ার সবচাইতে অলস লোকটি থেকে শুরু করে সবচাইতে কর্মঠ কিংবা ক্ষমতাধর লোকটিকেও তো মরে যেতে হবে।
তাহলে কিসের জন্য সংগ্রাম? কী জন্য মেধা? কী জন্য প্রেম-ভালোবাসা-মায়া? কিসের জন্য একে অন্যকে কর্মঠ কিংবা অলস বলা?
জন্মেই যেহেতু নির্ধারিত মৃত্যু।
একজন অন্যকে বলে, ‘সবাই দোয়া করবেন, আমার পরিবারের জন্য। সবাই দোয়া করেন আমার স্বজন যেন সুস্থ হয়ে ওঠে। সবাই দোয়া করেন সবাই যেন সুস্থ হয়ে যায়। যেন আরও হায়াৎ পায়।’
তারপর? বেঁচে থাকবে কি চিরকাল?
না।
তবু সবাই বাঁচতে চায়, বাঁচাতে চায়। কিসের জন্য! ওই সম্পর্ক।
ওই যে বললাম, লাশের চারপাশ ঘিরে সেই কোলাহল। কোথায় দূর-দুরান্ত থেকে কত স্বজন ছুটে আসে। কোলাহলে অংশ নেয়। কান্নায় অংশ নেয়, আড্ডায় অংশ নেয়।
মৃত বাড়িতে খাবার পাঠাতে হয়। সেই খাবারের মেন্যু ঠিক হয়। পাতিলে পাতিলে খাবার হাজির হয়। কেউ কাঁদে, কেউ খায়, কেউ বেড়ে দেয়, কেউ হাসায়–যেন এক পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান।
কতদিন পর পরিবারের সবাই একসঙ্গে। মৃত বাড়ি যেন হয়ে ওঠে আনন্দের মহামিলন, পুনর্মিলন।
আচ্ছা, সুখ কি শুধু বেঁচে থাকায়?
মৃত্যুতে কি সুখ নাই?
কেউ জানে?
হয়তো, মৃত্যুর পরই অনন্ত সুখ। কিংবা এই দুনিয়াতেই সুখ। তারপর অনন্ত দুঃখ।
মায়ের গর্ভে একা বেড়ে ওঠা শিশু হৃষ্টপুষ্ট হয়ে দুনিয়াতে আসা। তারপর সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে একা শুয়ে যায়।
আচ্ছা সব ধর্মের শিশুরা তো মায়ের গর্ভেই বেড়ে ওঠে। তবে মৃত্যুর পর দেহটির সঙ্গে কী হবে তা নির্ধারণ করে দেয় ধর্ম? মায়ের গর্ভের কি কোনো ধর্ম নেই?